Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

What Mujib Said

Jyoti basu is DEAD

Jyoti Basu: The pragmatist

Dr.B.R. Ambedkar

Memories of Another Day

Memories of Another Day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Thursday, January 24, 2013

প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী।বললেন সিপিএম হল গোখরো সাপ।তৃণমুলী জনতাকে তাঁর উদাত্ত আহ্বান, গোখরো সাপ ঘরে ঢুকলে পিটিয়ে মারতে হয়।প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তাঁর বরাদ্দ লাঠি ঝাঁটা আর লাথি।তিনি রেয়াত করেন নি সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারতকেও। মনে রাখবেন, পশ্চিম বঙ্গের জন্মই কিন্তু হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের গর্ভে।সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের বোঝা মাথায় নিয়ে খন্ডিত ভূগোলে জ্যোতিপ্রিয় কনও ব্যক্তি বিশেষ নয়, যে তাঁর নিন্দা করলেই এই ব্রাহ্মণ্য আধিপাত্যবাদী হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাব আমরা। পলাশ বিশ্বাস



 প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী।বললেন সিপিএম হল গোখরো সাপ।তৃণমুলী জনতাকে তাঁর উদাত্ত আহ্বান, গোখরো সাপ ঘরে ঢুকলে পিটিয়ে মারতে হয়।প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তাঁর বরাদ্দ লাঠি ঝাঁটা আর লাথি।তিনি রেয়াত করেন নি সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারতকেও। মনে রাখবেন, পশ্চিম বঙ্গের জন্মই কিন্তু হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের গর্ভে।সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের বোঝা মাথায় নিয়ে খন্ডিত ভূগোলে জ্যোতিপ্রিয় কনও ব্যক্তি বিশেষ নয়, যে তাঁর নিন্দা করলেই এই ব্রাহ্মণ্য আধিপাত্যবাদী হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাব আমরাশুধুই কি জ্যোতিপ্রিয় মদন মিত্র, শুভেন্দু অধিকারি, এমনকি বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী যে ভাষা আমদানী করছেন, তা হিংসার পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করে চলেছে। 

পলাশ বিশ্বাস

আবার আক্রমণাত্মক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তবে এবার তাঁর বক্তব্য রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সামাজিক সৌজন্য অতিক্রম করে এবার প্রত্যক্ষ আক্রমণের প্ররোচনা দিল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী। বিরাটির এক জনসভায় তিনি সিপিআইএম-কে বিষধর সাপের সঙ্গে তুলনা করে পিটিয়ে মারার ইঙ্গিত দেন।


 প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী।বললেন সিপিএম হল গোখরো সাপ।তৃণমুলী জনতাকে তাঁর উদাত্ত আহ্বান, গোখরো সাপ ঘরে ঢুকলে পিটিয়ে মারতে হয়।প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর জন্য তাঁর বরাদ্দ লাঠি ঝাঁটা আর লাথি।তিনি রেয়াত করেন নি সীতারাম ইয়েচুরি বা প্রকাশ কারতকেও। মনে রাখবেন, পশ্চিম বঙ্গের জন্মই কিন্তু হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের গর্ভে।সেই রক্তাক্ত ইতিহাসের বোঝা মাথায় নিয়ে খন্ডিত ভূগোলে জ্যোতিপ্রিয় কনও ব্যক্তি বিশেষ নয়, যে তাঁর নিন্দা করলেই এই ব্রাহ্মণ্য আধিপাত্যবাদী হিংসা, ঘৃণা ও সন্ত্রাসের সংস্কৃতি থেকে মুক্তি পাব আমরা।এই সংসকৃতিরই খেসারত দিতে হচ্ছে ভবিষত্এর নূতন প্রজন্মকেও।টিটাগড়ে কিশোরের হাতে উঠে এল আগ্নেয়াস্ত্র, খূন হল এক শিশু।এখনও এ রাজ্যের মানুষ রগরগে সিরিয়াল বিনোদনের মত এই ঘৃণা অভিযানে মত্ত।ফল হতে চলেছে মারাত্মকশুধুই কি জ্যোতিপ্রিয় মদন মিত্র, শুভেন্দু অধিকারি, এমনকি বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রত মুখার্জী যে ভাষা আমদানী করছেন, তা হিংসার পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করে চলেছে। 

সিমিএমের বিরুদ্ধে কী কী করা উচিত, বিরাটিতে একটি সভায় তারই খতিয়ান দিচ্ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী। সেই সভায় তাঁর বক্তব্যের একটি ব্যাখ্যায় বিরোধীরা বলছে, সিপিএম-কে প্রয়োজনে পিটিয়ে মারার কথা বলেছেন খাদ্যমন্ত্রী। বিরোধীদের তিনি 'বিষধর সাপে'র সঙ্গে তুলনা করেছেন। 

কী বলেছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক? এদিনের সভায় খাদ্যমন্ত্রী বলেছেন, 'সাপের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করবেন? বাড়িতে গোখরো বা কেউটে সাপ ঢুকলে আপনি কী করবেন? ওদের সঙ্গেও তা-ই করুন।' সিপিএম-কে প্রকাশ্য জনসভা না-করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, 'জনরোষের মুখে পড়লে প্রশাসনের কিছুই করার থাকবে না।' প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, সীতারাম ইয়েচুরিদের কড়া সমালোচনার পাশাপাশি কংগ্রেসের দুই নেতা অরুণাভ ঘোষ এবং নির্বেদ রায়কেও 'অবোধ' এবং 'নির্বোধ' তকমা দিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী। 

