Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

What Mujib Said

Jyoti basu is DEAD

Jyoti Basu: The pragmatist

Dr.B.R. Ambedkar

Memories of Another Day

Memories of Another Day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Wednesday, January 19, 2011

কবিওয়ালা বা কবিগান


কবিওয়ালা বা কবিগান

  1. কবিগানের উৎপত্তি ও বিকাশ কোন শতক পর্যন্ত ?
  2. কবিগানের উল্লেখ্যযোগ্য কবিওয়ালের নাম কি কি?
  3. কবিগানের আদিগুরু হিসেবে পরিচিত কে ?
  4. গোঁজলা গুই এর উল্লেখযোগ্য শিষ্য কে কে ?
  5. বাংলা টম্পাগানের জনক কে ছিলেন?
  6. 'নানা দেশের নানান ভাষা, বিনে স্বদেশী ভাষা পুরে কি আশা'। এই গানটির রচয়িতা কে?
  7. টম্পা গান থেকে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কোন ধারার সুত্রপাত?
  8. কবিওয়ালাদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতি কে অর্জন করেছিল?
  9. কবিগানের কয়টি বিভাগ কি কি?
  10. হরু ঠাকুরের প্রকৃত নাম কি?
  11. কবিয়াল কেষ্ট মুচির প্রকৃত নাম কি?
  12. কবিগানের বিশেষ গৌরবের যুগ কত সাল পর্যন্ত বিসতৃত ছিল?
  13. কবিওয়ালাদের মধ্যে সবচেয়ে আধুনিক মানসিকতা লালন করতেন কে?
  14. কবিওয়ালদের মধ্যে পর্তুগীজ খ্রিষ্টান কে ছিলেন?

———————-

  1. উঃ অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ থেকে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে।
  2. উঃ গোঁজলাই গুই, ভরানী বেনে, হরু ঠাকুর, কেষ্টা মুচি, ভোলা ময়রা, এন্টনী ফিরিঙ্গি, নিতাই বৈরাগী প্রমুখ।
  3. উঃ গোঁজলা গুঁই।
  4. উঃ লালু নন্দলাল, রঘুনন্দ, রামজীবন দাস প্রমুখ।
  5. উঃ নিধু বাবু।
  6. উঃ নিধু বাবু।
  7. উঃ বাংলা গীতিকবিতা।
  8. উঃ ভবানী বেনে।
  9. উঃ ৪টি। বন্দনা, সখী সংবাদ, বিরহ ও খেউর।
  10. উঃ হরেকৃষ্ণ দিঘাড়ী।
  11. উঃ কৃষ্ণচন্দ্র চর্মকার।
  12. উঃ ১৭৩০-১৮৩০ সাল পর্যন্ত।
  13. উঃ রাম বসু।
  14. উঃ এন্টনি ফিরিঙ্গি।
Share
-- http://banglalibrary.evergreenbangla.com/blog/%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE-%E0%A6%95%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8/

কবিগান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কবিগান বাংলা লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা। এই ধারায় লোককবিরা প্রতিযোগিতামূলক গানের আসরে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

সূচিপত্র

 [আড়ালে রাখো]

[সম্পাদনা]প্রকৃতি

কবিগান সাধারণত দুটি দলের দ্বারা গীত হয়। প্রত্যেকটি দলের নেতৃত্বে থাকেন একজন "কবিয়াল" বা "সরকার"। তাঁর সহকারী গায়কদের বলা হয় "দোহার"। এঁরা সাধারণত নেতার কথাগুলিই পুনরাবৃত্তি করেন।[১] কবিগান শুরু হয় "বন্দনা" বা "গুরুদেবের গীত"-এর মাধ্যমে। "বন্দনা" অংশটি সরস্বতীগণেশ, জনতা ও শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়। এটি কবিয়াল যেমন উপযুক্ত করেন, তেমনভাবে গান। এরপর রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান গাওয়া হয়। এটিকে কেউ কেউ "আগমনী" বলেন। এরপর চারটি বিষয়বিত্তিক গান গাওয়া হয়: "সখী সংবাদ", "বিরহ", "লহর" ও "খেউড়"। এরপর প্রতিযোগিতামূলক অংশটি শুরু হয়।[২] কবিগানের আসরে এই অংশটিকে "কবির লড়াই"-ও বলা হয়। এই অংশে একজন গীতিকার-সুরকার মুখে মুখে গান বেঁধে অপর গীতিকার-সুরকারকে আক্রমণ করেন এবং তিনিও গানের মাধ্যমে সেই আক্রমণের প্রত্যুত্তর দেন।[৩]

[সম্পাদনা]ইতিহাস

সজনীকান্ত দাশ তাঁর বাংলার কবিগান গ্রন্থে লেখেন, বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে প্রচলিত বিভিন্ন সাংগীতিক ধারার মিলনে কবিগানের জন্ম। এই ধারাগুলির নাম বহু বিচিত্র – তরজা, পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ আখড়াই, ফুল আখড়াই, দাঁড়া কবিগান, বসা কবিগান, ঢপকীর্তন, টপ্পা, কৃষ্ণযাত্রা, তুক্কাগীতি ইত্যাদি।[২] ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ও ড. হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতো খ্যাতনামা সাহিত্য গবেষকগণ কবিগান নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন।[২]

ড. সুশীল কুমার দের মতে, অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে, এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতেও কবিগানের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু কবিওয়ালাদের প্রকৃত বিকাশকাল হল ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যবর্তী সময়।[২] এই সময় বাংলা কাব্যের ধর্মীয় ও আনুষ্ঠানিক উপাদানগুলি ফিকে হয়ে আসতে শুরু করেছিল। বাংলা কাব্যও বৈষ্ণব কবিতার ধারা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে মুদ্রণযন্ত্রের আবির্ভাব এই বেরিয়ে আসার প্রচেষ্টাকে সার্থক করে তোলে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পরবর্তী অর্ধশতাব্দীকাল নব্য কবিগান ও পাঁচালি গান কলকাতা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলে এতটাই জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে সাহিত্যের অন্যান্য ধারাগুলির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়েছিল।[৪] পরবর্তীকালেও কলকাতায় কবিগানের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও গ্রামবাংলায় এর জনপ্রিয়তা কিছুমাত্র কমেনি।[২]

ময়মনসিংহের মুগ ভালো, খুলনার ভালো কই।

ঢাকার ভালো পাতাক্ষীর, বাঁকুড়ার ভালো দই।।
কৃষ্ণনগরের ময়রা ভালো, মালদহের ভালো আম।
উলোর ভালো বাঁদর পুরুষ, মুর্শিদাবাদের জাম।।
রংপুরের শ্বশুর ভালো, রাজশাহীর জামাই।
নোয়াখালির নৌকা ভালো, চট্টগ্রামের ধাই।।
দিনাজপুরের কায়েত ভালো, হাবড়ার ভালো শুঁড়ি।
পাবনা জেলার বৈষ্ণব ভালো, ফরিদপুরের মুড়ি।।
বর্ধমানের চাষী ভালো, চব্বিশ পরগণার গোপ।
গুপ্তিপাড়ার মেয়ে ভালো, শীঘ্র-বংশলোপ।।
হুগলির ভালো কোটাল লেঠেল, বীরভূমের ভালো বোল।
ঢাকের বাদ্য থামলেই ভালো, হরি হরি বোল।।
−ভোলা ময়রা


ড. সুশীল কুমার দে কবিওয়ালাদের প্রশংসাই করেছেন। তাঁর মতে, এঁরা ছিলেন সমাজের নিচু তলার মানুষ। সমাজের নিচু তলার মানুষদের মধ্যেই ছিল এঁদের জন্ম ও বিচরণ। তাই এই সমাজের চিন্তাভাবনা অনুভূতিগুলি তাঁরা ভালই বুঝতেন। আধুনিক সাহিত্যকার সমাজের যে অংশকে অশিক্ষিত মনে করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন, সেই অংশে এঁদের জনপ্রিয়তা ছিল অবিসংবাদী।[২]

[সম্পাদনা]কবিয়াল

একাধিক সংখ্যক কবিয়াল বা কবিওয়ালা জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অষ্টাদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যবর্তীকালে কেবলমাত্র বীরভূম জেলাতেই শ তিনেক খ্যাতনামা কবিয়াল বিদ্যমান ছিলেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন কবিয়াল ছিলেন গোঁজলা গুঁই। তিনি ও তাঁর সমসাময়িক লালু–নন্দলাল, রঘু ও রামজি অষ্টাদশ শতাব্দীতে বিদ্যমান ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিখ্যাত কবিয়ালরা ছিলেন হরু ঠাকুর (১৭৪৯–১৮২৪), নিতাই বৈরাগী (১৭৫১–১৮২১), রাম বসু (১৭৮৬–১৮২৮), ভোলা ময়রা ও অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি।[১][২]

বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের কবিয়ালরা হলেন বলহরি দে (১৭৪৩–১৮৪৯), শম্ভুনাথ মণ্ডল (১৭৭৩-১৮৩৩), তারকচন্দ্র সরকার (১৮৪৫–১৯১৪), রমেশচন্দ্র শীল (১৮৭৭–১৯৬৭), রাজেন্দ্রনাথ সরকার (১৮৯২–১৯৭৪), ও বিনয়কৃষ্ণ অধিকারী (১৯০৩–১৯৮৫)।[১][২]

চারণকবি মুকুন্দ দাস প্রকৃতপক্ষে ছিলেন একজন কবিয়াল।[২] বালিকা বধূ নামে এক বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রটি চিত্রিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে মুকুন্দ দাসের গান কিভাবে জনসাধারণকে প্রভাবিত করেছিল, তাও এই চলচ্চিত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।[৫]

অপর এক বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ছিলেন জন্মসূত্রে পর্তুগিজ। তাঁর জীবনী অবলম্বনেও একটি জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এই ছবিতে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির নামভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি অভিনেতা উত্তম কুমার[৬]

ঊনবিংশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কবিয়াল ভোলা ময়রা গায়ক হিসেবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর গানে শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো হয়ে থাকত। এই জাতীয় জনপ্রিয় বিনোদন অনুষ্ঠানের গুরুত্ব অনুধাবন করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ভোলা ময়রার বিশেষ প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, "বাংলাকে জাগাতে যেমন রামগোপাল ঘোষের মতো বাগ্মী, হুতোম প্যাঁচার মতো আমুদে লোকের প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন ভোলা ময়রার মতো লৌকিক গায়কদের।"[৭] এঁর জীবন অবলম্বনেও ভোলা ময়রা নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।[৮]

[সম্পাদনা]পাদটীকা

  1. ↑ ১.০ ১.১ ১.২ Sarker, Swarochish। Kavigan। প্রকাশক: Asiatic Society of Bangladesh। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22
  2. ↑ ২.০ ২.১ ২.২ ২.৩ ২.৪ ২.৫ ২.৬ ২.৭ ২.৮ Das,Kishoriranjan, Radha Birbhumer Kaviwala O KaviganPaschim Banga, Birbhum Special Issue, pp. 289–309, (in Bengali), February 2006, Information and Culture Deptt., Government of West Bengal
  3.  Bengali music can be broadly classified under five heads। প্রকাশক: infobengal। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22
  4.  Sen, Sukumar, Dr., History of Bengali Literature, Sahitya Akademi, pp. 156–157, ISBN 8172011075
  5.  Balika Bodhu (1967)। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22
  6.  Anthony Firinghi (1981)। প্রকাশক: calcuttatube। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22
  7.  Ahmed, Wakil। Bhola Moira। । প্রকাশক: Asiatic Society of Bengladesh। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22
  8.  Bhola Moira (1977)। প্রকাশক: spice। সংগৃহীত হয়েছে: 2009-03-22

কবিগানের কবিকবিগানের আসরে গেলে তিনি সব ভুলে যান। তখন কোনো পিছুটান থাকে না, মনে হয় না পৃথিবীতে তাঁর কোনো সংসার আছে, স্ত্রী আছে, মা আছে, ছেলেমেয়ে আছে। সদানন্দ সরকার কবিগানের আসরে গিয়ে এমন একটা ভাবের জগতে প্রবেশ করেন_সে সময় যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ পেয়ে যান সাইমন জাকারিয়া
বাংলাদেশ কবিগানের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে খ্যাত। কবিগানের ধারায় বর্তমানে দেশের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম সদানন্দ সরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয়, শহরে বসে যাঁরা হাতে, কলমে-কাগজে বা কম্পিউটারে কবিতা লেখেন, বহু কাব্যগ্রন্থও প্রণয়ন করেছেন অথচ তাঁদের অধিকাংশই জানেন না কবি সদানন্দ সরকারের নাম। শুধু তাই নয়, শহুরে শিক্ষিত কবিদের অনেকেই হয়তো জানেন না_এখনো দেশের গ্রামাঞ্চলে একধরনের তাৎক্ষণিক এবং তর্কমূলক কবিতা 'কবিগান'_এর প্রচলন রয়েছে। গ্রামের সেই কবিগানের কবিরা একদিকে যেমন হন শাস্ত্রীয় পাণ্ডিত্যের অধিকারী, অন্যদিকে তেমনি তাঁরা হন জ্ঞানকাণ্ডের সব বিষয়, বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব, রাজনীতি, ইতিহাস, যোগাচার, তন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে সমান পারদর্শী ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও অনাবিল রসের অধিকারী। অথচ কোনো আধুনিক কবিতা সংকলনে তাঁদের কবিতা গৃহীত হয় না। অনেকেই মনে করতে পারেন_গ্রামের কবিগানের কবিরাই শহুরে কবিদের মতো হয়তো কোনো ছন্দ জ্ঞান থাকে না, এমনকি কাব্যতত্ত্বের কোনো নিয়মশৃঙ্খলাও তাঁরা বুঝি মানেন না। কিন্তু আমাদের মনের ভেতর জমে ওঠা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কালিমা ও শহুরে কাব্যচর্চার অহঙ্কারকে সমূলে উপড়ে ফেলার প্রতিজ্ঞা নিয়ে কবিগানের কবি সদানন্দ সরকারের কাব্যসাধনার কিছু কথা আজ উপস্থাপন করছি। 
কবি সদানন্দ সরকার ১৩৬৪ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসের কোনো এক সোমবার জন্মগ্রহণ করেন। সদানন্দ সরকারের বাবার নাম বিরাজ সরকার (বর্তমানে মৃত) এবং মায়ের নাম শ্যামলা (৮০)। সাত ভাইবোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। তিনি ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ২৫ ফাগ্লুন বাসন্তী সরকারের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার জীবনে তিনি তিন কন্যা_রঞ্জনা, বন্দনা, সুবর্ণা এবং এক চেলে সুভেন্দু সরকারের জনক।
কবি সদানন্দ সরকার ১৬-১৭ বছর বয়সে খুলনা জেলার রূপসা থানার শিয়ালী গ্রামের কবি নিখিলরঞ্জন মালাকারের কাছে কবিগানের শিক্ষা নেন। টানা ১০ বছর গুরুর কাছে শিক্ষা নিয়ে তিনি কবিগান পরিবেশনের প্রথাগত নিয়ম ডাক্, মাল্শি, সখী সংবাদ, কবি, টপ্পা, পাঁচালি, জোটক, ভোর বা গোষ্ঠ, মাথুর ইত্যাদি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। এ ছাড়া একই সময়ে তিনি দক্ষ কবি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় রামায়ণ ও ক্লাসিক্যাল সংগীত শিক্ষায়ও নিজেকে নিবেদন করেন। ক্লাসিক্যাল সংগীতে তাঁর গুরু_প্রফুল্লচন্দ মণ্ডল (বর্তমানে মৃত)। দীর্ঘ আট বছর গুরুর শিক্ষায় তিনি ধ্রুপদী সংগীতের ১০টি রাগ-রাগিনী ও ১০টি ঠাটে দক্ষতা অর্জন করেন। 
সদানন্দ সরকারের রামায়ণ গানের গুরু খুলনার বটিয়াঘাটা থানার হেতালগুনিয়া গ্রামের অনন্ত বাছাড়। সদানন্দ সরকার গুরু অনন্ত বাছাড়ের কাছ থেকে কীর্তন-আঙ্গিকে সপ্তকাণ্ড রামায়ণ শিখলেও তিনি রামায়ণের পাঁচটি পালা_'সীতার বিবাহ', 'সীতাঅন্বেষণ', 'লক্ষ্মণ-শক্তিশেল', 'রাবণবধ', 'অশ্বমেধযজ্ঞ' পরিবেশন করতেই বেশি অভ্যস্ত। এখনো কবিগানের পাশাপাশি কোনো বিশেষ আয়োজনে নিমন্ত্রিত হলে তিনি রামায়ণ পরিবেশন করেন।
কবিগান পরিবেশনের জন্য কবি সদানন্দ সরকারকে কোনো কোনো সময় টানা দুই-তিন মাস বাড়ির বাইরে থাকতে হয়। দীর্ঘ এ সময় বাড়ির সঙ্গে তাঁর প্রায় কোনো সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। তিন মাসের মধ্যে হয়তো কোনো দিন মাত্র দুই ঘণ্টার জন্য বাড়ি এসে আবার আসরে ছুটে যেতে হয়। কবিগানের জন্য বছরের অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে থাকায় তাঁর সংসারে কোনো অশান্তি সৃষ্টি হয় কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন করতেই কবি সদানন্দ সরকার বললেন, 'সংসার জীবনে আমি খুবই সুখী। গানের সঙ্গে আমার সংসারের কোনো দ্বন্দ্ব নেই। যদিও কবিগানের জন্য অধিকাংশ সময় আমাকে সংসারের বাইরে থাকতে হয়। আসলে, আমাদের বাড়িওয়ালা (স্ত্রী) আমার সংসারটা ধরে রেখেছেন। এ ছাড়া মা এখনো বেঁচে আছেন। তবে সংসারে আমার অভাববোধ তো সব সময় থাকে। কিন্তু কবিগানের আসরে গেলে আমি সব ভুলে যাই। তখন আমার কোনো পিছুটান থাকে না, মনে হয় না পৃথিবীতে আমার কোনো সংসার আছে, স্ত্রী আছে, মা আছে, পুত্র-কন্যা আছে। আমি কবিগানের আসরে গিয়ে এমন একটা ভাবের জগতে প্রবেশ করি_সে সময় আমি যেন হাতের মুঠোয় স্বর্গ পেয়ে যাই। এ-ই তো আমার জীবনের আনন্দ।'
এ পর্যায়ে সদানন্দ সরকারকে তাঁর পরিবেশিত কবিগানের পালাগুলোর নাম জিজ্ঞেস করি। উত্তরে তিনি জানান, 'দাদা গো, কবিগানের তো কোনো পালা হয় না, বিষয়বস্তু হয়। আমরা মূলত ১৮ পুরাণ (যেমন_নারদীয় পুরাণ, শিব পুরাণ, কালিকা পুরাণ, স্কন্ধ পুরাণ, ব্রহ্ম-বৈবর্তীয় পুরাণ, ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ, মৎস্যপুরাণ ইত্যাদি), বেদ-বাইবেল, কুরআন, চৈতন্যচরিতামৃত, পৃথিবীর চারটি শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত এবং বঙ্কিমচন্দ চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মীর মশাররফ হোসেনসহ আরো অনেকের সাহিত্য থেকে কবিগানের বিষয়বস্তুর আলোচনা করে থাকি। এ ছাড়া আমাদের সায়েন্স বা বিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, ধর্ম ইত্যাদি নিয়েও পড়াশোনা করতে হয়।'
কবিগান পরিবেশনায় কবি সদানন্দ সরকারের যেমন খারাপ কিছু অভিজ্ঞতা আছে তেমনি কিছু ভালো অভিজ্ঞতা আছে। তিনি বলেন, 'আমাদের বিভিন্ন ধর্ম নিয়ে যুক্তিনির্ভর কথা বলতে হয়। যুক্তি যদি কখনো হিন্দুদের বিরুদ্ধে যায়, তো হিন্দুরা খেপে যায়। আবার যুক্তি যদি মুসলমানদের বিরুদ্ধে যায়, তো তারাও ক্ষেপে যায়। আসরজুড়ে একটা হইচই শুরু হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় নতুন ও নিরপেক্ষ যুক্তি এঁটে।'
সদানন্দ সরকারের নিজের রচিত গানের সংখ্যা প্রায় পৌনে ২০০টি। ভাটিয়ালি (ধুয়াগান), ৯টি শ্যামাসংগীত, ১০টি ভজনগীতি, একটি ভবানী বিষয় (মালসী), একটি কবি। নিজের রচিত গানগুলো তিনি যেমন কবিগানের আসরের প্রয়োজনে লিখেছেন তেমনি আসরে তিনি অন্যের রচিত দেড় শতাধিক গান পরিবেশন করেন। এ ছাড়া তিনি কবিগানের আসরে দাঁড়িয়ে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় প্রতিপক্ষের কবির বিপক্ষে নিজের যুক্তি স্থাপনে এবং প্রতিপক্ষের কবির যুক্তি খণ্ডনে বহু টপ্পা ও কবি শ্রেণীর গান মুখে মুখে বেঁধে আসরে পরিবেশন করেন। 
জোট ছাড়া কবিগান হয় না। একটা কবিগানের আসরে দুইজন কবি এবং দুটি কবির দল লাগে। সদানন্দ সরকার এ যাবৎ_কবি অনাদিজ্ঞান সরকার, কবি নিখিল রঞ্জন মালাকার, কবি কৃষ্ণকান্ত রায়, কবি গৌরাঙ্গ রায়, কবি নীরা সরকার, কবি শ্যামল সরকার, নিশিকান্ত সরকার, নারায়ণ বালা, সঞ্জয় রায় প্রমুখ কবির সঙ্গে জোট বেঁধে গান পরিবেশন করেছেন।
সদানন্দ সরকার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ভারতের চবি্বশ পরগনার মধ্যমগ্রাম, বসিরহাট, নদীয়ার গোলাইচণ্ডী, কর্ণাটকের মহিসুর-রাইসুর প্রভৃতি স্থানে গান পরিবেশন করেছেন। প্রতিবছর গড়ে ১০০ রাত পালা ও গান পরিবেশনের হিসাবে ৩২ বছরে তিনি প্রায় তিন হাজার ২০০ রাত গান পরিবেশন করেছেন।
কবি সদানন্দ সরকারের কাছে কবিগানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানতে চাই। উত্তরে তিনি বলেন, 'বর্তমানে যারা কবিগানে আসছে, তারা পড়াশোনা না করে শুনে শিখে কবিগান করছে। এতে বর্তমানে কবিগান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, গানের বিষয় আলোচনার কোনো গভীরতা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে কবিগান তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।' তিনি আরো বলেন, 'এমন পরিস্থিতি বিবেচনা করে আমরা কবিরা মিলে সমপ্রতি একটা কবি সংস্থা গঠন করেছি। এই কবি সংস্থার সভাপতি হলেন কবি নিশিকান্ত সরকার। কবি সংস্থার মাধ্যমে আমরা নতুন কবিদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করব। একই সঙ্গে যাদের পড়াশোনা নেই তাদের কবিগান করার আগে পড়াশোনা করার প্রতি অনুরোধ করব। না পড়ে কবিগান করার জন্যও আমরা নতুন কবিদের নিরুৎসাহিত করব।' কবি সদানন্দ সরকার একান্তভাবেই চান দেশের কবিগান আবার তার সমৃদ্ধির মর্যাদা ফিরে পাক।

মাটির মানুষ

আলকাপ থেকে যাত্রা-কবিগান,
লোকশিক্ষায় অবিচল গুরু-শিষ্য

অশোককুমার কুণ্ডু • বর্ধমান

দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা কোনওদিন সে অর্থে
আলোকবৃত্তে আসেননি। অথচ, গোটা জীবন জেলার মনন এবং সাংস্কৃতিক মানচিত্রকে

রঙিন করে তুলেছেন। মাটি থেকে উঠে আসা সেই সব মানুষের কথা।

দুই কবিয়াল। সাকিন একই জেলায়। এক জন গুরু, অন্যজন শিষ্য। মধ্য পঞ্চাশের জয়দেব মাঝি। বাস বননবগ্রামে। বছর তিরিশের সামসের আলমের বাড়ি মেমারি থানার মণ্ডল গ্রামে।

গুরু হিন্দু, শিষ্য মুসলমান। দু'জনের প্রগাঢ় মিল সুরে, কথনে এবং রসবোধে।

পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তিও অপরিসীম। গুরু-শিষ্যের এমন সামাজিক সম্পর্কে অভিভূত হতে হয়। বসবাসের নিরিখে দূরত্ব যাই-ই হোক, ধর্মের নিরিখে দু'জনের বাস ভিন্ন সংসারে। কিন্তু তাঁদের মিলিয়েছে সুর। বাংলার পুরাতন লোকশিক্ষা ও বিনোদনকে শ্রোতার সামনে মেলে ধরেছেন এঁরা। তাঁদের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন কবিগানের সঙ্গে। কবিগানের কোনও আসরে জয়দেব যদি হন মাথা, তাহলে সামসের সেই অনুষ্ঠানের কলিজা। ব্যাখ্যায় প্রাজ্ঞ জয়দেব। আর চটজলদি উত্তরে অর্থাৎ প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের কাটানে তেমনই সুযোগ্য শিষ্য সামসের।

''আমরা কুশক্ষেত্রীয়। অর্থাৎ নিম্ন জাতি, দুলেদের একটি উপশাখা। গান ভালবাসতাম। মানে গ্রামের ওই সব চালু গান। নবাবুল মিঞার দলে আলকাপে বাচ্চা ছেলের ভূমিকায় অভিনয়। এর পরে লেটোর দলে। পরে অ্যামেচারের যাত্রাদলে। গাঁয়ের এক কাকা, অনাথবন্ধু বললেন, 'ভাইপো তোমার গলায় সুর আছে। ওটিকে বেশি করে ধরো'। নবাবুল

মিঞাও তাই বলেছিল। তারপরে গানটাকেই আঁকড়ে ধরি। একটু একটু করে কবিগানে নাম হল। এক সময় শিষ্য পেলাম সামসেরকে। এখন দু'জনে দল নিয়ে ঘুরে বেড়াই।''—কবিয়াল হয়ে ওঠার ইতিহাস শোনালেন জয়দেব।

বর্ধমান জেলার কবি গায়ক হিসাবে একাধিকবার সরকারি পুরস্কার পেয়েছেন জয়দেব। এ ছাড়া রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের প্রচারাভিযানেও অংশ নিয়েছেন। জয়দেব কথায়, ''এতে জীবিকার সুরাহা হয়।'' তবে, কবিয়ালের কথায় যত সুর-ঝাঁঝ-হাসি, ঘরে অভাবও ততটাই। যৎসামান্য জমিজিরেতে ঘর চলে না। কবিগানও তো বছরভর চলে না। তবুও গান ভালবাসি, আনন্দ পাই। শ্রোতারা রাত জেগে আসর শুনতে আসেন। আনন্দে বাহবা দেন। সেটাও তো সুখের।''—দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন জয়দেব। এমন অভাবের মধ্যেও ছেলেকে কলেজের গণ্ডি পার করিয়েছেন। মেয়েরাও শিক্ষিত।

কবিয়ালদের সবচেয়ে বড় গুণ বিষয়ের পুনর্নির্মাণ। বিষয় তো সেই পুরাতন—বহুপঠিত রামায়ণ ও মহাভারত। তারই বিভিন্ন অংশ ভেঙে নিয়ে সময়োপযোগী করে দর্শকদের আনন্দ দেওয়া এবং সেই সঙ্গে তাকে তলে তলে লোকশিক্ষা।

একটু শোনা যাক সেই সামান্য পুনর্নির্মাণ।

আসরের দু'প্রান্তে দুই কবিয়াল। সমাজের নানা প্রসঙ্গ থেকে চলে এল সেই প্রাগৈতিহাসিক প্রসঙ্গ। পুরুষ-নারীর সম্পর্ক। বহুগমন। এক সময় মূল গায়ক প্রশ্ন তুলল, দ্রৌপদীর যে পাঁচ স্বামী। তার বেলায়? অন্য প্রান্তের গায়কের জবাব—'তখন তো খোরপোশ মামলা ছিল না। তা নারী যদি বহুগমন করে তো পুরুষ করবে না, এ যুক্তি ঠিক নয়। ওহে কবিয়াল, তুমি রাত জেগে কত রোজগার করো? পাঁত স্ত্রী যদি মামলা ঠুকে দেয় তো তোমাকে ডুবে মরতে হবে'। অপর কবিয়ালের শ্রোতাদের দিকে হাতজোড় করে উক্তি, 'মা জননী আপনারাই বলুন, দেবতাদের যা মানায় আমাদের মতো সামান্য মানুষদের তা মানায়'?

প্রশ্নকর্তাকে ফের ঠেসে ধরলেন প্রতিপক্ষ। অবশ্য পুরোটাই কবিতায় ও সুরে। কিন্তু লাভ হল অন্য জায়গায়। গ্রামের ধনী মানুষটি ১০০ টাকার একটি পাত্তি উপহার দিলেন উত্তরকর্তাকে। কারণ, কবিগানের মজুরি যথেষ্ট নয়। শোনা গেল মেডেল ছাড়া, টাকা-পয়সা সব ভাগ হয়বাজনদার-হারমোনিয়াম বাদক সকলের সঙ্গে। এটাই কানুুন।

এক ফাঁকে ভেসে আসে একেবারে ভিন্ন প্রশ্ন—'আপনাদের অাসরে এই তর্ক-বিতর্ক কি আগে থেকে ঠিক করা থাকে'?

কবিয়ালের সহ্যস্য উত্তর, ''আপনি মশাই এত শিক্ষিত লোক, এমন ধরা প্রশ্ন! আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়ার সাবজেক্ট কি আগে থেকে ঠিক করা থাকে? আমাদের আসরে উঠেই প্রশ্ন, আসরেই তার উত্তর। তা না হলে তো কবিয়ালের জন্ম সার্থক হয় না।''

ভ্রম সংশোধন

দক্ষিণবঙ্গে 'মাটির মানুষ' কলামে গত ৮
নভেম্বর নাটা নাচকে....নাটুয়া গুণধর'

সংবাদে ছাপা ছবিটি গুণধরবাবুর নয়।

এই ত্রুটির জন্য আমরা দুঃখিত।

গুণধরবাবুর আসল ছবিটি প্রকাশ করা হল।

previous story
http://anandabazar-unicode.appspot.com/proxy?p=archive/1081122/22south4.htm



কবিগান

দর্শক-শ্রোতার 'সরকার'

মদন সরকার | 



জেঠামশাই মোক্তারি ছেড়ে দিয়ে দেশবিদেশে কবিগান করে বেড়াতেন। জেঠামশাইয়ের নাম বিজয়নারায়ণ আচার্য। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের অন্যতম কবিয়াল। নেত্রকোনা কোর্টে তিনি মোক্তারি করতেন। এই পেশায় অবশ্য তেমন যশ করতে পারেননি। কবিগান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।
শশীমোহন আচার্য আমার বাবা। আমার জন্ম ১৩২৪ সালের আশ্বিন মাসে সহিলপুর গ্রামে। সহিলপুর গ্রামটি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার সিংহের বাংলা ইউনিয়নে। আমার পুরো নাম মদনমোহন আচার্য। কেউ ডাকে মদন আচার্য, কেউ বলে মদন ঠাকুর, আর কেউ বা কয় মদন সরকার। মদন সরকারই বেশি ডাকে। আমার আর একটি নাম আছে। পাবার দেওয়া। ইন্দুভূষণ আচার্য। এ নামে আমাকে কেউ চেনে না, এ নামে কেউ ডাকেও না। নাম বদলের একটি কাহিনি আছে।
আমার জন্মসালে নেত্রকোনায় কবিগান গাইতে এলেন বরিশালের মদন শীল। তিনিও পূর্ববঙ্গের খ্যাতিমান কবিয়াল ছিলেন। আসরে কবির লড়াই বেঁধে গেল আমার জেঠা বিজয় আচার্যের সঙ্গে। সে লড়াইয়ে মদন শীলকে হারিয়ে বিজয় আচার্য সোনার মেডেল পেলেন। আনন্দে তিনি আত্মহারা। বাড়ি ফিরে দেখলেন আমার জন্ম হয়েছে। আনন্দে তিনি মদন শীলের নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখলেন মদনমোহন আচার্য। বাবার দেওয়া নাম ইন্দুভূষণ স্কুলের কাগজপত্রেই রয়ে গেল। জেঠামশাইয়ের দেওয়া নামেই সবাই ডাকে। সহজে ডাকার জন্য অনেকে আমার নামের মোহনটা ছেড়ে দিয়ে শুধু মদন আচার্য বলে। আমি ব্রাহ্মণ বলে অনেকে মদন ঠাকুর বলে ডাকে। কবিগান গাইতে যেয়ে আমি কায়স্থের পদবি সরকার পেলাম। হলাম মদন সরকার। সরকার কায়স্থের পদবি হলেও কবিগানের 'সরকার' আলাদা পদবি। যারা কবিগান গাইত তাদেরই দর্শক-শ্রোতারা সম্মান করে 'সরকার' বলে সম্বোধন করত। ব্রাহ্মণ হয়েও 'সরকার' পদবিতে আমার মন্দ লাগে না। ভালোই লাগে। 'সরকার' তো দর্শক-শ্রোতাদের সম্মানের ডাক। 
এখন বয়স আমার ৯২ বছর। শরীর আর চলে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। বাড়িতে বসে কেবল মনে মনে সুর ভাঁজি। পুরোনো দিনের কথা মনে করি। আনন্দময় দিনের কথা ভাবি। কবিগানের সেই স্বর্ণযুগের কথা ভাবি। তখন আমার যৌবন ছিল। এখন আমি জীবনের শেষের দিকে। এখন—'শুভ্র বরণ করলাম ধারণ,/দাড়ি গোঁফে চুলে,/কেবল পান সুপারি মুলামুড়ি,/দন্তের অন্তকালে।/এখন আর যাই না লঙ্কা,/কাকলী হয়েছে বঙ্কা,/সমন রাজা বাজায় ডঙ্কা,/এ বুড়াকে ধরবে বলে।/সুখ গেল সরিয়া,/অন্ধকারে চলাফেরা,/পরের হাতে ধরিয়া।/শ্বাস ঘনঘন, কাশ ঘনঘন,/তব পদে নিবেদন করি পুনঃ পুনঃ,/যে তা-তা-তা বলে যেতে পারি মরিয়া।'
পড়ালেখা বেশি করিনি। আটপাড়া থানার অভয়পাশা স্কুলে পড়েছি। তখন বড় বোনের বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে থাকতাম। অভয়পাশা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পড়া শেষ করে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে দুই-তিন ক্লাস পড়েছি। লেখাপড়ায় মন বসে না। শুধু জেঠামশাইয়ের কবিগান আমাকে টানে। সেই টান এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। আমি ভেতরে ভেতরে তাও টের পাই তখন।
কবিয়াল হিসেবে জেঠামশাইয়ের নাম তখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও কবিগানের নেশার প্রবল ঘোরে জেঠামশাইয়ের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াই। কবিগান শুনি রামু, রামগতি, রামদয়ালের মতো বড় বড় কবিয়ালের। মাঝে মাঝে আসরে উঠতাম জেঠামশাইয়ের আশীর্বাদে। তাঁর সুবাদে সম্মানও ভালো পেতাম। দিনে দিনে কবিগানে পাকা হতে লাগলাম। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী পড়ে তত্ত্বকথার সন্ধান করতাম। আমার সমসাময়িক সঙ্গী পেলাম সাধু সরকার, কালী ধর, ক্ষেত্রমোহনসহ আরও অনেককে। তাঁদের অনেকের নাম আজ আর মনে করতে পারি না। আমি ওস্তাদ কবিয়াল রামসুন্দরের কাছে দীর্ঘদিন পাঠ নিয়েছি। ১৮ বছর বয়সে আমরা ঘুরতে শুরু করেছি সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা। অনেক জমিদারবাড়িতে কবিগান করেছি। সে সময় কবিগান শুনতেন জমিদার-নায়েবসহ সমাজের বড় বড় মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে কবিগান শুনত। আমার দলের খুব নামডাক ছিল। আমরা কয়েকজন কবি সরকার কথা দিয়ে কথা কেটে আসর জমাতাম। 
'হিন্দু আনি, মুসলমানি,
করতাম আমরা টানাটানি।'
কখনো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করে আমরা চিন্তা করিনি। সম্প্রীতি বজায় রাখতাম। ধর্ম যা-ই হোক, সবাই মানুষ। এই বোধ সবার মধ্যে ছিল। আমরা ভাবতাম: 'পাখির দুটি পাখাই সমান,/তদ্রূপ হিন্দু-মুসলমান।/এক পাখা কাটলে পরে,/পাখি কি আর উড়তে পারে।/পাখাহীন পাখির থাকে না পরান।' 
শ্রোতারা বসে কবিগান শুনত। টপ্পা চলত যুক্তি দিয়ে, শব্দের ছন্দ দিয়ে। যুক্তি শুনে দর্শকশ্রোতা হাততালি দিত। নিজেকে তখন জমিদার মনে হতো। সে সময় কবিয়ালের সম্মান ছিল, কদর ছিল। এখন নেই। সময় বদলে গেছে। দেখতে দেখতে পাল্টে গেল অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের নিজস্ব সম্পদ কবিগানের দুর্দশা কাটল না।
'ব্রিটিশ রাজ্যের অবসান,/জিন্না আনল পাকিস্তান,/রাখল দেশের গৌরবমান/মূর্তি-মন্ত হইয়া,/ও তার ভাবলীলা অবসান,/রাজ্য ছাড়ল আইয়ুব খান,/দিনে দিনে টিক্কা, ইয়াহিয়া।/বহু সংগ্রাম করে শেষ,/শেখ আনল বাংলাদেশ,/শান্তি সুখে ছিলাম বেশ।/দেশবাসী যত,/আতাতায়ী যত ঢুকে পড়ে,/যেনতেন প্রাণে মারে।/আরো সকল সহকারে/ দুঃখ দিয়া কত।'
কবিগান তো আর সারা বছর চলত না। তাই সংসার টানতে অন্য কাজও করেছি। কবিগানের পাশাপাশি পিতল, কাঁসার বাসনপত্রে খোদাই করে নাম লিখতাম। হরফপ্রতি আট আনা পেতাম। সে পয়সা সংসারের কাজে আসত। এ কাজটি আমি শিল্প হিসেবে মনে করতাম।
দেখতে দেখতে অনেক কাল গড়িয়ে গেছে। গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে। দর্শক-শ্রোতাদের রুচির বদল হয়েছে। ভাবের বদল হয়েছে। টাকার দরকার আমারও ছিল। তখন তা বুঝিনি। এখন সন্ধ্যাকালে বুঝি। এখন বুঝলেই কি, আর না বুঝলেই কি? সময়ের কাজ সময়ে করিনি। তবে তার জন্য কোনো খেদ নেই। টাকার দিকে তাকাইনি। আমি গান চাইছি। তাই দিয়েই আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। 
'হঠাৎ করে আইল ধন,/টাকার ভিতরে এত গুণ,/নির্দোষী হয় করিয়া খুন,/টাকার ভিতর দিয়া।/লোকে একটা কথা বলে,/পুত্রশোক টাকা ভুলে।/যত ইতি কর্ম চলে,/হাতের টাকা দিয়া।/টাকা জানি পরমার্থ,/টাকাহীনের জনম ব্যর্থ।/জনসমাজে অপদার্থ,/স্বার্থ কি আর বেচে।/ধার-কর্জ কেউ চাইলে দেয় না,/খাইছে কিনা খবর নেয় না।/গরিবের দায় এ যাতনা,/জীবন ভরা আছে।'
শিল্পী হিসেবে দেশের মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কবি হিসেবে সম্মান পেয়েছি। সরকারের খাতায়ও আমার নাম আছে। সরকার আমায় বছরে ছয় হাজার টাকা ভাতা দেয়। হোক কম, তবু সরকারের সম্মানী! এটি আমার জন্য গৌরবের। নিজের আর কোনো আয় নেই। ছেলের আয়েই জীবন বাঁচাই। গ্রামের বাজারে ডাক্তারি করে আমার ছেলে রবীন্দ্র আচার্য। যা পায় তা দিয়ে তার ছেলেমেয়েসহ আমাকে নিয়ে কোনোক্রমে দিন চালায়। আমার স্ত্রী লাবণ্য বালা গত হয়েছে কয়েক বছর আগে। দুই মেয়ে শোভা ও বিভার বিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। সন-তারিখ মনে নেই। বিভা রামমঙ্গল গায়। কীর্তনের দল আছে তাঁর। এ দিয়ে সে সংসার চালায়। আমরা কেউ ভালো নেই। একবার আহার আরেকবার অনাহারে দিন চলে। শুধু অতীত মনে হয়। কী ছিলাম, এখন কী হলাম!
'এখন দল নাই,/ডুলি নাই।/বিপক্ষের সরকার নাই,/আমারে আর দরকার নাই।'
এখন পারের আশায় বসে আছি। কখন তাঁর ডাক পাই—তখন তাঁর কাছে চলে যাব। আমার গাওয়া গান শুনে যে মানুষেরা খুশি হতো, তাদের কাছে থেকে যাবে আমার কবিতা, আমার গান, গানের সুর। এ ভেবেই মনে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। জীবনটাকে সার্থক ভাবি।
অনুলিখন: আলী আহাম্মদ খান

বাংলা সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে পোস্টের রিভিউ (দ্বিতীয়)

০৩ রা আগস্ট, ২০০৮ দুপুর ১২:০৪

শেয়ার করুনঃ
00

তপন বাগচী বলেছেন: 
মনোমোহন দত্ত (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), মলয়া সঙ্গীত
বিজয় সরকার (নড়াইল), কবিগান, বিচ্ছেদী গান
রমেশ শীল (চট্টগ্রাম), কবিগান, মাইজভাণ্ডারী গান
প্রফুল্ল গোঁসাই (প্রফুল্লরঞ্জন বিশ্বাস, নড়াইল), বৈঠকী গান
মোসলেম বয়াতী (নড়াইল), জারিগান
গনি বয়াতী (বরিশাল), জারিগান
পাগলা কানাই (ঝিনাইদহ), ধুয়াগান, জারিগান
কাঙাল হরিনাথ মজুমদার (কুষ্টিয়া), বাউলগান
মহিন শাহ (ফরিদপুর), বাউলগান
জসীমউদদীন (ফরিদপুর), পল্লীগিতি, ভাটিয়ালী
মেছের শাহ (ফরিদপুর), মুর্শিদিগান
চণ্ডী গোঁসাই (গোপালগঞ্জ), বৈঠকীগান
রবীন্দ্রনাথ মিশ্র (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান
নীলকমল (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান
ভূপতিভূষণ বর্মা (কুড়িগ্রাম), ভাওয়াইয়াগান
আবদুল হালিম বয়াতী (মাদারীপুর), ভাবগান ও বিচারগান
গীতা দত্ত
আভা আলম
সঞ্জীব চৌধুরী.....
হরিচারণ আচার্য, কবিগান
রাজেন সরকার, কবিগান
তারক সরকার, কবিগান
অনাদিজ্ঞান সরকার, কবিগান
মনোহর ঠাকুর, বৈঠকীগান
মহসিন হোসাইন, কবিগান ও লোকসঙ্গীত গবেষক
অশ্বিনী গোঁসাই, মতুয়া সঙ্গীত
সুকণ্ঠ গাইন, রামায়ণগান................
মনে পড়লে আবার লিখব.....