স্বাভাবিক ভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বিরোধীরা। সিপিএম নেতা মানব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, 'প্রত্যক্ষ ভাবে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।' প্রাক্তন মেয়র বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য এহেন মন্তব্যে রাজ্যপালের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন। পাশাপাশি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে বরখাস্ত এবং গ্রেপ্তার করার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। 

রেজ্জাক মোল্লাকে ক্ষমা চাইতে হবে, দাবি 'শব্দসন্ত্রাসে' উদ্বিগ্ন মানসের
এই সময়: রাজ্য রাজনীতির কুশীলবরা যখন একের পর এক কটু কথায় শব্দ দূষণের মরিয়া প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, সেই সময় রাজনীতিক মানস ভুঁইয়া স্বতোপ্রণোদিত হয়ে সংযমের সবক শেখাতে চাইছেন৷ দলমত নির্বিশেষেশ সমস্ত রাজনীতিকের কাছে তাঁর আবেদন,'শব্দ সন্ত্রাস প্রতিরোধ করুন৷ এগুলো বাংলার সংস্কতির অঙ্গ হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে যাচ্ছে৷' প্রধানমন্ত্রীকে সিপিএম নেতা রেজ্জাক মোল্লা হারামখোর বলায় তাঁকে নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন মানসবাবু৷ কিন্ত্ত দমছেন না রেজ্জাক৷ তিনি এদিন বলেন, 'মন্তব্য প্রত্যাহার
করার প্রশ্নই ওঠে না৷ যা বলেছি বেশ করেছি৷' তবে এদিন হারামখোর শব্দ দলের সম্পর্কেও প্রয়োগ করেছেন তিনি৷ তাঁর বক্তব্য, আমার দলেও অনেক হারামখোর আছে৷ তা না হলে আমরা ক্ষমতা হারালাম কেন? রেজ্জাক বলেন, ২০১৩'তে আমার লক্ষ্য হল দল ও দেশকে হারামখোর মুক্ত করা৷

মানসবাবু একইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী সম্পর্কে সিপিএম বিধায়ক আনিসুর রহমানের মন্তব্যকে ফের নিন্দা করে নিজেকে দুর্মুখ রাজনীতিকদের উর্ধ্বে তুলতে চেয়েছেন৷ প্রদেশ কংগ্রেসের কার্যালয় বিধানভবনে দীর্ঘ সাংবাদিক বৈঠকে মানসবাবু বলেন, প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে রেজ্জাক মোল্লা যে মন্তব্য করেছেন, তা মুখে আনতে আমার লজ্জা করছে৷ তবুও বলতে হবে৷ তিনি প্রধানমন্ত্রীকে হারামখোর বলেছেন৷ সাবধান করে বলতে চাই, আপনি বিচলিত ব্যক্তিত্ব৷ দলে অবাঞ্ছিত৷ আপনি দলীয় দর্শন ও ধর্মীয় দর্শনের ঘুর্ণাবর্তে রয়েছেন৷ এটা আপনার ব্যক্তিগত মত নাকি
দলের পরিকল্পনা জানি না৷ জননেতার হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চান৷' এদিকে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফের আপত্তিকর মন্তব্য করায় তৃণমূল যখন বিধানসভায় আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বাধিকার ভঙ্গের দ্বিতীয় নোটিশ আনতে চলেছে, তখন কংগ্রেস আলিমুদ্দিনের সংস্কতিকে ফের কাঠগড়ায় তুলছে৷ মানসবাবুর প্রশ্ন, 'আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, বিমান বসুকে প্রশ্ন করতে চাই আলিমুদ্দিনে এমন ভাষা শিক্ষা কবে থেকে চলছে?'

তবে তৃণমূল কংগ্রেস কিন্তু রেজ্জাক মোল্লার মন্তব্যকে এখনও প্রকাশ্যে নিন্দা করতে এগিয়ে আসেনি৷ আনিসুর বিতর্কে হাওয়া খারাপ বুঝে সিপিএম কালক্ষেপ না করে দুঃখ প্রকাশ করেছিল৷দলের চির বিতর্কিত নেতা রেজ্জাকের সাম্প্রতিকতম মন্তব্যে কিন্তু সিপিএম অশ্লীল কিছু দেখছে না৷ বরং বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র প্রশ্ন তুলেছেন, উনি এমন কিছু বলেননি যা নিয়ে হইচই হতে পারে৷ হারামখোর শব্দের অর্থ যে অসত্‍ উপায়ে রোজগার করে৷ কোল ব্লক কেলেঙ্কারি সহ কেন্দ্র সরকার যে সব দুর্ণীতিতে যুক্ত সেই কথাই বলতে চেয়েছেন তিনি৷ যারা
এই সব ক্ষমার কথা বলছেন তাঁদের তো কেউ ক্ষমা চাননি৷'

সামান্য বল খেলা নিয়ে বচসা, আর তা নিয়ে ঝামেলার জেরে গুলি করে খুন করা হল সাত বছরের এক শিশুকে। উত্তর চব্বিশ পরগনার টিটাগড়ে এই ঘটনায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। গতকাল বিকেলে খেলার সময় বল নিয়ে ঝগড়া হয় দুই শিশুর মধ্যে। সামান্য ওই ঘটনার রেশ গড়ায় দুই শিশুর পরিবারে। অভিযোগ, মহম্মদ আরমান নামে এক যুবক রাহুল গিরি নামের শিশুকে গুলি করে। 

বারাকপুরের পি এন বোস হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে রাহুল গিরির মৃত্যু হয়। পুলিস ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে। ঘটনার পর থেকে আরমান পলাতক। তার সন্ধানে তল্লাসি চালাচ্ছে পুলিস। 


জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের উস্কানিমূলক মন্তব্যের পর তীব্র সমালোচনার মুখে সরকার ও শাসকদল। পরিস্থিতি সামাল দিয়ে দলের মুখরক্ষার চেষ্টা করেছেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। নিজের দলকে সংযত হওয়ার কথা বলেছেন তিনি। সব পক্ষকেই অসহিষ্ণু না হওয়ার আর্জি জানিয়েছেন শিল্পমন্ত্রী।  

রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকতেই পারে, তবে পিটিয়ে মেরে ফেলার মত মন্তব্য কোনও মন্ত্রীর মুখে শোভা পায় না। এই মন্তব্য আইনবিরুদ্ধ বলেও জানিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। রাজ্যের একজন মন্ত্রীর মুখে এধরনের উস্কানিমূলক মন্তব্য শোভা পায়না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের মন্তব্যের জেরে এই প্রতিক্রিয়া বিজেপি রাজ্যসভাপতি রাহুল সিনহার। 

প্রসঙ্গত, প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী। বিরাটির এক জনসভায় তিনি সিপিআইএম-কে বিষধর সাপের সঙ্গে তুলনা করে পিটিয়ে মারার ইঙ্গিত দেন। 


ফের অসৌজন্যের রাজনীতি। দীপা দাশমুন্সির বিরুদ্ধে অশালীন মন্তব্য করলেন রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। দীপা দাশমুন্সির মাথার ডাক্তার দেখানো উচিত বলে মন্তব্য করলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আক্রমণাত্মক মন্তব্যের পর, মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে দাবি করেন দীপা দাশমুন্সি। সেই বক্তব্যেরই প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে দীপা দাশমুন্সির বিরুদ্ধে ওই মন্তব্য করেন সুব্রত মুখার্জি। 

সারের দাম বাড়ানো নিয়ে কেন্দ্রের সমালোচনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নজিরবিহীন ভাবে আক্রমণ করে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। ক্যানিংয়ের সভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, সারের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করে তিনি দশবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। এরপরই মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্ন, "তাহলে আর কী করব? তাহলে কি মারব?" এরই প্রেক্ষিতে দীপা দাশমুন্সি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ক্ষমা চাওয়ার দাবি করেন। এই প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন দীপা দাশমুন্সির `মাথার চিকিৎসা` করানোর পরামর্শ দেন। 

চলতি মাসেই রাজ্যে একের পর এক রাজনৈতিক সংঘর্ষের নিরিখে রাজ্যপাল কড়া প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তার প্রতিক্রিয়ায় রাজ্যপালের কড়া সমালোচনা করে সুব্রতবাবু বলেছিলেন রাজ্যপালের মন্তব্য এক্তিয়ার বহির্ভূত, রাজনৈতিক। তিনি আরও বলেন, "রাজ্যপালের বক্তব্য উসকানিমূলক।" এর পরেই ডানা ছাঁটা পড়ে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের। সরকারের হয়ে বিবৃতি দিতে নিষেধ করা হল পঞ্চায়েতমন্ত্রী তথা তৃণমূলের শীর্ষ নেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়কে। সরকারের তরফে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হওয়ার অলিখিত অধিকার দেওয়া হয় শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে।

এর পর আজ এই মন্তব্যের জেরে ফের বিতর্কে জড়ালেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী।

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এ দিনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সিপিআইএম নেতা মানব মুখার্জি বলেন, "প্রত্যক্ষভাবে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। এমনকী তাঁর বক্তব্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার ইঙ্গিতও দেখতে পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ।


"প্রধানমন্ত্রীকে মারার কথা বলিনি"

http://zeenews.india.com/bengali/videos/mamata-on-pm_1911.html


সিপিআইএমকে প্রকাশ্যে জনসভা না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন 'জনরোষের মুখে পড়লে প্রশাসনের কিছু করার থাকবে না।' শুধু তাই নয়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, সীতারাম ইয়েচুরিকে আক্রমণ করার পাশাপাশি কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ ও নির্বেদ রায়কে 'অবোধ' ও 'নির্বোধ' বলে অভিহিত করেন তিনি।

পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে, জেলায় জেলায় বেড়ে চলা দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ঠেকাতে নির্দেশ দিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু দলনেত্রীর নির্দেশে যে বিশেষ কাজ হয়নি মঙ্গলবার তা স্বচক্ষে দেখলেন মুকুল রায়। বাঁকুড়ার ইন্দাসে তাঁর সামনেই প্রকাশ্য সমাবেশে এক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিষোদগার করল অন্য গোষ্ঠী। মুকুল রায়ের অবশ্য দাবি বিশৃঙ্খলাকারীরা সিপিআইএমের মদতপুষ্ট।  