কানা বাবা বলেছেন:
গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার
দেবু ভট্টাচার্য্য
কার্তিক দাস বাউল
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়
আনোয়ারউদ্দিন খান
নজরুল ইসলাম বাবু
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় 
নকিব খান 
লোপামুদ্রা মিত্র
জীবনানন্দ দাশ, জয় গোস্বামী, শঙ্খ ঘোষ, নীরেন চক্রবর্তী প্রোমুখ কবির কোবতেগুলানে সুর দিয়া মচেৎকার গান বানাইচিলো হ্যায়...
'বেণীমাধব', 'আবার আসিবো ফিরে' গানগুলানতো তো পুরা জুশ...
লোপামুদ্রার ওয়েবলিন্ক 
মৌসুমী ভৌমিকের লিরিক্সগুলানও ভালা...

সেলিম তাহের বলেছেন: 
জালাল উদ্দিন খান ( জালাল গীতিকা)

মুজিব মেহদী বলেছেন: লালন
শীতালং শাহ
পাগলা কানাই
দেওয়ান রশিদ
দুদ্দু শাহ
নেধু শাহ
শাহ আরকুম
পাঞ্জু শাহ
হাছন রাজা
রাধারমণ
শাহ আবদুল করিম
রশিদউদ্দিন
জালালউদ্দিন খাঁ
দ্বিজদাস
দীন শরৎ
হরিচরণ আচার্য
আজাহার বয়াতী
রমেশ শীল
মুকুন্দ দাস
মনোমোহন দত্ত
লাল মামুদ
সুলা গাইন
বিজয় নারায়ণ আচার্য
কানাইলাল শীল
রামগতি শীল
রামকানাই নাথ
নিবারণ পণ্ডিত
ভবা পাগলা
উকিল মুনসি
চান খাঁ পাঠান
তৈয়ব আলী
মিরাজ আলী
দুলু খাঁ
আবেদ খাঁ
উমেদ আলী
আবদুল মজিদ তালুকদার
আবদুস সাত্তার
ইদ্রিছ মিয়া
আলী হোসেন সরকার
গুল মাহমুদ
প্রভাত সূত্রধর
আবদুল হেকিম সরকার

মূল পোস্ট

লালন ফকির
হাসন রাজা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ডি এল রায়
রজনী কান্ত সেন
অতুল প্রসাদ
কাজী নজরুল ইসলাম
উকিল মুন্সি
শাহ আব্দুল করিম
খান আতাইর রহমান
আবু হেনা মোস্তফা কামাল
জসীম উদ্দিন
আব্দুল আলীম
শচীন দেব বর্মন
মাহমুদুন নবী
আব্বাস উদ্দিন
সলিল চৌধুরী
প্রতুল মুখোপাধ্যায়
আব্দুল জব্বার
কাঙালিনি সুফিয়া
ভুপেন হাজারিকা
লাকি আকন্দ
শেফালী ঘোষ
আব্দুর রহমান বয়াতি
রাধা রমণ
সুধীন দাস
......

যোগ করুন আপনার প্রিয় এবং জানা তালিকা...

http://www.somewhereinblog.net/blog/Bashpo/28826864

নববর্ষ সংখ্যা ১৪১৭ মুখবন্ধ

বাঙালির বিশ্বরূপ

সাজ্জাদ শরিফ

শাস্ত্র হিসেবে নৃতত্ত্ব কিছুটা পথ এগিয়ে যাওয়ার পর প্রশ্নটা তুলেছিলেন একজন নৃতাত্ত্বিকই, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা সমাজগুলোর পর্যবেক্ষণকে কেন বলা হবে নৃতত্ত্ব, আর ধনী সমাজের পর্যবেক্ষণকে কেন আমরা বলব সমাজতত্ত্ব? এরপর নৃতত্ত্ব আর আগের পথ ধরে এগিয়ে যাওয়ার সাহস পায়নি। একটু ঘুরিয়ে এখানেও এ প্রশ্ন তোলা যায়, শিক্ষিত সমাজের সৃজনশীল প্রকাশকে যেখানে আমরা ডাকি 'শিল্প' বলে, সেখানে আনপড় সমাজের সংস্কৃতিকে কেন বলা হবে 'লোকশিল্প'?
নানাজনের লেখাপত্র থেকে 'লোকশিল্প' সম্পর্কে মোটা দাগে যে ধারণা মেলে তা অনেকটা এ রকম: 'লোকশিল্পে'র ভাষা স্থির। কারণ এর ভাষাটির সুনির্দিষ্ট একটি ধারণা আনপড় সমাজে আগে থেকেই হাজির থাকে। ব্যক্তিশিল্পী সেই সামাজিক ভাষাটিতে নিজের সৃজনশীলতা রূপায়ণ করেন। আগে থেকে তৈরি হয়ে থাকা ভাষায় আত্মাহুতি দেন ব্যক্তিশিল্পী। অর্থাৎ আমাদের লোকায়ত শিল্পচর্চার পুরো ঘটনাটি যেন ইতিহাসের বাইরের ঘটনা। সময় পাল্টাচ্ছে, কিন্তু শিল্পের ভাষা ও অভিজ্ঞতা পাল্টাচ্ছে না।
বিষয়টি একটু বিশদ করা যাক। আমরা দিব্যি দেখতে পাচ্ছি, সৃষ্টিশীল ধারণা ও ভাষার অভিনবত্বে আধুনিক শিল্পীরা আমাদের যারপরনাই হতচকিত করে তুলছেন। অথচ গ্রামেগঞ্জে যাঁরা গাজীর পট আঁঁকছেন, যুগের পর যুগ তাঁদের অঙ্কনশৈলীতে চোখে ধরা পড়ার মতো বদল ঘটছে কোথায়? এ থেকে চটজলদি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আমাদের দেরি হয় না যে, নতুন যুগের মার্জিত শিল্পকলা যেখানে সমসাময়িক ইতিহাসের হাত ধরে উঠে এসেছে, 'লোকশিল্প' সেখানে পড়ে রয়েছে পেছনে। এ শিল্পকলা বিলীয়মান অতীতের স্মৃতিচারণ মাত্র। এর মূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক। এ শিল্পের পেছনে কাজ করছে একটি পিছিয়ে থাকা বা পশ্চাদ্পদ সমাজের মন। আমাদের সচল জীবনে এর কোনো যোগ নেই। 'লোকশিল্পে'র প্রতি আমাদের দরদ আছে বটে, তবে সেটা জাতীয়তাবাদী আবেগে, জাতির 'শেকড়' খোঁজার অন্বেষায়।
বলছিলাম আনপড় পশ্চাদ্পদ সমাজের মনের কথা, তাদের পিছিয়ে থাকা শিল্পকলার কথা। এই ধারণারই গোড়ায় আঘাত করেছিলেন ফরাসি ভাবুক ক্লদ লেভি-স্ত্রস। মিথ অ্যান্ড মিনিং বইয়ে তিনি বললেন, এ সমাজকে পশ্চাদ্পদ ভাবার লেশমাত্র অবকাশ নেই, কারণ 'চারপাশের জগত, এর প্রকৃতি এবং নিজেদের সমাজকে বোঝার তাগিদে ও কামনায় এঁরাও উদ্গ্রীব। এ কারণে একেবারে দার্শনিক, এমনকি কখনো কখনো বিজ্ঞানীদের মতো, এঁরাও বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এগিয়ে চলেন।' ক্লদ এখানেই থামেন না। শিক্ষিত ও আনপড় সমাজের পার্থক্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, লোকায়ত সমাজ 'আলাদা কারণ এঁরা স্বল্পতম রসদ নিয়ে বিশ্বজগত সম্পর্কে একটি সাধারণ ধারণায় পৌঁছাতে চান—আর এ ধারণা নিছক সাধারণ নয়, বরং সামগ্রিক।' (বাঁকা হরফ ক্লদ লেভি-স্ত্রসের)। জগদ্বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের দোহাই দিয়ে তিনি বলেন, শিক্ষিত সমাজের বৈজ্ঞানিক মন এর বিপরীত। নিজেদের সমস্যা সমাধানের জন্য সবকিছু তাঁরা বিভক্ত করে আনে। সহজ কথায়, আনপড় সমাজের বিশ্বরূপ অখণ্ড, আধুনিক সমাজের বিশ্বধারণা বিচূর্ণ। তাঁদের নিজ নিজ শিল্পকলায়ও সেই বিশ্বরূপেরই অভিব্যক্তি।
এই ধারণার চাক্ষুস নমুনা দেখেছিলাম জাপানের এক লোকশিল্প জাদুঘরের চত্বরে পা রাখার পর। কামরার পর কামরায় বিপুলায়তন সে জাদুঘরে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এমন সব লোকায়ত শিল্পের নিদর্শন, যা রচিত হয়েছে কেবল ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোয়। ইতিহাসের সেসব ব্রাহ্মমুহূর্ত কীভাবে ভেঙে দিচ্ছে 'লোকশিল্পে'র তথাকথিত চেনা ছক, সে ছিল অবাক বিস্ময়ে দেখার মতো ব্যাপার।
শিল্পরচনার প্রক্রিয়ায় গ্রামীণ শিল্পীর লড়াই বরং আরও তীব্র। গ্রামসমাজের মানসে গেঁথে থাকা শিল্পভাষাটি তৃপ্ত করে শুরু করতে হয় তাঁদের শিল্পরচনা। কিন্তু আবার ওরই মধ্যে রূপায়ণ করতে হয় শিল্পীর নিজস্ব শিল্পচেতনা। সমাজের কাঙ্ক্ষিত শিল্পভাষার মধ্যে তাই সেখানে স্ফূর্তি ঘটে ব্যক্তিশিল্পীর নিজস্ব মুদ্রা ও পাল্টে যাওয়া বিশ্ববোধ। ইতিহাসের দীর্ঘ পটভূমিকায় এই বিবর্তন এত ধীর ও সূক্ষ্ম যে ধৈর্যের সঙ্গে লক্ষ না করলে সহজে নজরে আসে না। বাংলাদেশের লোকায়তিক শিল্পের নিবিড় পর্যবেক্ষক, যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক হেনরি গ্লাসির বর্ণনায়, এ শিল্প 'ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক, বৌদ্ধিক ও ইন্দ্রিয়পরায়ণ, উদ্ভাবনমুখর ও চিরায়ত, বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক, প্রয়োজনীয় ও মনোহর, ইচ্ছা ও বাস্তবতার এক সমন্বয়।'
আমাদের লোকায়ত শিল্পেও এভাবে রচিত হয়ে চলেছে বাংলার নিজস্ব ও অখণ্ড বিশ্বরূপ। আর গ্রামেগঞ্জে তা রচনা করে চলেছেন আমাদের প্রজ্ঞাবান শিল্পীরা; যাত্রায়, পটে, মৃত্ ও ধাতুশিল্পে, গানের বিচিত্র উচ্ছৃত ধারায়। জাতি হিসেবে আমাদের স্বপ্ন ও লড়াইয়ের খবর পেতে হলে এ শিল্পেরই কাছে আমাদের বারবার ফিরে ফিরে আসতে হবে।

বাউলগান

বাউলের আউলা কথা

আবদুল করিম শাহ

সাধনায় মগ্ন আবদুল করিম শাহআমার বয়স এখন প্রায় চার কুড়ি দশ। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। সাঁইজির কথায় বলতে গেলে:
দিনে দিনে হলো আমার দিন আখেরি \ 
আমি ছিলাম কোথা এলাম কোথা 
আবার যাব কোথা সদাই ভেবে মরি \
বাল্যকাল খেলায় গেল
যৌবনে কলঙ্ক হলো
বৃদ্ধকাল সামনে এলো
মহাকাল এসে করলো অধিকারী \
এই তো অবস্থা! পারঘাটায় বসে আছি—কখন দয়ালচাঁদের নাও আসে সেই আশায়। আকুল হয়ে ডাকছি কখন তাঁর কৃপা হয়:
পারে লয়ে যাও আমায়।
আমি অপার হয়ে বসে আছি
ওহে দয়াময় \
নাই আমার ভজনসাধন
চিরদিন কুপথে গমন
নাম শুনেছি পতিতপাবন
তাইতে দেই দোহাই \
আমি একা রইলাম ঘাটে
ভানু সে বসিল পাটে
তোমা বিনে ঘোর সংকটে
না দেখি উপায় \
আগেকার নদীয়া জেলা—এখনকার জেলা কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার অধীন অঞ্জনগাছি গ্রামে আমার জন্ম। মায়ের কাছে শুনেছি, বাংলা ১৩২৭ সনের ভাদ্র মাসে যে-বার বড় বন্যা সব গ্রামগঞ্জ ভাসিয়ে নিয়েছিল, সেই মহাদুর্যোগের কালে আমি হই। আমার বাপের নাম ঝুমুর আলী আর মায়ের নাম কুসুম। আমরা 'জোয়ারদার' বংশের লোক। জায়গাজমি বেশ ভালোই ছিল। আমরা ছিলাম সম্পন্ন গেরস্ত। বাপজান ঝুমুর আলী কৃষিকর্ম করতেন। পাশাপাশি গানবাজনাও ভালোবাসতেন। আর আমাদের অঞ্জনগাছি গ্রাম ছিল গানের গ্রাম। যাত্রাপালা, ভাসান, ধুয়োজারি, পদ্মাপুরাণ, গাজীর গীত—এসব গান হামেশাই হতো। সারা বছরই গানের আসর লেগে থাকত। তবে ফসল ওঠার পর চাষি-গেরস্তের কাজকামের অবসর মিলত, তখন জাঁকিয়ে এসব গানের আসর-বাসর বসত। তখন উৎসব-আনন্দে গ্রামের চেহারাটাই বদলে যেত।
বাপজান ঝুমুর আলীর অন্তরে এক ধরনের উদাস ভাব ছিল—সেই কারণে বাপ-মা দুজনই কুষ্টিয়া শহরের কোলে উদিবাড়ী গ্রামের চিশতিয়া তরিকায় সাধক মনসুর শাহের কাছে দীক্ষা নেন। আর সেই সঙ্গে ছিল গান-বাজনার ঝোঁকও। ভাবগানের পাল্লায় অংশ নিতে গ্রামের বাইরেও নানা জায়গায় ডাক পড়ত তাঁর। পাল্লার গানে বাপজানের বেশ নাম-যশও ছিল। আমার মা-ও কিন্তু শুনে শুনে গান তুলতে পারতেন—গলাও ছিল বেশ ভালো। কিন্তু সেই সুর ওই বাড়ির ভেতরেই ঘোরাফেরা করত। একটু বড় হয়ে বাপজানের সঙ্গে গানের আসরে যাওয়া শুরু করলাম। তাঁর গানের সঙ্গে জুড়ি বাজাতাম। এ রকম করে গানের ওপর খুব মন বসে গেল। বলতে গেলে বাপজানই আমার গানের প্রথম গুরু—তাঁর কাছেই এ বিদ্যের হাতেখড়ি।
অঞ্জনগাছি সেই সময়ে ছিল ছবির মতো গ্রাম। এর পাশ দিয়ে বয়ে যেত পারুল নামের ছোট্ট একটি নদী। অবশ্য এখন আর সেই নদী নেই—হেজেমজে শেষ হয়ে গেছে। তার ওপরে এখন ফসলের মাঠ। তো সেই পারুল নদী আমাকে খুব টানত। রোজই প্রায় পারুল নদীর পাড়ে গিয়ে বসে থাকতাম আর গুনগুন করে গান গাইতাম। এভাবে ধীরে ধীরে কখন যেন গানের মোহ আমাকে টেনে নিয়ে গেল ভিন্ন এক জগতে। এই অঞ্জনগাছি গ্রামেরই আবুল মকসুদ—সম্পর্কে আমার জ্ঞাতি-ফুপা—শব্দগানের ওস্তাদ গায়ক ছিলেন। তিনিই আমাকে হাতে ধরে ভাবগানের তালিম দেন। তখন থেকেই মনটা উড়ু উড়ু। গানের নেশায় ঘর ছাড়লাম সেই ১৬-১৭ বছর বয়সেই। গেলাম কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানার জগন্নাথপুরের তছের শাহ ফকিরের কাছে। বলা যায়, তছের শাহ ফকিরি গান শেখার কপিন এঁটে দিলেন ভালো করে। বেশ কিছুকাল ছিলাম তাঁর কাছে। তারপর এলাম ফকির বেহাল শাহের দ্বারে। তাঁর নিবাস ছিল আলমডাঙ্গা থানার ফরিদপুর গ্রামে। এখানে একনাগাড়ে থাকি বেশ কয়েক বছর। বেহাল শাহ একেবারে উজাড় করে দিলেন তাঁর গানের ভান্ডার। মহত্-মহাজন সাধু-গুরুর কাছে আমার যা কিছু কদরদানি তার মূলে বেহাল শাহ। এ কথা আমি দশমুখে বলব যে বেহাল শাহই আমার গানের প্রধান গুরু। অবশ্য আরও দু-চারজন সাধু-গুরুর কাছে সামান্য গানের শিক্ষা নিলেও বেহাল শাহই আমার গানের জগতের চক্ষুদানির গুরু।
গান তো যা হোক শেখা হলো। ভাবগানের মধ্যে মন ডুবে গেল। এখন সাধনগুরুর খোঁজে পথে নামলাম। আমার বাপ-মা দুজনই বয়েত হয়েছিলেন উদিবাড়ীর মনসুর শাহ ফকিরের কাছে। আমিও প্রথমে এখানেই দাখিল হলাম। তারপর শুরু হলো পথে পথে ঘোরা—সাধুসঙ্গ করি আর পড়ে থাকি আখড়ায় আখড়ায়। মনটা শা হয় না। সব সময়ই মন কী যেন খুঁজে বেড়ায়। তখন আমার উঠতি বয়স—এই ২৫-২৬ বছর হবে আর কি। অবশেষে মনের মতো গুরুর সন্ধান মিলল সদর কুষ্টিয়ার হালসার কাছে শঙ্করদিয়া গ্রামে ফকির নিমাই শাহের ধামে এসে। নিমাই শাহ ছিলেন সতী মায়ের ঘরের সাধক-ফকির। তাঁর সঙ্গ-সান্নিধ্য আর বাক্য শুনে মনের বন্ধ জানালাগুলো সব খুলে গেল। এক মরমি আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল অন্তরের অন্ধকার ভুবন। দীক্ষা নিলাম তাঁর কাছে। দুনিয়ার ফিকির ছেড়ে হলাম সাধনপথের ফকির। নিমাই শাহের গুরুপরম্পরার পরিচয় এবার নেওয়া যাক। নিমাই শাহের গুরু ছিলেন জেলা যশোরের মহেশপুর থানার নওদাগাঁও বুঝতলার অমূল্য শাহ, তাঁর গুরু কুষ্টিয়ার মীরপুর থানার মল্লিকপুরের পাঁচু শাহ, তাঁর গুরু চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা থানার বণ্ডবিল গ্রামের খুদু শাহ। খুদু শাহের গুরুর নামও জানতাম—কিন্তু এখন আর মনে পড়ছে না।
বাউল-ফকিরের ঘর পাঁচটা: সতী মায়ের ঘর, লালন সাঁইয়ের ঘর, উজল চৌধুরীর ঘর, দেলবার শাহের ঘর আর পাঞ্জু শাহের ঘর। আমরা সতী মায়ের ঘরের ফকির, তবে অন্য ঘরের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক আছে—ভাবের আদান-প্রদান—সাধুসঙ্গ হয়ে থাকে। লালনের ঘরই এখন সবচেয়ে বড় ঘর—তাঁর পদ-পদাবলিই সাধু-গুরু বাউল-ফকিরের কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এই যে আমি, সতী মায়ের ঘরের ফকির হলেও প্রধানত লালনের গানই গেয়ে থাকি। সতী মায়ের ঘরের গানেরও অনেক নামকরা গায়ক ছিলেন। ঝিনাইদহের জহরদ্দি শাহ উজল চৌধুরীর ঘরকে আলোকিত করে রেখেছিলেন তাঁর গানের ভেতর দিয়ে। দেলবার শাহের ঘরের গান গাইতেন হালসার আকবর ফকির। পাঞ্জু শাহের গান সাধুমহলে অনেকেই গেয়ে থাকেন। আর লালন সাঁইজির গান তো সব আসর-বাসরে সবাই করে থাকেন।
আমি এক ভবঘুরে ফকির। সেই যৌবনকালে ঘর ছেড়েছিলাম, বলতে গেলে এখনো পথে পথেই আছি—স্থায়ী ঠাঁই আর হয়নি। অবশ্য বাউলের আসল ঠিকানা তো সেই আলেক সাঁইয়ের ধাম। তো যা-ই হোক, জন্মগ্রাম অঞ্জনগাছি ছাড়ার পর বহু ঘাটের পানি খেয়ে প্রথমে নীলমণিগঞ্জের কাছে শর্ষেডাঙ্গায় আখড়া গড়ে তুলি। সেখান থেকে যশোরের বাঘারপাড়া থানার নলডাঙ্গা, তারপর যশোরের বারান্দিপাড়ায় প্রায় এক যুগ থাকি। অন্তরের তাগিদে আর গুরুর মায়ায় শঙ্করদিয়ায় গুরুবাড়িতেও কয়েক বছর বাস করি। আবার ফিরে যাই বারান্দিপাড়ায়। তারপর কুষ্টিয়ার চৌড়হাসে কিছুকাল থাকার পর আসি এখন যেখানে আছি— কুমারগাড়ার ক্যানালপাড়ার বস্তিতে। এখানেই একটা আখড়াবাড়ি করে সাধুভক্ত শিষ্য-শাবকদের নিয়ে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাতে চাই।
একটা কথা এখানে বলে রাখি। বাউল-ফকিরদের মধ্যে কিন্তু নারী-পুরুষে কোনো বিভেদ নেই। পুরুষ ও প্রকৃতির যুগলসাধনেই তো সেই অধরাকে ধরতে হয়—মনের মানুষকে পাওয়া যায়। নারীর গুরুত্ব ও মর্যাদা তাই বাউলসাধনায় অনেক ওপরে। বাউল-ফকিরদের আদি গুরুও তো মাধব বিবি নামের এক মুসলমান নারী। রাসুল তো তাঁর মারেফতের গুপ্ত জ্ঞান দিয়ে যান বিবি ফাতেমাকে। আমাদের ঘরের ধর্মগুরু সতী মাও তো একজন নারী। ফকিরানি যে নারী-পুরুষ সবাইকেই দীক্ষা দেওয়ার অধিকারী, সে তো আমার নিজের চোখেই দেখা। খোর্দ আইলচারার কালিদাসী ফকিরানি, ফরিদপুর গ্রামের শুকচাঁদ শাহের সেবাদাসী বানু মাতাজি আর কোকিল শাহের সেবাদাসী যশোদা ফকিরানির কাছে দীক্ষা নেওয়া সাধনপথের নারী-পুরুষের সংখ্যা একেবারে কম নয়। জাঁহাপুরের খোদাবক্স শাহই তো শেষকালে বানু মাতাজির কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। আর গানের দলেও তো কোনো কোনো ফকিরানির দাপটের কথা মনে পড়ে—এঁদের মধ্যে কুষ্টিয়া শহরের পাশেই মঙ্গলবাড়িয়ার ননীবালা, সরোজগঞ্জের পাশের বলগাতি গ্রামের সুরধনী আর লাইলি ফকিরানির কথা কি কখনো ভোলা যায়!
এই নব্বই বছর বয়সে কত বড় বড় সাধক-মহাজনের সঙ্গ লাভ করেছি, তা ভাবলে নিজেকে ধন্য মনে হয়। এঁদের বেশির ভাগই আজ আর নেই—একে একে সব বিদায় নিয়েছেন। তাঁরা ভাগ্যবান—তাঁরা সব পরমাত্মায় মিশে গেছেন। সেই পরমগুরু অমূল্য শাহ, নিমাই শাহ, বেহাল শাহ, শুকচাঁদ শাহ, শৈলকূপার বসন্তপুরের কালাচাঁদ শাহ ও আতর আলী শাহ, শালিখা থানার গোয়ালখালীর মহেন্দ্র গোঁসাই, জাঁহাপুরের খোদাবক্স শাহ, মেহেরপুরের যাদবপুরের গোলাম ঝড়ু শাহ, ঝিকরগাছার বাঁকড়ার কানাই শাহ, ঝুটিয়াডাঙ্গার নঈমুদ্দীন শাহ, ঝিকরগাছার কানকুলা চাঁদা গ্রামের গহর শাহ, ছেঁউড়িয়ার গোলাম ইয়াসিন শাহ, মকছেদ আলী শাহ—আরও কত মহত্-মহাজনের নাম মনে পড়ে। এই সেদিন চলে গেলেন খলিসাকুণ্ডির ফকির আবদুর রব শাহ। হায়, তাঁরা আজ কোথায়! আমি অধম-পাপী শুধু পড়ে আছি ভবযন্ত্রণা ভোগ করতে। ভাবি বসে—অন্তিমকালে 'কবে সাধুর চরণধূলি মোর লাগবে গায়'!
সাধুসঙ্গের কত স্মৃতি আজ মনের মধ্যে গুমরে ফেরে—কোনোটা আনন্দের, কোনোটা বেদনার। গুরু-শিষ্যের মান-অপমানের একটা ঘটনার কথা বলি। শুকচাঁদ শাহের গুরু ছিলেন অমূল্য শাহ। কিন্তু তিনি গোপনে আবার গুরুপদে দীক্ষা নেন হরিয়ারঘাটের খোদাবক্স শাহের কাছে। তো এই শুকচাঁদ শাহ তাঁর ফরিদপুর গ্রামের আখড়ায় এক সাধুসঙ্গের আয়োজন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই গুরুভক্তির নিদর্শন হিসেবে সেবাসামগ্রীর 'পারস' দিতে হয়। শুকচাঁদ সেই 'পারস' যখন খোদাবক্স শাহের সামনে পেশ করলেন, তখন বিস্মিত-ব্যথিত অমূল্য শাহ মাথা নিচু করে বসে রইলেন আর তাঁর দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। এই দৃশ্য দেখে উপস্থিত সাধুরা শুকচাঁদকে তিরস্কার করে গুরু অমূল্য শাহের কাছে মাফ চাইতে বললেন। অনুতপ্ত শুকচাঁদ গুরুর দুই পা জড়িয়ে ধরে মাফ চাইলে অমূল্য শাহ শুধু বললেন, 'বাবা শুকচাঁদ, যে মানুষটা তোমাকে মাফ করবে, সেই মানুষ তো আর আমার মধ্যে নেই! সে তো কখন চলে গেছে!' এই ঘটনা সাধু-গুরুদের মধ্যে বেশ ক্ষোভের সঞ্চার করে। এর কিছুকাল পরে শুকচাঁদ শাহ তাঁর ভক্তবাড়িতে হঠাৎ দাস্ত-বমি হয়ে দেহত্যাগ করেন। এসব কথা ভাবলে মনটা বড় নরম হয়ে যায়। গুরু যে চোখের মণি—শুকচাঁদ সেই গুরুমাহাত্ম্য বোঝেনি, সে কারণেই এই ঘটনা—সাধুরা তাই মনে করেন।
এই জীবনে কত মানুষের সঙ্গে যে পরিচয় হয়েছে, সে কথা আর কী বলব! আমেরিকা থেকে এসেছিলেন ক্যারল সলোমন—তাঁর শখ হয়েছিল লালন ও বাউলদের নিয়ে কাজ করার। তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হয় পয়লা কার্তিক ছেঁউড়িয়ায় লালন সাঁইজির স্মরণোৎসবে। কোন সাল তা আজ আর মনে নেই, তবে বছর তিরিশেক আগে হবে বলে মনে হয়। মেম সাহেব কার কাছে যেন আমার নাম শুনে আমাকে খুঁজে বের করেন। আমার কাছে তিনি জানতে চাইলেন, 'চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে, আমরা ভেবে করব কি'—এই গানটার গোপন মানে কী? তিনি ভেবেছিলেন এটি লালনের গান। আমি তাঁকে বললাম, 'এ তো লালনের গান নয়। এর পদকর্তা বীরভূমের বাউল গোপাল শাহ। আর এসব তত্ত্বকথার আলোচনা তো এখানে হতে পারে না, আমার ঘরে এলে কথাবার্তা হওয়া সম্ভব।' আমি তখন যশোরের বারান্দিপাড়ায় থাকতাম। এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ক্যারল আমার বারান্দিপাড়ায় ভাড়াবাড়িতে এসে উপস্থিত। এই যাত্রায় আমার ওখানে মাস খানেক ছিলেন। বাউলগান ও তত্ত্ব নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল তাঁর, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জিজ্ঞেস করতেন। আমিও সাধ্যমতো তাঁর জিজ্ঞাসার জবাব দিতাম—আর মেম সাহেব খাতায় টুকে নিতেন। এর পরও আরও বেশ কয়েকবার তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে ঢাকা-কুষ্টিয়া-যশোরে। একবার তাঁকে নড়াইলের ডুমদিতে কবিয়াল বিজয় সরকারের বাড়িতে নিয়ে যাই। তিন-চার দিন ছিলেন। অনেক রাত পর্যন্ত নানা তত্ত্ব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতো। লালনের গানের অনুবাদ ও এই মহেক নিয়ে তিনি কিছু লিখেছিলেন বলে শুনেছি। আমেরিকা থেকে মাঝেমধ্যে চিঠি দিতেন। মেম সাহেবের মনটা বড় সরল ছিল, আর খুব মিশুকও ছিলেন। সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারতেন। আমাকে ও ফকিরানিকে খুব ভক্তি করতেন। তাঁর কাছ থেকে আমরা অনেক সাহায্যও পেয়েছি। একবার আমি কুষ্টিয়ায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে মেম সাহেব ঢাকায় নিয়ে গিয়ে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এই মানুষটিও প্রায় বছর ঘুরে এল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
মানুষের কাছে তো বাউলের ভক্তি-ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চাওয়ার নেই। তবু মিথ্যে বলব না, মানুষের শ্রদ্ধা-ভক্তি-ভালোবাসার পাশাপাশি সাহায্য-সহযোগিতাও কম পাইনি। এই যে ঢাকার বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এবং আরও অনেকে আমাকে খুব ভালোবাসেন। তাঁদের কথা ভুলব না। সরকার নাকি বাউলদের সাহায্য-টাহায্য করে থাকে বলে শুনেছি, কিন্তু কাজে তো তার প্রমাণ পাইনি। কুষ্টিয়ার শিল্পকলা একাডেমীতে মেন্টর ফেলোশিপে লালনের গান শেখানোর দায়িত্ব পেয়েছিলেন ফকির মহিন শাহ। উনি মারা গেলে সেই জায়গায় আমাকে দয়া করে বহাল করা হয়—বছর দেড়েক কাজ করেছিলাম। তারপর আর কেউ ডাকেনি। ১৫-১৬ বছর আগে স্যার (আবুল আহসান চৌধুরী) লালন-শিল্পীদের সঙ্গে আমাকেও কলকাতায় নিয়ে যান। মধুসূদন মঞ্চে আমার গান শোনার জন্য শ্রদ্ধেয় অন্নদাশঙ্কর রায় এসেছিলেন। স্যার কিছুদিন আগে গৌতম ঘোষ নামে কলকাতার এক সিনেমার লোককে নিয়ে এসেছিলেন আমার এই ভাঙা ঘরে। তিনি নাকি লালন সাঁইজিকে নিয়ে সিনেমা করবেন। রাত প্রায় সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়ে অনেক গান শোনালাম ফরমায়েশমতো। সিনেমায় লালনের কয়েকটা গান আমাকে দিয়ে গাওয়ানো হবে বলে গৌতম ঘোষ জানালেন। পরে শুনলাম, অন্য গায়ককে দিয়ে তাঁরা গান করিয়েছেন। একবার শুনলাম, সরকার নাকি আমাকে 'একুশে পদক' দেওয়া নিয়ে ভাবছে। ভাবলাম, মরণের আগে হলে তো বেশ ভালোই হয়। কিন্তু কাঙালের ভাগ্যে কি আর শিকে ছেঁড়ে! সাঁইজিই তো বলেছেন: 'সকলি কপালে করে।/ কপালের নাম গোপালচন্দ্র/ কপালের নাম গুয়ে-গোবরে'।
সাধুসঙ্গ আর নানা মহতের গান করতে করতে শখ হলো নিজে গান বাঁধার। এ বড় সাহসের কাজ। কোথায় লালন সাঁই, দুদ্দু শাহ, পাঞ্জ শাহ, জহরদ্দি শাহ, হাউড়ে গোঁসাই, যাদুবিন্দু—আর কোথায় করিম শাহ! এ যেন কুঁজোর কাত হয়ে শোয়ার মতো ব্যাপার। যা-ই হোক, সাঁইজির কৃপায় তা নয় নয় করে ২০-২৫ খানা গান রচনা করেছি—দৈন্য, নবুয়ত, বেলায়েত, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব—এসব আর কি! আসরে-বাসরে দু-একখানা গান গাওয়াও হয়। অধম করিমের একটা দৈন্যপদ বলি:
এসো ব্যথার ব্যথিত ওগো তুমি আমার সাঁই।
তোমার মতো ব্যথার ব্যথিত ব্রহ্মাণ্ডে কেউ নাই \
দয়াল দরদি হে লুকাইলে কোন্ শহরে
অধম রাহা-পানে চেয়ে বঞ্চিত সদাই \
দীনবন্ধু জগত্কর্তা ভুলো না এ অধীনের কথা
দরবেশ নিমাই চাঁদ মোর পরম পিতা
অধম করিম বলছে তাই \
গান আর গুরু ছাড়া বাউল হয় না। গানই হলো বাউল-ফকিরের ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। সাধকের সব ইচ্ছা-আকুতি তো গানের ভেতর দিয়েই প্রকাশ পায়। গানে গানেই তো বাউল তার মনের মানুষকে খোঁজে—স্রষ্টাকে খুঁজে বেড়ায়। আমিও সেই ভাব নিয়েই গান গাই। গানই আমার জীবন। গান নেই তো আমিও নেই। গান না করলে আমার ভালো লাগে না। আসরে-বাসরে সাধুসঙ্গে তো গাই-ই, এমনই শুয়ে শুয়েও আপন মনে গান করি। গান হলো আমার আত্মার খোরাক। বাউল-ফকিরের এই করণকারণ আর গান-বাজনার জন্য তো কসুরি কম হয়নি। মোল্লা-মৌলবিরা তো গলা টিপে ধরেছে। কিন্তু বাউলের গান তবু থামেনি, থামবে না কখনো। কেননা এই গান 'মানুষ সত্যে'র গান—এই গান কোনো জাত-ধর্মের গান না—এ হলো মানুষকে ভালোবাসার গান। আলেক সাঁই।
অনুলিখন: আবুল আহসান চৌধুরী