মঙ্গলবার কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি ও সিপিআইএমের সন্ত্রাসের প্রতিবাদে বাঁকুড়ার ইন্দাসে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। সবে তখন সমাবেশ মঞ্চে এসেছেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। আচমকাই সভায় উপস্থিত তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের একাংশ রবিউল হোসেনকে ফের ইন্দাসের ব্লক সভাপতি হিসেবে ঘোষণা করার দাবি জানাতে থাকেন। মুহূর্তেই সমাবেশ মঞ্চে শুরু হয়ে যায় তুমুল হইহট্টগোল, বিশৃঙ্খলা। বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে শেষমেষ মাইক হাতে নিতে হয় মুকুল রায়কে। 

 
 
মুকুল রায় যাই দাবি করুন। ইন্দাসের কাছে তৃণমূল কংগ্রেসের গৌতম বেরা গোষ্ঠীর সঙ্গে রবিউল হোসেন গোষ্ঠীর বিরোধ সুবিদিত। দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষও নতুন কোনও ঘটনা নয়। কিছুদিন আগে রবিউল হোসেনকে তৃণমূলের ইন্দাস ব্লক সভাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করে দল। দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় বিধায়ক গুরুপদ মেটেকে। গুরুপদ মেটে আবার গৌতম বেরা গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ। এই ঘটনা নিয়ে রবিউল হোসেন গোষ্ঠীর ক্ষোভ ছিলই। মঙ্গলবার মুকুল রায়ের উপস্থিতিতে তা সামনে আসায় দলের অস্বস্তি বাড়ল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। 


আবার আক্রমণাত্মক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তবে এবার তাঁর বক্তব্য রাজনৈতিক শিষ্টাচার ও সামাজিক সৌজন্য অতিক্রম করে প্রত্যক্ষ আক্রমণের প্ররোচনা দিল বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। প্রধান বিরোধীদল সিপিআইএমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করতে গিয়ে এবার তাঁদের কার্যত পিটিয়ে মারার উস্কানি দিলেন খাদ্যমন্ত্রী। বিরাটির এক জনসভায় তিনি সিপিআইএম-কে বিষধর সাপের সঙ্গে তুলনা করে পিটিয়ে মারার ইঙ্গিত দেন। 
দেখুন কী বললেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক

এ দিনের সভায় জ্যোতিপ্রিয়বাবু "সাপের সঙ্গে কী ব্যবহার করবেন? বাড়িতে গোখরো বা কেউটে সাপ ঢুকলে আপনি কী করবেন? ওদের সঙ্গেও তাই করুন।" 

সিপিআইএমকে প্রকাশ্যে জনসভা না করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন 'জনরোষের মুখে পড়লে প্রশাসনের কিছু করার থাকবে না।' শুধু তাই নয়, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, গৌতম দেব, সীতারাম ইয়েচুরিকে আক্রমণ করার পাশাপাশি কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ ও নির্বেদ রায়কে 'অবোধ' ও 'নির্বোধ' বলে অভিহিত করেন তিনি।

দেখুন খাদ্যমন্ত্রীর উস্কানিমূলক মন্তব্য
 

জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের এ দিনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে সিপিআইএম নেতা মানব মুখার্জি বলেন, "প্রত্যক্ষভাবে সমাজবিরোধীদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে।"

স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ্য জনসভায় তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে রাজ্য রাজনীতির বিভিন্ন মহলে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে। এমনকী তাঁর বক্তব্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠার ইঙ্গিতও দেখতে পাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট মহলের একাংশ।

জ্যোতিপ্রিয় কেউটে মন্তব্য দেখুন ভিডিওতে

http://zeenews.india.com/bengali/zila/jyotipriya-controversy_10923.html


বিরাটি ও কলকাতা: ফের বিস্ফোরক মন্তব্য খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের৷ বিরাটীর এক জনসভায় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে তীব্র আক্রমণ করে জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেছেন, এখন আর ব্র্যান্ড বুদ্ধ নয়৷ বুদ্ধবাবু ব্যান হয়ে গিয়েছেন৷ একইসঙ্গে তিনি সিপিএমকেও তীব্র আক্রমণ করেছেন। ঘৃণার মনোভাব উস্কে দিয়ে তিনি  দলীয় কর্মীদের সিপিএমের প্রতি কেমন আচরণ করা উচিত, সেই ব্যাপারেও ফের ফতোয়া দিয়েছেন। এর পাশাপাশি, দলের যুব শাখার সভাপতি তথা হলদিয়ার সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীর ভাষা ধার করে  বলেছেন, সিপিএমের সঙ্গে কেউটে সাপের মতো ব্যবহার করুন৷একধাপ এগিয়ে তিনি কার্যত সিপিএমকে বিষাক্ত সাপের মতো পিটিয়ে মারার প্ররোচণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কেউটে বা গোখরো সাপ ঘরে ঢুকলে যে ব্যবহার করতে হয়, সেই ব্যবহার সিপিএমের সঙ্গে করতে হবে। সিপিএমের উদ্দেশে জ্যোতিপ্রিয়র কটাক্ষ, গ্রামে ঢুকতে ভয় পাচ্ছে বলে শহরে সভা করছে সিপিএম৷ ক্ষমতা থাকলে শাসনে সভা করতে বলেছেন সিপিএমকে৷ পুলিশি নিরাপত্তা তিনি দেবেন বলে দাবি করেছেন৷ কিন্তু সিপিএম নেতাদের জনতা পিটিয়ে মারলে তাঁর কিছু করার নেই৷ মন্তব্য করেছেন জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক৷

সিপিএম জ্যোতিপ্রিয়র মন্তব্যের নিন্দা করেছেন। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেছেন, জ্যোতিপ্রিয় নতুন কথা বলছেন না। এর আগেও একাধিক তৃণমূল নেতা একই ধরনের ভাষা ব্যবহার করেছেন। আসলে একটা স্বৈরতান্ত্রিক ঝোঁক মাথা চাড়া দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন সেলিম।

একইসঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে দলের নেতানেত্রীদের সাম্প্রতিক ধারা মেনে সংবাদমাধ্যমকেও তীব্র আক্রমণ করেছেন তিনি। এবিপি আনন্দের অনুষ্ঠান প্রতি-পক্ষ-এর প্রতি ফের বিদ্বেষ উগরে দিয়েছেন জ্যোতিপ্রিয়।নাম করে এবিপি আনন্দকে বয়কটের ডাক দিলেন তিনি।

 জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের আক্রমণের নিশানা থেকে বাদ পড়লেন না কংগ্রেস নেতারাও৷ বিরাটির সভা থেকে এদিন সিপিএমের পাশাপাশি তিনি কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন তিন কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী অধীর-দীপা-আবু হাসেম খান চৌধুরীকে৷ কংগ্রেস নেতা অরুণাভ ঘোষ এবং নির্বেদ রায়কেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি তিনি৷
অধীর রায়চৌধুরিকে 'খুনি' বলতেও কসুর করেন নি জ্যোতিপ্রিয়। এর পাশাপাশি দীপা দাসমুন্সি এবং আবু হাসেমকেও কার্যত ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন।   কংগ্রেসের অপর দুই নেতা  অরুনাভ ঘোষ ও নির্বেদ রায়কেও জনসংযোগহীন এবং 'অবোধ-নির্বোধ' বলে কটাক্ষ করেছেন তিনি।

জ্যোতিপ্রিয়র এই আক্রমণকেই রুচিহীন মানসিকতার পরিচয় আখ্যা দিয়েছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য  নির্বেদ রায়  তৃণমূল নেতাকে আত্মপরিচয় না ভোলার পরামর্শ দিয়েছেন।  অরুনাভ  জ্যোতিপ্রিয়কে অশিক্ষিত আখ্যা দিয়েছেন।  অধীর তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আসলে তৃণমূল নেতারা কে কত বেশি অশালীন ভাষা ব্যবহার করে নেত্রীর কাছাকাছি আসতে পারেন তার একটা প্রতিযোগিতা চলছে।জ্যোতিপ্রিয়র বিস্ফোরক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সবাইকে সংযত হতে বললেন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়৷ একইসঙ্গে কটাক্ষ করলেন সংবাদমাধ্যমকে৷ তাঁর মন্তব্য, 'সবাইকে সংযত হতে হবে৷ ভাষার যে অবক্ষয়, খবরের কাগজ দেখলে মনে হচ্ছে, শুধু সরকারি প্রতিনিধিরাই এসব করছেন৷ অসহিষ্ণু হলে চলবে না৷ এ পক্ষ, ও পক্ষ, প্রতি-পক্ষ, সবাইকেই বলছি৷'

http://abpananda.newsbullet.in/kolkata/59-more/32864-2013-01-24-08-52-58


পরিবর্তনের হাওয়ার দাপট এড়াতে পারলেন না খোদ নেতাজিও৷ তাঁর জন্ম-জয়ন্তী পালনের অনুষ্ঠানস্থল পরিবর্তনের সরকারি প্রয়াস ঘিরে জন্ম নিল নতুন বিতর্ক৷ রেড রোডের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান সরকারি উপেক্ষার শিকার৷ এই অভিযোগে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন বিরোধীরা৷ 