যাত্রা

যাত্রামঞ্চে সাড়ে পাঁচ হাজার রাত

জ্যোৎস্না বিশ্বাস

দস্যুরানি ফুলন দেবীর ভূমিকায় জ্যোত্স্না বিশ্বাসপারিবারিকভাবে কীর্তন গাইতাম ছোটবেলায়। ছিল নাচার অভ্যাস। অভিনয় করার ইচ্ছেও ছিল মনে। তখন অভিনয় কী জানতাম না। জানতাম কেবল সুচিত্রা সেন। তাঁর ছবি দেখেছি। নিজেকে তখন সুচিত্রা সেন ভাবতে শুরু করি। তাঁর মতো শাড়ি পরা, তাঁর মতো কোমরে শাড়ির কোণ গুঁজে দেওয়া, তাঁর ব্লাউজের মতো হাতা বানানো। মনে হতো সুচিত্রা সেন হতে পারলেই বুঝি জীবন সার্থক। কিন্তু সুচিত্রা সেন কীভাবে হওয়া যায়, তার কোনো পথই আমার জানা ছিল না।
জন্ম আমার সিরাজগঞ্জে। বাবার নাম গণেশ সূত্রধর, মায়ের নাম এলোকেশী সূত্রধর। তাঁদের আগ্রহেই গানের চর্চা করতাম।
আমাদের এলাকা তখন যাত্রাগানের জন্য বিখ্যাত। নারায়ণচন্দ্র দত্ত ১৯৪৪ সাল থেকে যাত্রাদল পরিচালনা করতেন বাসন্তী অপেরা নামে। সারা দেশে নামডাক ছিল ওই দলের। একসময় তিনি দল করা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু তাতে ওই এলাকার যাত্রাগান বন্ধ হয়নি। শখের যাত্রা হতো বিভিন্ন গ্রামে। আমিও শখের যাত্রাদলে গান গেয়েছি, নেচেছি, দু-একটা চরিত্রে অভিনয়ও করেছি।
১৯৫৯ সালে আমাদের গ্রামে বাবুল অপেরা আসে গান গাইতে। আমরা যাত্রা দেখতে যাই। সিরাজদৌলা পালা দেখি। যাত্রায় এলাকা সরগরম হয়ে ওঠে। নারায়ণবাবু আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। বাসন্তী অপেরা আবার চালু করেন। বিরাট পোস্টার ছাপালেন 'মেয়ে-পুরুষ সম্মিলিত যাত্রাদল'। এর আগে ছেলেরাই মেয়েদের অভিনয় করত। কেবল বাবুল অপেরায় মঞ্জুশ্রী মুখার্জি এসেছেন চট্টগ্রামের বাবুল থিয়েটার থেকে। মঞ্জুশ্রীদির বাড়ি মাদারীপুরে। কিন্তু তাঁরা চট্টগ্রামেই থাকতেন। তাঁর বাবা খুব বড় যন্ত্রশিল্পী ছিলেন।
তো নারায়ণবাবু এসে বাবাকে ধরলেন, 'আপনার মেয়ে তো নাচতে-গাইতে জানে। আমাকে দিন, আমার দলে ওকে নিতে চাই।' আমি বাসন্তী অপেরায় যোগ দিলাম। ওই দলে ডিরেক্টর হিসেবে যোগ দিলেন অমলেন্দু বিশ্বাস। তিনি চট্টগ্রামে কমলা থিয়েটার ও বাবুল থিয়েটার থেকে বাবুল অপেরার মাধ্যমে যাত্রাজগতে প্রবেশ করেন। এরপর তিনি আসেন বাসন্তী অপেরায়। ওই দলে তখন মঞ্জুশ্রী বিশ্বাস এবং পাবনার অনিল ঘোষ আছেন। আমি সখিনৃত্য করব, এই ভেবেই দলে ঢুকি। কিন্তু একদিন ডিরেক্টর অমলেন্দু বিশ্বাস ডেকে বললেন, 'এই মেয়ে, তুমি অভিনয় করবে।' আমি তো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে পড়ি। অত বড় নামকরা ডিরেক্টরের সামনে কথা বলতেই ভয় পাই। মঞ্চে গিয়ে অভিনয় করব কীভাবে? এই ভেবে আমার অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়! কিন্তু তিনি সাহস দিলেন। তখন সাহজাদপুরে আমাদের প্যান্ডেল। তিনি ডেকে আমাকে ভাওয়াল সন্ন্যাসী পালায় আশ্রমদুহিতা রত্নাবলীর ভূমিকায় নির্বাচন করেন। দুটি গান ছিল আমার কণ্ঠে। 
ওস্তাদ যতীন্দ্রমোহন সাহা ছিলেন দলের গানের মাস্টার। তিনি আমাকে গান দুটি শিখিয়ে দিলেন। এমন কোনো যন্ত্র নেই, যা তিনি বাজাতে পারতেন না। খুব গুণী লোক ছিলেন। এমনভাবে গান শেখাতেন যে আমরা সহজেই তুলে নিতে পারতাম। সেই সময়ের প্রখ্যাত শিল্পী বাঁশরী লাহিড়ী তাঁর ছাত্রী ছিলেন। তিনি এ নিয়ে খুব গর্ব করতেন। এই বাঁশরী লাহিড়ীর ছেলে বাপ্পী লাহিড়ীও খুব নামী শিল্পী হন। যতীন সাহার বন্ধু ছিলেন বারীন মজুমদার। বারীন মজুমদার তাঁকে বড় শিল্পী হিসেবে মান্য করতেন। বারীন মজুমদার ঢাকা এসে তাঁর প্রতিভার সবটুকু উজাড় করে দিলেন। দেশ তাঁকে বরণ করল। কিন্তু ওস্তাদ যতীন সাহা সংগীতজ্ঞ হয়েও সবার কাছে সেই জ্ঞান বিতরণ করতে পারলেন না। আমরা যাত্রার মানুষ এখনো ওস্তাদ যতীন সাহার সংগীত প্রতিভাকে সম্মান করি। তাঁর শেখানো গানের জোরে বুঝি মোটামুটি উতরে গেল। সেই শুরু।
একসময় সেই নামকরা ডিরেক্টর অমলেন্দু বিশ্বাস তো আমার জীবনসঙ্গীই হয়ে ওঠেন!
আমার সঙ্গে আরেকটি মেয়ে অভিনয়জগতে আসেন—নারায়ণচন্দ্র দত্তের মেয়ে দুলু দত্ত। তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সূর্য দত্ত ও তাঁর তিন মেয়ে মায়া দত্ত, ছায়া দত্ত ও জ্যোৎস্না দত্তেরও খুব নামডাক ছিল।
সিরাজদৌলায় নায়িকা চরিত্রে ছিলেন শান্তি দেবী। একবার তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিকেলে সিদ্ধান্ত হলো, আমাকে ওই চরিত্র করতে হবে। বিশ্বাসবাবুর নির্দেশনায় আমি একবেলা রিহার্সেল করে ওই পরীক্ষায়ও উতরে গেলাম।
অনেক দলে অভিনয় করেছি। বাসন্তী অপেরা ছাড়াও বাণীশ্রী, গীতশ্রী, নিউ বাবুল, বুলবুল অপেরায় কাজ করেছি। একসময় এসে গঠন করি চারণিক নাট্যগোষ্ঠী। এটি চারণিক অপেরা, চারণিক সম্প্রদায় নামেও পরিচিতি লাভ করে। বিভিন্ন সময় আমার বিপরীতে যাঁরা অভিনয় করেছেন, তাঁদের মধ্যে অমলেন্দু বিশ্বাস ছাড়াও অমূল্য দত্ত, পরিমল সাহা, চিত্তরঞ্জন পাল, শ্যামল মজুমদার প্রমুখ নায়কের কথা মনে পড়ছে।
অমলেন্দু বিশ্বাসের সঙ্গেই বেশি অভিনয় করেছি জুটি বেঁধে। ভাওয়াল সন্ন্যাসী পালায় তিনি ছন্দক আমি রত্নাবলী, সিরাজদৌলা পালায় তিনি সিরাজ আমি লুত্ফা কিংবা আলেয়া, মহামতি লেনিন পালায় তিনি লেনিন আমি সাশা পাবলোভা, হিটলার পালায় তিনি হিটলার আমি মারিয়া, মাইকেল মধুসূদন পালায় তিনি মাইকেল আমি দেবকী কিংবা হেনরিয়েটা, সম্রাট জাহান্দার শাহ পালায় তিনি জাহান্দার আমি লালকুমারী, একটি পয়সা পালায় তিনি দিবাকর আমি শর্বরী, পাঁচ পয়সার পৃথিবী পালায় তিনি অঞ্জন আমি আইভি, জানোয়ার পালায় তিনি অরণ্য সেন আমি ঈশিতা, লোহার জাল পালায় তিনি প্রদীপ আমি তাটিনী। কত যে সুখের দিন ছিল তখন!
একবার একটা মজার ঘটনা ঘটে। লোহার জাল পালায় আমি তটিনী চরিত্রে অভিনয় করছি। নায়ক প্রদীপের আমি সত্মা। অমলেন্দু হলো প্রদীপ। মানে আমরা মা ও ছেলে। আমি মঞ্চে উঠে বলছি, 'তুমি কেমন ছেলে রে বাবা! সত্মা হলেই যে রাক্ষুসী হয়, এমন কথা কে বলেছে শুনি?' এমন সময় প্রদীপ মঞ্চে এসে বলে, 'তুমি আমার মা?'
এই সময় এক ভদ্রলোক দর্শক সারি থেকে মঞ্চের ওপর উঠে একেবারে রেগেমেগে বলছেন, 'আরে মশাই, আপনারা কী শুরু করলেন? নিজের বউকে মা বলে ডাকছেন! আপনার লজ্জা-শরম কিছু নাই নাকি?' বিশ্বাসবাবু বোঝানোর চেষ্টা করছেন, 'এটা সত্যি নয়, অভিনয়। মঞ্চে এ রকম বলা যায়।' কিন্তু কে শোনে কার কথা? অনেক কষ্টে ওই ভদ্রলোককে নিবৃত্ত করে তবেই আমাদের পরের দৃশ্যে যেতে হলো।
আরেক দিন মমতাময়ী মা পালায় আমার অভিনয় দেখে আসরজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়। আমি গ্রিনরুমে এসে পোশাক বদল করে বসে আছি। একজন লোক এসে আমার চরিত্রের নাম ধরে খুঁজছেন। তিনি নাকি আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি এগিয়ে বলাম, 'এই যে আমি।' তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছেন না। পরের দৃশ্যে যখন মঞ্চে গেছি, তখন বুঝতে পারলেন যে এই আমি আর সেই আমি একই। তখন মঞ্চে এসে আমাকে ১০০ টাকার একটি নোট উপহার দেন তিনি। সেটি আমার কাছে অনেক বড় উপহার।
১৯৭৭ সালে উত্তরবঙ্গের পাটগ্রাম কলেজ মাঠে এক সপ্তাহ ধরে অভিনয় করছি। একেক দিন একেক চরিত্রে। কলেজ কমিটি ও গ্রামবাসী মিলে আমাকে সংবর্ধনা দিয়ে 'যাত্রাসম্রাজ্ঞী' উপাধি দেয়। এ রকম আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছি। একবার ঝিনাইদহ জেলার কোটচাঁদপুরে অভিনয় করছি। তখন আমাদের দলের জয়জয়কার সারা দেশে। কপোতাক্ষ নদের পাড়ে প্যান্ডেল। একদিন অভিনয়ের পর এলাকায় এত সুনাম ছড়ায় যে পরের দিন মানুষ ছুটে আসে। টিকিট শেষ হয়ে গেলেও মানুষের সারি শেষ হয় না। প্যান্ডেল প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম। সে কী অবস্থা! মানুষের এত আগ্রহ খুব কমই দেখেছি। শেষে প্যান্ডেল এক রকম খুলে দিতে হয়।
ভালোবাসার বিপরীতে মানুষের কাছ থেকে লাঞ্ছনাও কম পাইনি। সে কথা বলছি না আর।
একটা অন্য রকম ঘটনা বলি। আমাদের দেশে যেসব পালা মঞ্চস্থ হয়, তার প্রায় সবই পশ্চিমবঙ্গের পালাকারদের লেখা। এ দেশে মৌলিক পালা লেখার লোক তেমন নেই। বিশ্বাসবাবু ও আমি এ দেশের খ্যাতিমান নাট্যকারদের অনুরোধ করলাম পালা লিখে দেওয়ার জন্য। অনেকেই প্রতিশ্রুতি দিলেন। কিন্তু পাণ্ডুলিপি পেলাম দুজনের কাছ থেকে। নরেনদা, মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নরেন বিশ্বাস ম্যাক্সিম গোর্কির মা উপন্যাসের যাত্রারূপ করে দিলেন। আর মামুনুর রশীদ তাঁর নাটক এখানে নোঙর নাটকের যাত্রারূপ করে দিলেন। আমরা প্রথম বছর মামুনুর রশীদের এখানে নোঙর যাত্রাপালা মঞ্চায়নের আয়োজন করলাম। মামুন ভাই তখন বিশ্বাসবাবুর সঙ্গে দীর্ঘদিন আলাপ করে, যাত্রা দেখে তাঁর নাটকের রূপান্তর ঘটালেন। আমাদের সঙ্গে মানিকগঞ্জে জোবরা গ্রামেও গেছেন একাধিকবার। এসব অভিজ্ঞতা নিয়ে ওই পালা রচনা করলেন। আমরাও আনন্দিত, দেশের একজন খ্যাতিমান নাট্যকারের লেখা পালা আমাদের দলে প্রথম মঞ্চায়ন করেছি। আমাদের দলে লেনিন, হিটলার, মাইকেল, জানোয়ারসহ প্রভৃতি পালা মঞ্চায়ন করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। এবার মামুনুর রশীদের এখানে নোঙর করে নতুন ইতিহাস করব। অনেক উত্তেজনা আর প্রত্যাশা নিয়ে মঞ্চে উঠেছি। দুটো দৃশ্য হয়ে গেছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই। কেমন যেন মনে হচ্ছে। হঠাৎ কয়েকজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের মধ্যে একজন নিজেকে এলাকার চেয়ারম্যান পরিচয় দিয়ে মঞ্চে উঠে এসে বললেন, 'ভাই, আপনারা এই নাটক বন্ধ করুন। আমরা যাত্রা শুনতে আসছি। যাত্রা শোনান।' যতই তাঁদের বোঝানো হচ্ছে, এটি দেশের একজন বড় নাট্যকারের লেখা যাত্রাপালা, তাঁরা কিছুতেই শুনতে চাইছেন না। তাঁদের বক্তব্য, 'টিকিট কেটেছি যাত্রা দেখার জন্য, নাটক দেখতে চাই না।' কী আর করা, এখানে নোঙর পালার মঞ্চায়ন ওখানেই শেষ। ওই রাতেই শুরু হলো আরেক পালা অচল পয়সা। দর্শকেরা শান্ত হয়ে যাত্রা দেখল। নাটক থেকে যাত্রা যে আলাদা, তা সেদিন সাধারণ দর্শক বুঝিয়ে দিল।
বহুদিন তো হলো, যাত্রার সঙ্গে আমার ঘর-সংসার। আমার স্বামী এ দেশের শ্রেষ্ঠ যাত্রাব্যক্তিত্ব। দেশের মানুষ তাঁকে নটসম্রাট আখ্যা দিয়েছেন। রাষ্ট্র তাঁকে 'একুশে পদক' দিয়ে সম্মান জানিয়েছে। আমাকে লোকে 'যাত্রাসম্রাজ্ঞী' বলে ডাকে। আমার মেয়ে অরুণা বিশ্বাসকে সবাই চেনে। আমার ছেলে মিঠু বিশ্বাস নাটক পরিচালনা করছে। আমি লিখেছি যাত্রাওয়ালা নামের একটি ধারাবাহিক নাটক। মঞ্চের জন্যও লিখেছি যাত্রাপালা রক্তস্নাত একাত্তর। গঠন করেছি অমলেন্দু বিশ্বাস কল্যাণ ট্রাস্ট। যাত্রায় যাঁরা বিভিন্ন পর্যায়ে অবদান রেখেছেন তাঁদের আমরা সম্মান জানাতে চাই। চাই অমলেন্দু বিশ্বাসের জীবনী রচিত হোক। যাত্রার জন্য একটা জাদুঘর করতে চাই। যাত্রার দুস্থ শিল্পীদের সহায়তার জন্য ফান্ড গঠন করতে চাই। যাত্রার ঐতিহ্য নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি।
যাত্রাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য সরকার একটা উদ্যোগ নিয়েছে। একটা কমিটির মাধ্যমে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ওই কমিটিতে আমরা যারা আছি, আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। সেটির বাস্তবায়ন হলে যাত্রার দুর্দশা কিছুটা ঘুচতে পারে। আমরা যাত্রার জন্য প্রতি রাতের অনুমতি নেওয়ার প্রথা বাতিলের কথা বলেছি। অশ্লীল নৃত্যের জন্য যাত্রাশিল্পীদের দায়ী করা হয়। কিন্তু এটি যে আয়োজকদের চাপে করতে হয়, সে খোঁজ কেউ নেয় না। এ কারণে গোটা যাত্রাসমাজের প্রতি দোষারোপ করা হচ্ছে। এ বছর প্রায় ৪০টি দল মাঠে ছিল। আমিও চারণিক অপেরা নিয়ে সিরাজগঞ্জ গিয়েছিলাম। আমি আগেই জানিয়েছি যে আমার দলে কোনো নাচের মেয়ে নেই। আয়োজকেরা তাতেই রাজি হয়েছে। বলেছে, 'দিদি, আমরা আপনার অভিনয় দেখতে চাই।' প্রথম রাত ভালোই গেল। দ্বিতীয় রাতে আয়োজকদের সুর পাল্টে গেল। বলে, 'দিদি, দর্শকেরা চাইছে। দু-তিনটা নাচের মেয়ে যদি আনা যেত, তাহলে ভালো হতো।' আমি তাদের প্রস্তাবে রাজি হইনি। দল নিয়ে ফিরে এসেছি। কিন্তু যাত্রা যাঁদের জীবিকা, তাঁরা তো প্যান্ডেল ফেলে চলে আসতে পারে না। আপস করেই তাঁদের গান গাইতে হয়।
সেই ১৯৫৭ সাল থেকে প্রায় ৪৫ বছর ধরে যাত্রায় আছি সক্রিয়ভাবে। বছরে ছয় মাস যাত্রার ঋতু। প্রতি মাসে ২০ রাত হিসেবে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার রাত যাত্রামঞ্চে কাটিয়েছি। অথচ এই শিল্পের এখন দুর্দশা। এই দুর্দশা এখনো কাটাতে পারছি না। যত দিন বাঁচি, যাত্রা নিয়েই বাঁচতে চাই। আমি আজ যে জ্যোৎস্না বিশ্বাস, যাত্রামঞ্চই তাঁকে তৈরি করেছে। আমি যাত্রার জন্য আরও কিছু করে যেতে চাই।
অনুলিখন: তপন বাগচী

কীর্তন

সংসার তখন গানের আসর

ঝর্না সরকার

বন্দনা, কীর্তন শুরুর আগেবাবার কোলে বসেই কীর্তনের আসর অসম্ভব ভালো লেগে যায়। আজ থেকে ৫০ বছর আগে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে রামযাত্রায় অভিনয়ের মাধ্যমে হাতেখড়ি হয়। পরে কিশোর বয়সে হাতেখড়ি হয় হরিণাম সংকীর্তনের। বাবার গড়া 'মঞ্জুশ্রী সমপ্রদায়' নামের কীর্তনের দলটি এখন পরিচালনা করছি আমার বোন মঞ্জুশ্রী সরকারকে নিয়ে। বাবা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের বিজয়কৃষ্ণ ভাবুক। তিনি ছিলেন কবিয়াল বিজয় সরকারে শিষ্য। তিনি তাঁর বড় মেয়ে মঞ্জুশ্রীর নামে গড়ে তোলেন কীর্তনের দল। বাবার দলেই দুই বোন গান করেছি।
দুই বোনের বিয়ে হয় দুই জেলায়। বড় বোনের বিয়ে হয় বরিশালের বানারীপাড়ার আটঘর-কুড়িয়ানা গ্রামের। তাঁর স্বামী হরেন্দ্রনাথ সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। আমার বিয়ে হয় মাদারীপুর জেলার সদর থানার কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। আমার স্বামী প্রফুল্ল কুমার সরকার এই দলের এখন মূল পরিচালক।
ভগবানকে আরাধনা করা, প্রার্থনা করার একমাত্র মুখ্য পথই এই হরিণাম সংকীর্তন। আমরা একে ধর্মানুভূতিতেই মানি। তাই এর সঙ্গে মন-প্রাণ বেঁধে দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
পয়লা কার্তিক থেকে ৩০ জ্যৈষ্ঠ পর্যন্ত বছরের এই আট মাস কীর্তনের দলের বিভিন্ন স্থানে থাকে। বর্ষা মৌসুমে ঝড়-বৃষ্টির জন্য কীর্তনের আসর তেমন একটা সম্ভব হয় না। তাই এই সময়টা বিশ্রামের। যদি কোনো পাকা মন্দিরের বড় ছাউনির নিচে আয়োজন করা হয় তবে অল্প-বিস্তর আসরের আয়োজন করা হয়ে থাকে।
অনেক পুরস্কার পেয়েছি। অনেকে কীর্তন আয়োজকদের কাছ থেকে স্বর্ণের মেডেলও পেয়েছি। আর পেয়েছি অসংখ্য মানুষের ভালোবাসা। ১০টি ক্যাসেট বের হয়েছে কীর্তন ও কীর্তনভিত্তিক গানের।
একদিন ভোর ছয়টা থেকে পরের দিন ভোর ছয়টা পর্যন্ত বিরতিহীন চলে এই তারকব্রহ্ম হরিণাম সংকীর্তন। একদিনে চার প্রহর। কোনো অনুষ্ঠান হয় অষ্টপ্রহরব্যাপী, কোনো অনুষ্ঠান ২৪ প্রহরব্যাপীও। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই কীর্তনকে প্রার্থনা হিসেবেই নেয়। আজ দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিকভাবেও এর প্রসার বাড়ছে। মানুষের মধ্যে ভালোবাসা তৈরি হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সুদীর্ঘ ৪৫ বছর ধরেই বাংলাদেশে গান গেয়ে বেড়াচ্ছি।
একটি কীর্তনের দলে ১২ থেকে ১৩ জন লোক থাকে। দলে যারা থাকে, তাদের সবার রুটিরুজির একমাত্র উপায় এই কীর্তন। দলের সবাইকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেওয়ার পরে যা থাকে, তা-ই দুই বোনের একমাত্র অবলম্বন। খোল, বেহালা, দুটি জুড়ি, দোতারা বাজিয়ে কীর্তন করে। আর্থিক অবস্থা নির্ভর করে আয়োজকদের সাধ্যের ওপর। একেকটি আয়োজনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পায় একটি কীর্তন দল। দলের সবাই এই অর্থ পারিশ্রমিক অনুযায়ী ভাগ করে নেয়। 
কীর্তনের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা যত দিন আসরে অংশ নিতে পারেন তত দিনই তাঁদের আয়। যখন বয়স বাড়ে। পরিশ্রম করা সম্ভব হয় না তখন তাঁদের দুর্দশা কেউ দেখে না। তাই এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কোনো বিকল্প নেই। দেশে সাড়ে চার শর বেশি কীর্তনিয়া দল আছে। এর মধ্যে কিছু দল আছে দেশব্যাপী আলোচিত। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এই কৃষ্টি হারিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও সরকারিভাবেই এগিয়ে আসা উচিত। 
বর্তমানে মঞ্জুশ্রী সম্প্রদায় পরিচালনা করছেন আমার স্বামী প্রফুল্ল কুমার সরকার। দুই ছেলে, এক মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতেই বাস করি। ছেলে প্রদীপ কুমার সরকার মাদারীপুরের কেন্দুয়া ইউনিয়নের বাহাদুর উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সারা দেশে আমাদের দুই বোনের নামডাক শুনে আমাদের ছেলেমেয়েরাও গর্ববোধ করে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বায়না করার জন্য মানুষ ছুটে আসে আমাদের বাড়িতে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও এতে গর্ব করে। বছরের আট মাস বাড়ির বাইরে থাকলেও ছেলেমেয়েদের কোনো আক্ষেপ নেই।
এক নাগাড়ে চার-পাঁচ মাসও থাকতে হয় বাড়ির বাইরে। এর জন্য ছেলেমেয়েদের মনে কোনো দুঃখ নেই। এখন টেলিফোনের যুগ, প্রতিদিন খবর নেওয়া যায়। একসময় তা ছিল না। ছোট ছেলেমেয়েদের রেখেও গান গেয়ে বেড়িয়েছি। কেবল রোজগারের আশায় তা কিন্তু নয়। এর সঙ্গে মানুষের প্রতি ভালোবাসা আছে। সৃষ্টিকর্তার গুণকীর্তনে পুণ্য আছে। যখন ভাবি আমাদের গান শোনার জন্য হাজার হাজার মানুষ আসবে, তখন আর ঘরে বসে থাকতে পারি না। ভক্তদের টানে ছুটে যাই। গানের আসরই মনে হয় আমার সংসার। এ কথা ঠিক যে আমরা যে গান করি, তাতে হিন্দুধর্মের সাধন-ভজনের কথা থাকে। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা এই কীর্তনিয়া পেশাকে খুব সম্মানের চোখে দেখে থাকে। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের যেসব হিন্দু সম্প্রদায় বাস করে, তারা আমাদের দলের নাম এবং দুই বোনের নাম জানে। এটা আমাদের গর্ব। আমরা আমাদের মা-বাবার জন্য খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি নিজেদের। তাঁরাই আমাদের দুই বোনকে সংগীতের পথে উৎসর্গ করেছেন।
আমরা সারা বছরই বিভিন্ন এলাকায় যাই। হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ দেখি অনুষ্ঠানে। মহেষখালী দ্বীপে সাগরের মধ্যে যে মন্দির, যেখানে অনুষ্ঠান করেছি। কী যে অনুভূতি হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। কক্সবাজার এলাকার বিভিন্ন মন্দিরে অনুষ্ঠান করেছি।
সারা বাংলার একেক জায়গায় একেক রকম অবস্থা। রাজশাহী, নাটোরের জয় কালীবাড়ি, রাজারবাড়িতে অনুষ্ঠান করেছি। সেখানকার আয়োজন এক রকম। এ বছর মাদারীপুর, বাগেরহাট ও নড়াইলে গান করেছি।
আমাদের ধর্মানুষ্ঠানে আমরা শ্যামাপূজা করি। নলুয়া চট্টগ্রামে। যেখানে মা মাটির নিচ থেকে নিজে উঠেছে বলে স্থানীয় মানুষেরা বিশ্বাস করে। কষ্টিপাথরের মূর্তি মায়ের সামনে ধূমধাম করে পূজা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ আসছে। মেদিনী বাবুর বাড়ি, বিরাট অনুষ্ঠান হয়। লাখ লাখ মানুষ আসে দেশের বিভন্ন এলাকা থেকে।
বৈষ্ণবসভা, ব্রাহ্মণ, কাপড়চোপড় দান, কত কিছু, কত আয়োজন! আমরা খুব আনন্দের মাঝারে আছি। এই কীর্তন করতে করতে যদি জীবনের শেষও হয়ে যায় তাতেও আমাদের কোনো দুঃখ নেই। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যেতে কষ্ট হয়। কিন্তু যখন হরিণাম নিয়ে আমরা লাখ লাখ মানুষের মধ্যে যাই, তখন সেই কষ্ট আমরা ভুলে যাই। 
আমার বড় দিদি মঞ্জুশ্রীর নামে আমাদের দল। কোনো আসরে যখন লাখ লাখ মানুষ বলে আমরা মঞ্জুশ্রীর দুই বোনের গান শুনতে চাই। তাঁদের নামযপের সময় কখন, তখন কী যে আনন্দ লাগে! এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সব কষ্ট তখন ভুলে যাই।
আমার বাবা আমাদের অনেক কষ্ট করে গান শিখিয়েছেন, কীর্তন শিখিয়েছেন। পাকিস্তান আমলে মেয়েরা খুব বেশি স্বাধীনতা নিয়ে চলাফেরা করতে পারেনি। এমন বৈরী পরিবেশে বাবার উৎসাহেই আমাদের এই পথে আসা। দুই বোনের বিয়ের আগে এলাকায় ও আশপাশের জেলায় অনুষ্ঠান করেছি। আমাদের দুই বোনের বিয়ের পর পাঁচ-ছয় বছর অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। সন্তানাদি হওয়ার পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের উৎসাহে স্বাধীনতার পরে পূর্ণ উৎসাহ নিয়ে আমরা আরও সংগঠিতভাবে দল গঠন করি। সেই থেকে অনবরত পথচলা শুরু হয়েছে। এখন ঠাকুরের নামেই সারা দেশে ঘুরছি। আমাদের এই নামের মধ্যে কোনো কষ্ট নেই। 
'৭৪-এ স্থায়ীভাবে দল গঠন করে পথে নেমেছি। আমরা এখনো হরিনামের কীর্তনের পথেই আছি।
আমার দিদি মঞ্জুশ্রী কোটালীপাড়া বাবার বাড়িতেই স্থায়ী বাসস্থান গড়েছেন। তাঁর দুই ছেলে বাবুল সরকার ও অনিরুদ্ধ সরকার। মেয়ের নাম বিনীতা বিশ্বাস।
৬ এপ্রিল কীর্তনের দলটি ছিল বাগেরহাট জেলায়। পরের দিন ৭ এপ্রিল বাগেরহাট ছেড়ে আমরা চলে আসি নড়াইলে। এখানে তাদের জন্য বড় আয়োজন। আগামী চৈত্রসংক্রান্তির দিনে আমরা কীর্তনের দল নিয়ে দেশের বাড়িতে ফিরব। বাঙালি জীবনের উৎসবমুখর পয়লা বৈশাখে আমরা মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জে থাকব পরিবার-পরিজনের সঙ্গে।
অনুলিখন: জহিরুল ইসলাম খান

জারিগান

জারিগানে চার যুগ

আবদুর রহমান বয়াতি

দেখতে দেখতে বয়স আমার ৭০ পার হলো। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারির এক তারিখে আমার জন্ম। চার যুগ ধরে বাংলার মঞ্চ মাতাইছি। এখন কথা কইতে পারি না। সব কথাই শুনতে পাই, বুঝতে পাই, কইতে চাই কিন্তু পারি না। সবচেয়ে বড় কষ্ট, এখন গান গাইতে পারি না। 
আমার একটা গান আছে—দেহঘড়ি। গানটা আমাকে কিছু দিছে। এর জন্য অনেক প্রশংসাই পাইছি। এর বাইরে আরও অনেক গান গাইলাম। এ দেশের সবখানেই গান করছি। আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানসহ আফতাবের গান, লালনগীতি, কবিগান, জারিগান, বিচারগান, সারি, মারফতি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, এর বাইরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বৃক্ষরোপণ, নির্বাচনী, টিকাদান, দুর্যোগ-বন্যা—এসব বিষয়ে গান বানাইছি আর গাইছি।
সব মিলাইয়া শ তিন-চাইর শ হইব আমার লেখা গান। 'মরণের কথা কেন স্মরণ করো না', 'আমার এত সাধের রংমহল ঘর ইঁদুরে কেটে বিনাশ করতেছে', 'আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে', 'আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণের ধৈর্য মানে না', 'হাটের মাঝে ভাঙল হাঁড়ি, টাকুরটুকুর বাজে ঢোল', 'আয় রে পাগলের দলে আয়', 'ঘুড্ডি হয় তিন তালা', 'কাম কামেলা খেলছে খেলা বাতাস পাইয়া', 'বাবায় আমায় দিল বিয়ারে, বুড়া জামাই চাইয়া', 'আমায় এত দুঃখ দিলি বন্ধুরে', 'মনপাগলে কাঁটাবনে মধু খাইতে যাইয়ো না', 'আমাদের বাংলাদেশের গান'—এ রকম আরও অনেক গান সারা দেশের মানুষ শুনছে।
আমার গানের মূলভাব হইল 'মানুষ'। কইতে আইলাম, কই যামু, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব এক, জাত নাই, ধর্ম নাই, সবাই মানুষ একই।
আব্বার বেশির ভাগ গানই দেহতত্ত্বের গান। আমার দেহঘড়ি গানটিও মূলত দেহতত্ত্বের গান। দেহের ভেতর যে কলকব্জা রয়েছে, তারই বর্ণনা। জারিগানে আবদুল গণি, খবির দেওয়ান, মোসলেম উদ্দিন, সাইদুর রহমান; পালাগানে খালেক দেওয়ান, রজব আলী দেওয়ান, দলিলুদ্দিন বয়াতি, হালিম বয়াতি, রশিদ সরকার, সমশের আলি, আলেক দেওয়ান, ননী ঠাকুর, মারফত আলী, আলাউদ্দিন বয়াতি, মাখন দেওয়ান, আবুল সরকার, পরেশ আলী দেওয়ান—এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে গান গাইছি। বিচ্ছেদী গানও গাইছ। ওটা পালাগানেরই একটা অংশ। পালাগান গাইতে গাইতে, রাত দুইটার পর বিচ্ছেদী গান গাওয়া 
বিজয় বিচ্ছেদী গান খুব নাম করেছে। কবিয়াল বিজয় সরকারের গানকে 'বিজয় বিচ্ছেদ' বলে। আর আমার গানগুলো একটু হালকা, মানে পাবলিক শুনতে খুব মজা পাইত। যেমন 'পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী, প্রাণ সজনী, পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী', 'আমি ভুলি ভুলি, মনে করি সইগো, প্রাণের ধৈর্য মানে না, বন্ধুরে ভুলিতে পারি না'—এ রকম ষাইট-সত্তরটা বিচ্ছেদী গান বানাইছি। 
নবী-রসুল, আউলিয়া, সাহাবিদের নিয়ে অনেক জারিগান গাইছি। জারিগানের প্রায় ২০০ ক্যাসেট বাজারে আছে। আমাকে তো একসময় জারিসম্রাটও কওয়া হইত। অন্য গানের ক্যাসেটও পাঁচ-ছয় শ হইব।
অ্যান কোম্পানি, ডন, দোয়েল, এইচআরসি, সাউন্ডটেক, এটিএন মিউজিকসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ক্যাসেট আছে। ২৫-৩০ বছর আগের অল্প টাকার চুক্তিতে রেকর্ড হতো। আমি তখন একেক দিন একটা কইরা ক্যাসেট করতাম। ক্যাসেটে কবি আলাউদ্দিন বয়াতি, জালালুদ্দিন, খালেক দেওয়ান সাহেবের গান, রজব আলী দেওয়ান, মালেক দেওয়ান এ রকম প্রবীণ যাঁরা ছিলেন তাঁদের গানও গাইছি। তবে আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানই বেশি গাইছি। তাঁর প্রায় এক হাজার গান আছে। চার খণ্ড বইতে এগুলো ছাপা হইছে। ভালো কবি ছিলেন তিনি।
আমেরিকা, স্কটল্যান্ড, জাপান, রাশিয়া, ইরান, ভারত, জার্মান, ইংল্যান্ড, বাহরাইন, আবুধাবি, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, কাতার—সব মিলে ৩০/৩৫ দেশে গান লইয়া ঘুরছি। ।
সিনেমার জন্যই গান গাইছি। সিনেমায় অভিনয়ও করছি। মাসুদ পারভেজের গুনাহগার ছবিতে গাইছি 'আল্লা মানুষ বানাইয়া খেলছ যারে লইয়া/সেই মানুষ কেমনে গুনাহগার', আমজাদ হোসেনের কসাই ছবিতে জারি সুরে গান 'আরে প্রথমে বন্দনা করি আল্লা মালেক সাঁই/যাঁর উপাস্য ত্রিভুবনে অন্য কেহ নাই', হূদয় থেকে হূদয় ছবিতে বিজয় সরকারের 'এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে/সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে', খান আতার ছবি ফারাক্কায় 'মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি' গানটা গাইছি। হাফিজ উদ্দিনের অসতী ছবিতেও একটা গান আছে। 
এখন বয়স হয়েছে। অধিকাংশ লোকশিল্পীর শেষকাল দারিদ্র্যে কাটে। আমার ব্যাপারেও হয়তো তেমন কিছু ঘটেছে। আমাদের আদিনিবাস বিক্রমপুরে। আমাদের চারতলা বিল্ডিং ছিল। আমার বাবা তোতা মিয়া হোটেলের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৯ সালে সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এখন ভাড়াবাসায় থাকি। ভাবলেই চোখে জল আসে। আমি গান নিয়ে পইড়া ছিলাম। অন্য কোনো পথে যাই নাই। আমার ছেলেও এই পথেই আছে।
২০০৩ সালে অসুস্থ হইয়া পড়ি। ডাক্তার বলে ব্রেইনে রক্তের ছিটা জইমা আছে। এগুলো ধীরে ধীরে কাইটা যাইব, সাত বছর চইলা গেল, ভালো তো হয় না। বিদেশ যাইতে পারলে হয়তো ভালো হইতে পারতাম।
অসুস্থ হওয়ার পরে আর গান গাইতে পারি না। শিষ্যরা মাঝেমধ্যে আসে। আমার ছেলে আলমও গান করে। ও আমার লগে হারমোনিয়াম বাজাইছে। এখন কি-বোর্ড বাজায়। যা পায়, তা-ই দিয়ে চলি। এভাবে আর কত দিন, জানি না!
অনুলিখন: সাইম রানা