সরকারের যাবতীয় উদ্যোগ এ দিন ছিল নেতাজি ভবনে৷ যেখানে উপস্থিত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী৷ রেড রোডে সরকারের তরফে নেতাজি মূর্তিতে মাল্যদান করলেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী৷ কিন্তু, প্রতিবছর রেড রোডের অনুষ্ঠানে পূর্ত দফতরের পক্ষ থেকে মঞ্চ বাঁধা এবং মাল্যদানের জন্য ল্যাডারের যে ব্যবস্থা করা হয়, এ বার তা করা হয়নি বলে অভিযোগ৷ আর তাই এ নিয়ে ক্ষুব্ধ বিরোধীরা৷ 
পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এবিষয়ে বলেছেন, সরকারিভাবে অন্য জায়গায় হচ্ছে। হয়ত সেজন্য এখানে কিছু করা হয়নি। পূর্ত্ত বিভাগ প্রতিবছরই এখানে অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা করে। এ সম্পর্কে সুব্রত বলেছেন, এবছর কেন করেনি এটা তিনি জানেন না।
প্রতিবছর ফরওয়ার্ড ব্লকের মঞ্চ নেতাজি জন্মজয়ন্তী কমিটি রেড রোডে নেতাজির জন্মদিন পালন করে আসছে৷ বাম আমলে এটাকেই সরকারি অনুষ্ঠানের মর্যাদা দেওয়া হত৷ হাজির থাকতেন মুখ্যমন্ত্রী৷ গত বছর, নেতাজি জন্মজয়ন্তী কমিটিকে বাদ দিয়ে এককভাবে রেড রোডে নেতাজির জন্মদিন পালনের দায়িত্ব নেয় রাজ্য সরকার৷ যদিও, নেতাজির মূর্তিতে মালা দিতে বাম নেতারা হাজির হলে, সৌজন্য দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষকে আগে মালা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান৷ কিন্তু উদ্যোক্তার ভূমিকা থেকে বামেদের ছেঁটে ফেলায় তুমুল বিতর্ক হয়৷ যে বিতর্ক এড়াতেই এবার মুখ্যমন্ত্রী আগেভাগেই, ক্যানিংয়ের সভা থেকে জানিয়ে দেন, তিনি এবার নেতাজি ভবনে যাবেন৷ রেড রোডে যাবেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ 
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরেই, নেতাজি জন্মজয়ন্তী কমিটি রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে অনুষ্ঠান পালনের দায়িত্ব গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করে৷ কিন্তু, অভিযোগ, তাঁদের সেই চিঠির উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি রাজ্য সরকার৷ ফলে বিপাকে পড়েন তারা৷ শেষ মুহূর্তে, মঙ্গলবার, পুলিশের দ্বারস্থ হন৷  লালবাজারের অনুমতি নিয়েই আয়োজন করেন অনুষ্ঠানের৷ মঙ্গলবার সন্ধ্যায়, মহাকরণ থেকে ফ্যাক্স মারফত অনুমতিপত্র পৌঁছয় উদ্যোক্তাদের হাতে৷ অনুষ্ঠানের আগের দিন অনুমতি এসে পৌঁছানোর তীব্র নিন্দা করেছেন সিপিএম নেতা গৌতম দেব।
রেড রোডের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতি নিয়ে এ দিন, তীব্র আক্রমণ করেন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ৷ তাঁর দাবি, মুখ্যমন্ত্রী এখানে না এসে অপমান করেছেন নেতাজিকে।
মুখ্যমন্ত্রী না এলেও, রেড রোডে হঠাত্‍‍ হাজির হন স্বয়ং রাজ্যপাল৷ যদিও, সরকারি আমন্ত্রণপত্রে তাঁর নাম ছিল না৷ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে উল্লেখ ছিল, রেড রোডের অনুষ্ঠানে হাজির থাকবেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়৷ কিন্তু, সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়েই রেড রোডের অনুষ্ঠানে হাজির হন রাজ্যপাল৷ 

http://abpananda.newsbullet.in/state/34-more/32841-2013-01-23-15-55-19

কোচবিহার: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতিকৃতিকে সাক্ষী রেখে মারপিটে জড়িয়ে পড়ল তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী৷ তাতে দেশনায়কের জন্মদিন পালন শিকেয় উঠল৷ ভেস্তে গেল দলের কর্মসূচি৷ অনুষ্ঠানে যেতেই পারলেন না বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন৷ 
কোচবিহারের মাথাভাঙার কাছে নয়ারহাটে ওই সংঘর্ষে জখম হয়েছেন উভয় গোষ্ঠীর মোট ১২ জন৷ এদের মধ্যে এক জনের শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাঁকে কোচবিহারের মহারাজা জিতেন্দ্রনারায়ণ হাসপাতালে ভর্ত্তি করা হয়েছে৷ আরও ১২ জনের চিকিত্‍সা চলছে মাথাভাঙ্গা মহকুমা হাসপাতালে৷ এদের মধ্যে দু'জনের আঘাত গুরুতর৷ 

নেতাজির জন্মদিন উদযাপনে বুধবার পৃথক পৃথক কর্মসূচি ছিল তৃণমূলের দুই গোষ্ঠী৷ সকালে উভয় পক্ষের মিছিলের পর ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর উদ্যোগে ভলিবল প্রতিযোগিতার আয়োজন ছিল৷ বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন ওই প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করবেন বলে ঘোষণা ছিল৷ মাথাভাঙা ১ নম্বর ব্লক তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি মজিদুল হোসেন ও তৃণমূলের কিষাণ-খেতমজুর সংগঠনের সংশ্লিষ্ট ব্লক সভাপতি গোলাম মোস্তাফার নেতৃত্বে দু'টি পৃথক শোভাযাত্রা মুখোমুখি হতেই সংঘর্ষ বেধে যায়৷ ওই গোলমাল যে তাঁদের দলের কর্মীদের মধ্যেই, তা স্বীকার করে তৃণমূলের ওই ব্লক সভাপতি মজিদুল হোসেন বলেন, 'দলেরই কিছু কর্মী আমাদের মিছিলের উপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করেন৷ ব্যাপক মারধর করেন ওরা৷ তাতে আমাদের মিছিলে সামিল ৭ জন আহত হন৷' 

ব্লক তৃণমূল কিষাণ-খেতমজুর কংগ্রেস সভাপতি গোলাম মোস্তাফা বলেন, 'তৃণমূলের একটি গোষ্ঠী আমাদের শোভাযাত্রা আক্রমণ করেছিলেন৷ ধারালো অস্ত্র নিয়ে ওরা আমাদের কর্মীদের আঘাত করেন৷ তাতে আমাদের ৬ জন আহত হয়েছেন।' কোচবিহারের পুলিশ সুপার অনূপ জয়সোয়াল জানিয়েছেন 'ঘটনাটি সম্পর্কে খোঁজ নিচ্ছি৷' গণ্ডগোলের জেরে নয়ারহাটে নেতাজির জন্মদিন পালনের মূল অনুষ্ঠান ও ভলিবল ম্যাচ ভেস্তে যায়৷ 

ঝামেলার খবর পেয়ে সেখানে আর যাননি বনমন্ত্রী হিতেন বর্মন৷ কিন্ত্ত গোষ্ঠী সংঘর্ষের কথা তিনিও এড়িয়ে গিয়েছেন৷ হিতেনবাবু বলেন, 'নয়ারহাটে একটি অনুষ্ঠানে আমার যাওয়ার কথা ছিল ঠিকই, কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত আর যাওয়া হয়নি৷' তবে দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, 'দলে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে প্রয়োজনে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷'

http://eisamay.indiatimes.com/netaji-birthday-celebration-spoiled/articleshow/18163808.cms

অধীরের মোকাবিলায় রেজিনগরে দায়িত্ব শুভেন্দু অধিকারীকে



অধীরের মোকাবিলায় রেজিনগরে দায়িত্ব শুভেন্দু অধিকারীকে
শীর্ষেন্দু গোস্বামী 
বহরমপুর: প্রার্থী হুমায়ুন কবীর, কিন্তু রেজিনগরে কংগ্রেসের টক্কর নেবেন শুভেন্দু অধিকারী৷ মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বিধানসভাটির উপ-নির্বাচন দলের পক্ষে পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছেন তমলুকের সাংসদ৷ অধীর চৌধুরীর খাসতালুকে 'ঘোগের বাসা' তৈরির দায়িত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকেই উপযুক্ত মনে করেছেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়৷ আসার আগেই শুভেন্দুবাবুর নির্দেশে রেজিনগরে ঘুঁটি সাজানোর কাজ শুরু করে দিয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা-কর্মীরা৷ 

তৃণমূল শিবির উজ্জীবিত হলেও, মমতার এই কড়া চালে নিঃসন্দেহে চাপ বাড়বে রেল প্রতিমন্ত্রীর ঘাড়ে৷ মুর্শিদাবাদ জেলা তাঁর দুর্গ বলে শুধু রাজ্যে নয়, গোটা দেশে প্রচার থাকায় সেই ভাবমূর্তি রক্ষার তাগিদ রয়েছে অধীরবাবুর উপর৷ রেজিনগর কেন্দ্রে কংগ্রেসের প্রার্থী হলেও, আসলে লড়াইটা যে তাঁর সঙ্গে, তা ভালোই বোঝেন তিনি৷ সেই লড়াইয়ে তাঁর মোকাবিলায় তাই হুমায়ুন কবীরের বকলমে নিজের প্রতিনিধি হিসাবে নন্দীগ্রাম বিজেতাকে পাঠাচ্ছেন মমতা৷ 

শুভেন্দুবাবু দায়িত্ব নেওয়ার খবরে এখন রেজিনগরে রাজনৈতিক মহলে টানটান পরিস্থিতি৷ গোটা রাজ্যের চোখ থাকবে এই কেন্দ্রের দিকে৷ কংগ্রেস, তৃণমূল, উভয় শিবিরের কাছেই রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রীর কেন্দ্রটির দখল 'প্রেস্টিজ ফাইট' হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কংগ্রেস প্রার্থীর নাম আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে তৃণমূল সংগঠন সাজানোর কাজে নেমে পড়েছে৷ এখনও এসে না পৌঁছলেও, তমলুকের সাংসদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওই বিধানসভা কেন্দ্রে ১৪টি গ্রাম পঞ্চায়েতে নির্বাচন প্রস্তুতির কাজ তদারকির জন্য জেলা স্তরের বাছাই করা ১৪ জন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে৷ ওই ১৪ জনের কাজ তদারকির জন্য আবার তিন সদস্যের একটি কমিটি গড়ে দেওয়া হয়েছে৷ সপ্তাহে এক দিন বসে ওই কমিটি কাজের পর্যালোচনা করবে৷ 

যদিও এখনও পু্রো পরিকল্পনা খোলসা করেননি শুভেন্দু৷ ৩১ জানুয়ারি এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে তিনি দায়িত্ব নেবেন বলে জানিয়েছেন রেজিনগরের পদত্যাগী বিধায়ক হমায়ুন কবীর৷ কংগ্রেস ছেড়ে তিনি তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় ওই কেন্দ্রে উপ-নির্বাচন হচ্ছে৷ হুমায়ুন বলেন, 'আমি প্রার্থী ঠিকই, কিন্তু নির্বাচনে আমাকে জেতানোর জন্য প্রয়োজনীয় যা করার, তা করতে শুভেন্দুদাকেই দায়িত্ব দিয়েছেন দিদি৷ সমস্ত পরিকল্পনা তিনিই চূড়ান্ত করবেন৷' 

টেলিফোনে প্রদেশ তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'দায়িত্ব আমার একার নয়৷ সবাই মিলে ভোটের কাজ পরিচালনা করবে৷ সে ব্যাপারে আমার প্রস্তাব ৩১ জানুয়ারি রেজিনগরে গিয়ে জানাবো৷ ওই দিন শক্তিপুরে কর্মীসভা ডাকা আছে৷ সেখানেই সব বলবো৷' তিনি আসার আগেই রেজিনগরে তৃণমূল প্রার্থীর প্রচারে আসবেন কৃষিমন্ত্রী বেচারাম মান্না ও সাংসদ কল্যাণ বন্দোপাধ্যায়৷ দুর্মুখ বলে পরিচিত ওই দু'জনকে দিয়ে অধীরের বিরুদ্ধে প্রাথমিক আক্রমণ শানানোর পরিকল্পনা নিয়েছে তৃণমূল৷ 