পালাগান

এক আসরে বাজিমাত

ইসলাম উদ্দিন

নারীবেশে পালা পরিবেশন করছেন ইসলাম উদ্দিনবাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের কিচ্ছাকার-পালাকারদের মধ্যে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগে'র প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করার সুযোগ পাই। শুধু তা-ই নয়, শহুরে শিক্ষিত ছাত্রদের মধ্যে তুলে দিয়েছিলাম নিজের করা সবচেয়ে জনপ্রিয় কিচ্ছা-পালা 'কমলারানীর সাগরদিঘি'। আমার সেই কিচ্ছাপালাটি নিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগ' বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে একটি নবযাত্রার সূচনা করে এবং বাংলাদেশের ময়মনসিংহ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এই গ্রামীণ নাট্যাঙ্গিকটির পরিবেশনা করে আসে ভারতের জাতীয় নাট্যশিক্ষা প্রতিষ্ঠান দিল্লির এনএসডিতে এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনি নগরে। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয়ভাবে আমার কিচ্ছাপালা পরিবেশনার জন্য নিজস্ব বাদ্যযন্ত্রী ও দোহারদের সঙ্গে করে সুদূর বিলেতের রাজধানী লন্ডনে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি।
দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে সংগৃহীত যে আখ্যানগুলোকে পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে 'গীতিকা' বা 'ব্যালাড' বলে উল্লেখ করেছিলেন পরবর্তীকালের গবেষকদের অনেকেই আবার সেই একই আখ্যানগুলোকে বলেছেন 'পালাগান'। স্থানীয়ভাবে তাকে 'কিচ্ছাগান' এবং 'পালাকার'কে সাধারণত 'কিচ্ছাকার' বা 'কিচ্ছাদার' বলা হয়। সাম্প্রতিককালের দিলু বয়াতী, শাহ জাহান বয়াতী, মিলন বয়াতী ও আলফাজ বয়াতীও কিচ্ছাগান পরিবেশন করে নাম কুড়োচ্ছে।
আমার জন্ম ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২ আগস্ট কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ থানার নোয়াবাদ গ্রামে। গ্রামীণ পরিবেশে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমে নিজ গ্রামের মক্তবে আরবি শিক্ষা শুরু করি। কায়দা-আমপারার পাঠ চুকিয়ে কোরআন পাঠে উত্তীর্ণ হই। এ সময় নিজেও জানতাম না যে একদিন আমি কিচ্ছাকার হয়ে উঠব। অবশ্য মক্তবের আরবি শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে একবার আমাকে ঝুমুরগান গাইতে হয়। সে এক ঘটনা বটে! আমাদের গ্রামে ঝুমুরযাত্রা হচ্ছে, বইটার নাম হলো 'কাশেম-মালা'। এই সময় আমি মক্তবে পড়ছি। তখন ছেলে দিয়ে মেয়ে বানাতে হতো। এই সময় মিউজিক স্টাফদের মধ্যে হারমোনিয়াম মাস্টারকে এক মাস কিংবা দুই মাসের জন্য কনটাক্টে আনতে হয়েছিল। ওই লোক কিন্তু বন্দনা গাইবে যে চারটা ছেলে তাকে বানিয়েছে। মেয়ে চরিত্রে যে অভিনয় করবে ওকে সে বানিয়েছে। সবকিছু হয়ে গেছে কিন্তু নায়কের চরিত্রে যে অভিনয় করবে কাশেম, ওই কাশেম পাচ্ছে না। একটা ছেলেকে আনা হয় কিন্তু তার কণ্ঠ মিলছে না। যে স্কেলে গান গাইব সে স্কেলে গলায় টান দিতে পারে না। প্রায় সাত-আটজন ছেলেকে দেখা হলো। কোনো ছেলেকে নায়ক বানানো যাচ্ছে না। গানে কণ্ঠ আসে না। আমি যদিও মক্তবে পড়ি কিন্তু মক্তব থেকে বাইরে এলে মাঝে মাঝে গানে টান মারি। তখন আমাদের এক দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই, নাম আবু সিদ্দিক, সে গানের মধ্যে অভিনয় করেছে, সে একদিন আমাকে বলে, 'এই তুই গান করবি? যদি গান করিস তয় সন্ধ্যেবেলা রিহার্সেলে আসিস।' আমি বললাম, 'না, আমি মক্তবে পড়ি আমার বাড়ির লোকজন যদি শোনে আমারে মাইর দেবে।' সে তখন বলে, 'আজ ভালো রিহার্সেল হইব, বাঁশি আসবে, ঢোল আসবে, সবাই আসবে তুই আসিস।' আমি এই কথা শুনে সেখানে যাই। দেখি সিরিয়াস রিহার্সেল হচ্ছে, আমি কয়েকজন লোকের পেছনে চুপ করে বসে থাকি। দেখি কাশেমের চরিত্রে কোনো ছেলের মাস্টারের সঙ্গে মিলছে না। এর মধ্যে ওই লোকটা, যে আমাকে প্রতিদিন বলে, মাস্টারের কানে গিয়ে বলেছে, সে আসছে। এর কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটা আমার পেছনে এসে আমাকে পাঁজাকোলা করে ধরেছে। ধরে নিয়ে হারমোনিয়াম মাস্টারের সামনে নিয়ে বসায়। তখন দেখি আমার সারা শরীর দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। আর হারমোনিয়াম মাস্টার তখন রূপবানের গান বলছে, গুনাইয়ের গান বলছে, সব গান বলছে, খালি বলে তুমি একটা টান দেও, একটা টান দেও, দেখি তোমার সুরটা কেমন। এত করে বলছে কিন্তু আমার গান আসছে না। আমি দেখছি আমার কাপড়-চোপড় ভিজে যাচ্ছে। অনেক বলার পরে আমি গানে টান দিলাম। আমি হারমোনিয়ামের স্কেলের মধ্যে নিয়ে টান দিয়েছি। তখন বলছে, 'তুমার হইছে। তুমি যাও।'
আমার একটা বড় ভাই ছিল ফাইজুর রহমান, আমার সে ভাইটা মারা গেছে। সে যাত্রাপালায় অভিনয় করত। উনার উকিল শ্বশুর কিন্তু আবার 'কাশেম-মালা' বইয়ের ম্যানেজার। এই উকিল শ্বশুর এসে আমার বড় ভাইকে ধরেছে যে, 'যদি তুমার ভাইরে না দেও তো এই বই নামানো যাইতেছে না।' তখন ভাই বলে, 'সে তো মক্তবে পড়ে ওরে তো দেওয়া যাইতাছে না'। উনি বললেন, 'মক্তবে পড়ুক অসুবিধা নেই... আমরা যে বইতে হাত দিছি ওর জন্য শুধু পারতিছি না... ও এই বইটা শুধু করে চলে আসবে।' উনি উকিল শ্বশুর, আমার ভাই খুব অরাজি হতে পারছে না। তখন ভাই বলে, 'ওরে দিয়ে বই করাইতে পারবেন?' লোকটা বলে, 'পারব।'
তারপর সেই বই করলাম। এরপর আস্তে আস্তে গ্রামের আরও অনেক নাটকের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। এভাবেই মক্তব থেকে কোরআন পর্যন্ত পাঠ চুকিয়ে আমি গ্রামীণ নাট্যপালার অভিনয়ের প্রতি ঝুঁকে পড়ি। প্রথম পর্যায়ে 'কাশেম-মালা' ও 'দস্যু বাহরাম' নামের দুটি ঝুমুরযাত্রা পালায় অভিনয় করি। তখন আমার বয়স ১২-১৩ বছরের মতো। এ সময় গ্রামের মানুষজন নিয়ে নাটক করি। নাটকের নাম জীবন্ত কবর। একদিন আমাদের এলাকায় কিচ্ছাগান করতে আসেন কুদ্দুস বয়াতী। তাঁর কিচ্ছার আসর দেখে আমি তাঁকে ওস্তাদ মেনে নিই এবং তাঁর বাড়ি যাই।
আমি যাওয়ার পরে উনি বলছিলেন যে 'তুমারে আমি এক বৎসরের মধ্যে স্টেজে তুলব। এক বৎসরের মধ্যে তুমি কিচ্ছা করতে পারবা।' পরে তাঁর সঙ্গে থাকি, ঘুরিফিরি। এই সময় একটানা ছয় মাস আমি আমার বাড়িতে ছিলাম না। ছয় মাস আমার গুরু কুদ্দুস বয়াতীর সঙ্গে থাকার পরও আমি কিছু ধরতে পারছি না, কিচ্ছার কিছু বলতে পারছি না। কারণ, তিনি আমাকে নিয়ে বসেন না, রিহার্সেল করেন না, আলাদাভাবে বসেন না, কিচ্ছার কাহিনিগুলো বোঝান না। তখন কুদ্দুস বয়াতীর ডাইনা বিষ্ণুপদের কাছে বললাম, আমি তো এখনো কিছুই পারি না, কিন্তু আর ছয় মাস গেলে আমার সময় শেষ, এখন পর্যন্ত আমি স্টেজে বন্দনা গাইতে পারি না।
উনি আমাকে বললেন, 'তুমি আমাদের দলের তবলচি মাস্টার হাশেমের কাছে যাও, সে আমার থেকে বেশি অভিজ্ঞ।' এই হাশেম আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করত। এখন পর্যন্ত এই হাশেম আমার খবর নেয়। পরে আমি হাশেমের কাছে গেলাম। সে আমাকে বসে বসে কিচ্ছার গল্পগুলো বোঝায়। কিন্তু আমার ওস্তাদ জানে না যে আমি হাশেমের কাছ থেকে গল্পগুলো শিখে নিচ্ছি। ওই সময়ে একদিন বাড়িতে এসে আমি একটা ডায়েরি নিয়ে যাই। পরে যে কোনো জায়গায় যে কিচ্ছার প্রোগ্রাম করে আমি ওই প্রোগ্রামটা আমি আমার ডায়েরিতে তুলে রাখি। তবে আমার ওস্তাদ জানে না যে আমি ডায়েরি করি। পরে আমি তিন মাসের মধ্যে আমার ওস্তাদের সবগুলো কাহিনি ডায়েরিতে লিখে শেষ করে ফেলি। এই করে নয় মাস হয়ে গেছে আমার। এরপর চৈত্র মাসের দিন আসে। আমার ওস্তাদ বলে, 'অনুষ্ঠান নাই, ল একটা কাজ করি।' 'কী কাজ?' 'ব্যবসা করি।' আমি বলি, 'কীসের ব্যবসা?' 'সাইকেল লইয়া আটার ব্যবসা।' তখন আমি বললাম যে 'ওস্তাদ আমি ব্যবসা করতাম না। আমি আমার কাজ করবাম চাই।' 'কী কাজ?' 'যে আমাকে আপনার যে বাদ্যযন্ত্রগুলো আছে ওগুলো আমারে দিয়ে দেন আমি ভাটি এলাকায় পালাগান করতে যাইতে চাই।' 
আমার কথা শুনে সে বলছে, 'তুমি কি পারবা এই কিচ্ছাগান করতে?' আমি বলি, 'চেষ্টা করি। চেষ্টা করে দেখি।' 'তে তুমি কোন পর্যন্ত গেছো তা আমি জানি না...তুমারে আমি শিখাইছি না।' 'আমি যেটুকু জানি সেটুকু নিয়েই চেষ্টা করে দেখি কিছু করতে পারি কি না।' পরে উনার যে গানের কারিগর ছিল হারমোনিয়াম মাস্টার নিজামউদ্দিন, তবলচি মাস্টার নিমাই এবং ডাইনা এই তিনজন লোক নিয়ে প্রথম গেলাম কদমশ্রী গ্রামে। কদমশ্রী গেলাম এই কারণে যে আমি নতুন, আমি কিচ্ছা এখনো গাই না, প্রথমে তাই আত্মীয়-পরিচিতের গ্রামে গেলাম। আসলে কদমশ্রী গ্রামে ছিল আমাদের হারমোনিয়াম মাস্টার নিজাম উদ্দিনের ভগ্নীপতির বাড়ি। সে গ্রামে যাওয়ার পর লোকজন এসে বলে, 'নিজাম উদ্দিন, তুমি কারে নিয়া আইছো?' বলে, 'কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র।' বলে, 'কুদ্দুস বয়াতীর কিচ্ছাই ভালো লাগে না, তুমি কুদ্দুস বয়াতীর ছাত্র নিয়া আইলা।' কেউ আগ্রহ দেখাচ্ছে না কিচ্ছাগান শোনার জন্য। আমার মন খারাপ হয়ে যায়। আমি রাত্রিবেলা নিজামকে বললাম, 'চান্নি রাত, কেউ যখন কিচ্ছাগান শুনতে চাইছে না তখন নিজেরা মিলে কয়েকটা গান করো। রাতটা পার করি।' তখন কুপি বাতি ধরিয়েছে। নিজাম উদ্দিন গান শুরু করেছে। গান গাইলে বেশ কয়েকজন মানুষ আসছে। পরে একজন মুরব্বি লোক এসেছেন, তিনি বলছেন, 'নিজাম উদ্দিন, গান তো শুনছি, তুমরা যখন কিচ্ছা নিয়া আইছো, তুমাদের কিচ্ছা একটু শুনি।' পরে আমি যখন প্রথম কিচ্ছার বন্দনায় টান দিয়ে একটা লাফ দিলাম তখন ওই লোকটা বলে, 'দাঁড়াও।' লাফ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকটা বলছে, 'দাঁড়াও।' তখন আমি চিন্তা করলাম, কুদ্দুস বয়াতীর গানই শোনে না। আর আমি প্রথম টান দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বলছে, 'দাঁড়াও', তাহলে মনে হয় আমার কিচ্ছাও শুনবে না। লোকটা বলে, 'এই তুমি বসো।' তখন আমি বসলাম। তখন ওই লোক কয়েকজনকে বলছে, 'এই তোরা কি কিচ্ছা শুনবি?' সবাই এক সঙ্গে বলে, 'হ, হ, শুনব।' লোকটা বলল, 'তাহলে আমার বাড়িতে যাইয়া হ্যাজাক নিয়া দোকান থেকে ত্যাল ভরে নিয়ে আয়। কিচ্ছার ভাব ভালো আছে কিচ্ছা হবে।' লোক পাঠিয়ে দিয়ে তেলটেল ভরে এনে হ্যাজাক বাতির আলোয় আসর শুরু হয়ে গেল। আমার এই প্রথম কিচ্ছাগানের পালাটা ছিল গুলে হরমুজ।
কেন্দুয়া থানার কদমশ্রী গ্রামে প্রথম কিচ্ছাগান পরিবেশন করার পর আমি যাই খালিয়াজুড়ি থানায়। এই থানার গোছিগাই, অ্যাড়াবাজ, নিজগাঁও, আড্ডা প্রভৃতি গ্রামে একটানা ২৪ দিন কিচ্ছা পরিবেশন করি। ২৪ দিনে খরচ বাদে আমি প্রথম জীবনের কিচ্ছাগানের সম্মানী হিসেবে ২৮৩০ টাকা অর্জন করি। তাদের নিজেদের মধ্যে চুক্তি ছিল যে যা কামাই হবে তার অর্ধেক পাবে ইসলাম উদ্দিন আর বাকি অর্ধেক পাবে গানের দলের বাকি তিনজন। আমার প্রথম আয় আমি ওস্তাদের হাতে দিয়ে আসি।
আমি চিন্তা করলাম, আমি তো নিজের যোগ্যতায় আজ কামাই করতে শিখেছি। তারপর নিজে দল করলাম নিজের গ্রামে এসে। নিজ গ্রামে এসে প্রথম যে কিচ্ছাগানটি করি তার নাম উতলা সুন্দরী ও কাকাধরের খেলা। এরপর নিয়মিতভাবে নিজের দল নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে আমির সাধু, সুন্দরমতি, উর্বলা সুন্দরী, রাম-বিরাম, গেন্দেকুল, জাহাঙ্গীর বাদশা, মতিলাল, ফিরোজ খাঁ, রূপকুমার ইত্যাদি নামের কিচ্ছাগান পরিবেশন করি। একটা কথা বলি, আমি আমার জীবনকাহিনী নিয়ে একটা পালাগান রচনা করেছি। ২০০৭ সালে সেটি ঢাকায় পরিবেশন করি 'কিচ্ছাদার' নামে।
এসব পালাগান করতে তো একটা ভাব লাগে। গ্রামে সেই ভাবটা পাওয়া যায়। গ্রামের জনগণ সব ভাষা বুঝতে পারে। আবার শহরে গেলে, শহুরে ভাষা বলতে আমাদের খুব ভেজাল হয়। ঢাকা গেলে একটু সমস্যা লাগে আমার বোঝাতে গিয়ে। ঢাকার লোকেরা বোঝেন, তবে একটু পরিশ্রম নিয়ে করতে হয়। যেমন গ্রামের অনুষ্ঠান আমি ছয় ঘণ্টা করলেও এতটুকু পরিশ্রম হয় না। কিন্তু ঢাকা শহরে দুই ঘণ্টা করলেই পরিশ্রম হয়। একটা হিসাবের ভেতরে কথা বলতে হয়।
তবে, ঢাকাতে পালাগান করার জন্য স্থায়ীভাবে থাকতে চাই না। কেননা, যে আমি গ্রামে পালাগান করে ঢাকার মানুষের কাছে মর্যাদা পেয়েছি সে আমি ঢাকাতে স্থায়ীভাবে চলে গেলে মর্যাদাহীন হয়ে যাব। মানুষ আমার কাছে আসে, সুন্দরভাবে পালাগানটা করি বলে। হয়তো ঢাকাতে সুন্দরভাবে পালাগানটা ধরে রাখতে পারব না। আমি গ্রামে থেকেই পালাগান করতে চাই।
গ্রামের পালাকার হিসেবে আমার এই প্রত্যয় আমাদের চলতি হাওয়ার সঙ্গে বদলে যাওয়ার রীতির প্রতিবাদ হয়ে ধরা দেয়। আমরা ভাবতে থাকি কীর্তিমান হওয়ার পথে যেন নিজের স্থানটি না হারিয়ে ফেলি এবং ভুলে না যাই নিজের বলয় এবং বেড়ে ওঠার উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ। 
অনুলিখন: সাইমন জাকারিয়া

কবিগান

দর্শক-শ্রোতার 'সরকার'

মদন সরকার

'মোক্তারিতে হয়ে ফেল,
মোছে দিলেন কেরাসিন তেল।'

জেঠামশাই মোক্তারি ছেড়ে দিয়ে দেশবিদেশে কবিগান করে বেড়াতেন। জেঠামশাইয়ের নাম বিজয়নারায়ণ আচার্য। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গের অন্যতম কবিয়াল। নেত্রকোনা কোর্টে তিনি মোক্তারি করতেন। এই পেশায় অবশ্য তেমন যশ করতে পারেননি। কবিগান নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।
শশীমোহন আচার্য আমার বাবা। আমার জন্ম ১৩২৪ সালের আশ্বিন মাসে সহিলপুর গ্রামে। সহিলপুর গ্রামটি নেত্রকোনা জেলার সদর থানার সিংহের বাংলা ইউনিয়নে। আমার পুরো নাম মদনমোহন আচার্য। কেউ ডাকে মদন আচার্য, কেউ বলে মদন ঠাকুর, আর কেউ বা কয় মদন সরকার। মদন সরকারই বেশি ডাকে। আমার আর একটি নাম আছে। পাবার দেওয়া। ইন্দুভূষণ আচার্য। এ নামে আমাকে কেউ চেনে না, এ নামে কেউ ডাকেও না। নাম বদলের একটি কাহিনি আছে।
আমার জন্মসালে নেত্রকোনায় কবিগান গাইতে এলেন বরিশালের মদন শীল। তিনিও পূর্ববঙ্গের খ্যাতিমান কবিয়াল ছিলেন। আসরে কবির লড়াই বেঁধে গেল আমার জেঠা বিজয় আচার্যের সঙ্গে। সে লড়াইয়ে মদন শীলকে হারিয়ে বিজয় আচার্য সোনার মেডেল পেলেন। আনন্দে তিনি আত্মহারা। বাড়ি ফিরে দেখলেন আমার জন্ম হয়েছে। আনন্দে তিনি মদন শীলের নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখলেন মদনমোহন আচার্য। বাবার দেওয়া নাম ইন্দুভূষণ স্কুলের কাগজপত্রেই রয়ে গেল। জেঠামশাইয়ের দেওয়া নামেই সবাই ডাকে। সহজে ডাকার জন্য অনেকে আমার নামের মোহনটা ছেড়ে দিয়ে শুধু মদন আচার্য বলে। আমি ব্রাহ্মণ বলে অনেকে মদন ঠাকুর বলে ডাকে। কবিগান গাইতে যেয়ে আমি কায়স্থের পদবি সরকার পেলাম। হলাম মদন সরকার। সরকার কায়স্থের পদবি হলেও কবিগানের 'সরকার' আলাদা পদবি। যারা কবিগান গাইত তাদেরই দর্শক-শ্রোতারা সম্মান করে 'সরকার' বলে সম্বোধন করত। ব্রাহ্মণ হয়েও 'সরকার' পদবিতে আমার মন্দ লাগে না। ভালোই লাগে। 'সরকার' তো দর্শক-শ্রোতাদের সম্মানের ডাক। 
এখন বয়স আমার ৯২ বছর। শরীর আর চলে না। কথা বলতেও কষ্ট হয়। বাড়িতে বসে কেবল মনে মনে সুর ভাঁজি। পুরোনো দিনের কথা মনে করি। আনন্দময় দিনের কথা ভাবি। কবিগানের সেই স্বর্ণযুগের কথা ভাবি। তখন আমার যৌবন ছিল। এখন আমি জীবনের শেষের দিকে। এখন—'শুভ্র বরণ করলাম ধারণ,/দাড়ি গোঁফে চুলে,/কেবল পান সুপারি মুলামুড়ি,/দন্তের অন্তকালে।/এখন আর যাই না লঙ্কা,/কাকলী হয়েছে বঙ্কা,/সমন রাজা বাজায় ডঙ্কা,/এ বুড়াকে ধরবে বলে।/সুখ গেল সরিয়া,/অন্ধকারে চলাফেরা,/পরের হাতে ধরিয়া।/শ্বাস ঘনঘন, কাশ ঘনঘন,/তব পদে নিবেদন করি পুনঃ পুনঃ,/যে তা-তা-তা বলে যেতে পারি মরিয়া।'
পড়ালেখা বেশি করিনি। আটপাড়া থানার অভয়পাশা স্কুলে পড়েছি। তখন বড় বোনের বাড়ি রামেশ্বরপুর গ্রামে থাকতাম। অভয়পাশা স্কুলে পঞ্চম শ্রেণী পড়া শেষ করে নেত্রকোনা চন্দ্রনাথ স্কুলে ভর্তি হলাম। সেখানে দুই-তিন ক্লাস পড়েছি। লেখাপড়ায় মন বসে না। শুধু জেঠামশাইয়ের কবিগান আমাকে টানে। সেই টান এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্য নেই। আমি ভেতরে ভেতরে তাও টের পাই তখন।
কবিয়াল হিসেবে জেঠামশাইয়ের নাম তখন দেশবিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আমিও কবিগানের নেশার প্রবল ঘোরে জেঠামশাইয়ের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াই। কবিগান শুনি রামু, রামগতি, রামদয়ালের মতো বড় বড় কবিয়ালের। মাঝে মাঝে আসরে উঠতাম জেঠামশাইয়ের আশীর্বাদে। তাঁর সুবাদে সম্মানও ভালো পেতাম। দিনে দিনে কবিগানে পাকা হতে লাগলাম। রামায়ণ, মহাভারত, চণ্ডী পড়ে তত্ত্বকথার সন্ধান করতাম। আমার সমসাময়িক সঙ্গী পেলাম সাধু সরকার, কালী ধর, ক্ষেত্রমোহনসহ আরও অনেককে। তাঁদের অনেকের নাম আজ আর মনে করতে পারি না। আমি ওস্তাদ কবিয়াল রামসুন্দরের কাছে দীর্ঘদিন পাঠ নিয়েছি। ১৮ বছর বয়সে আমরা ঘুরতে শুরু করেছি সিলেট, বরিশাল, ময়মনসিংহ, গৌরীপুর, মুক্তাগাছা। অনেক জমিদারবাড়িতে কবিগান করেছি। সে সময় কবিগান শুনতেন জমিদার-নায়েবসহ সমাজের বড় বড় মানুষ। হিন্দু-মুসলিম সবাই মিলে কবিগান শুনত। আমার দলের খুব নামডাক ছিল। আমরা কয়েকজন কবি সরকার কথা দিয়ে কথা কেটে আসর জমাতাম। 
'হিন্দু আনি, মুসলমানি,
করতাম আমরা টানাটানি।'
কখনো হিন্দু-মুসলিম বিভাজন করে আমরা চিন্তা করিনি। সম্প্রীতি বজায় রাখতাম। ধর্ম যা-ই হোক, সবাই মানুষ। এই বোধ সবার মধ্যে ছিল। আমরা ভাবতাম: 'পাখির দুটি পাখাই সমান,/তদ্রূপ হিন্দু-মুসলমান।/এক পাখা কাটলে পরে,/পাখি কি আর উড়তে পারে।/পাখাহীন পাখির থাকে না পরান।' 
শ্রোতারা বসে কবিগান শুনত। টপ্পা চলত যুক্তি দিয়ে, শব্দের ছন্দ দিয়ে। যুক্তি শুনে দর্শকশ্রোতা হাততালি দিত। নিজেকে তখন জমিদার মনে হতো। সে সময় কবিয়ালের সম্মান ছিল, কদর ছিল। এখন নেই। সময় বদলে গেছে। দেখতে দেখতে পাল্টে গেল অনেক কিছু। কিন্তু আমাদের নিজস্ব সম্পদ কবিগানের দুর্দশা কাটল না।
'ব্রিটিশ রাজ্যের অবসান,/জিন্না আনল পাকিস্তান,/রাখল দেশের গৌরবমান/মূর্তি-মন্ত হইয়া,/ও তার ভাবলীলা অবসান,/রাজ্য ছাড়ল আইয়ুব খান,/দিনে দিনে টিক্কা, ইয়াহিয়া।/বহু সংগ্রাম করে শেষ,/শেখ আনল বাংলাদেশ,/শান্তি সুখে ছিলাম বেশ।/দেশবাসী যত,/আতাতায়ী যত ঢুকে পড়ে,/যেনতেন প্রাণে মারে।/আরো সকল সহকারে/ দুঃখ দিয়া কত।'
কবিগান তো আর সারা বছর চলত না। তাই সংসার টানতে অন্য কাজও করেছি। কবিগানের পাশাপাশি পিতল, কাঁসার বাসনপত্রে খোদাই করে নাম লিখতাম। হরফপ্রতি আট আনা পেতাম। সে পয়সা সংসারের কাজে আসত। এ কাজটি আমি শিল্প হিসেবে মনে করতাম।
দেখতে দেখতে অনেক কাল গড়িয়ে গেছে। গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল গড়িয়েছে। দর্শক-শ্রোতাদের রুচির বদল হয়েছে। ভাবের বদল হয়েছে। টাকার দরকার আমারও ছিল। তখন তা বুঝিনি। এখন সন্ধ্যাকালে বুঝি। এখন বুঝলেই কি, আর না বুঝলেই কি? সময়ের কাজ সময়ে করিনি। তবে তার জন্য কোনো খেদ নেই। টাকার দিকে তাকাইনি। আমি গান চাইছি। তাই দিয়েই আমি মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি। 
'হঠাৎ করে আইল ধন,/টাকার ভিতরে এত গুণ,/নির্দোষী হয় করিয়া খুন,/টাকার ভিতর দিয়া।/লোকে একটা কথা বলে,/পুত্রশোক টাকা ভুলে।/যত ইতি কর্ম চলে,/হাতের টাকা দিয়া।/টাকা জানি পরমার্থ,/টাকাহীনের জনম ব্যর্থ।/জনসমাজে অপদার্থ,/স্বার্থ কি আর বেচে।/ধার-কর্জ কেউ চাইলে দেয় না,/খাইছে কিনা খবর নেয় না।/গরিবের দায় এ যাতনা,/জীবন ভরা আছে।'
শিল্পী হিসেবে দেশের মানুষের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। কবি হিসেবে সম্মান পেয়েছি। সরকারের খাতায়ও আমার নাম আছে। সরকার আমায় বছরে ছয় হাজার টাকা ভাতা দেয়। হোক কম, তবু সরকারের সম্মানী! এটি আমার জন্য গৌরবের। নিজের আর কোনো আয় নেই। ছেলের আয়েই জীবন বাঁচাই। গ্রামের বাজারে ডাক্তারি করে আমার ছেলে রবীন্দ্র আচার্য। যা পায় তা দিয়ে তার ছেলেমেয়েসহ আমাকে নিয়ে কোনোক্রমে দিন চালায়। আমার স্ত্রী লাবণ্য বালা গত হয়েছে কয়েক বছর আগে। দুই মেয়ে শোভা ও বিভার বিয়ে দিয়েছি অনেক আগেই। সন-তারিখ মনে নেই। বিভা রামমঙ্গল গায়। কীর্তনের দল আছে তাঁর। এ দিয়ে সে সংসার চালায়। আমরা কেউ ভালো নেই। একবার আহার আরেকবার অনাহারে দিন চলে। শুধু অতীত মনে হয়। কী ছিলাম, এখন কী হলাম!
'এখন দল নাই,/ডুলি নাই।/বিপক্ষের সরকার নাই,/আমারে আর দরকার নাই।'
এখন পারের আশায় বসে আছি। কখন তাঁর ডাক পাই—তখন তাঁর কাছে চলে যাব। আমার গাওয়া গান শুনে যে মানুষেরা খুশি হতো, তাদের কাছে থেকে যাবে আমার কবিতা, আমার গান, গানের সুর। এ ভেবেই মনে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। জীবনটাকে সার্থক ভাবি।
অনুলিখন: আলী আহাম্মদ খান

গম্ভীরা

অসংগতির বিরুদ্ধে গান

মাহবুবুল আলম

গম্ভীরার আসরে নানা-নাতিপ্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে আমি প্রথম গম্ভীরা গান পরিবেশন করি। হঠাৎ করেই আমাকে সুধীজনের সামনে গম্ভীরা পরিবেশন করতে হয়। ১৯৬২ সালের কথা, দিন-তারিখ ঠিক মনে পড়ছে না। আমি তখন হরিপুর জুনিয়র মাদ্রাসার (বর্তমানে হরিপুর ১ নম্বর উচ্চবিদ্যালয়) চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। মাদ্রাসায় খবর এল স্কুল পরিদর্শনে ইন্সপেক্টর সাহেব আসবেন। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। তখন প্রধান শিক্ষক ছিলেন মোফাক্কার হোসেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, ছোট আকারে হলেও একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। আর অনুষ্ঠানে অবশ্যই ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গান থাকবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল গম্ভীরা করবে কে, এই নিয়ে। প্রধান শিক্ষক সম্পর্কে আমার দাদা (আমার পিতামহের ছোট ভাই)। তিনি আমার সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের কথা জানতেন। তাই তিনি সহকর্মীদের বললেন, 'আমাদের মাহবুব তো একটু-আধটু গান করে আর মুখুটি (মুখরা) ভালো, পারলে ও-ই পারবে গম্ভীরা করতে।' যেই কথা সেই কাজ। গম্ভীরা লেখা হলো, শুরু হলো অনুশীলন। নির্দিষ্ট দিনে ইন্সপেক্টর সাহেবের সামনে গম্ভীরা পরিবেশন করা হলো। আমি ছিলাম নানার চরিত্রে। এই প্রথম মঞ্চে গম্ভীরা গেয়ে আমি যথেষ্ট প্রশংসা পেলাম। শিক্ষক, সুধীজন মন্তব্য করলেন, গম্ভীরা গান করলে মাহবুব একদিন নামকরা শিল্পী হবে। ইন্সপেক্টর সাহেব গম্ভীরার নানা চরিত্রে মুগ্ধ হয়ে আমাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দিলেন। সেদিন থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু করলাম গম্ভীরা গান করা।
সে সময় এখনকার মতো প্রতিষ্ঠিত তেমন কোনো গম্ভীরা দল ছিল না। তাই স্থানীয় স্কুল, ক্লাব বা যেকোনো উপলক্ষে অনুষ্ঠান হলেই আমাকে নানার চরিত্রে অভিনয় করতে হতো। বয়সে ছোট হলেও গম্ভীরা গান গাওয়ার কারণে সবাই আমাকে একটু বেশি স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, যা আমাকে পুলকিত করত। পরে ঐতিহ্যবাহী হরিমোহন ইনস্টিটিউশনে (বর্তমানে হরিমোহন সরকারি উচ্চবিদ্যালয়) ভর্তি হওয়ার পর আমি স্কাউটিংয়ে যোগ দিই। স্কাউটিংয়ের সুবাদে জাম্বুরিসহ বিভিন্ন সমাবেশে গম্ভীরা গান পরিবেশনের সুযোগ পাই। এভাবে লেখাপড়ার পাশাপাশি সীমিতভাবে আমি গম্ভীরাচর্চা অব্যাহত রাখি। 
আম-কাঁসা-পিতল-লাক্ষা ও রেশনের জন্য বিখ্যাত অনন্য লোকসংগীত গম্ভীরা ও আলকাপ গানের তীর্থভূমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার দুর্গাপুর গ্রামে আমার জন্ম। মহান ভাষা আন্দোলনের বছর ১৯৫২ সালের ৮ জুলাই আমার জন্ম, এ জন্য আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি। বাবার নাম সাদাতুল ইসলাম, মা বিলকিস বানু। আমি পেশায় ও নেশায় একজন গম্ভীরা শিল্পী। 
১৯৮৪ সালের ১ মার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত হয়। নবগঠিত জেলার দ্বিতীয় জেলা প্রশাসক মো. নূরুজ্জামান মিয়া একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন—'গম্ভীরার জন্য বিখ্যাত এই জেলায় রকীবুদ্দীন-কুতুবুল আলমের দল ছাড়া আর কি কোনো গম্ভীরা দল নেই?' তখন জেলার বিশিষ্ট সাংবাদিক ডি এম তালেবুন নবী তাঁকে বলেন যে মাহবুব নামে একজন শিল্পী রয়েছেন, যিনি দীর্ঘদিন ধরে গম্ভীরা অনুশীলন করে আসছেন। তাঁর কথার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে গম্ভীরা পরিবেশনের সিদ্ধান্ত নেন। তালেবুন নবী বিষয়টি আমাকে অবহিত করলে আমি দল গঠনে প্রয়াসী হই। আলকাপ গানের এ সময়ের তুখোড় ছোকরা (আলকাপ গানে ছেলেরা মেয়ে সেজে অংশ নেয়) বরেন্দ্রনাথ ঘোষকে নাতি ও উৎসাহী কয়েকজনকে দোহারি ও যন্ত্রী হিসেবে নিয়ে অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে দল গঠন করি। তখন থেকেই শুরু হয় সংগঠিত দল নিয়ে আমার গম্ভীরা গান।
১৯৮৬ সালে আমি দল নিয়ে বাংলাদেশ বেতারে কণ্ঠস্বর পরীক্ষায় অংশ নিই এবং শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হই। বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত দল হিসেবে অদ্যাবধি আমার দল গম্ভীরা পরিবেশন করে আসছে। ১৯৮৮ সালে আমি প্রথম বাংলাদেশ টেলিভিশনে গম্ভীরা পরিবেশনের সুযোগ পাই। টেলিভিশনে প্রথম অনুষ্ঠান আমার জন্য একটি দুর্লভ স্মৃতি হয়ে আছে।
বাংলাদেশের একটি গম্ভীরা দল তখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি লাভ করেছিল, দলটি হচ্ছে রকীবুদ্দীন-কুতুবুল আলমের গম্ভীরা দল। হঠাৎ একটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে, ১৯৯৫ সালে কুতুবুল আলম ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন রকীবুদ্দীন আমাকে অনুরোধ করেন নানা হিসেবে তাঁর দলে যোগদান করার জন্য। তাঁর কথায় সম্মত হয়ে আমি তাঁর দলে নানা হিসেবে যোগ দিই এবং জাতীয় প্রচারমাধ্যমসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গম্ভীরা পরিবেশন করতে থাকি।
২০০২ সালে বাংলাদেশের গম্ভীরা গানের কিংবদন্তি শিল্পী রকীবুদ্দীন অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ অবস্থায় তিনি আমাকে লোকসংগীতের এ সমৃদ্ধ ধারাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য অনুরোধ জানান। আমি তখন ফাইজুর রহমান মানিকে নাতি হিসেবে নিয়ে দল গঠন করি এবং দলের নাম রাখি, 'চাঁপাই গম্ভীরা'। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমার গম্ভীরা দলের গান রচনা করেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। বর্তমানে আমি গম্ভীরা গান রচনাসহ দলনেতার দায়িত্ব পালন করছি। আমার দল ইতিমধ্যে বাংলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী, এশিয়াটিক সোসাইটিসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গম্ভীরা পরিবেশন করেছে। দেশের ছয়টি বিভাগের ৪০টিরও বেশি জেলায় গম্ভীরা পরিবেশনের সুযোগ আমার হয়েছে। সূচনালগ্ন থেকেই আমি গম্ভীরার নানা চরিত্রে রূপদান করি, সেহেতু আমি এখন সবার কাছে 'নানা' হিসেবে পরিচিত। আনন্দের বিষয় যে ছেলেও ডাকে আমাকে নানা, আবার তার বাবাও ডাকে নানা বলে। গম্ভীরা যে আমাকে জনমানুষের কত কাছাকাছি নিয়ে গেছে, দর্শক-শ্রোতাদের অভিব্যক্তি দেখেই আমি তা অনুভব করতে পারি। এর চেয়ে বেশি আর কিছু পাওয়ার নেই।
গম্ভীরা গান করতে গিয়ে আমার অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ ছাড়াও সরকারের কর্মসূচি, দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ হয়েছে। ইতিমধ্যে আমি প্রাথমিক শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা, গণযোগাযোগ, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গম্ভীরা করেছি। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিওর গণসচেতনতামূলক অনুষ্ঠান, টিআইবির দুর্নীতিবিরোধী অনুষ্ঠান, ডেমিয়েন ফাউন্ডেশনের যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের নিরাপদ মাতৃত্ব, শিশুমৃত্যু হার রোধ, নির্বাচনী আচরণবিধি, ইউনিসেফের মানসম্মত শিক্ষা ও নারী শিক্ষার গুরুত্ব ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গম্ভীরা করেছি। ১৯৮৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমার দল প্রায় পাঁচ হাজার গম্ভীরা পরিবেশন করেছে।
এবার ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসা যাক। কথায় বলে, 'শিল্পীর গানে গগন ফাটে, শিল্পীর হাঁড়ি কুত্তায় চাটে।' গম্ভীরা পরিবেশন করে আর্থিকভাবে লাভবান না হলেও যথেষ্ট সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আমি বর্তমানে একটি বেসরকারি কলেজে গ্রন্থাগারিক হিসেবে কর্মরত। ১৯৮৩ সালে আমি বিএ পাস করি। পরে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা করেছি। ব্যক্তিগত জীবনে আমি বিবাহিত।
গম্ভীরা গান করে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করলেও অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখন পর্যন্ত গম্ভীরা অনুশীলনের বা চর্চার জন্য নিজস্ব কোনো জায়গা বা ঠাঁই করতে পারিনি। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি—সবার কাছে ধরনা দিয়েছি, সবাই শুধু আশ্বাসই দিয়েছেন আর আমাদের ব্যবহার করেছেন। কোনো ফল হয়নি।
প্রতিবাদী লোকসংগীত হিসেবে পরিচিত হলেও গম্ভীরা এখন আর আগের মতো নেই। একসময় গম্ভীরা গানে সমাজের অসংগতিগুলো আলোচনার মাধ্যমে উঠে আসত। ফলে ভুল-ত্রুটিগুলো শোধরানো যেত। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা গম্ভীরা পরিবেশনের জন্য ডাকেন, গানে তাঁরা তাঁদের সাফল্যের কথাই বেশি করে তুলে ধরতে বলেন। তাঁদের অসংগতির কথা তুলে ধরলে পরে তাঁরা আর ডাকতে চান না। বর্তমানে কিছু এনজিও নিজেরা নিজেদের মতো করে গম্ভীরা দল গঠন করেছে। তারা শুধু নিজেদেরই গুণগান করে। এসব কারণে গম্ভীরার প্রকৃত উদ্দেশ্য খর্ব হচ্ছে।
গম্ভীরা মূলত চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলের গান। সাধারণত এ অঞ্চলের ভাষায় এ গান পরিবেশিত হয়ে থাকে। কিন্তু দুঃখ লাগে, বর্তমানে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষও গম্ভীরা গান করছে। অন্য এলাকার মানুষ গম্ভীরা করলে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষাকে বিকৃত করে তাদের গাওয়া গান গম্ভীরার যথার্থ মান ক্ষুণ্ন করছে। এতে গম্ভীরা স্বকীয়তা হারাচ্ছে। তাঁদের প্রতি আমার আহ্বান, গম্ভীরা গান যদি করতেই হয়, তাহলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভাষাকে আয়ত্ত করুন এবং শুদ্ধ ভাষায় গান পরিবেশন করুন। এ প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই রংপুর অঞ্চলের ভাওয়াইয়া যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ বা অন্যান্য জেলার ভাষায় শ্রুতিমধুর হয় না, তেমনি চাঁপাইনবাবগঞ্জের গম্ভীরা গানও অন্য জেলার ভাষায় শ্রুতিমধুর হয় না। জাতীয় প্রচারমাধ্যমগুলোকে এদিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। 
গম্ভীরা গানের বিকাশে এ পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি। বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক গান বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তা নিয়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন একাডেমি বা পরিষদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমরা আজও কোনো গম্ভীরা একাডেমি বা সে ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারিনি। গম্ভীরা গানকে বাঁচাতে, গম্ভীরা শিল্পীদের বাঁচাতে তথা গম্ভীরা চর্চার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান অবশ্যই প্রয়োজন। এ জন্য আমরা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমার রচিত একটি গম্ভীরা গানের কিছু অংশ উদ্ধৃত করে আমার কথার ইতি টানছি। 
দুঃখের কথা কহি কাকে 
কে শুনবে হাঁর কথা 
গম্ভীরা গান গাহি হামরা 
মনে লিয়্যা ব্যথা-নানা হে। 
গম্ভীরায় সুদৃষ্টি দিলে 
শিল্পীদেরও সম্মান মিলে 
গম্ভীরা গান উঠবে জ্বলে 
কর চিন্তা-ভাবনা।
অনুলিখন: মাযহারুল ইসলাম

আলকাপ

আলকাপের জন্য অভিসার

কেরামত সরকার

আলকাপ গাইছেন কেরামত সরকারআলকাপই আমার প্রথম ভালো লাগা, যা আমি আজও বহু কষ্টের মধ্যেও লালন করে আসছি। এই আলকাপ গান আমি প্রথম শুনি আবদুস সাত্তার সরকারের কাছে। তিনি আমার দাদা। তা প্রায় ষাট বছর আগের কথা। তাঁর দলের গান শোনা ও দেখার পর থেকেই এই গানে হাস্যরসের যে মজা, তা আমাকে ভীষণভাবে টানে। আর সেই টানেই আমার আলকাপ গানে আসা।
পূর্বপুরুষ থেকেই আমরা চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার পলশা গ্রামের অধিবাসী। বাবা মো. মালেক উস্তুর একসময় নয়াগোলা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ছিলেন। আমাদের অল্প কিছু জায়গাজমি আছে। ওই জমিতে চাষাবাদ আর কোর্টে মোহরার (আইনজীবীর সহকারী) কাজ করে সংসার চলে। সেই সঙ্গে আছে আমার আনন্দ-বিষাদের আলকাপ। 
খুব অবাক লাগবে যে, দাদার কাছে আলকাপ গান শুনলেও সেখান থেকে কোনো উৎসাহ-উদ্দীপনা পাইনি। বরং উল্টোটাই হয়েছে। দাদা ও বাবা উভয়েই আমাকে আলকাপ গান করতে অনেকবার নিষেধ করেছেন। কিন্তু নিষেধ করলে কী হবে, তখন আমাকে আলকাপের নেশায় পেয়েছে। ঘনঘোর বর্ষার বিদ্যুৎ চমকানো রাতের পিচ্ছিল পথে যেমন পা টিপে টিপে রসের আধার শ্রীমতী রাধিকা পরমপুরুষ প্রেমময় শ্রীকৃষ্ণের জন্য অভিসারে বের হন—সবকিছু উপেক্ষা করে—ঠিক তেমনি আমি অনেক ঝড়ঝাপটার মধ্যেও লোকনাট্য আলকাপ ধরে রেখেছি। কষ্ট না করলে যেমন কেষ্ট পাওয়া যায় না, তেমনি অনেক দুর্যোগ আর অশান্তির মধ্যেও বুকে আছে এই গানের অদম্য পাগলপারা এক নেশা। 
এই অদম্য নেশার ঘোর কাটাতে বাবা আমাকে দুবার ঘরছাড়া করেন। 'ঘর বাইনু বাহির, বাহির বাইনু ঘর/পর বাইনু আপন, আপন বাইনু পর'। এ এক অদ্ভুত নেশার উন্মাদনা আর তার হাতছানি। ঘর ছাড়লেও ছাড়িনি প্রথম ভালো লাগাকে। অতঃপর আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরা বাবাকে বুঝিয়ে শান্ত করলে আবার আমি ঘরে ফিরি। কেননা, ঘরই বোধহয় নিশ্চিন্ত আশ্রয়। আমি ঘরে ফিরলে বাবা অন্য রাস্তা খোঁজেন আমাকে ঘরমুখী করতে। তখন আমি সতেরো বছরের এক অস্থির যুবক। দুঃসহ এক বয়স। রক্তে আলকাপের নেশা। এ নেশার ঘোর কাটাতে বাবা আমার শক্ত কঠিন হাতের সঙ্গে এক নরম কোমল হাত মিলিয়ে দিলেন। বিয়ের পর স্ত্রীর প্রেমের ডোরে বাঁধা পড়ে যদি আলকাপের নেশার ঘোর কাটে—এই ছিল আমার পিতৃদেবের ঐকান্তিক ইচ্ছা। কিন্তু মুচকি হেসেছিলেন বিধাতা।
তাই আলকাপ থেকে সরে আসা হয়নি আমার আজও। সাতাত্তর থেকে অদ্যাবধি এই লোকনাট্য করে আসছি। আটাত্তরে এসএসসি এবং একাশিতে এইচএসসি পাস করি। তেরাশি সালে ফরম পূরণ করেও বিএ পরীক্ষায় বসা হয়নি। সে সময় আমার চাকরি হয়ে যায় বিআরডিবিতে; ১০ বছর আমি সেখানে চাকরি করি। আলকাপ গান করার জন্য কর্তৃপক্ষ আমাকে ছুটি দিতে আপত্তি করায় সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত বিদায় নিয়ে চলে আসি।
আমার আলকাপ গানের প্রকৃত গুরু বাদল পাল। তাঁর কাছেই আলকাপ গানের তাল, মান, লয়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুর শিক্ষা পেয়েছি। ১০ বছর আমি এই গুরুর কাছে শিখেছি। দাদা আলকাপ গান করলেও আমার গান করা পছন্দ করতেন না বলে তাঁর কাছে আমার শেখা হয়নি। শ্রদ্ধেয় বাদল দা খুব মন দিয়ে শেখাতেন। তিনি আজ আর নেই। অপাপবিদ্ধ লোকে তাঁর বাস হোক এই প্রার্থনা করি। 
এই লোকনাট্য করা নিয়ে সংসারে অশান্তি আছে। স্ত্রী, ছেলেমেয়ে—তারা কেউ চায় না আমি আলকাপ করি। কিন্তু আমি সবকিছু উপেক্ষা করেই এই গান গেয়ে চলেছি। এই গান করে আর্থিক সচ্ছলতা পাইনি। জীবন-জীবিকার জন্য তাই কোর্টে মোহরার কাজ করি, আর বাকি সময়ে জমি চাষাবাদ করি। তাতে করে বউ, ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে যায় সংসারের খরচ। এই গান করি মনের আনন্দে। দলে ১৫ জন লোক। এক আসর গান করে যে টাকা পাই, তাতে কোনোমতে যাতায়াত খরচ চলে। চাল-ডাল আর কেনা হয় না। জামা-কাপড় তো দূরের কথা। 
এক যুগ আগেও পূজা-পার্বণ উপলক্ষে আলকাপ করার জন্য ডাক পেতাম। রাতে পূজা, আরতি—এসব শেষ হয়ে গেলে প্রথমে যাত্রাপালা এবং পরে বসত আলকাপের জমজমাট আসর। চারদিকে লোকে লোকারণ্য। দর্শক-শ্রোতা প্রাণভরে সেই সব আসরে উপস্থিত হতো। উপচে পড়া ভিড় চারদিকে। মধ্যখানে খোলা আসর। ওপরে টানানো থাকত চাঁদোয়া বা শামিয়ানা। জ্বলে উঠত হ্যাজাক কিংবা ডে-লাইট। এসব কিছু মিলিয়ে এক অদ্ভুুত মজা আর আনন্দের সঙ্গে গানের আসরে গান করা। দুই দলে বসত আলকাপের আসর। কবিগানের লড়াইয়ের মতো জমে উঠত প্রাণবন্ত আসর। তখন তো চিত্তবিনোদনের জন্য ছিল না এত দূরদর্শন আর স্যাটেলাইটের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন। এসবের দৌরাত্ম্যে তো গ্রামীণ ঐতিহ্য আর লোকসংস্কৃতি এখন মৃতপ্রায়। ধুকধুক করে কোনোমতে টিকে আছে। কবিগান, জারিগান, সারিগান, ভাটিয়ালি, যাত্রা, আলকাপ, কেচ্ছাকাহিনি, গম্ভীরা—সবই ধুঁকছে। কেউ বেশি, কেউ কম। 
আগে বিভিন্ন পূজা—দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কালী, রায়রাজা, বাসন্তী পূজা উপলক্ষে আমরা আমন্ত্রণ পেতাম আলকাপ করার জন্য। আমরাও মুখিয়ে থাকতাম এসব আসরে যাওয়ার জন্য। দলের ১৫ জনকে খবর দিতে হতো। সবাই এসে আমার বাড়িতে হাজির হলে একসঙ্গে আমরা রওনা দিতাম নির্দিষ্ট পূজামণ্ডপে গান করার জন্য। এখন আর আগের মতো পূজা-পার্বণে ডাক পড়ে না। কেমন যেন সব ঝিমিয়ে যাচ্ছে। যুগযন্ত্রণায় কাতর সবাই। উত্তরবঙ্গের রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নঁওগা জেলার মধ্যেই এই আলকাপ ঘুরপাক খায়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় আলকাপ হয় বলে জানি। পূজা-পার্বণ ছাড়াও বিভিন্ন মেলা উপলক্ষে আলকাপের আসর বসে। আমি চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার মহারাজপুর মেলা, কানসাট মেলা, সরজন মেলা, কালুপুর মেলা—এসব জায়গায় আলকাপ করেছি। এসব মেলার আয়োজন কিছুটা ভিন্ন। মেলা কর্তৃপক্ষ প্যান্ডেল করে টিকিট-প্রথার মাধ্যমে গানের আয়োজন করে থাকে, যেখানে আমাদের প্রতি আসরে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়। 
পূজা-পার্বণ আর মেলার বাইরে কোনো কোনো সময় ডাক পড়ে আলকাপ করার জন্য। আমি একে বলি ফরমায়েশি আলকাপ। সমাজের হয়তো নামীদামি কেউ ডেকে আলকাপ করতে বলেন। সময় দেন মাত্র আধঘণ্টা। এর মধ্যেই আসর শেষ করতে হবে। এভাবে আলকাপের আসর জমে না। তাও আবার এক দলের আসর। দুই দল থাকলে তবেই জমে আসর। 
'আল' অর্থ হচ্ছে খোঁচা বা টিপ্পনী আর 'কাপ' আরবি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে মশকরা বা কৌতুক। কৌতুকের রসে সমাজের অন্যায়-অসংগতি আলকাপ লোকনাট্যের মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকের সামনে আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করি। এটি এক ধরনের লোকনাট্য। গ্রাম্য গাথা, সাধারণ সামাজিক বা রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে এর পালা বা কাহিনি রচিত হয়। একটি দলের গঠন হয় সরকার (গানের রচয়িতা), ক্যাইপ্যা (নায়ক), ছোকরা (পুরুষ-মেয়ে সাজিয়ে ছোকরা করা হয়), দোহারি, ডুগি-তবলাবাদক, হারমোনিয়ামবাদক ও জুড়িবাদক—এসব নিয়ে। কোনো কোনো দলে আবার বংশীবাদকও থাকেন। প্রথমে গানের আসর শুরু করা হয় দেব-দেবীর জয়সূচক বন্দনা করে, তারপর করা হয় আসরবন্দনা। আসরবন্দনার পর সরকার দেবতা ও শ্রোতার উদ্দেশে প্রণতি জানিয়ে বন্দনা করেন। এর পরে ছোকরার খেমটা নাচ। নাচের পরে আলকাপের মূল কাহিনি বা ঘটনা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে শ্রোতা-দর্শকের সামনে লোকনাট্যের ঢঙে অভিনয় করে পরিবেশন করা হয়। পুরুষেরা ধুতি ও শার্ট পরে এবং সঙ্গে একটা গামছা নিয়ে অভিনয় করে। আর মেয়েরা (পুরুষকে মেয়ে সাজানো হয়) শাড়ি পরে অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করে থাকে। 
আসরবন্দনার নমুনা এ রকম: 'এসো মা হূদে বিন্দুবাসিনী/ওমা তুমি সাকার, আমার অহংকার/মধুর ঝংকার মৃদু সুহাসিনী/মম হূদি মন্দিরে আমি দেখা দাও/অরূপ ছাড়িয়ে স্বরূপে দাঁড়াও/যুগল রূপে দীপালি জ্বালাও মা/প্রাণভরে ঈশান-ঈশানী/নাই কোনো শক্তি, নাই কোনো মোর ভাষা/তবুও গুণ গাহিবার আশা/প্রাণের পিপাসা মা মিটাও সেই আশা/মুখে দাও মা ভাষা মধুর ভাষিণী।' এরপর আলকাপ গানের সরকার বন্দনার মাধ্যমে সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন।
নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহের ঘটনা আজ আর কারও অজানা নেই। এই নিয়ে লেখকেরা অনেক বইও লিখেছেন। তেমনি একটা বন্দনা: 'ইলা মিত্র করে আইন জারি/লেকচার দিল কত গো বন্ধুগণ/তার ফলে সাঁওতাল সব গেল জেলে/কোথায় গেল হাবু বাবু নাই অন্বেষণ/ওই ভারতের ঘরে ঘরে বিবাদ বাধিল/লীগ-কংগ্রেস আর মহাসভার দল গঠন হলো।/তার পরে কমিউনিস্ট হলো/ভারতটাকে ঘিরে নিল/ইলা মিত্র নামে নারী/লেকচার দিচ্ছে ভারী ভারী/বলব কি আর বলব ভাই তার কথা/বলতে প্রাণে কষ্ট হয় হয় গো ব্যথা/বলব কি আর/সে তো বাবুর পরিবার/দেখ নাচোল থানার ভিতরে/কত রকম অন্যায় করে/দারগা পুলিশ জমাদার/মেরে করিল ছারখার/রাখিল জেলের ভিতরে/গভর্নর জানতে পেরে/পুলিশ পাঠায় ঘরে ঘরে/সাঁওতাল-ধরিবার তরে গো/কিছু কিছু ধরা পড়ল/বাকিরা সব লুকাইল/লুকায়ে ভাবে মনে মনে/পাকিস্তান আর রবে না।' 
আলকাপে হাস্য-কৌতুকের মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে সরস করে সহজ ভাষায় দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়। তবে এখন যুগের দাবির কারণে আলকাপে কিছু পরিবর্তন দরকার। বিশেষত, মেয়েদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে। এখন আমরা আলকাপ করতে গিয়ে ঠিক বুঝতে পারি যে দর্শক আর ছোকরা বা মেয়েদের ভূমিকায় পুরুষদের দেখতে চায় না। ভবিষ্যতে এই গান টিকিয়ে রাখতে হলে মহিলা ছোকরা, নৃত্যশিল্পী ও অভিনেত্রীর প্রয়োজন। প্রসঙ্গত বলি, ২০০৯ সালে এক মেয়েকে দিয়ে ছোকরার ভূমিকায় অভিনয় করিয়েছিলাম, যেটা বিটিভি ওয়ার্ল্ড মোট ২৯ বার প্রচার করেছে। এটা আমার আলকাপ-জীবনের একটা বড় পাওয়া। এই গান টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান ও শুভবোধসম্পন্ন মানুষের এগিয়ে আসা জরুরি। যাঁরা দেশের সংস্কৃতির শেকড় ও ঐতিহ্যকে ভালোবাসে, ওই সব মরমি লোককে আমরা আমাদের পাশে পেতে চাই। চাই তাঁদের আন্তরিক সহযোগিতা। জাতীয় পর্যায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোয় আমরা আলকাপ করতে চাই। এই গানের প্রচার ও প্রসারের জন্য এটাও জরুরি। এ জন্য সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করি। 
বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়, আমার জানামতে, যে কয়জনের দল আছে, তাঁরা হচ্ছেন ১. কেরামত সরকার, ২. জয়চাঁদ সরকার, ৩. জাহাঙ্গীর সরকার, ৪. শফিকুল সরকার, ৫. বীরেন সরকার, ৬. কেতাবুর সরকার, ৭. লুত্ফর সরকার ও ৮. ভিখু সরকার। 
সাধারণত অগ্রহায়ণ থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত আলকাপের গানের আসর বসে। বেশির ভাগ আসরই রাতে শুরু হয়। শেষ হতে হতে কখনো সকাল কিংবা দুপুরও পার হয়ে যায়। দুই দল থাকলে এমনটি প্রায়ই হয়। কবিগানের মতো লড়াই জমে ওঠে। খুব মজার কথা যে, এই গান করতে গিয়ে হর্ষ-বিষাদের অভিজ্ঞতাও স্বাভাবিকভাবেই জমা হয়েছে। বিটিভিতে প্রচার কিংবা অজস্র মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছি; তেমনি পেয়েছি বিষাদও। নওগাঁ জেলার মহাদেবপুর থানার পণ্ডিতপুর গ্রামে একবার আলকাপ করতে গিয়েছিলাম। দুই রাত আলকাপ করেছি। কিন্তু বিদায়ের সময় অদ্ভুতভাবে কর্তৃপক্ষ কোনো টাকা-পয়সা না দিয়ে চুপ মেরে গেল। অতঃপর টাকা-পয়সা ছাড়াই আমরা হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। 
এই আলকাপ গানের শুরু কবে হয়েছিল এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে অবিভক্ত ভারতবর্ষের মালদহের সুবল কানীর একটি গানে আলকাপ গানের প্রথম রচয়িতা হিসেবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার মোনাকষা গ্রামের বোনাকানার নাম পাওয়া যায়। এখানে আছে—'প্রথম মোনাকষার বোনাকানা/আলকাপ গান করেন রচনা/তার পরেতে সুবেদার আলী ভাই/বাড়ি তাহার মালদহতে হয়/তার পরেতে ঝাঁকসু সরকার নামটি শুনি/তার জঙ্গীপুরে বাড়ি জানি/আলকাপে যে বিখ্যাত রে ভাই/জাগিরুদ্দিন শাহর নাম/তার নূরপুরেতে হয়তো ধাম।' 
এই আলকাপ গান উত্তরবঙ্গ ছাড়াও বাঙালি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকসংস্কৃতিপ্রেমী মানুষের সহযোগিতায় পরিপুষ্ট হয়েছে। উভয় সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি টিকিয়ে রাখতে এই গান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে বহুদিন থেকেই। এর ব্যাপক চর্চা, প্রসার ও প্রচারে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি সুস্থ-সচেতন ও শুভবোধসম্পন্ন সংস্কৃতিবান মানুষ এগিয়ে আসবেন—এই আমার আন্তরিক প্রত্যাশা। 
অনুলিখন: কনকরঞ্জন দাস

সার্কাস

আনন্দ-সার্কাস

বীরেনচন্দ্র দাস

দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের পরিবেশনালক্ষ্মণ দাস মানুষের মনে আনন্দ দেওয়ার ব্রত নিয়ে সার্কাস দল প্রতিষ্ঠা করেন, আমি তাঁর উত্তরসূরি হিসেবে সার্কাস দেখিয়ে আনন্দ পাই। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন ঠেকাতে দেশীয় সংস্কৃতিচর্চার বিকল্প নেই। তাই নিজস্ব সংস্কৃতির ধারা অক্ষুণ্ন রেখে পল্লি বাংলার সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্ট-বেদনা ভুলিয়ে দিতে ৬০ বছর ধরে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস নিয়ে ছুটে চলেছি গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। এর পোশাকি নাম দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাস পার্টি হলেও মানুষ একে লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস নামেই জানে। যখন দেখি মানুষ সার্কাস দেখে আনন্দ পায়, তৃপ্তি বোধ করে, তখনই আমার মনে হয় আমাদের কষ্ট, আমাদের প্রচেষ্টা, আমাদের সাধনা সার্থক হয়েছে। যত দিন বেঁচে আছি, তত দিন লক্ষ্মণ দাসের সার্কাস নিয়ে দেশজুড়ে মানুষকে আনন্দ দিতে চাই।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার উত্তর পালরদী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আমার বাবা লক্ষ্মণচন্দ্র দাস। তাঁর বাবা অশ্বিনীকুমার দাস ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। অশ্বিনী দাসের তিন ছেলে রঘুনাথ দাস, যদুনাথ দাস ও লক্ষ্মচন্দ্র দাস। ছোট ছেলে লক্ষ্মণচন্দ্র দাস ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন হাসিখুশি ও চঞ্চল প্রকৃতির। যৌবনে ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী ও শক্তিবান যুবক। লক্ষ্মণচন্দ্র দাস খেলার ছলে শৈশবের বন্ধুদের নিজস্ব আঙ্গিকে শারীরিক কসরত দেখিয়ে আনন্দ দিতেন। লেখাপড়ায় ছিল খুব অমনোযোগী। তিনি স্কুলে স্কুলে ঘুরে শারীরিক কসরত দেখাতেন। চল্লিশের দশকের মাঝামাঝি কোনো একদিন বাবার শাসনে অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তারপর তাঁর মেসোমশাই সাধুচরণ দাসের 'দি সাধনা লায়ন সার্কাস'-এ চলে যান। একজন নবীন শিল্পী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে অল্পদিনের মধ্যেই সার্কাস দেখতে দেখতে নিজে শারীরিক কসরত রপ্ত করে একাধিক খেলা দেখানোর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পরবর্তীকালে তাঁর মেসোমশাই সাধু দাসের সঙ্গে কিছুদিন থাকার পর তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে তাঁর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ১৯৪৮ সালে তিনি নিজেই একটি সার্কাস দল গঠনের উদ্যোগ নেন। নিজ গ্রাম উত্তর পালরদী এসে লক্ষ্মণচন্দ্র দাস ৮-১০ জন খেলোয়াড় নিয়ে একটি দল গঠন করেন এবং নিজের নামেই নামকরণ করেন। 'লক্ষ্মণ দাস সার্কাস' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এতে তাঁর ভাইয়েরা তাঁর ওপর বিরাগ হন। তাঁর মেসোমশাই সাধু দাসের সার্কাসে থাকাকালে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা দু-তিনজন সহকারী শিল্পী তাঁর সঙ্গে যোগ দেন। গৌরনদী উপজেলার উত্তর বিজয়পুর গ্রামের ম্যাজিক শিল্পী রাসু ঠাকুর তাঁর সহকারী হিসেবে যোগ দেন। তখন সার্কাসের তেমন কোনো খেলাধুলার উপকরণ কিংবা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জীবজন্তু ছিল না। লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের যাত্রা শুরুর পর মানুষকে আনন্দ দেওয়ার লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে ছুটে যেতেন দেশের এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে। দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানোর সুযোগে ধীরে ধীরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ খেলোয়াড়, পশুপাখি ও খেলাধুলার উপকরণ সংগ্রহের মধ্য দিয়ে পঞ্চাশের দশকে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস একটি পূর্ণাঙ্গ সার্কাস দলে পরিণত হয়। লক্ষ্মণ দাস নিজেও সার্কাসে দাঁত দিয়ে রড কাটা, গলা ও চক্ষু দিয়ে রড বাকা করা ও ভারোত্তোলন খেলা প্রদর্শন করতেন। তিনি বরিশাল ব্যামাগারের একজন সদস্য ছিলেন। অল্প সময়ে সুনাম-সুখ্যাতি ও বিসৃ্ততি লাভ করে দেশজুড়ে। দেশের মানুষের কাছে লক্ষ্মণ দাস সার্কাস একটি জনপ্রিয় নাম হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। বাবার সার্কাসকে ঘিরেই (লক্ষ্মণ দাসের) পারিবারিক ঐতিহ্য তৈরি হয়। গৌরনদীর দাস পরিবার সারা দেশে একটি সুপরিচিত পরিবার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যের প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। মুক্তিকামী মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার, ঠিক তখন পশ্চিমা হায়েনারা ২৫ মার্চ সেই কালরাত্রির হত্যাযজ্ঞের সময় পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার মাটিভাঙ্গা এলাকায় লক্ষ্মণ দাস সার্কাস নিয়ে সার্কাস প্রদর্শন করছিলেন। দেশ যখন পুরোপুরি সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিষয়টি বুঝতে পেরে লক্ষ্মণ দাস তাঁর সার্কাসের দলবল নিয়ে একাত্তরের এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে নিজ বাড়ি গৌরনদীতে ফিরে আসেন। গৌরনদীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অবস্থান নিতে আসছে এ খবর শুনে লক্ষ্মণ দাস তাঁর পরিবার পরিজন ও সার্কাসের দলবল নিয়ে গৌরনদী গয়নাঘাট থেকে নৌকাবহরের কিছু নৌকা রেখে বাকি নৌকা নিয়ে বৃহত্তর গৌরনদীর বাকাল ইউনিয়নের কোদালধোয়া গ্রামের প্রত্যন্ত পল্লিতে অবস্থান নেন। বর্তমানে এটি আগৈলঝাড়া উপজেলার অন্তর্গত। সেখানে তাঁর পরিবারপরিজন নিয়ে কোদালধোয়া হাইস্কুলে এবং সার্কাসের লোকজন কোদালদোয়া খালে মিস্ত্রি বাড়ির কাছে নৌকা ভিড়িয়ে আত্মগোপন করে বসবাস শুরু করেন। পশুপাখি নৌকায় থাকলেও সার্কাসের একমাত্র হাতিটি স্কুলের পাশে একটি গাছের সঙ্গে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখেন। এ সময় লক্ষ্মণচন্দ্র দাস সার্কাসের কলাকুশলী, শিল্পী, লোকজন ও স্থানীয়দের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ সংবাদ স্থানীয় রাজাকাররা গৌরনদী কলেজে পাকিস্তানি হানাদার ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়। একপর্যায়ে হানাদারদের আক্রমণের খবর পেয়ে লক্ষ্মণ দাসের পরিবার ও সার্কাসের লোকজন পালিয়ে গিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। একমাত্র লক্ষ্মণ দাস সার্কাসের মায়ায় ওই স্থানেই থেকে যান। ১৯৭১ সালের ১৬ জুন পাকিস্তানি হানাদাররা রাজাকারদের সহায়তায় অতর্কিত গুলি করে সার্কাসের পশুপাখি, জীবজন্তু হত্যা করে। পরে স্কুলের কক্ষ থেকে লক্ষ্মণ দাসকে খুঁজে বের করে গুলি করে হত্যা করে। এ সময় প্রভুভক্ত একমাত্র হাতিটি গর্জন করে সর্বশক্তি দিয়ে গাছ উপড়ে ফেলে নিহত প্রভু লক্ষ্মণ দাসের লাশের কাছে ছুটে এলে হানাদাররা হাতিটিকে লক্ষ্য করে গুলি করে ঝাঁজরা করে দেয়। হানাদাররা চলে যাওয়ার পর তাঁর স্বজনেরা ফিরে এসে লক্ষ্মণ দাসের লাশ ও প্রভুভক্ত হাতিটিকে মাটিচাপা দিয়ে তাঁর পরিবারের সবাই ভারতে পালিয়ে যান। আমি যাই তিন মাস পরে। ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিই। তবে আমি মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় থাকলেও আমার বাবার নাম নেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়।
দেশ স্বাধীনের পর লক্ষ্মণ দাসের দুই ভাই ও ছেলে অরুণচন্দ্র দাস, আমি বীরেনচন্দ্র দাস, চূড়ামণি দাস ও বাসকলাল দাস খোকন সার্কাসটি পুনরায় চালু করি। মালিক হিসেবে আমাকে এবং পরিচালক হিসেবে বড় ছেলে অরুণচন্দ্র দাসকে মা নীলা রানী দাস দায়িত্ব দেন। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার গৌরনদী উপজেলার হোসনাবাদ গ্রামের নিজাম উদ্দিন আকন রিলিফের তাঁবু থেকে কযেকটি তাঁবু ও অর্থ দিয়ে সাহায্য করেন। ১৯৭৩ সালে কৃষি সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাদ সার্কাসের প্যান্ডেল তৈরির জন্য কিছু টিন প্রদান করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি পাঁচ লাখ টাকা, একটি বাঘ শাবক, একটি ভাল্লুক ও একটি হাতি দেওয়ার ঘোষণা দেন। ১৫ আগস্টে তিনি শহিদ হন। দেশের পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৭৬ সালে বরিশালের জেলা প্রশাসক আবদুল হাকিম সার্কাসের হাতি কেনার জন্য ঋণ দিয়ে সহায়তা করেন। আরও অনেকের সহায়তায় আমরা পুরোদমে সার্কাসটিকে চালু করি।
১৯৭৯ সালে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমীর আমন্ত্রণে ঢাকায় সার্কাস দেখাই। ওই সময় সরকারের কাছ থেকে দুই লাখ টাকার অনুদান পাই। ১৯৮০ সালে সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় পদক প্রদান করা হয়। 
বাবার স্মৃতি ধরে রাখতে আমার বড় ভাই অরুণচন্দ্র দাস বাবার কিছু খেলা দেখান। প্রায় ৪০ বছর ধরে তিনি খেলা দেখাচ্ছেন। চোখ দিয়ে ও গলা দিয়ে লোহার রড বাঁকা করা, ভারোত্তোলন ও গ্লোব খেলা ইত্যাদি দেখাতে তিনি দক্ষ। এর মধ্যে সবচেয়ে জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ হলো লোহার পাত দিয়ে তৈরি ডিম্বাকৃতির ২০ ফুট ব্যাসের লোহার খাঁচার মধ্যে মোটরসাইকেল চালানো। কখনো কখনো হাত ছেড়ে বার বার চক্কর দেওয়ার একপর্যায়ে মোটরসাইকেল নিয়ে খাঁচার উপরিভাগে ১৬ ফুট ওপরে গিয়ে হুক ধরে ঝুলে থাকা। এই খেলাটি এতই ঝুঁকিপূর্ণ যে সামান্য ত্রুটিতে প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে।
আমাদের সার্কাসে বর্তমানে ৪২ জন নারী ও শিশুশিল্পীসহ প্রায় শতাধিক শিল্পী রয়েছেন। এ ছাড়া নৃত্যশিল্পী, দর্শকদের আরও বেশি প্রাণবন্ত ও আনন্দ দিতে জোকার রয়েছে। খেলার মধ্যে রয়েছে মোটরসাইকেল গ্লোব, ত্রিফলা বর্ষা, রিং নৃত্য, রশিনৃত্য, সাইকেল এক চাকা, সাইকেল দুই চাকা, হাই সাইকেল, তার সাইকেল, বাম্বু ব্যালেন্স, তারে যাতায়াত, অগ্নি রিংয়ে জাম্পসহ অসংখ্য খেলা। পশুপাখির মধ্যে রয়েছে বানর, হাতি, বাঘ, ভাল্লুক, ঘোড়া ও গাধা। আকর্ষণীয় ম্যাজিক তো রয়েছেই।
দীর্ঘ সার্কাসজীবনে সব সময় সবচেয়ে বড় যে সমস্যায় আমাদের পড়তে হয় বা হয়েছে তা হলো সার্কাস প্রর্দশনের অনুমতি পাওয়া নিয়ে হয়রানি। শো প্রদর্শনের আগে যখনই আমরা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের শরণাপন্ন হই তখন অনেকেই বাড়তি সুবিধা দাবি করে। প্রতিদিন সার্কাসের শিল্পী, কলাকুশলী, কর্মচারী, পশুপাখিদের ভরণ-পোষণ ও বেতনে প্রায় এক লাখ টাকা খরচ হয়। অনুমতি না পাওয়ায় সার্কাস বন্ধ থাকলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে হয়। বর্তমানে এর সঙ্গে আরও একটি সমস্যা যোগ হয়েছে—তা হলো সার্কাসের শো প্রদর্শন করতে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ ব্যবহার করতে না দেওয়া। এ সমস্যার কারণে আমরা অনেক সময় সার্কাস দেখাতে পারি না। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে অনুমতি নিয়ে হয়রানি না হলে রমজান মাস বাদ দিয়ে আমরা বছরে ১১ মাস সার্কাসের শো করতে পারি। সার্কাস বন্ধ থাকলে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকা লোকসান হয়। সার্কাস শুরুর পর দীর্ঘ ৬২ বছরে সবচেয়ে বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল জোট সরকারের সময়ে। দেশে জঙ্গি তৎপরতা শুরু হলে সার্কাস প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় শো বন্ধ করে দিয়ে বসে বসে কলাকুশলী, পশুপাখি ও কর্মচারীদের পকেটের টাকা খরচ করে মাসের পর মাস পালতে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সার্কাস বন্ধ থাকায় খেলার উপকরণও বিনষ্ট হয়। অনুশীলন না থাকায় পশুপাখি তাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া খেলা ভুলে যায়। গ্রামীণ মানুষের নির্মল বিনোদনের এই মাধ্যমটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।
অনুলিখন: জহুরুল ইসলাম

পুতুলনাচ

পুতুল হাসে, পুতুল কাঁদে

নজরুল ইসলাম

বাবার পুতুলনাচের দল ছিল। নাম রূপসী বাংলা পুতুলনাচ। বাবা নিজেই পুতুল-মাস্টার ছিলেন। তিনি পুতুল নাচাতেন। পুতুল হাসে, পুতুল ফাঁদে। পুতুল গায়, নাচে আবার নাটকের মতো অভিনয়ও করে। বিষয়টি শৈশবে আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হতো। তখন দেশ স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান আমল। আমাদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে। প্রথমে বাবার নামের সঙ্গে দলের পরিচিতি আসে। আশপাশের গ্রামের লোকজনের কাছে 'রূপসী বাংলা পুতুলনাচ' দলটি মকবুল মাস্টারের দল হিসেবে পরিচিত হয়। এরপর আমি দল গঠন করি 'দি নিউ স্টার সোনালী ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ' নামে। কিন্তু লাইসেন্স করার সময় শুধু 'নিউ সোনালী ঝুমুর ঝুমুর পুতুলনাচ' নামটুকু রাখি। এই নামে ২৭ বছর চালিয়ে আসছি। সুনামও পেয়েছি।
এখানে বলে রাখা ভালো, আমার দল আর বাবার দলের মধ্যে একটা বিস্তর ফারাক রয়েছে। আমি এখন ১২ জন কর্মী নিয়ে দল চালাচ্ছি।
সুতোয় টানা পুতুল নাচাই। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে অর্গান, ড্রামসেট, জুড়ি ব্যবহার করছি। কিন্তু ওই আমলে (পাকিস্তানি আমলে) আমার বাবার দলে সুতোয় টানা তারের পুতুল এবং দস্তানা পুতুলের নাচ হতো। বাদ্যযন্ত্রের তালিকায় থাকত হারমোনিয়াম, জুড়ি, বাংলা ঢোল, বাঁশের বাঁশি এবং খমক-খঞ্জুরি। এখানকার মতো প্যান্ডেল করে টিকিট কেটে তখন পুতুলনাচের আসর বসত না। আমার দল গঠনের আগে বাবার দলে যখন পুতুল নিয়ে খেলতাম (পুতুল নাচাতেন) তখন আসর বসত গ্রামের কোনো মোড়ল-মাতবরের বাড়ির আঙিনায়। হিন্দু অঞ্চল হলে মন্দিরসংলগ্ন চত্বরে। সেখানে প্রচুর লোকজন আসত। শিশু, যুবা থেকে বৃদ্ধরা পর্যন্ত। পুতুলের হাসি, কান্না, নাচ দেখে তারা খুব মজা পেত। আর আয়োজন হতো পাউতি ধরে (টাকার একটি অংশ) আর তোলা তুলে (মাঙ্গন বা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বউ-ঝিদের কাছ থেকে চাল, ডাল, আনাজ-তরকারি তুলে)। এতে পুতুলনাচ দেখিয়ে শুধু টাকাই পেতাম না, চতুষ্পাঠী পণ্ডিতদের মতো উপঢৌকন পেতাম; চাল, আনাজ-তরকারি পেতাম। একবার মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর থানার খালপাড়ে পুতুলনাচ দেখাতে গেছি। গ্রামের পশ্চিম মাথায় পুতুলনাচ দেখানোর পর ডাক এল পূর্ব মাথায়। সেখানে দেখানোর পর গ্রামের এক মাতবর এসে আব্দার করলেন তাঁর বাড়িতে পুতুলনাচ দেখাতে হবে। বললাম, গ্রামের দুই মাথাতেই তো দেখলেন। আবার কেন? লোকটি বললেন, এটা আমার ইজ্জতের ব্যাপার। এর সঙ্গে আমার মানসম্মান জড়িয়ে রয়েছে। পরে জেনেছিলাম, লোকটি ছিল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য।
আর একবার পুতুলনাচ দেখাতে গেছি খুলনার বুড়ো ফকিরের থানে। মানিকগঞ্জের বলরাম রাজবংশীর বিশ্বরূপা পুতুলনাচ দল আগেই পৌঁছে গেছে, আমরা জানি না। আমরা যাওয়ার পর থানে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। ভাবলাম আমরা ফিরে আসব। ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মধ্যে মুরব্বিরা এলেন। তাঁরা থানের থেকে মাইলখানেক দূরে গ্রামে প্রবেশমুখে আমাদের পুতুলনাচের কথা বললেন। বাবা ছিলেন আমার দলে। তিনি অসম্মতি জানালেন। তাতে থান ও বুড়ো ফকির মাজার কমিটির লোকজন আমাদের অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। ইতিমধ্যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও এসে গেছেন। তিনি অনুরোধ করে গ্রামে ঢোকার পথেই পুতুলনাচ দেখাতে বললেন। জানালেন, 'এই থানের মেলার বিশেষ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে পুতুলনাচ। আপনারা চলে গেলে একদিকে ঐতিহ্য নষ্ট হবে, অন্যদিকে আমাদের দুর্নাম হবে। ইজ্জত যাবে।' একসময় পুতুলনাচ দেওয়াটা মানসম্মান-ইজ্জতের ব্যাপার ছিল। এক গ্রামে পুতুলনাচ হয়েছে, অন্য গ্রামে তা দেখাতেই হবে। তখন গ্রামে পুতুলনাচ দেওয়ার জন্য বাড়ির বউ-ঝিরা আব্দার করতেন। আর পুুতুলনাচ দেখে শিশু থেকে শুরু করে থুরথুরে বুড়োরা পর্যন্ত আনন্দে মেতে উঠতেন। এই মুহূর্তে একটা কথা মনে পড়ছে। একবার চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ থানার কানসাট গেছি পুতুলনাচ দেখাতে। ভাদ্রসংক্রান্তি মেলা উপলক্ষে। আমরা হেমেন্দ্র কুমার নাট্যমঞ্চে পুতুলনাচ দেখাচ্ছি। পাশেই একটি প্যান্ডেল।
যশোর থেকে দল এসেছে। গনেশ অপেরা। ভালো নামডাকের দল। কিন্তু রাতে ঘটল কি—একদল লোক যাত্রাগানের ভেতর অধিক নাচগানে আপত্তি তুলে প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা যাত্রার সমঝদার দর্শক। কিন্তু ওই রাতে যাবেন কোথায়?
শেষ পর্যন্ত তাঁরা এসে পুতুলনাচের দাবি জানান। অত রাতে পুতুলনাচ! আমি তো অবাক! স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে আমরা পুতুলনাচের ব্যবস্থা করি। সে রাতে 'রূপবান' পালার নাচ দেখাই। এই পালার অভিনয় দেখাতে অনেকগুলো পুতুল লাগে। তখন দলে অনেকগুলো, হরেক রকম পুতুল থাকত।
এখন আর অত লাগে না। এখন এই শিল্পের কদর কমেছে। গ্রামে আর আগের মতো পুতুলনাচের আয়োজন হয় না। এখন মেলা-পার্বণ উপলক্ষে কোনোরকমে টিকে আছে শিল্পটি। আগের নিয়মে পুতুলনাচ প্রদর্শনীর কথা আর ভাবাও যায় না। এখন দর্শনীর বিনিময়ে পুতুলনাচ হয়। কোথাও ১০ টাকার টিকিট, আবার কোথাও তারও বেশি ২০ টাকায় টিকিট বিক্রি করা যায়।
প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়টি শো করা যায়। এক একটি শোতে গোটা পঞ্চাশেক লোক আসে। তাতে খরচ বাদ দিয়ে তেমনটা আর থাকে না। ১২ জন স্টাফ বেতন, টিকিট ছাপা, প্যান্ডেল তৈরি করা, মঞ্চ বাঁধা—এতে যে খরচ যায়, তা পোষানো দায়। এ ছাড়া প্রচারের খরচটাও এখন কম যায় না। ইদানীং নাচের প্রচলন ঘটেছে। পুতুলনাচের আসরে এ এক বিড়ম্বনা। কিন্তু নাচ না থাকলে শহুরে দর্শক আসবেই না। গ্রামের মেলা আর শহুরে মেলার মধ্যে পার্থক্য অনেক। ফলে আমরা পুতুলনাচের মালিকেরাও চালাক হয়ে গেছি। দর্শক ডেকে দুই-তিনটা নাচ-গান দিয়ে, শেষে চার-পাঁচটা পুতুল এনে সামান্য নাচাই। এতে সময় বাঁচে, শো বেশি করা যায়, আবার সূত্রধরেরও শ্রম কম যায়। বাদ্যযন্ত্র যারা বাজায় তাদের অবশ্য কষ্ট একটু বেশিই হয়।
তা হোক। টাকা একটু বেশি দিয়ে পুষিয়ে দিই। এর ফলে পুতুলনাচের আসরে আগে যেভাবে যাত্রার অংশবিশেষ করতাম তা এখন আর করতে পারি না। আগে রূপবান, লাইলি মজনু, রাখাল বন্ধু, মহুয়া, বেহুলা সুন্দরী, সত্ মা চরিত্র যাত্রার অংশ দেখাতাম। এখন একটা বাউলগান, নৌকাবাইচ, সাপখেলা, বরবধূ—এই জাতীয় জোড়াতালির অনুষ্ঠান দিয়ে শেষ করে দিই। বুঝি, এও এক প্রকার প্রতারণা। তবু সময়ের সঙ্গে তাল রেখে চলতে গিয়ে করতে হচ্ছে।
টেলিভিশনে পাপেট শো দেখি। ভালো লাগে। কিন্তু ওতে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ কোথায়? আমাদের যদি সরকারিভাবে নেকনজরে দেখা হতো, তাহলে পুতুলনাচ আবার আগের অবস্থানে ফিরে যেত। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বানী বীণা, সাতক্ষীরার নিউ রংমহল পুতুলনাচ দলে সুতোয় টানা পুতুলের নাচ-গান মনোযোগ দিয়ে দেখেছি। সূত্রধরের অপূর্ব টেকনিক আমাকে মুগ্ধ করেছে। কিন্তু নাচের নগ্নতায় বড়ই ব্যথিত হয়েছি। আমার বাবার সঙ্গে পুতুল নাচাতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধনমিয়া সরদারের রয়েল বীণা পুতুলনাচের দলের সঙ্গে মেলায় প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। তখন কোনো রকম নাচ-গান করতে হয়নি। কোনো কোনো প্যান্ডেলে একজন শিশুশিল্পীর পর্যায়ের কাউকে দিয়ে একটা সংগীত পরিবেশন করে নিতাম। এরপর পেছনের বক্সমঞ্চ থেকে (গ্রিনমঞ্চ) সামনের উদ্যান মঞ্চে (মূল মঞ্চ) পুতুলের প্রবেশ ঘটাতাম। এটা করতাম পাকিস্তানের শেষ দিকে এসে। এর আগে সামনের উদ্যানমঞ্চখ্যাত এই মঞ্চটির কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এটা ধীরে ধীরে বাধ্যতামূলক মঞ্চে পরিণত হয়েছে। শুধু মেয়েদের নাচ-গানের জন্য। আমরা এই জাতীয় নাচগান বর্জন করতে চাই। তার জন্য সেই রকম পরিবেশ চাই।
লোকশিল্প নিয়ে লোকমানসের সঙ্গে মিশে কাজ করতে চাই। পুতুলনাচ আবার গ্রামে ফিরে যাক—এটাই কামনা। স্কুল, মন্দির, বারোয়ারিতলা, গ্রামের মাতবরদের দহলিজ কিংবা চৈত্রসংক্রান্তি, মহরম, পয়লা বৈশাখসহ গ্রামীণ মেলাতে থেকে পুতুলনাচের চর্চা করতে চাই। আমার দলের সূত্রধর দুজন, বিপ্লব ও ফরিদা, অন্য কোনো কাজ জানে না। ওরা যাত্রাশিল্পীদের মতো সামনের মানুষ না। ওরা পেছনের মানুষ। ওদের কেউ দেখে না। দেখে ওদের হাতের আঙুলের কারুকার্য। শোনে ওদের চটার বাঁশি কিংবা পাতার বাঁশির ডাক, গান, কথোপকথন। একসময় বছরজুড়ে পুতুলনাচ দেখাতে পারতাম। এখন ছয় মাস পারি না। ফলে ওরাও ছয় মাসের মতো ছুটি পায়। তা বলে ওদের বাঁশির ডাক, হাতের টেকনিক কিন্তু ওরা ভোলে না। কাজ শুরু হলে দলে এসে ঠিকই পুতুল নাচায়। একটা একটা করে পুতুলের পোশাক পাল্টায়। একই পুতুল শুধু পোশাকের গুণে ভিন্ন রূপ পায়। একটু আগে যে ছিল রাজা; মুহূর্তে পোশাক পাল্টে দিয়ে তাকে সাজানো হচ্ছে প্রজা। অনুরূপ রানিকে বানানো হচ্ছে দাসী। তবে সুতোয় টানা তারের পুতুলের পোশাক থাকে পূর্ব নির্ধারিত। যে অনুষ্ঠানে যে জাতীয় পালা হোক, গান হোক কিংবা নৃত্য, যুদ্ধ হোক—পুতুলের সেই চরিত্রানুযায়ী সাজপোশাক পরানো থাকে। আমার দলে এখন ২৫টির মতো পুতুল আছে। সবগুলো অনুষ্ঠানে কাজে লাগে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে পুতুল এবং এর উপকরণ সবকিছুরই দাম বেড়ে গেছে। যার ফলে আমরাও খুব সতর্ক থেকে পুতুল নাচাই। যাতে সহজে পুতুলের মুখাবয়বের রং না চটে, পোশাক সহজে ময়লা না হয়। মোট কথা, সময়ের সঙ্গে তাল রেখে পাল্লা দিয়ে আমাদের চলতে হচ্ছে।
অনুলিখন: এমএ মজিদ

পটচিত্র

পটশিল্পে নয় পুরুষ

শম্ভু আচার্য

৪৫০ বছরের পুরোনো আঁকিয়ে আমাদের আচার্য পরিবার। আমার বাবা সুধীর আচার্য। মা কমলা দেবী। জাতি-গোত্র ব্রাহ্মণ, লগ্ন আচার্য। পেশা পঞ্জিকা দেখে বিয়ে বর্ণনা করা। জ্যোতিষকর্ম আর পূর্বপুরুষেরা নির্মাণ করতেন প্রতিমা, আলপনা। দিনবদলের সঙ্গে তাঁরাও বদলালেন বিভিন্ন সময়ে নানা পেশায়। আমি বাবার বড় ছেলে। আমার ছেলে অভিষেক আচার্যও আঁকে। ৪৫০ বছরে যা হয়নি, আমার জীবনে তা ঘটেছে সাধনার বর রূপে। 
৪৫০ বছর আগে আচার্যের প্রথম পুরুষ পট আঁকাকে পেশা করেছিলেন। তখনকার পটচিত্র ছিল সম্পূর্ণ ধর্মভিত্তিক। সময়ের পরিবর্তনে তাঁরা একদিন হয়ে ওঠেন পটুয়া। সনাতন ধর্ম আর সহজাত লোককৃষ্টির বিষয় নিয়েই ছিল পটচিত্রের অন্যতম আকর্ষণ। এভাবেই শিল্পের আত্মবিশ্লেষণ পটে সত্য ও বাস্তবে রূপ নেয়। 
আমাদের বাংলার 'লোক' ফোক আর পুরাণ হাজার বছরের চিরায়ত কৃষ্টি, যা যুগ যুগ ধরে বয়ে চলেছে। এসব শিল্প-সংস্কৃতির মধ্যে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের যে আদিলগ্ন পরিসর, তারই একটি ধারা এই পট। পরবর্তী সময়ে চমৎকার পরিবেশনার ভেতর দিয়ে গ্রামবাংলার জনমানুষের জনপ্রিয় ও সামাজিক চাহিদা পূরণ করার একটা অবস্থান ক্রমশ গড়ে ওঠে। নিজস্ব সত্তার আত্মপরিচয়ে ধারাবাহিক একটা চরিত্র গড়ে উঠতে থাকে এসব পটচিত্রে, যা আজ কৌশলগত ধারায় নিজেকে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এই চিত্রে যেমন আছে বাস্তব জীবনের সংলগ্নতা, তেমনি অন্য প্রান্তে গড়ে উঠেছে সাধিত স্বপ্নের প্রাসঙ্গিক ভাবনা। 
আমি ছয় বছর বয়সে বাবার সঙ্গী হয়েছি। দিন গেছে চর্চা, সাধনা আর দুঃখ-কষ্টের ভেতর দিয়ে। পটচিত্রকে এই সময়ে পরিচিত করতে পেরে নিজেকে আমি ভাগ্যবান বলে মনে করি। মনে পড়ে পূর্বপুরুষের কথা। জানামতে তাঁরা নয় পুরুষ পট আঁকিয়ে। পূর্বপুরুষ নরসিংদী থেকে মুন্সিগঞ্জের কমলাঘাট রিকাবি বাজারের পাশের কালিন্দিপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন। এঁদের প্রথম আদি পেশা ছিল তাঁতের শাড়িতে নকশা করা। পরে প্রতিমা তৈরি এবং পটচিত্রের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মনে রাখা যায়, পটচিত্র নতুনভাবে তৈরি হয় না, বংশক্রমান্নয়ে এটা গড়ে উঠছে। এখন অনেকেই পটচিত্র আঁকেন, এটা একটা ভালো লক্ষণ।
কঠিন নিয়ম মেনে পটচিত্র আঁকতে হয়। শিশিরভেজা সকালে গোসল করে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে মন্ত্র পরে ধ্যানমগ্ন হতে হয়। পরবর্তী সময়ে ফোটানো জলের সঙ্গে দেশীয় বানানো রং মিশিয়ে ক্যানভাসে প্রয়োগ করতে হয়। অপবিত্র অবস্থায় বা ইচ্ছা করলেই যখন-তখন আঁকা সম্ভব নয়। এই চিত্র আঁকার কিছু নিয়মতান্ত্রিক ব্যাকরণ আছে, যা মেনে এবং শিখে এসব পটচিত্র আঁকতে হয়। ফোক-লোক আচার-কৃষ্টির বিষয় গ্রামবাংলার আবহমানকালের জনমানুষেরই প্রকৃত উৎসব অনুষ্ঠান, যা পরম্পরায় বিভিন্ন পথ ধরে এসেছে নানা মাধ্যম হিসেবে। 
দুই বাংলায় পটচিত্রে কিছুটা ভিন্নতা আছে। তবু পটচিত্রের আদিবিষয়কি সম্পর্ক দুই বাংলায় খুব কাছাকাছি। ইউরোপিয়ান কোনো চিত্রের সঙ্গে পটচিত্রের কোনো মিল নেই বা কোনো প্রভাব নেই। এটা বাংলার মূল সংস্কৃতির ধ্রুপদী দিকনির্দেশনচিত্র হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত।
পটচিত্রের স্বধর্মই বাস্তবকে রূপান্তরিত করা। প্রাকৃতিক ও সাদৃশ্যবোধক লক্ষণগুলো দেশীয় তাৎপর্য নিয়ে মানসিক স্তরে পৌঁছে দেওয়া। স্মৃতি ইচ্ছা কল্পনার চেতনে-অবচেতনে প্রসারিত হতে থাকে নিরবধি। ঠিক তেমনি রূপকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে একটি অনির্বচনীয় বোধ জেগে ওঠে। সম্ভবত এ কারণেই চেনা কিছুকে অচেনা মনে হয়। এই অচেনা অপরিচয়ের অনুভূতি একদিকে যেমন স্থির, অন্যদিকে লৌকিক অর্থে একাধিক সংকেতের সম্ভাবনা গড়ে তোলা। পটচিত্র তাঁর বিষয়ের দিক থেকে পরিষ্কার ও অর্থবহ।
এই শিল্প দেশীয় কৃষ্টির ধ্রুপদী শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাক, এই আমার প্রত্যাশা। 
অনুলিখন: মাহবুব কামরান

ধাতু-তক্ষণ

ধাতুতে স্বপ্নের আঁচড়

সুকান্ত বণিক

সুকান্ত বণিকের শিল্পজগৎআমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বংশাই নদী। এই নদীর জলে সাঁতার কেটে পার হয়েছে আমাদের শৈশব। সেই শৈশব আজও যেন পেতলের একটি বেল্ট দিয়ে বাঁধা—তবে একদিন পেতলের ওই বেল্টটিকে যে লুকিয়ে রেখেছিলাম ছেলেবেলার খেলার অবসরে, সেই বেল্টটি আমি আজও পাইনি। আজ রাধা-কৃষ্ণ, গণেশ, শিব, মনসা আর বুদ্ধমূর্তি তৈরিতে সময় কেটে যায়। যখন অবকাশ মেলে, আমার পেতলের বেল্টটিকে বারবার খুঁজে ফিরি।
বেল্টটি এখন বংশাই নদীর মতোই মৃত। কিন্তু মানুষের ছেলেবেলার কি মৃত্যু ঘটে? কাজের ফাঁকফোকরে কেন যেন স্মৃতি হয়ে হানা দেয় আমার ছেলেবেলা, আমার সেই হারানো বেল্ট। এই যে আমি সুকান্ত বণিক, ৩৭ বছর বয়সে পৌঁছে ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখি, কাঁসা-পেতল, মোমের গন্ধ, ঢালাইয়ের কাজ আর পেতলের মূর্তির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে করতে কবে যেন বড় হয়ে গেছি!
ঐতিহ্যগতভাবে আমাদের পরিবার কাঁসা-পেতলের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। ঠিক কবে বা কে প্রথম আমাদের পরিবারকে এই মেটাল শিল্প-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত করেন, তার সঠিক লেখাজোখা আজ আর পাওয়া যাবে না। তবে পাঁচ প্রজন্মের বংশলতিকার হিসাব শনাক্ত করে এটুকু বলতে পারি, এই শিল্প-ঘরানার সঙ্গে আমাদের পরিবারের সম্পর্ক ২০০ বছরের কম নয়। সেই যে লালবিহারী বণিক, শরত্চন্দ্র বণিক, সর্বমোহন বণিক এবং আমার বাবা ফণীভূষণ বণিক—পূর্বপুরুষের এই সমৃদ্ধ পরম্পরার মাধ্যমে কাঁসা-পেতলের কারুশিল্পের সঙ্গে আজ জড়িয়ে আছে আমার ক্ষুদ্র নামটিও।
১৯৭৩ সালের ১৭ জানুয়ারি আমার জন্ম। যখন এতটুকুন ছিলাম, সে থেকে দেখে আসছি, আমাদের দোতলা বাড়ির এক কোণে আপন মনে কাজ করে চলেছেন বাবা-জেঠারা। কখনো তাঁরা মোমের সাজি তৈরি করছেন, সেই সাজির ওপর সাজাচ্ছেন মাটির প্রলেপ, আবার আগুনে পোড়ানোর পর তাতে পেতলের ঢালাই দিচ্ছেন পরম মমতা আর গভীর নিষ্ঠায়—এভাবেই কাঁসা-পেতলের গন্ধময় এক ভুবনে গায়ে বংশাই নদীর জল মেখে আমি বেড়ে উঠেছি।
১৯৮৪-৮৫ সাল হবে। এক সাদা মেমসাহেব বাবার শিল্পকর্মে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে একটি রঙিন টেলিভিশন উপহার দিলেন। টেলিভিশন সে সময় আমাদের কাছে বিশাল ব্যাপার, বিরাট আনন্দদায়ক ঘটনা। তবে এই ছোট্ট ঘটনাটির মধ্য দিয়েই সেদিন আমার কৈশোর-উত্তীর্ণ মন বুঝেছিল এই শিল্পের মহিমা। পুরোপুরি না হলেও অন্তত এটুকু সেদিন সে বুঝতে পেরেছিল যে এই শিল্পের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা অন্যদের মুগ্ধ-বিস্ময়াবিভূত করতে পারে। তবে পারিবারিক এই পেশার সঙ্গে পরবর্তীকালে আমার জীবন জড়িয়ে যাবে—এমন ভাবনা মাথায় আসেনি সেদিন।
কাঁসা-পেতলের শিল্পের সঙ্গে আমি নিজেকে যুক্ত করেছি নিতান্ত পারিবারিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে। '৯৩-এ জেঠা সাক্ষীগোপাল বণিকের মৃত্যু হলো। আমাদের পরিবারে নেমে এল তীব্র অনটন। সেই দুর্যোগমুহূর্তে আমার বাবা ফণীভূষণ বণিক তাঁর পৈতৃক ব্যবসায় দেখছিলেন শুধু লোকসানের অঙ্ক। বস্তুত প্রযুক্তির নানা উত্কর্ষ ও আধুনিকায়নের ফলে কাঁসা-পেতলের প্রাচীন শিল্পটি জনরুচিতে তত দিনে 'সেকেলে' হয়ে যাচ্ছিল। সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে শ্রমিক হিসেবে সিঙ্গাপুর যাওয়ার জন্য ঘোরাঘুরি করলাম কিছুদিন। কিন্তু ভাগ্যদেবী ছিলেন অপ্রসন্ন। অবশেষে কাঁসা-পেতলের পারিবারিক ব্যবসা নতুনভাবে গড়ে তোলার জন্য বাবার গদিতে বসতে হলো। তখন ভাবনায় এল, ঐতিহ্যকে ঠিক রেখে কীভাবে এই শিল্পকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করে তোলা যায়। এ সময় আমার সঙ্গে পরিচয় ঘটে আমেরিকান নাগরিক মাথিও এস ফ্রিডমেনের। এন্টিক সংগ্রাহক এই মানুষটি আমাদের কাঁসা-পেতল শিল্পকর্ম দেখেন, মোহিত হন এবং এই শিল্পের শৈল্পিক-বাণিজ্যিক সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন আমাকে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মেটাল কস্টিং: ফাইভ টেকনিক নামে একটি বইও লিখেছেন তিনি। মূলত তাঁর মাধ্যমেই আমেরিকায় পৌঁছে গেল ধামরাইয়ের কাঁসা-পেতলের শিল্প। কাঁসা-পেতলের তৈরি বুদ্ধমূর্তি কিংবা রাধা-কৃষ্ণ মূর্তির ঠাঁই মিলল যুক্তরাষ্ট্রের সাদা দালানকোঠায়।
এরপর হয়তো সাফল্য এসেছে। সরস্বতীর পাশাপাশি দেখা মিলেছে লক্ষ্মীরও। বংশাই নদীতীরবর্তী অখ্যাত জনপদ ধামরাই খ্যাত হয়েছে কাঁসা-পেতলের হলুদাভ আলোয়। আর সেই আলোর ঝলকানি স্পর্শ করে, আমেরিকান দূতাবাসের আমন্ত্রণে ২০০২ সালে আমেরিকার ১০টি রাজ্য ঘুরে ঘুরে দেখেছি ওদের সংস্কৃতি-ঐতিহ্য। কাঁসা-পেতলের শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য বাংলাদেশ ক্রাফট কাউন্সিলের ব্যবস্থাপনায় ২০০৭ সালে নেপালি শিল্পীদের সঙ্গে সংস্কৃতি বিনিময় কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়েছি হিমালয়কন্যার সেই দেশে। এত সব সম্মাননার মধ্যেও বুকে খেদ থেকে যায়। কি আমেরিকা, কি নেপাল—ওদের লৌকিক ঐতিহ্যের চেয়ে আমাদের বাংলাদেশের কাঁসা-পেতলের শিল্পের ঐতিহ্যমূল্য কোনো অংশে কম নয়। এই শিল্প অনেক ক্ষেত্রে আমার দেশের শৈল্পিক ও ঐতিহ্যিক মহিমাকে আরও ওপরে তুলে ধরে। যদিও আমাদের এই সম্ভাবনাময় শিল্পটি আজও পুরোপুরি শিল্পের আকার পায়নি। আক্ষেপ এই, কাঁসা-পেতলে তৈরি এই নান্দনিক শিল্পকর্মের অধিকাংশ ক্রেতাই বিদেশি। দিনমান শ্রম ও ঘামে আমরা যে মূর্তিগুলো মূর্ত করে তুলি, শেষাবধি তা শোভা পায় বিদেশ-বিভুঁইয়ে।
আমাদের দেশে বিপুল অর্থ খরচ করে বিভিন্ন শৌখিন শিল্পদ্রব্য কেনার বিষয়ে আগ্রহী মানুষ কম নেই। অথচ মেটালে প্রস্তুত করা আমাদের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকর্ম ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতা খুঁজে পাওয়া কঠিন।
এখানে বলে রাখা ভালো, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও নেপালেও কাঁসা-পেতলের শিল্প রয়েছে। তবে ওদের সঙ্গে আমাদের মৌলিক পার্থক্য এই, একই ডায়েস বা ছাঁচ দিয়ে ওরা অসংখ্য শিল্পকর্ম তৈরি করে। কিন্তু আমাদের পদ্ধতিটি একেবারেই ভিন্ন—হস্তনির্ভর। আমরা একটি ছাঁচ দিয়ে একটি মাত্র শিল্পকর্মই প্রস্তুত করি। ফলে কাঁসা-পেতলের শিল্পে আমাদের নান্দনিকতা অন্যদের চেয়ে সমৃদ্ধ।
আমার পেতলের বেল্টটি হারিয়ে গিয়েছিল একদিন। সেই বেল্টের স্মৃতি বুকে নিয়ে বারবার স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন ভেঙে যায়। আজ চার বছর ধরে কাঁসা-পেতলের শিল্প রপ্তানির ক্ষেত্রে আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সরকার যদি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে এই সম্ভাবনাময় শিল্পের ব্যাপারে একটু সদয় হয়, বিভিন্ন বাণিজ্য মেলায় যদি মেটাল শিল্পের জন্য পৃথক কর্নারের ব্যবস্থা রাখা যায়, তবে দীর্ঘকাল বাহিত এই কাঁসা-পেতলের শিল্পের সুষমাও ছড়িয়ে পড়তে পারে দশদিগন্তে। অন্যদিকে কাঁসা-পেতলের শিল্পের কাঁচামাল আমাদের অগোচরেই পাচার হয়ে যায়। এই শিল্পের প্রতিষ্ঠার জন্য পাচার রোধ করাও জরুরি।
আমি এক অভাজন। সম্বলও তেমন নেই—স্বপ্ন ছাড়া। দুচোখে তাই মুঠি মুঠি স্বপ্ন লেগে আছে। সেই স্বপ্নে দেখতে পাই, একদিন যে বালক তার পেতলের বেল্টটি হারিয়ে ফেলেছিল, যে বেল্টটি সে খুঁজে চলেছে আশৈশব—পেতলের সেই বেল্টের বদলে এখন সে তাকিয়ে আছে অসংখ্য অনিন্দ্য কাঁসা-পেতলের মূর্তির দিকে। যে মূর্তি লৌকিক বাংলার শৌর্য-গৌরবকেই মূর্ত করে তুলছে বারবার, বিশ্বের অবারিত আকাশে।

নীলু ঠাকুর
অষ্টাদশ - উনবিংশ শতক
কবি নীলু ঠাকুর - হরু ঠাকুর ও রাম বসু প্রভৃতির পরবর্তী কবিওয়ালাদের মধ্যে অন্যতম | 

ইনি প্রথমে হরু ঠাকুরের দলে ছিলেনপরে নিজের নামে দল বাঁধেন | নিজের দল বাঁধার পরও 
হরু ঠাকুর তাঁকে গান রচনা করে দিতেন | 

নিলু ঠাকুরের এক ভাই ছিলেন | তাঁর নাম রামপ্রসাদ | রামপ্রসাদও ভাইয়ের কবির দলে থাকতেন | 
সেই 
কারণে এই দল 'নিলুরামপ্রসাদি দল' নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল |  নিলু ঠাকুরের নিজের রচিত 
গান বড়ো ছিল না | প্রসিদ্ধ কবি
গানের বাঁধনদার কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য তাঁর দলের গান রচনা করে 
দিতেন |



.                                      --- উত্স:  
দুর্গাদাস লাহিড়ি সম্পাদিত "বাঙালীর গান" ১৯০৫  

.                                                   


dakshinbanga

next story






জারিগান

জারিগানে চার যুগ

আবদুর রহমান বয়াতি | তারিখ: ১৪-০৪-২০১০

দেখতে দেখতে বয়স আমার ৭০ পার হলো। ১৯৩৯ সালের জানুয়ারির এক তারিখে আমার জন্ম। চার যুগ ধরে বাংলার মঞ্চ মাতাইছি। এখন কথা কইতে পারি না। সব কথাই শুনতে পাই, বুঝতে পাই, কইতে চাই কিন্তু পারি না। সবচেয়ে বড় কষ্ট, এখন গান গাইতে পারি না। 
আমার একটা গান আছে—দেহঘড়ি। গানটা আমাকে কিছু দিছে। এর জন্য অনেক প্রশংসাই পাইছি। এর বাইরে আরও অনেক গান গাইলাম। এ দেশের সবখানেই গান করছি। আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানসহ আফতাবের গান, লালনগীতি, কবিগান, জারিগান, বিচারগান, সারি, মারফতি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী, এর বাইরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, বৃক্ষরোপণ, নির্বাচনী, টিকাদান, দুর্যোগ-বন্যা—এসব বিষয়ে গান বানাইছি আর গাইছি।
সব মিলাইয়া শ তিন-চাইর শ হইব আমার লেখা গান। 'মরণের কথা কেন স্মরণ করো না', 'আমার এত সাধের রংমহল ঘর ইঁদুরে কেটে বিনাশ করতেছে', 'আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে', 'আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণের ধৈর্য মানে না', 'হাটের মাঝে ভাঙল হাঁড়ি, টাকুরটুকুর বাজে ঢোল', 'আয় রে পাগলের দলে আয়', 'ঘুড্ডি হয় তিন তালা', 'কাম কামেলা খেলছে খেলা বাতাস পাইয়া', 'বাবায় আমায় দিল বিয়ারে, বুড়া জামাই চাইয়া', 'আমায় এত দুঃখ দিলি বন্ধুরে', 'মনপাগলে কাঁটাবনে মধু খাইতে যাইয়ো না', 'আমাদের বাংলাদেশের গান'—এ রকম আরও অনেক গান সারা দেশের মানুষ শুনছে।
আমার গানের মূলভাব হইল 'মানুষ'। কইতে আইলাম, কই যামু, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সব এক, জাত নাই, ধর্ম নাই, সবাই মানুষ একই।
আব্বার বেশির ভাগ গানই দেহতত্ত্বের গান। আমার দেহঘড়ি গানটিও মূলত দেহতত্ত্বের গান। দেহের ভেতর যে কলকব্জা রয়েছে, তারই বর্ণনা। জারিগানে আবদুল গণি, খবির দেওয়ান, মোসলেম উদ্দিন, সাইদুর রহমান; পালাগানে খালেক দেওয়ান, রজব আলী দেওয়ান, দলিলুদ্দিন বয়াতি, হালিম বয়াতি, রশিদ সরকার, সমশের আলি, আলেক দেওয়ান, ননী ঠাকুর, মারফত আলী, আলাউদ্দিন বয়াতি, মাখন দেওয়ান, আবুল সরকার, পরেশ আলী দেওয়ান—এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে গান গাইছি। বিচ্ছেদী গানও গাইছ। ওটা পালাগানেরই একটা অংশ। পালাগান গাইতে গাইতে, রাত দুইটার পর বিচ্ছেদী গান গাওয়া 
বিজয় বিচ্ছেদী গান খুব নাম করেছে। কবিয়াল বিজয় সরকারের গানকে 'বিজয় বিচ্ছেদ' বলে। আর আমার গানগুলো একটু হালকা, মানে পাবলিক শুনতে খুব মজা পাইত। যেমন 'পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী, প্রাণ সজনী, পিরিতে কইরাছে কলঙ্কিনী', 'আমি ভুলি ভুলি, মনে করি সইগো, প্রাণের ধৈর্য মানে না, বন্ধুরে ভুলিতে পারি না'—এ রকম ষাইট-সত্তরটা বিচ্ছেদী গান বানাইছি। 
নবী-রসুল, আউলিয়া, সাহাবিদের নিয়ে অনেক জারিগান গাইছি। জারিগানের প্রায় ২০০ ক্যাসেট বাজারে আছে। আমাকে তো একসময় জারিসম্রাটও কওয়া হইত। অন্য গানের ক্যাসেটও পাঁচ-ছয় শ হইব।
অ্যান কোম্পানি, ডন, দোয়েল, এইচআরসি, সাউন্ডটেক, এটিএন মিউজিকসহ বিভিন্ন কোম্পানিতে ক্যাসেট আছে। ২৫-৩০ বছর আগের অল্প টাকার চুক্তিতে রেকর্ড হতো। আমি তখন একেক দিন একটা কইরা ক্যাসেট করতাম। ক্যাসেটে কবি আলাউদ্দিন বয়াতি, জালালুদ্দিন, খালেক দেওয়ান সাহেবের গান, রজব আলী দেওয়ান, মালেক দেওয়ান এ রকম প্রবীণ যাঁরা ছিলেন তাঁদের গানও গাইছি। তবে আমার গুরু আলাউদ্দিন বয়াতির গানই বেশি গাইছি। তাঁর প্রায় এক হাজার গান আছে। চার খণ্ড বইতে এগুলো ছাপা হইছে। ভালো কবি ছিলেন তিনি।
আমেরিকা, স্কটল্যান্ড, জাপান, রাশিয়া, ইরান, ভারত, জার্মান, ইংল্যান্ড, বাহরাইন, আবুধাবি, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, কাতার—সব মিলে ৩০/৩৫ দেশে গান লইয়া ঘুরছি। ।
সিনেমার জন্যই গান গাইছি। সিনেমায় অভিনয়ও করছি। মাসুদ পারভেজের গুনাহগার ছবিতে গাইছি 'আল্লা মানুষ বানাইয়া খেলছ যারে লইয়া/সেই মানুষ কেমনে গুনাহগার', আমজাদ হোসেনের কসাই ছবিতে জারি সুরে গান 'আরে প্রথমে বন্দনা করি আল্লা মালেক সাঁই/যাঁর উপাস্য ত্রিভুবনে অন্য কেহ নাই', হূদয় থেকে হূদয় ছবিতে বিজয় সরকারের 'এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে/সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে', খান আতার ছবি ফারাক্কায় 'মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি' গানটা গাইছি। হাফিজ উদ্দিনের অসতী ছবিতেও একটা গান আছে। 
এখন বয়স হয়েছে। অধিকাংশ লোকশিল্পীর শেষকাল দারিদ্র্যে কাটে। আমার ব্যাপারেও হয়তো তেমন কিছু ঘটেছে। আমাদের আদিনিবাস বিক্রমপুরে। আমাদের চারতলা বিল্ডিং ছিল। আমার বাবা তোতা মিয়া হোটেলের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৯ সালে সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে এখন ভাড়াবাসায় থাকি। ভাবলেই চোখে জল আসে। আমি গান নিয়ে পইড়া ছিলাম। অন্য কোনো পথে যাই নাই। আমার ছেলেও এই পথেই আছে।
২০০৩ সালে অসুস্থ হইয়া পড়ি। ডাক্তার বলে ব্রেইনে রক্তের ছিটা জইমা আছে। এগুলো ধীরে ধীরে কাইটা যাইব, সাত বছর চইলা গেল, ভালো তো হয় না। বিদেশ যাইতে পারলে হয়তো ভালো হইতে পারতাম।
অসুস্থ হওয়ার পরে আর গান গাইতে পারি না। শিষ্যরা মাঝেমধ্যে আসে। আমার ছেলে আলমও গান করে। ও আমার লগে হারমোনিয়াম বাজাইছে। এখন কি-বোর্ড বাজায়। যা পায়, তা-ই দিয়ে চলি। এভাবে আর কত দিন, জানি না!
অনুলিখন: সাইম রানা



Best 


প্রসঙ্গ বাংলা গান নিয়ে কিছু কথা

বিশ্বজিৎ রায়

 

 

করুণাময় গোস্বামী

হালআমলে বাংলাগান যে চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে চলেছে এর কারণ প্রকৃত সমালোচক ও সঙ্গীতপ্রেমীর অভাব। এ-ছাড়া পত্র-পত্রিকার স্থানাভাব (সংগীতবিষয়ক লেখা) আরেকটি প্রধান কারণ। রবীন্দ্রনাথের হাতে গান লেখা না হলে আজকের উন্নাসিকরা হয়তো গানকে জাতেই তুলতেন না। এসবই হয়তো নিছক ক্ষোভের কথা মনে হতে পারে কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। 

আমরা মুখে বলি, হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে আমাদের বাংলা গানের। কিন্তু এ-কথা পুরোপুরি আস্থার সঙ্গে বলতে পারি না। আস্থা আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই নেই, তারপরও মুখে বলি। কেননা এই আস্থার মূল থেকে বলতে হলে গভীরভাবে জানতে হয়, যুক্তি দিয়ে বিচার করতে হয়। আমাদের আস্থার এই জায়গায় বিরাট ফাটল রয়েছে। আমরা সকলেই বাংলা গান শুনি, শুনে মন্তব্য করে বসি। মন্তব্যের যৌক্তিকতা কতটুকু তা নিয়ে যথার্থ ব্যাখ্যা নেই, বা দর্শন নেই। বাক্স্বাধীনতার অবাধ যুগে সকলেই মন্তব্য করবেন নিজের মতো করে এটা যেমন সত্যি, তেমনি যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা থাকাও ততটা জরুরি। না হলে, পাগলের প্রলাপ হয়ে দাঁড়ায় পুরো বিষয়টাই।        

শুধু গান করার জন্য নয়, গান শোনা বা বোঝার জন্যও ব্যাকরণ প্রয়োজন। কিছুটা ভিন্ন হলেও গানের ব্যাকরণ মেনে, ছন্দ মেনেই পথ চলতে হয়। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পার হচ্ছে কোনো না কোনো একটি পদ্ধতি ও ছন্দের মধ্য দিয়েÑসেই গতিময়তায় ছন্দপতন হলেই থেমে যেতে পারে জীবনের চাকা। পদ্ধতি বা ব্যাকরণ মেনে না চললে জীবনে যেমন বিপর্যয় দেখা দিতে পারে, তেমনি মন্তব্য করার প্রক্রিয়াটি পারে পাগলের প্রলাপে রূপান্তরিত হতে। গান করা, শোনা বা বোঝার ক্ষেত্রটাও সেরূপ। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়, ধুর্জ্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অমিয়নাথ সান্যাল, দিলীপকুমার রায়, ওয়াহিদুল হক প্রমুখেরা সঙ্গীত সমালোচনার যে অধ্যায়টি রচনা করলেন তা কোনোভাবেই ব্যাকরণ না জেনে নয়। গানকে গান হয়ে উঠার ক্ষেত্রে যেমন শিল্পীর মনন ও কণ্ঠের গঠনটি সুচারু হওয়া প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন শ্রোতার মননের গঠনটিও। এ দুয়ের বোঝাপড়া একসূত্রে বাঁধা পড়লেই গান হয়ে ওঠে যথার্থ। আর এই বোঝাপড়া একটা নিছক ব্যাকরণের সূত্র ধরে হলেও মন্তব্যকে যুক্তির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।

কথাটি এই প্রসঙ্গে বলা যে, আজকাল গানবাজনার জগতটি যখন বাজনাগান দখল করে নিয়েছে তখন নিশ্চয়ই শ্রোতার মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে বলে বোধ করি। কিন্তু এই পরিবর্তন যে একেবারেই ব্যাকরণসম্মত নয় -এই কথাটি জোর দিয়ে বলার লোকের বড়ই অভাব। শ্রোতা ক্রমশ উল্টোমুখো হয়ে ছুটতে শুরু করেছে। শ্রোতার মননশীলতার জগতটি দখল করে নিয়েছে দেখার জগত। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, তাকে যদি কেউ দৃশ্য জগৎ আর শ্রব্য জগতের মধ্যে একটাকে ছেড়ে দিতে বলেন, তাহলে তিনি দৃশ্যজগত ছেড়ে দেবেন। সংগীতকলা শ্রোতার কল্পনা শক্তিকে জাগিয়ে তোলে, ফলে এটা দৃশ্যমান কোনো বিষয় নয়। যেদিন থেকে দৃষ্টির সীমানায় এই কলাকে হাজির করা হল সেদিন থেকে শ্রোতার কল্পনা শক্তি হারাতে বসল। শুধু কি তাই ? হারাতে বসল সংগীতের স্থায়ীত্বও। চলমান সংসারে গানই কেবল দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করি।                       

গান যেখানে হারিয়ে যাচ্ছে সেখানে গান নিয়ে লেখা বা পড়ার হাল কেমন হবে তা বলাই বাহুল্য। দুই বাংলা জুড়ে মাত্র হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ গান নিয়ে লিখছেন। তাঁদের ভাবনা জগতে পাখা মেলে ওড়ার পাঠকও খুব সীমিত। লিখছেন সুধীর চক্রবর্তী, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, করুণাময় গোস্বামী, সন্জীদা খাতুন, মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, মৃদুল কান্তি চক্রবর্তী প্রমুখ। অথচ কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার কিংবা প্রবন্ধকারের কোনো অভাব তো চোখে পড়ে না। হালআমলে বাংলাগান যে চলতি হাওয়ার পন্থী হয়ে চলেছে এর কারণ প্রকৃত সমালোচক ও সংগীতপ্রেমীর অভাব। এ-ছাড়া পত্র-পত্রিকার স্থানাভাব (সংগীতবিষয়ক লেখা) আরেকটি প্রধান কারণ। রবীন্দ্রনাথের হাতে গান লেখা না হলে আজকের উন্নাসিকরা হয়তো গানকে জাতেই তুলতেন না। এ-সবই হয়তো নিছক ক্ষোভের কথা মনে হতে পারে কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। প্রসঙ্গক্রমে ওয়াহিদুল হকের কথা মনে পড়ে গান নিয়ে ভাবনাচিন্তা ছিল যাঁর স্বভাবজাত। সেই মানুষটি সংগঠনপ্রেমী হয়ে উঠলেন। কেবল রবীন্দ্রনাথই হয়ে উঠল তাঁর চিন্তা ও কর্ম প্রসারের ক্ষেত্র।

সংগীত বিষয়ে আলোচনা কিংবা লেখা চাইলে ওয়াহিদুল হক বিমুখ করতেন না কাউকে। সঙ্গীত নিয়ে ভাবনার বিষয়টি তাঁর এতই গভীরের ছিল যে, কলম ধরলেই সর সর করে লেখা হয়ে যেতো। উঁচুমানের সে-সব লেখা আজকে অনেকেরই কাছেই সংগ্রহে রয়েছে। কিন্তু সংগঠন গড়ার কারিগর যিনি তাঁর কাছে বই বের করার উপযোগী চিন্তার সময় কোথায়? বই লেখার চেয়ে সংগঠন গড়ার ক্ষেত্রে তিনি শ্রম দিয়েছেন বেশি। এছাড়া রবীন্দ্রগানের প্রসারে ঘুরে বেড়িয়েছেন বাংলাদেশের পুরোটাই। তাঁরই সহযাত্রী হয়ে দীর্ঘকাল পথ চলেছেন সংগীত গবেষক করুণাময় গোস্বামী। পেশাগত কারণেই বোধ হয় বাইরে না ছুটে তিনি কেবল লেখার ক্ষেত্রে মনোযোগী। অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি লেখালেখির কাজও চালিয়ে যাচ্ছেন। সে কারণেই সংগীত বিষয়ে তাঁর লেখা কয়েকটি বই আছে আমাদের কাছে। এতে  আমরা কিছুটা স্বস্তি লাভ করি।                   

বইটির ভূমিকা পড়ে জানা গেল এর বেশ কটি লেখা ফরমেশি। মোট ছটি প্রবন্ধ প্রসঙ্গ বাংলা গান বইয়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বহুল তথ্যসম্বলিত, বহু বিষয়ের অবতারণা ও স্বচক্ষে দেখা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অজানা অনেক ঘটনাপঞ্জি এই প্রবন্ধগুলোতে হাজির করা হয়েছে। সংগীত বিষয়ে তাঁর রচনা পাঠ আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। লেখার পরতে পরতে উপমা সংযোজন ও ঐতিহাসিক মন্তব্য বা ঘটনার উত্থাপন তাঁর প্রবন্ধে ভিন্ন মাত্রার সৌন্দর্য বাড়ায়। পড়াশোনার স্তরটি যে তাঁর বিশাল সেই পরিচয় তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ সঙ্গীতকোষ থেকে প্রসঙ্গ বাংলা গান পর্যন্ত সবকটি বইয়েই আমরা পাই। সংগীত তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রীয় ক্ষেত্র। ফলে তাঁর সামগ্রিক চিন্তা-ভাবনা, মেধা-মনন, পড়াশোনা, বিচার-বিশ্লেষণ সকল কিছুই সংগীতকে ঘিরে। অন্য অনেকের মতো কেবল রবীন্দ্রনাথ পর্যন্তই তাঁর জানার পরিসর সীমাবদ্ধ নয়।           

'নাগরিক ধারার বাংলা গান' রচনাটিতে যেমন নিধুবাবু-রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের বিষয়টি উঠে এসেছে, তেমনি উঠে এসেছে সবাক ফিল্ম-সংগীতের পণ্যমূল্যÑগণজাগরণের গান প্রসঙ্গ। তিনি জানাতে চেয়েছেন, নগরকে কেন্দ্র করেই বাংলা গানের প্রধান ধারাসমূহ বিকাশ লাভ করে। এমনকি লোকজ ধারার গান রচয়িতাগণও শহরে বা নগরে বাস করতেন। এর অর্থ এই নয় যে, গ্রাম্যধারার গানের চল সে-সময় ছিল না। এই ধারাটি নিরন্তর প্রবাহিত ছিলই যুগ যুগ ধরে। যাকে বলা হতো দেশি সংগীত। তাঁর মতে, চর্যাগীতি-গীতগোবিন্দ-শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-বৈষ্ণবপদাবলী-শাক্তপদসংগীত-টপ্পা-ধ্রুপদ-খেয়াল-ব্রহ্মসংগীত-দেশাত্মবোধক গান ও আধুনিক গান-গণসংগীত ইত্যাদি সবগুলোকেই নাগরিক ধারার বাংলা গান বলা যায়। এই মন্তব্যের সপক্ষে তিনি নানা যুক্তি দিয়েছেন। চর্যাগীতি মার্গসংগীত। চর্যার রচয়িতাগণ-জয়দেব-বড়ু-চ-ীদাস-চ-ীদাস-রামপ্রসাদ-নিধুবাবু-রাজা রামমোহন রায় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নগর জীবনে থেকেই সংগীত রচনা করেছেন। এই ধারাবাহিকতার ভেতর দিয়েই গড়ে উঠেছে নাগরিক বাংলা গান।                            

কলকাতা নাগরিক গান বিকাশের একমাত্র কেন্দ্রে পরিণত হয় ইস্ট ই-িয়া কোম্পানির যুগেই। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠালগ্নেই নবজাগরণের উদ্ভব। সাহিত্য-সংস্কৃতিতে শুরু হয় নূতনের গান। নাটক শুরু হল সাধারণ রঙ্গালয়ে। গানের সুরে লাগল পাশ্চাত্য সুরের হাওয়া। মানব-মানবীর প্রেমধারার পাশাপাশি দেশাত্মবোধ নিয়ে গান রচনা শুরু হল। এই গানের মধ্য দিয়ে রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত হল সঙ্গীতকলাটি। সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতির এই নবজাগরণ পুরো বাংলাকেই ক্রমে উজ্জীবিত করে তুলল। এই উন্মেষকালে নাগরিক ধারার বাংলা গান পালে হাওয়া লাগিয়ে বহু বিভাজিত ধারায় পেলবতা ছড়াতে লাগল। পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রটি পূর্ণমুক্তির স্বাদ পেল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে আকারমাত্রিক স্বরলিপি এসে বাংলা গানের স্থায়িত্ব বাড়িয়ে দিল।           

এ-সব কথা আলোচনার সূত্র ধরে বলা হলেও কিছুটা খটকা লাগে যখন নাগরিক ধারার বাংলা গান ১৯৪৭ সালে এসে থমকে দাঁড়ায়। রচনাটিতে এই সময়কালটিই বেশি করে প্রাধান্য পাবার কথা। কেননা, তিনি যখন কৈশোর অতিক্রান্ত তখনই তিনি দেশভাগ দেখেছেন, ৫২'র ভাষা আন্দোলন দেখেছেন, ৫৬'র এফডিসি প্রতিষ্ঠা দেখেছেন, ৬৪'র টেলিভিশন কেন্দ্রের যাত্রাশুরু দেখেছেন, ৭১'র দেশ স্বাধীন হবার পর্যায়গুলো তো দেখেছেনই তারপরেও ৩৬টি বছর নাগরিক ধারার বাংলা গানের ক্রমাবর্তন তিনি পরিণত বয়সেই দেখছেন। ফলে বই পড়ে জানার ক্ষেত্রের চেয়ে তাঁর কাছে নিজের বিচার-বিশ্লেষণ দিয়ে আজকের গানের অবস্থানের ব্যাখ্যা করার সুযোগ ছিল। তা থাকলে রচনাটি পূর্ণতা পেতো।                   

  রচনাটি ছাপা হয়েছিল বাংলা একাডেমীর গবেষণা পত্রে। সেই অর্থে বাংলাদেশ পর্বটি সম্পর্কে বিশেষ বিবেচনায় সেখানে বিশদভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল। প্রবন্ধের মধ্যে এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যা এই রচনার জন্য খুব বেশি প্রাসঙ্গিক নয়, তবে জ্ঞানের সীমানা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এর মূল্য অনেক। দেশি সংগীতের বিশাল আলোচনাটি এখানে বৃহৎ রাখার যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাই না। এই সুবৃহৎ প্রবন্ধে মার্গসংগীতেরই ক্রমবিবর্তনের ধারায় নাগরিক ধারার বাংলা গানের উদ্ভব দেখানো হয়েছে। নাগরিক জীবনে বসবাস করে একটি মানুষ পল্লীগীতি রচনা করলে তা কি নাগরিক গান হবে-এই প্রশ্নটি থেকেই যায়। যেহেতু চর্যাগীতি মার্গসংগীতের আদলে রচিত, সেইহেতু শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বা জয়দেবের গীতগোবিন্দও মার্গসংগীতের অনুসারী। এটি পুরোপুরিভাবে মেনে নিতে কষ্ট হয় এজন্যে যে, চ-ীদাসের রাধা যখন গেয়ে ওঠে, 'কেবা শুনাইল শ্যাম নাম' বা 'সই কেমনে ধরিব হিয়া' কিংবা 'এ ঘোর রজনী মেঘের ঘটা' তখন মন বলে ওঠে মার্গ সংগীতের কোনো জোর নেই এই সারল্যকে ফুটিয়ে তুলতে। মার্গ সংগীত রূদ্রাক্ষের মালা তাই বকুল ফুলের সৌরভে তার কোনো স্থান নেই। নগর জীবনে থেকেও মানুষ গ্রামীণ জীবনাচারের মর্মকে অন্তরে ধারণ পারে। লোকজ ধারার আদলে শচীনদেব বর্মন বাঙালি জীবনে যে গান উপহার দিলেন তা নাগরিক ধারারই গান আবার নির্মলেন্দু চৌধুরী বা পূর্ণদাস নাগরিক জীবনে বসবাস করেও যে গানকে কণ্ঠে তুলে নিলেন তা সর্ব অর্থেই দেশি গান। তবে বলতে দ্বিধা নেই যে, এই আলোকিত মানুষটির যে-কোনো রচনাই আমাদের সংগীত চেতনাকে শাণিত করে। এই প্রবন্ধটিতে তা করেছে।                                  

তাঁর দ্বিতীয় প্রবন্ধটির বিষয় আমাদের গান নিয়ে। নামকরণ 'বাংলা গান'। '৪৭ পরবর্তী বিষয় নিয়ে লেখা শুরু হলেও বেশিরভাগ রচনা জুড়েই রবীন্দ্র-নজরুল প্রসঙ্গ আলোচিত হয়েছে। এ-ছাড়া ঢাকার বেশ কটি সংগঠনের সংগীতচর্চার ইতিহাস উঠে এসেছে। এখানেও বাংলা আধুনিক গানের ধারাটির বিশালতা থাকা সত্ত্বেও বিষয়টি যেন সযতেœ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করি। এটি একটি ফরমেশি লেখা। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠার পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে প্রকাশিত স্মারক গ্রন্থে এই রচনাটি ছাপা হয়েছিল। লেখক শুরুতেই বলেছেন, '১৯৫২ থেকে ২০০২ পর্যন্ত যে কালপর্ব, তাতে সংগীতচর্চার ভূমিকা রচনা করেছে পূর্ববর্তী পঞ্চাশ বছর।' এই কথার সূত্র ধরেই প্রবন্ধের ১১ পৃষ্ঠা জুড়ে গত পঞ্চাশ বছরের ফিরিস্তি উল্লেখ করলেন। এই পঞ্চাশ বছরকে ধরা হয়েছে ১৯০১ সাল থেকে। তখন কোলকাতায় গ্রামোফোন কোম্পানি ব্যবসা শুরু করে। ১৯২৭ সালে কোলকাতায় স্থাপিত হয় বেতার কেন্দ্র। ১৯৩১ সাল থেকে শুরু সবাক চলচ্চিত্রের যুগ। ঢাকা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয় ১৯৩৯ সালেÑইত্যকার বিষয়াদি উঠে এসেছে পূর্ববর্তী পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে যার উপর দাঁড়িয়ে আমাদের সংগীতচর্চার ভিত গড়ে উঠেছে। যথার্থ বলা হয়েছে বলেই বোধ করি। ১৯০১ থেকেই কারিগরি উন্নতির পাশাপাশি বাংলা গানের হাওয়ায় গতি সঞ্চার হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ-দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত-নজরুলের পাশাপাশি নানামুখী গানের রচয়িতার সৃষ্টি হল। শ্লীল-অশ্লীল কিছুই বাদ পড়ে নি রচনায়। নাটকই হোক বা ফিল্মই হোক সর্বত্রই গান চাই-তাও আবার বেশি বেশি করে। সে-সময় একটি নাটক বা ফিল্মে গানের ভেতর দিয়েই সংলাপ বেঁধে দেয়া হতো। ফলে, রচয়িতার সংখ্যা যেমন স্ফীত হতে লাগল, তেমনি গায়ক-গায়িকা-সুরকারের সংখ্যাও বাড়তে লাগল।         

এই রচনায়ও লক্ষণীয় বিষয় এই যে, বাংলাদেশ পর্বটি এই আলোচনায় অনেকটা উপেক্ষিত থেকে গেল। বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, ছায়ানট, নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান ছাড়াও উদীচী, ক্রান্তি বা তৎকালীন অনেক সংগঠনের কোনো উল্লেখ এখানে নেই। তেমনি নেই অনেক গানের উল্লেখ যেগুলো চিরকালের হয়ে উঠেছে। যেমন করে রবীন্দ্র-নজরুল কর্মপরিধি নিয়ে আলোচনা হল তেমন করে আধুনিক গান নিয়ে হয় নি। আধুনিক গানের পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত এদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, নিত্যনূতন পাশ্চাত্য যন্ত্রের অর্ন্তভুক্তি, স্বদেশী যন্ত্রের প্রতি অবহেলা, গান রেকর্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সাধিত ব্যাপক পরিবর্তন, এনালগের স্থানে কম্পিউটারাইজড পদ্ধতির আগমন, গায়ন ও চর্চার ক্ষেত্রে নেমে আসা শৈথিল্য ইত্যাদি প্রসঙ্গ নিয়ে এই রচনায় কিছুটা আলোকপাত করা জরুরি ছিল বলে মনে করি।        

বইয়ের তৃতীয় প্রবন্ধ 'ভাটিয়ালি গান'। এই বিষয় নিয়ে সংগীত-সাহিত্যে প্রবন্ধ লেখা হয়েছে খুবই কম। এই রচনাটি ফরমেশি হলেও বিষয়ের গভীরতা, বিভিন্ন সংগীতরীতির তুলনামূলক আলোচনা এবং সর্বোপরি রাগ হিসেবে ভাটিয়ালির উদ্ভব ও বিকাশ নিয়ে চিন্তার স্ফুটন এতে রয়েছে। যাঁরা এই ভাটিয়ালি গান রচনা করেন তাঁদেরকে কোন নামে ডাকা হয়? বাংলার বহু বাউলের গান পাই ভাটিয়ালি সুরে। বরিশাল অঞ্চলের অনেক রচয়িতা বিচ্ছেদী গান রচনা করেছেন-তাঁদেরই বা কোন নামে ডাকা হবে? পদাবলি কীর্তনের যাঁরা রচয়িতা তাঁদের বলে মহাজন বা পদকর্তা। কবিগান যাঁরা লেখেন তাঁদের বলা হয় কবিয়াল। এমনি করে সব গানেরই রচয়িতার একটি নাম পরিচয় থাকা জরুরি, কিন্তু নেই। ভাটি অঞ্চলে বহু রচয়িতা বাউল নামে পরিচিত কিন্তু তাঁদের রচনা ভাটিয়ালি। ভাটিয়ালি গানের মূল বিষয় হল নদী-নৌকা-মানুষ। এর বাইরে ভাটিয়ালি সুরের কাঠামো ব্যবহার করে কীর্তন রচনা থেকে শুরু করে রোমান্টিক প্রেম-বিরহের গান রচনা হচ্ছে। ভাটি অঞ্চলের বাউলরা প্রায় সকলেই গৃহী। সংসারের মধ্যে থেকে নিয়মিত সংগীত রচনা ও সুর যোজনার কাজটি করে চলেছেন। বাউল নামে খ্যাত হলেও তাঁরা কেউই সম্পন্ন অর্থে বাউল নন। বাউলের সাধনা তাঁদের নেই। ভাটিবাংলার নিজস্ব রূপে তাঁরা গান রচনা করেন। আমার ধারণা, নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের হাওড় অঞ্চলকে বাংলাদেশের সংগীতাঞ্চল ঘোষণা দেয়া উচিত। বারো মাসই শোনা যায় সেখানে গান। ঘরে ঘরে চলে চর্চা। প্রায় সব গানই ভাটিয়ালি অঙ্গের। এমন গানপাগল মানুষের বাস আর কোনো অঞ্চলে আছে কি-না জানি না।


তিনি যথার্থই বলেছেন ভাটিয়ালি শুধুই এক প্রকার গান নয়, একটি সংগীতপদ্ধতি। নানা বৈচিত্র্যের ভাটিয়ালি প্রচলন রয়েছে আমাদের এই বাংলায়। ওরে, ওহে, বন্ধুরে, মাঝিরে ইত্যাদি টানসমৃদ্ধ গানের বাইরেও রয়েছে নানা কথামালার ভাটিয়ালি গান। এই গান বাংলার মানুষের মননে গভীর ছাপ ফেলেছে। বৈচিত্র্যপূর্ণ লোকসংগীতের মধ্যে ভাটিয়ালি একটি অন্যতম প্রধান ধারা।                   

  চতুর্থ প্রবন্ধে বাঙালির সংগীতচিন্তার বিবর্তনের ধারাটি উপস্থাপন করে লেখক বাংলা গানের চিন্তকদের সামনে একটি নূতন চিন্তার উন্মেষ ঘটালেন। বাংলাগানের হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বাঙালির সমাজচিন্তার বিবর্তনের পথ ধরে অনেক দূর এগিয়েছে। চর্যার কালে গানের ভেতর দিয়ে যে দর্শনের প্রতিফলন ঘটানো হল, সেই দর্শন আজকে গানের বিভিন্ন প্রকরণে বিন্যস্ত। মানুষের জীবন-জীবিকার পরিবর্তনের সূত্র ধরে এগিয়ে চলেছে দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তন। এই বিবর্তনের পথে শুধুমাত্র সংগীতের আলোচনাটাই প্রধান করে তুলেছেন বইটির লেখক। সাধুবাদ জানাই এই প্রাসঙ্গিক আলোচনার জন্যে। কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় গীতসূত্রসার (১৮৮৫) বইয়ের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন মানুষ কেবল গাইতে চায়, বাজাতে চায় কিন্তু সংগীত বিষয়ে বই পড়াকে বিড়ম্বনা মনে করে। ২০১০ সালে বসে বর্তমান আলোচকের সামনেও সেই অবস্থা। প্রবন্ধকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আমি কিছুটা দ্বিমত পোষণ করি। আক্ষরিক অর্থে বা মোটা দাগে এই পরিবর্তন লক্ষণীয় নয়। যে পরিমাণে সংগীত-শিক্ষার্থী বেড়েছে (একাডেমী পর্যায়ে), সংগীত বিষয়ে পড়ুয়া কলেজ বা বিশ্বদ্যিালয়ে যে সংখ্যায় শিক্ষার্থী রয়েছে, যত জন সংগীত শিল্পী বিভিন্ন গণমাধ্যমে অংশ নিচ্ছে সর্বোপরি যে পরিমাণ শ্রোতা রয়েছে গানেরÑসেই তুলনায় বিক্রি নেই সংগীত বিষয়ক বইয়ের। আবার এই কথাও অনস্বীকার্য যে, সংগীত বিষয় নিয়ে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীগণ সংগীতবিষয়ক বই পড়েন। সংগীত নিয়ে চিন্তাভাবনা করার মানুষেরা পড়েন নিশ্চয়। যদিও বিপুল জনগোষ্ঠীর তুলনায় এর আনুপাতিক হার নিতান্তই কম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নিবন্ধকারের নিজেরই সঙ্গীতকোষসহ বহু বইয়ের একাধিক সংস্করণ বেরুনোর পরও বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না।                     

বিভিন্ন লেখকের লেখনীতে সংগীতচিন্তার যে বিবর্তন তারই উপস্থাপনা এই প্রবন্ধ। বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্ন আলোচনা-সমালোচনার মধ্য দিয়ে এই বিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। সংগীতের সমালোচনা সাহিত্যই কেবল বাঙালির সংগীত চিন্তার বিবর্তনের ইতিহাস নির্মাণ  করেছে-এই বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে আমার। এমন অনেক সৃজনশীল শিল্পী ছিলেন যাঁেদর হাত ধরে সংগীতের নানামুখী কল্যাণ সাধিত হয়েছে। বাঙালির জীবনে রবীন্দ্রনাথ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক মানুষ। তাঁর সংগীতচিন্তা আমাদেরকে সর্বকালেই আলোড়িত করবে। তবে তাঁর সংগীতচিন্তা-ই সর্বশেষ কথা নয়, এবং সংগীত বিবর্তনের পথে একমাত্র পাথেয় নয়। লেখক নিজেই স্বীকার করেছেন, যে হিন্দুস্তানি সংগীতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজস্ব গীতরীতির প্রবর্তন করলেন-যা সমগ্র বাঙালির চৈতন্যে অনিবার্য হয়ে উঠল সেই বাঙালি এখন হিন্দুস্তানি গীতরীতিতে মজেছে এবং বাঙালির নাগরিক গানের বিকাশে অপরিহার্য হয়ে ওঠেছে। তবে এ-কথাও অনস্বীকার্য যে, রবীন্দ্রসংগীত-রবীন্দ্রনাথ এককভাবে বহু সংগীত সমালোচকের জন্ম দিয়েছেন। 

                                    

গণসংগীতের উত্থান এবং সংগীতের বিবর্তনে এর যোগসূত্রিতা কোনও সমালোচকের মতাদর্শে গড়ে ওঠে নি। সমাজ পরিবর্তনের চেতনায় রাজনৈতিক কর্মসূচির ধারায় এই সংগীতের উদ্ভব ঘটেছে। পপ, ডিসকো বা ব্যা-যে নামেই ডাকি এ-সব গানের শ্রেণী চরিত্র এক। সমাজের চাহিদা না থাকলেও এই গানের প্রসারে কোনো বেগ পেতে হয় নি। মাত্র গুটিকয়েক তরুণের প্রচেষ্টায় পাশ্চাত্যের রক এসে এই দেশে ব্যবসায়িক সফলতা পেল এবং সংগীতাঙ্গনে একটা স্থান করে নিল। এই সকল গান নিয়ে কোনো সমালোচনা গ্রন্থ রচিত হয় নি। সমালোচক, ঘটনার আলোকে বিষয়ের মূল্যায়ন করেন মাত্র। বেশ কিছু গুণী সমালোচকের নাম এই প্রবন্ধে উদ্ধৃত হলেও আসে নি আবদুশ শাকুরের নাম-যাঁর বেশ কটি সমালোচনা-গ্রন্থ রয়েছে। এই সীমাবদ্ধতা বাদ দিলে এটিও একটি অসাধারণ রচনা।


লেখকের পঞ্চম প্রবন্ধটি 'বাংলা গানের নূতন রূপ'। রচনাটির মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে হিন্দুস্তানি গান গায়নের স্বাধীনতা ও রবীন্দ্রসংগীতে এর আরোপ নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দিলীপ রায়ের দীর্ঘ কথোপকথন। উভয়ের তর্কবিতর্ক থেকে প্রকৃত পাঠক অবশ্যই এই যুক্তিকেই সমর্থন দেবেন যে, যাঁর গান তাঁর বাণী ও সুরালাপকে সুষ্ঠুভাবে বজায় রেখেই আগামী দিনের শিল্পী সে গান গাইবেন। গায়কের স্বাধীনতা কেবল নিজের রচনা গাইবার বেলায়। অন্যের রচনাকে নিজের মতো করে গায়নের কী যে খেসারত দিতে হয় তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি নজরুলসংগীত কিংবা লোকসংগীত গেয়ে। এই এলোমেলোভাব চলতে দিতে থাকলে নজরুলসংগীত উচ্চাঙ্গ বা লোকসংগীতরূপে কিংবা লোক সংগীত পাশ্চাত্য রকে বা নজরুল সংগীতের বর্তমান গায়নে পরিবর্তিত হয়ে পড়বে। ফলে এই বইটিতে বর্তমান নিবন্ধকার গায়ক-গায়িকাদের জন্যে অতি জরুরি একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, যাদের পড়বার কথা তারা পড়েন না। আজকে অনেক শিল্পী পুরনো দিনের গান করেন। পুরনো দিনের গান গাইতে তাঁদের গায়কী সেইকালকে যে রিপ্রেজেন্ট করে নাÑসেটা তাঁরা বুঝতে চান না। গান তোলার ক্ষেত্রেও নেই তেমন অনুশীলন। রেকর্ড থেকে তুলতে হয় বলে বাণীর ত্রুটি শিল্পীর কা-জ্ঞানকে কটাক্ষ করে। পুরনো দিনের গানের গায়ক হতে চাইলে এই রচনাটি অথবা রবীন্দ্রনাথের সংগীতচিন্তা বইটি পড়া জরুরিভাবে প্রয়োজন। রবীন্দ্রনাথের এই বইটি শিল্পী, সমালোচক, নবীন শিক্ষার্থী, সংগীতানুরাগী সকলের বিশেষ প্রয়োজনীয় গ্রন্থ।            

তাঁর পরবর্তী রচনাটি সংগীত বিষয়ক পাঠকদের কাছে বহুল পঠিত একটি প্রবন্ধ। ফলে এই প্রবন্ধটি নিয়ে নতুন করে লেখার কিছু নেই।             

প্রসঙ্গ বাংলা গান টুকরো টুকরো কয়েকটি প্রবন্ধের সংকলন হলেও বাংলা গানের অনুরাগী পাঠকদের কাছে এর মূল্য অপরিসীম। শ্রদ্ধেয় করুণাময় গোস্বামীর সংগীত বিষয়ক আরো আরো রচনা চাই-যা এই গানের দেশকে অধিকতর সমৃদ্ধ করতে সচেষ্ট হবে। এই দেশে গানবাজনার এগিয়ে যাবার দিকনির্দেশনা দেবার মানুষ নেই। জানিনা কবে, এই দেশের মহান শিল্পীরা পড়া এবং জানার মাধ্যমে নিজেদের জ্ঞানের পরিধি ও আত্মমর্যাদা বাড়াতে সক্ষম হবেন। সকল শিল্পীর প্রয়োজন বিষয়ের গভীরে গিয়ে গান করা। এই চৈতন্যের উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত করুণাময় গোস্বামীদের রচনার কোনো মূল্যায়ন হবে না যেমন, তেমনি হবে না আপন সংগীতের বিকাশ।

http://www.boierjagat.com/index.php?option=com_content&view=article&id=57:book10&catid=34:book1&Itemid=27


ময়মনসিংহ লোক সংস্কৃতি

ইমেইলপ্রিন্টপিডিএফ

নিউজডেস্ক, বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম;
লোক সংস্কৃতি,লোক উৎসব, লোকসংগীত, লোকগাঁথার দিক দিয়ে ময়মনসিংহ হলো তীর্থস্থান। ময়মনসিংহে একটি সংস্কৃতি ঐতিহ্য রয়েছে যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশ্বে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন সংগৃহীত ও সম্পাদিত মৈমনসিংহ গীতিকা ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনুদিত হয়ে বিশ্বসাহিত্যের মর্যাদা পেয়েছে।
এই গীতিকায় মহুয়া, চন্দ্রাবতী, দেওয়ানা মদিনা ইত্যাদি পালার কথা কে না শুনেছে। এছাড়াও রয়েছে মলুয়া, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা ইত্যাদি পালা। কয়েকটি উদ্ধৃতি দেয়া হলো : 


জেঠ মাসের ছোট রাইত ঘুমের আরি না মিটে।
কদমতলায় শুইয়া বিনোদ দিনের দুপুর কাটে॥
এছাড়াও রয়েছে
ইরাধরের বাড়ীৎ সাধু ধান না কিনিয়া।
আলাল দুলালে কিম্মত দিল দাম ধরিয়া॥

তাছাড়া যাত্রাগান, গ্রামীণ কাহিনীর উপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত নাটক ও যাত্রা ময়মনসিংহের ঐতিহ্য। ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত লোকসঙ্গীতগুলোর অন্যতম হলো বাউলগান, ভাটিয়ালী, কিস্সাপালা, কবিগান, কীর্তন, ঘাটুগান, জারিগান, সারিগান, মুর্শিদী, ঢপযাত্রা, বিয়ের গান, মেয়েলীগান, বিচ্ছেদী গান, বারমাসী, পুঁথিগান, পালকির গান, ধানকাটার গান, ধানভানার গান, হাইট্টারা গান, গাইনের গীত, বৃষ্টির গান, ধোয়া গান, শিবগৌরীর নৃত্য গীত, গাজীর গান, পটগান, আদিবাসীদের গান ইত্যাদি ।
সূত্র: বাতায়ন।
বাংলাদেশনিউজ২৪x৭.কম/এমএ/এসএকে.







বইপত্র] সংগীতের সাতাশ সন্দেশ 

স্বকৃত নোমান

মানব-চর্চিত সূক্ষ্ম ও সুন্দরতম কলা সংগীত সম্বন্ধে মহাকবি শেক্সপীয়র বলেছিলেন :
যে মানুষের মনে নেই সংগীত
সুরের নিক্কনে যে-জন হয় না বিচলিত
সে তো বিশ্বাসঘাতক, প্রতারক আর লুটেরা
অমাবস্যার রাতের নিকষ কালো রূপ তার আত্মায়
তার ভালোবাসা যেন নরকের অন্ধকার
তেমন ব্যক্তিকে বিশ্বাস করা উচিত হবে না তোমার।

গত বছর ঢাকা থিয়েটারের আমন্ত্রণে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক দেবেশ রায় এসেছিলেন ঢাকায়। আজিজ সুপার মার্কেটে শর্টফিল্ম অডিটরিয়ামে 'সেলিম আল দীন পাঠশালা'র পাঠচক্রে তিনি একটি বক্তৃতা করেছিলেন। হাছন-লালনের গান সম্পর্কে তার একটি মন্তব্য ছিল এ রকম : "বাড়ির কাছে আরশি নগর/সেথা এক পড়শি বসত করে/আমি একদিনও না দেখিলাম তারে...' কিংবা 'কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাঝার'—এসব গান শুনে যদি আমার চোখে জল না আসে, তবে এই দু'চোখ অন্ধ হয়ে যাক।"
হাছন-লালনের গানÑ সর্বোপরি সংগীত বিষয়ে এমন শক্তিশালী ও গভীর অনুভূতিসম্পন্ন মন্তব্য এর আগে কখনো শোনা হয়নি। দেবেশ রায়ের মন্তব্যের সঙ্গে সংগীত বিষয়ে শেক্সপীয়রের বক্তব্যের একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। গান শুনে যদি মানুষ বিচলিত না হয়, চোখে জল না আসে, সুর যদি কারো মনে পবিত্রতার জন্ম না দেয় তো সে কিসের মানুষ? সে বোধবুদ্ধিহীন মানুষ। একটা ফাঁপা মাল। যে কেবল খেতে জানে আর শুতে জানে। ঠিক পশুর মতো। মানুষ হলে তো সংগীতের সুর-ভাব-তাল-লয় আলোড়িত করত তাকে, বিচলিত করত। গভীর ভাবস্পর্শী সংগীত শুনে সে আবেগাপ্লুত হতো।
মানুষের রাষ্ট্রীয় সীমান্ত আছে। আছে ভাষারও। বাংলাদেশের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে আফ্রিকা মহাদেশের কোনো একটি দেশের মানুষ একই ভাষায় কথা বলে না। কিন্তু সংগীত এমনই একটি মাধ্যম যার কোনো রাষ্ট্রীয় সীমানা নেই। বাংলাদেশে বসে সুদূর আলাস্কার একটা গান শুনে আমাদের মন আকুল হয়। বুঝতে পারি, ওখানকার মানুষরা নৃত্য-বাদ্য সহযোগে যে গীত পরিবেশন করছেন, তা একটা নান্দনিক বিষয়। সেই নান্দনিক বিষয়টা যদি কোনোভাবে আমার কাছে ভালো লেগে যায়, তবে মনের ভেতর এক বিচিত্র অনুভূতির সঞ্চার হয়। গভীর কিছু একটা যেন উপলব্ধি করতে পারি। সেই সংগীতের ভাষাটা বুঝতে পারছি না, কিন্তু সুরের মাধমে ওই মানুষগুলোর মনের কথা বা ভাবটা যেন ঠিকই বুঝতে পারছি। এই হচ্ছে সংগীতের শক্তি। সংগীতকে তাই ভাব বিনিময়ের আন্তর্জাতিক ভাষাও বলা চলে।
এই ভারতীয় উপমহাদেশ সংগীতের জন্য একটা উর্বর ভূমি। বিশেষত শত শত নদী বিধৌত বাংলাদেশকে সংগীতের তীর্থস্থান বলা চলে। গানের সঙ্গে এ দেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। গান এ দেশের প্রাচীনতম ভাব-সম্পদ। হাছন রাজা, লালন সাঁই, রবি ঠাকুর, দ্বিগেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন, কাজী নজরুল, আব্দুল আলীম, আয়েত আলী খান, আব্বাস উদ্দীন কিংবা শাহ আবদুল করিম—বাংলার সংগীতাঙ্গনের এমন অসংখ্য নক্ষত্রের সুরের ধারায় এ দেশের মানুষ আপ্লুত হয়, মনকে সুন্দরের পবিত্রতায় ভরিয়ে তোলে। এ দেশের ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, বাউল, চট্কা, গম্ভীরা, জারি, সারি, কবিগান, পালাগান, র্তজা, বিচ্ছেদী, গাজন গান, লেটো গান, ধামাইল, পাঁচালি, বারোমাসি ইত্যাদি গানের মাধ্যমে মানুষ হাসে-কাঁদে, আনন্দে মাতে, মনের ভাব প্রকাশ করে। সত্যিই গানের জন্য একটি সমৃদ্ধ দেশ বাংলাদেশ।

দুই.
সংগীত বিষয়ে এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই : পাঠকদের এ কথা জানান দেয়া যে, সংগীত সন্দর্শন নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। সেটি সম্পূর্ণ বাংলা সংগীত বিষয়ক। গ্রন্থটি সম্পর্কে গতানুগতিক ধারার কোনো রিভিউ, আলোচনা কিংবা সমালোচনা করার মতো প্রজ্ঞা এ লেখকের নেই। তাই আলোচনা-সমালোচনা থেকে বিরত থাকাটাই নিরাপদ বলে মনে করছি।
সংগীত সন্দর্শন গ্রন্থখানির রচয়িতা মোবারক হোসেন খান। এ দেশের হাতেগোনা যে ক'জন সংগীতজ্ঞ বা সংগীত বিশারদ আছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি একজন। উচ্চাঙ্গ সংগীতের বহুবিশ্রুত নাম ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ তার বাবা। সে হিসেবে পাঠকদের একটা উচ্চাশা তৈরি হবার কথা যে, মোবারক হোসেন খান রচিত বই যেনতেন কোনো বাজারি বই নয়। বাস্তবিক পক্ষেই তা নয়। সংগীত সন্দর্শন গ্রন্থটিতে সংগীতকলা বিষয়ে তার গুরুগম্ভীর জ্ঞানের বহির্প্রকাশ ঘটেছে। ফলে পাঠকদের নিরাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই।
একজন পরিপূর্ণ মানুষের সর্ববিষয়ে অল্প-বিস্তর জ্ঞান থাকা চাই। অর্থনীতিবিদ কেবল অর্থনীতি নিয়ে পড়ে থাকবেন, রাজনীতিবিদ রাজনীতি নিয়ে, চিকিৎসক চিকিৎসা নিয়ে, আমলা সরকারি ফাইলপত্র নিয়ে দিন গুজরান করবেন এমন তো নয়। পরিপূর্ণ মানুষ হতে হলে সব বিষয়ে কম-বেশি জ্ঞান থাকা চাই বৈকি।
এসব বিষয়ের মধ্যে সংগীতও একটা বিষয়। যেনতেন বিষয় নয়, খুবই শক্তিশালী বিষয়। এ বিষয়টি সম্পর্কে জানা শোনা না থাকলে যেন আসলেই জ্ঞানের অপূর্ণঙ্গতা থেকে যায়। এ দেশের সংগীতের উৎপত্তি, বিকাশ, বর্তমান হকিকত, সংগীতের তাল-লয় ইত্যাদি জানার জন্য মোবারক হোসেন খানের সংগীত সন্দর্শন গ্রন্থখানি যথেষ্ট বললে মোটেও বাড়িয়ে বলা হবে না।
গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ। এর প্রকাশক জহিরুল আবেদীন জুয়েল ও আদিত্য অন্তর বেছে বেছে ভালো বইগুলোই প্রকাশ করে থাকেন সবসময়। প্রায় সাড়ে তিন শ পৃষ্ঠার এই বইটিতে ২৭টি প্রবন্ধ সন্নিবেশিত হয়েছে। কয়েকটির নমুনা : বাংলাদেশের লোকসংগীতে লোক ঐতিহ্য, লালন শাহ্-র গানে বাউল সম্পদ, হাছন রাজার গানের ভাবদর্শন, আবহমানকালের সংগীতের ধারা, বাংলা গানের পঞ্চ ভাস্কর, ভারতবর্ষের সংগীত সাধনা, সহস্রাব্দের সংগীত ইত্যাদি। বলা যায় এ সাতাশটি প্রবন্ধ সংগীতের সাতাশ সন্দেশ।
প্রতিটি প্রবন্ধই তথ্য ও তত্ত্বে ভরা। খুবই সহজ-সরল সাধারণ পাঠকের বোধগম্য ভাষায় লেখক সংগীত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এ গ্রন্থে। আবহমানকালের সংগীতের ধারা শীর্ষক প্রবন্ধটি থেকে কিছু আলোচনা উক্ত করা যেতে পারে। যেমন, "মানুষের সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সংগীতের জন্ম। মানুষের ভাব, অনুভূতি প্রকাশ করার মাধ্যম হিসেবে সংগীতের সৃষ্টি। ফলে সৃষ্টির পর থেকে সংগীতের সঙ্গে মানুষের একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর সৃষ্টির আদি থেকেই মানবজীবনে সংগীতের প্রভাব পরিদৃষ্ট হয়। তাই সংগীতের ইতিহাস মানবজীবনের সঙ্গে সমান্তরালভাবে অগ্রসর হয়েছে। আজ পর্যন্ত সংগীত শিল্পের মধ্যে নব নব উপাদান, রূপ ও ভাবের বিকাল হয়েছেÑ যে বিকাশ-বৈচিত্র্যকে নিয়ে চিত্র, ভাস্কর্য, সাহিত্য, কাব্য প্রভৃতি সুকুমার শিল্পের মতো সংগীতও সে গৌরব অর্জন করেছে। শ্রুতি, স্বর, গ্রাম, রাগ, অলঙ্কার, বর্ণ, রস, ভাব প্রভৃতিকে নিয়ে সংগীত সমৃদ্ধ। স্বরে এবং রাগ-বৈচিত্র্যের মধ্যে প্রাণ প্রকাশের মাধুর্য অফুরন্ত, তাই বিভিন্ন রাগের গঠন ও বিকাশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে কাব্য সৌন্দর্য দিয়ে ধ্যানরূপ ও চিত্ররূপÑ যে রূপের মধ্যে পাওয়া যায় মানুষেরই অপরূপ চিন্তাধারা ও শিল্পরুচির পরিচয়।"
সংগীতের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র অপরিহার্য। এই যুগলের মেলবন্ধনে এক ভিন্ন দ্যোতনার সৃষ্টি হয় মানুষের মনে। সংগীত সন্দর্শন গন্থে আলোচিত হয়েছে বাদ্যযন্ত্র বিষয়েও। একতারা, দোতরা, সারিন্দা, আনন্দ লহরী, লাউ, মেঘডম্বুর, বাঁশি, তবুড়ি, মন্দিরা, করতাল, ঢাক, ঢোল, মাদল, ডমরু, মৃদঙ্গ ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন লেখক। প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য, উৎপত্তি এবং কোন গানে কোনটি ব্যবহার হয়, তার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
গ্রন্থটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন সমর মজুমদার। দাম রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা।


সংগীত-পিপাসু ও গবেষকদের জন্য সংগীত সন্দর্শন একটি আকর গ্রন্থ
মোবারক হোসেন খান

সংগীত বিষয়ে বাংলাদেশে তেমন গবেষণা হয়নি। ছিটেফোঁটা যা-ও হয়েছে তা বাংলাদেশের সংগীত পিপাসু মানুষদের জন্য নিতান্তই নগণ্য। লোকগান নিয়ে কিছু গবেষণাধর্মী কাজ হলেও, রাগসংগীতের মহলটিতে কেউ সাহস করে হাত দেননি। লোকগান বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্য। রাগসংগীতের ঐতিহ্য আট শ বছরের বেশি। সংগীতের এই দুটো প্রধান বিষয় নিয়ে গবেষণাকর্ম বলা যায় অবহেলিত। তাই গবেষণার মাধ্যমে উপেক্ষিত সংগীতের প্রাণ হিসেবে গণ্য লোকসংগীত ও রাগসংগীতের গবেষণা কাজে আমি মনোনিবেশ করি। আমাদের পরিবারের সবাই বড় বড় সংগীতজ্ঞ। আমার জীবনেই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটে। আমার পিতা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে চাইলেন। তাঁর অভিপ্রায় সফল হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নেয়ার পর চাকরিতে যোগ দিতে হলো। তাই বলে কিন্তু পারিবারিক ঐতিহ্য সংগীত আমার জীবন থেকে একেবারে অন্তর্হিত হয়ে যায়নি। সংগীতের রেয়াজ করেছি। সংগীতের শিল্পী হয়েছি। আমার এই সংগীত শিক্ষা আমাকে সংগীতের গবেষণার কাজে উদ্বুদ্ধ করে এবং আমার গবেষণাধর্মী নির্বাচিত কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ নিয়ে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ সংগীত সন্দর্শন গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন। সংগীতের প্রতি যাঁরা আগ্রহী, যারা সংগীতপিপাসু এবং সংগীত নিয়ে যারা গবেষণাধর্মী কাজে উৎসাহী সংগীত সন্দর্শন তাদের কাছে নিঃসন্দেহে একটি আকর গ্রন্থ হিসেবে গণ্য হবে।

ঘোষণা
এখন থেকে 'বইপত্র' বিভাগটি নিয়মিত প্রকাশিত হবে সাপ্তাহিক-এ। বই-আলোচনা প্রকাশের জন্য নিম্ন ঠিকানায় দুই কপি বই প্রেরণের জন্য আগ্রহী লেখক ও প্রকাশকদের অনুরোধ করা যাচ্ছে।
বিভাগীয় সম্পাদক
বইপত্র
সাপ্তাহিক 
২৬ ইস্কাটন গার্ডেন, রমনা,  ঢাকা ১০০০
ফোন ৯৩৪৫৩৬৯, ৯৩৪৫৪৮৩ 
ফ্যাক্স ৯৩৩৩৩০৭
info@shaptahik.com

http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=4009

নেত্রকোনা
কবিয়াল মদন সরকার তৈজসে নাম লিখে টিকে আছেন
নেত্রকোনা প্রতিনিধি

কবিগান। আবহমান বাংলা সংস্কৃতির এক ঐতিহ্যবাহী উপাদান। এক সময় বাঙালির বিনোদনের  অনিবার্য অনুষঙ্গ। কবিগানের চাপান-উতোরে জমজমাট হয়ে উঠত বটের ছায়ায় গ্রামের আসর। মহুয়া-মলুয়াদের উপাখ্যান ছুঁয়ে যেত মানুষের মন। গ্রাম বাংলার সেই সংগীত-ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তপ্রায়। লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছেন লোকসাহিত্যে সমৃদ্ধ নেত্রকোনার কবিয়ালরাও।
মদন সরকার তেমনই এক অশীতিপর কবিয়াল। বলা যায় তিনিই নেত্রকোনার সর্বশেষ কবিয়াল। এক সময় বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও সিলেটের গ্রামাঞ্চলে ঝড় তুলেছেন তিনি। গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়িয়েছেন চারণ গায়কের মতো। সেই ঝড় ক্রমশ স্তিমিত হয়েছে। বার্ধক্যে নুয়ে পড়েছেন। কিন্তু তার বুকের ভেতর এখনও বাজে সেই হৃদয়ছোঁয়া সুর।
কবিয়াল মদন সরকারের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার সিংহেরবাংলা ইউনিয়নের সহিলপুর গ্রামে। বাংলা ১৩২৪ সনে তার জন্ম। মদন সরকারের আসল নাম (পারিবারিক) মদন মোহন আচার্য্য। কিন্তু কবিয়ালদের 'সরকার' বলে ডাকা হয়। তাই তিনিও পরিচিত হয়ে গেছেন মদন সরকার নামে।
মদন সরকারের বাবা শশী মোহন আচার্য্য বাউল গান গাইতেন। জেঠামশাই বিজয় নারায়ণ আচার্য্য ছিলেন পূর্ববাংলার প্রখ্যাত কবিয়াল। আরেক জনপ্রিয় কবিয়াল রামসুন্দর ছিলেন বিজয় নারায়ণের ছাত্র। মদন সরকার তার কাছেই গান শেখেন। তখন বয়স প্রায় ১৮। এরপর থেকে ৬০ বছরেরও বেশি সময় তিনি কবিগান গেয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু অভাব-অনটন-জরায় আজ তিনি পর্যুদস্ত। অসুস্থ হয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী। কেমন আছেন? Ñএমন প্রশ্নের জবাবে বললেন : 'বৃদ্ধ বয়সে মদনে/ঠেকলাম বড় নিদানে/বদনে দাঁতের কারবার নাই/কামের মধ্যে করতাম কাম/ তৈজসপত্রে লেখতাম নাম/অরে আট আনা দাম/এই কামও আর নাই।'
হ্যাঁ। এক সময় যে লোককবি রাতের পর রাত গান গাইতেন, কবিগানের আসরে মুগ্ধ করতেন হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতা, শেষজীবনে তিনি বাসনপত্রে নাম খোদাই করে দিন গুজরানের চেষ্টা করেন। আগে এক একটি বর্ণ খোদাই করে পেতেন মাত্র আট আনা। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে বাসনপত্রেও এখন আর কেউ নাম লেখাতে চান না। এছাড়া অসুস্থ হওয়ার পর গাঁয়ে গাঁয়ে ঘোরার সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছেন । ফলে দুবেলা ঠিকমতো দুমুঠো খাবারও জোটে না।
মদন সরকারের সঙ্গে বাউলি উদাসীপনা করছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। প্রবীণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসাবে তাকে মাসে ৫শ টাকা হারে সম্মানী দেওয়া হয়। দুর্মূল্যের বাজারে এই সামান্য টাকায় তার ওষুধপত্রও হয় না। তার ওপর এ সামান্য টাকাও নিয়মিত পান না।
এমন একটা সময় ছিল যখন সাধারণ মানুষই বাঁচিয়ে রাখত বাউল, ভাটিয়ালি আর কবিগানের শিল্পীদের। আবার রাজা-জমিদাররাও তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। কিন্তু আজ আর সেই দিন নেই।  লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অমূল্য উপাদানগুলো বিস্মৃতির অন্তরালে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ইতিহাস হয়ে যাচ্ছে গ্রামের উৎসবমুখর দিনগুলো। আমরা হারাচ্ছি আমাদের গানের মানুষ, প্রাণের মানুষ, শেকড় সংস্কৃতির অগণিত ধারক ও বাহকদের। অথচ এদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব, স্বকীয়তা। তাই ব্যক্তি কবিয়াল মদন সরকার নয়, সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারার বাহক মদন সরকারদের বাঁচিয়ে রাখতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।

যশোর

মনিরামপুরে প্রাথমিক শিক্ষার বেহাল দশা
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিনিধি

যশোরের মনিরামপুর উপজেলায় শিক্ষা অফিসার ও শিক্ষকের বেশ কয়েকটি পদ শূন্য পড়ে থাকায় শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। এমনকি উপজেলা শিক্ষা অফিসারের পদটিও ২০০৭ সাল থেকে শূন্য। এতে পাঠদান সমস্যা ছাড়াও দাপ্তরিক কাজকর্ম চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উপজেলার বর্তমান কর্মকর্তারা এ সমস্যা সমাধানের দাবি জানিয়ে ওপর মহলে দেনদরবার করেও কোনও ফল পাচ্ছেন না।
আয়তনের দিক দিয়ে মনিরামপুর দেশের দ্বিতীয় বড় উপজেলা। মোট ১৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা রয়েছে এ উপজেলায়। রয়েছে ৪৭ হাজার ৮শ ৩৮ জন প্রাথমিক শিক্ষার্থী। তারা ৩শ ৭৯টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে। কিন্তু শিক্ষক সঙ্কটের কারণে অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয়েই লেখাপড়া বিঘিœত হচ্ছে। মনিরামপুর উপজেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের ১৬টি পদ শূন্য রয়েছে। এছাড়া সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে ৩৮টি। ৬০ জন শিক্ষক রয়েছেন পিটিআই ট্রেনিংয়ে। ১শ ৩৮টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে ২৭ জন। এতে স্বাভাবিক পাঠদান চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে।
শিক্ষক সঙ্কট ছাড়াও এ উপজেলায় বেশ কয়েকটি  শিক্ষা অফিসারের পদও শূন্য রয়েছে। এখানে শিক্ষা অফিসারের আটটি পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে পাঁচটি। ২০০৭ সালের ২৮ জুন থেকে শূন্য রয়েছে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের পদ। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ঘুষ নেয়ার সময় তখনকার উপজেলা শিক্ষা অফিসার হাতেনাতে ধরা পড়ে চাকরি হারান। কিছুদিন আগে ওই মামলায় তার ৫ বছর জেল হয়েছে। বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও এ পদে এখনও কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে সহকারী শিক্ষকের সাতটি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে পাঁচটি। বর্তমানে দুজন মাত্র সহকারী শিক্ষা অফিসার এখানে কর্মরত। অফিস সহকারী পদেও লোকবলের সঙ্কট রয়েছে। পাঁচজন অফিস সহকারী থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র দুজন। শূন্য রয়েছে কম্পিউটার অপারেটরের পদও। ভারপ্রাপ্ত উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল আজিজ জানান, শিক্ষক সঙ্কটের কারণে স্কুলগুলোতে পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। একইভাবে শিক্ষা অফিসে কর্মকর্তা সঙ্কটের কারণে ব্যাহত হচ্ছে সুপারভিশন। অফিস সহকারী না থাকায় দাপ্তরিক কাজকর্মও স্বাচ্ছন্দ্যে করা যাচ্ছে না। কম্পিউটার অপারেটরের অভাবে বাইরে থেকে টাকা খরচ করে কাজ করাতে হচ্ছে। তিনি জানান, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলে জানানো হলেও সমস্যার কোনও সুরাহা হচ্ছে না। তিনি এ সমস্যা দ্রুত  সমাধানের দাবি জানান।

গাইবান্ধা

প্রচ- খরায় বোরো ক্ষেত চৌচির
আবু জাফর সাবু

গাইবান্ধায় চলছে প্রচ- খরা। গত ৫ মাসেও এখানে বৃষ্টি হয়নি। দাবদাহে মানুষের জীবন যেমন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তেমনি কৃষকরাও বোরো েেত সেচের কথা ভেবে ভেবে দিশাহারা। পানির অভাবে অনেক ধানক্ষেতই ফেটে চৌচির। অনেক এলাকাতেই পাম্পে তেমন পানি উঠছে না। বিশেষ করে গোবিন্দগঞ্জ ও পলাশবাড়ী উপজেলার বরেন্দ্র এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অস্বাভাবিক নিচে নেমে যাওয়ায় শ্যালো মেশিন মাটি খুঁড়ে ১০ থেকে ১২ ফুট নিচে নামিয়ে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। অপরদিকে বিদ্যুতের সীমাহীন লোডশেডিংয়ের কারণে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রগুলো বেশিরভাগ সময়ই অলস পড়ে থাকছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মওসুমে গাইবান্ধা জেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৩১ হেক্টর জমিতে বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই ল্যমাত্রা ছাড়িয়ে এবার ১ লাখ ২১ হাজার ৯৪০ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ হয়েছে। আশা করা হচ্ছে এবার ৪ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন চাল উৎপন্ন হবে। কিন্তু একদিকে বিদ্যুৎ ঘাটতি, অন্যদিকে দীর্ঘদিনের খরার কারণে শেষমেশ কাক্সিত এ উৎপাদন হবে না বলেই আশঙ্কা হচ্ছে। এবার এ জেলায় বোরো চাষ সফল করতে সেচকাজে ৪২ হাজার ২৩৪টি অগভীর, ৩৫৬টি গভীর এবং ৫৩টি লো-লিফট পাম্প ব্যবহার করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৫ হাজার ৮১১টি অগভীর, ৩১৮টি গভীর এবং ২৩টি লো-লিফট পাম্প বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সীমাহীন লোডশেডিংয়ের কারণে ওইসব সেচযন্ত্রের আওতাধীন জমিগুলো প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। ফলে ওইসব জমির বোরো তে শুকিয়ে হলদেটে হয়ে যাচ্ছে। গাইবান্ধা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ গোটা জেলায় বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে প্রায় ২০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে প্রতিদিন বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৭ মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎ সমস্যা এখন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে আর তার প্রভাব পড়েছে বোরোর েেত। গাইবান্ধা শহরেই এখন বিভিন্ন ফিডারে এক ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং করা হচ্ছে। পল্লী এলাকায় তো দু-তিন ঘণ্টাও চলে লোডশেডিং! কোথাও কোথাও আরও বেশি সময় ধরে লোডশেডিং করা হয়। এতে যে শুধু বোরো তেই সেচ সঙ্কটের মুখে পড়ে তাই নয়, শিল্প-কারখানাগুলোতেও মারাত্মকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে ভু-গর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় খাওয়ার পানির জন্যও হাহাকার পড়েছে গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকায়।

অবাধে চলছে মাটি ও বালু কাটা : হুমকিতে শহররা বাঁধ


গাইবান্ধা শহরসংলগ্ন ঘাঘট নদীর অকাল বন্যা ও ভাঙন ঠেকাতে নির্মিত শহর রা বাঁধের অস্তিত্ব হুমকির মুখে। প্রতিদিনই এ বাঁধ থেকে অবাধে মাটি ও বালু কেটে নিচ্ছে প্রভাবশালী মাটি ও বালু ব্যবসায়ীরা। অথচ এসব দেখার কেউ নেই।
মাটি ও বালু ব্যবসায়ীরা শহরের ব্রিজ রোড, ডেভিড কোম্পানিপাড়া, পুলবন্দি, কুটিপাড়া ও পূর্ব কোমরনই গ্রামসংলগ্ন নদী ও বাঁধ থেকে বালু ও মাটি কেটে ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৬টি ঠেলাগাড়িতে মাটি ও বালু বোঝাই করে বিক্রি করা হচ্ছে। নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর থেকে বর্ষা আসার আগ পর্যন্ত এভাবে অবাধে চলতে থাকে মাটি ও বালু কাটা। রোজ মাটি ও বালু বিক্রি ছাড়াও এই ব্যাসায়ীরা বর্ষা মওসুমকে সামনে রেখে মজুদ গড়ে তোলে। শ্রমিকদের দিয়ে নদী ও বাঁধ থেকে বালু ও মাটি কেটে স্তূপ করে রাখে বাঁধের ওপরেই। বর্ষায় এসব বালু ও মাটি চড়া দামে বিক্রি হয়। সরকারি আইন অনুযায়ী নদী থেকে বালু বা মাটি কাটতে হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপরে অনুমতি নিয়ে ট্রেজারি চালানমূল্যে নির্ধারিত রাজস্ব জমা দিয়ে ভূমি অফিস থেকে রসিদ (ডিসিআর) কেটে নিতে হয়। রসিদমূলে নির্ধারিত পরিমাপের চেয়ে বেশি বালু কেটে নেয়া হলে  ফের অনুমতি ও অর্থ জমা দিতে হয়।
এখানে সেসবের কোনও বালাই নেই। সরকারি নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে এবং সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় ঘাঘট নদীর বালু এবং শহররা বাঁধের মাটির যেন হরি লুট চলছে। এতে সরকারের রাজস্বের তি তো হচ্ছেই, পাশাপাশি ঘাঘট নদীর বন্যার হাত থেকে রার জন্য নির্মিত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধও চরম হুমকির মুখে পড়েছে।

ভোলা

বোরহানউদ্দিনে অপহৃত গৃহবধূর করুণ পরিণতি
ছোটন সাহা

বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের পদ্মা মনসা গ্রামের হাজী সফিউল্যার পুকুর থেকে অপহরণের ১৩ দিন পর ১৭ মার্চ এক গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এক সন্তানের জননী এই গৃহবধূর নাম ফাহিমা বেগম (২৫)। ৪ মার্চ ফাহিমার স্বামী মহসিন সঙ্গে ৪-৫ জন লোক নিয়ে এসে ফাহিমাকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। তার পর থেকেই ফাহিমা নিখোঁজ ছিল। নিহতের ভাই হারুন ৭ মার্চ বোরহানউদ্দিন থানায় অপহরণের অভিযোগ এবং ১১ মার্চ ভোলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। লাশ উদ্ধারের পর থেকে নিহতের শ্বশুরবাড়ির লোকজন পলাতক রয়েছে। পুলিশ সন্দেহভাজন মহসিনের বোন শাহেনুর বেগমকে গ্রেফতার করেছে। নিহতের মা জেবুন নেছা ও ভাই মোঃ হারুনের অভিযোগ এবং মামলার এজাহার সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের পারিবারিক কলহের জের ধরে ফাহিমাকে নির্মমভাবে হত্যা করে লাশ পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তারা জানায়, গত ৪ মার্চ রাত ৮টায় ফাহিমার স্বামী মহসিন ৪-৫ লোক নিয়ে ফাহিমাকে তার বাবার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ওই সময় নিহতের মা বাধা দিলে তাকেও মারধর করা হয়।  মহসিনের পানের বরজের পাশে ১৮ মার্চ ফাহিমার চুলের খোঁপা ও চাপা পরে থাকতে দেখে এবং ওই জায়গায় ধস্তাধস্তির চিহ্ন দেখতে পেয়ে নিহতের ভাই হারুন তাৎণিকভাবে আবারও থানা-পুলিশের শরণাপন্ন হলে থানার পুলিশ তাকে কোর্টে মামলা করার পরামর্শ দেয়। এরপর হারুন গত ১১ মার্চ ভোলা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মহসিনসহ ৭ জনকে আসামি করে ৩৬৪/৩০২/২০১/৩৪ ধারায় একটি মামলা (নং-৭৯/২০১০) করে।
এদিকে ১৭ মার্চ স্থানীয় জনতা পদ্মা মনসা গ্রামের হাজী সফিউল্যার পুকুরে একটি দুর্গন্ধযুক্ত লাশ দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয়। পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পানি থেকে লাশ উদ্ধার করে বিকাল সাড়ে ৪টায় বোরহানউদ্দিন থানায় নিয়ে আসে। এদিকে মামলার বাদী হারুন অভিযোগ করে বলেন, হত্যার ঘটনায় মামলা করার পর থেকে এলাকার প্রভাবশালী মহল মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে বোরহানউদ্দিন থানা অফিসার ইনচার্জ বেলায়েত হোসেন বলেন, হত্যা মামলার ঘটনার পর থেকে প্রধান আসামি মহসিনসহ বাকিরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এতে বোঝা যায় হত্যার সঙ্গে তারাই জড়িত। হত্যাকা-ে জড়িত সব আসামিকেই গ্রেফতার করতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে বলে তিনি জানান।

রাজবাড়ী

পদ্মায় বাঁশের বাঁধ দিয়ে ইলিশ ধরা চলছেই
সৌমিত্র শীল চন্দন

মৎস্য শিকার আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রভাবশালীরা রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মা নদীর অন্তত ১৫টি পয়েন্টে আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকার করছে। মাঝে প্রশাসনের প থেকে কিছু বাঁধ ভেঙে দেওয়া হলেও তারা আবারও বাঁধ দিয়ে মাছ ধরছে। নতুন করে কয়েক জায়গায় বাঁধ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, মৎস্য কর্মকর্তাদের যোগসাজশে তারা এসব বাঁধ তৈরি করছে। এতে নৌযান চলাচল যেমন বিঘিœত হচ্ছে তেমনি বেকার হয়ে পড়ছে জেলার ৮ হাজারেরও বেশি মৎস্যজীবী।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া থেকে পাংশা উপজেলার সেনগাম পর্যন্ত পদ্মা নদীর প্রায় ৪০ কিলোমিটার এলাকা ইলিশ ও পাঙ্গাশ মাছের চারণত্রে হিসাবে পরিচিত। বিভিন্ন সময়ে মতাসীন দলের ছত্রছায়ায় প্রভাবশালীরা এখানে নদীর মাঝখানে আড়াআড়ি বাঁশের বাঁধ দিয়ে তাতে কারেন্ট, ফাঁস, সুতিসহ বিভিন্ন ধরনের জাল ব্যবহার করে মাছ ধরছে এবং ডিম আহরণ করছে।
সরেজমিনে গিয়ে রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের চর বেনিনগর, সিলিমপুর, চরসিলিমপুর, গোদারবাজার, মৌকুরি, চরকাঠুরিয়া; গোয়ালন্দ উপজেলার রাখালগাছি, অন্তারমোড়, পুরুলি, চরকাঠুরিয়া, ডাকাতপাড়া ও বাহিরচর-দৌলতদিয়া এলাকায় বাঁশের বাঁধ দিয়ে মাছ ধরতে দেখা গেছে। অবৈধ মৎস্য শিকারের সঙ্গে জড়িত রয়েছে পাবনা ও রাজবাড়ী জেলার প্রভাবশালী এক চক্র। জাটকা ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও এরা এ আইনের তোয়াক্কা করছে না। রাজবাড়ী সদর উপজেলার মিজানপুর ইউনিয়নের বড় চরসিলিমপুরে পদ্মা নদীতে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর এপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত আড়াআড়িভাবে বাঁশ ও কারেন্টজালের বাঁধ দেওয়া হয়েছে। জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের পুরুলী, রাখালগাছি ও ডাকাতপাড়া এলাকায় রয়েছে বিশাল আকারের আরও ৪টি বাঁধ। মৌকুরি এলাকার জেলেরা জানান, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করেই বাঁধটি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরাদুল হক জানান, অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে মাছ শিকারের বিষয়টি তিনি কয়েক দিন আগে জেনেছেন। তিনি জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে বাঁধগুলো অপসারণের উদ্যোগ নেবেন। গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাসিরউদ্দিন জানান, একবার অভিযান চালিয়ে একটি বাঁধ অপসারণ করা হয়েছিল। বাকিগুলো খুব শিগগিরই অপসারণ করা হবে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন 'পুনরায় নদীতে বাঁশের বাঁধ দেওয়ার ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের কোনও কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।'

মৌলভীবাজার

দীর্ঘ খরায় ঝরে গেছে আমের গুটি
ইসমাইল মাহমুদ

মৌলভীবাজার জেলার পাহাড়ি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে আম গাছগুলোতে  প্রচুর গুটি এলেও ভয়াবহ খরায়  সেগুলো অকালেই ঝরে পড়েছে। তার ওপর পাহাড়ি এলাকার অধিকাংশ আম গাছে পোকার আক্রমণ দেখা দিয়েছে । তাই এ বছর এখানে আমের ফলন গত বছরের চেয়ে অনেক কমে যাবে বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা করছেন।
জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার মোহাজেরাবাদ পাহাড়ি এলাকার আমচাষি আবদুল হাশিম জানান, তার বাগানে প্রায় শতাধিক আমগাছ রয়েছে। গত মওসুমে এসব গাছ থেকে অর্ধলাধিক টাকার আম বিক্রি করেছেন। বর্তমান মওসুমের শুরুতে গত মওসুমের চেয়ে আমের বোল ও গুটি এলেও দীর্ঘ খরার কারণে  বেশিরভাগ গুটিই ঝরে পড়েছে। তাই এ বছর ২৫ হাজার টাকার আমও বিক্রি হবে কি না সন্দেহ। রাজনগর উপজেলার চৌধুরীবাজার এলাকার চাষি আবু তাহের জানান, খরার কারণে আমের গুটি আসার আগেই বেশ কয়েকবার তার বাগানের আম গাছগুলোতে পর্যাপ্ত সেচ দেওয়া হলেও মাটিতে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় তা তেমন কাজে আসেনি। ওই পানির অভাবেই তার বাগানের বেশিরভাগ আমের গুটি ঝরে পড়েছে। তবে পরবর্তীকালে এখানে বৃষ্টি হওয়ায় কিছু আমের গুটি রা পেয়েছে।
জেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, আর মাত্র এক মাস আগে বৃষ্টি হলেও আমের গুটি পেত। কিন্তু সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় আমচাষিরা ব্যাপক তির মুখোমুখি হয়েছেন।

সাভার

আশুলিয়ার নলিরপাড় খাল এখন রুগ্ণ নালা
সৌমিত্র মানব

সাভার উপজেলার আশুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী নলিরপাড় খাল ভূমিদস্যুদের দখল-তৎপরতায় এখন এক সঙ্কীর্ণ নালায় পরিণত হয়েছে। দীর্ঘ এক দশক ধরে সাভারে ব্যাপকভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠায় জমির দাম খুব বেড়ে গেছে। এতে অতিলোভী ভূমিদস্যু চক্র নলিরপাড় খালটি পর্যায়ক্রমে ভরাট করে শিল্প-কারখানা, বাজার ও হাউজিং প্লট তৈরিসহ নানা পন্থায় দখল করে নিয়েছে। খালটি ভূমিদস্যুদের হাত থেকে রায় সরকারের কোনও উদ্যোগ না থাকায় ক্রমেই তা অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, আশুলিয়ার কুটুরিয়া থেকে শুরু হওয়া নলিরপাড় খালটির বাইপাইল, গাজীরচট, ডেন্ডাবর অংশের দীর্ঘ দুই কিলোমিটার জায়গা ভূমিদস্যুরা জবরদখল করে নিয়েছে। সেখানে তৈরি করেছে শিল্প-কারখানা, হাউজিং প্লট, ব্যক্তিমালিকানাধীন বাজার, ব্যবসায়িক গুদাম ও শ্রমিকপল্লী। বাইপাইল এলাকার নবীনগর-কালিয়াকৈর মহাসড়কে নলিরপাড় খালটির ওপর দিয়ে পানির স্রোত স্বাভাবিক রাখার জন্য বিগত সরকার একটি সেতু নির্মাণ করে। কিন্তু ওই সেতুটির পাশেই মাটি ভরাট করে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা ভবন, কাঁচাবাজার, মাছের আড়ত ও বিপণনকেন্দ্র। সেতুটির নিচের অংশে মাটি ফেলে ভরাট করায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে বছরের ১২ মাসই অপর অংশে শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য জমে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়। আশপাশের জনসাধারণের এখন সেখানে টেকাই দায়। খালটি দখল হওয়ায় এতে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ১৯১৪-১৯২০ সালের সিএস, ১৯৫৮-১৯৬০ সালের এসএ এবং ১৯৬৮-১৯৭২ সালের আরএস খতিয়ানে কাগজে-কলমে খালটির অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও এখন দীর্ঘ এ খালের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই বললেই চলে। খালটি দখল করে বিভিন্ন হাউজিং প্রকল্প বাহারি নামে সাইনবোর্ড ঝুিলয়ে রেখেছে। ৩০-৪০ ফুট প্রশস্ত নলিরপাড় খালটি দখলদারদের থাবায় এখন ৪-৫ ফুট প্রশস্তের রুগ্ণ নালায় পরিণত হয়েছে। ওই খালটি দখলমুক্ত করতে স্থানীয় জনসাধারণ ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন আন্দোলন করলেও তাতে তেমন কোনও প্রভাব পড়ছে না দখলবাজদের ওপর।


No comments:

Post a Comment