লড়াই কঠিন বুঝতে পারছেন মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও৷ তিনি সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজের দুর্গ রক্ষার জন্য মরিয়া৷ তার উপর রেজিনগরে হুমায়ুনকে হারাতে পারলে মমতা বন্দোপাধ্যায়কে উচিত বার্তা দিতে পারবেন তিনি৷ সে কারণেই তমলুকের সাংসদের দায়িত্ব নেওয়া প্রসঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, 'যে যাই বলুন, মুর্শিদাবাদ যে কংগ্রেসের দুর্গ, তা আরও এক বার প্রমাণ হবে ভোটগণনার পর৷' 

নতুন প্রজন্মের আকর্ষণ বাড়াতে ফিল্মি জগতের তারকাদের মধ্যে তৃণমূলের যে জনপ্রতিনিধিরা আছেন, তাঁদেরও প্রচারে রেজিনগরে আনার পরিকল্পনা করেছে তৃণমূল৷ হুমায়ুন জানিয়েছেন, 'বিধায়ক দেবশ্রী ও চিরঞ্জীব এবং সাংসদ তাপস ও শতাব্দীকে আনার চেষ্টা হচ্ছে৷ তবে সবটাই ঠিক করবেন শুভেন্দুদা৷' রেজিনগরেও কি শেষ কথা বলবেন শুভেন্দু? না, গড় রক্ষা হবে অধীরের? উপ-নির্বাচনে সেই রায় দেবে রেজিনগর৷

সূর্যর আমলে পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে তদন্তের নির্দেশ দিল রাজ্য
এই সময়: পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখেই সূর্যকান্ত মিশ্রর আমলে পঞ্চায়েত দপ্তরের দুর্নীতি নিয়ে প্রশাসনিক তদন্তের নির্দেশ দিল রাজ্য সরকার৷ মঙ্গলবার মহাকরণে রাজ্যের পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় এই সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন৷ সুব্রতবাবুর কথায়, সর্বশিক্ষা অভিযান ও 'নির্মল গ্রাম' নামে গ্রামে ঘরে ঘরে সরকারি খরচে শৌচালয় তৈরির কেন্দ্রীয় কর্মসূচির টাকা নয়ছয় হয়েছে৷ সবটাই হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাদের সামনে রেখে৷ ভোটের দিন ঘোষণার আগেই তিনি তদন্ত শেষ করাতে চান৷ যাতে এই তদন্ত রিপোর্ট তৃণমূল কংগ্রেস প্রচারে আনতে পারে৷

বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র অবশ্য সুব্রতবাবুর তদন্তের ঘোষণাকে কোনও পাত্তা দিতে চাননি৷ তিনি বলেন, 'জনসভাতে বলেছি, আবার বলছি, আমার বিরুদ্ধে যা খুশি করুক, জেলেও পাঠাতে পারে সরকার৷ ভয় পাই না৷ বিবৃতি দিয়ে নয়, হিম্মত থাকলে করে দেখান সুব্রতবাবু৷'
সুব্রতবাবুর অভিযোগ, সর্বশিক্ষা অভিযানের নামে সূর্যবাবু পঞ্চায়েত দপ্তরের মন্ত্রী থাকাকালীন দলের লোকেদের চাকরি দেওয়ার নামে কেন্দ্রের অনুমতি ছাড়াই প্রায় আট হাজার শিশু শিক্ষা কেন্দ্র (এসএসকে) ও মাধ্যমিক শিক্ষা কেন্দ্র (এমএসকে) খুলেছে৷ যা সম্পূর্ণ বেআইনি৷ এই কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষকদের বেতন কেন্দ্রীয় সরকার দেয়৷ অনুমোদন না থাকা কেন্দ্রগুলিতে শিক্ষকদের বেতন দিতে বছরে রাজ্যের খরচ হচ্ছে ৫৫ কোটি টাকা৷ পঞ্চায়েত দপ্তরের অফিসাররা জেলাশাসককে নিয়ে সরেজমিনে দেখবেন, কেন্দ্রীয় অনুমোদন ছাড়া যে কেন্দ্রগুলি তৈরি হয়েছে, তা সরকারি নিয়ম মেনে হয়েছে কি না৷ কারণ, সরকারের কাছে অভিযোগ এসেছে বহু এলাকায় খাতা-কলমে এসএসকে ও এমএসকে থাকলেও, বাস্তবে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই৷ সুব্রতবাবু বলছেন, পার্টির সদস্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করতে গিয়ে তাঁদের বয়সের প্রমাণপত্র ও শিক্ষাগত যোগ্যতা কিছুই দেখা হয়নি৷ তদন্তের রিপোর্ট হাতে পেলেই নিয়ম মেনে চলা প্রতিষ্ঠানগুলিকে অনুমোদন দেওয়ার জন্য কেন্দ্রর কাছে পাঠানো হবে৷ বেআইনি কেন্দ্র ও শিক্ষকদের ব্যাপারে রাজ্য মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেবে৷ কারণ, রাজ্য সরকার এমএসকে-র ছাত্র-ছাত্রীদের প্রথাগত শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে চায়৷ এদের মধ্য শিক্ষা পর্সদের অধীনে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে৷

শুধু সর্বশিক্ষা নয়, বিরোধী দলনেতা যখন এই দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি গ্রামে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্প নির্মল গ্রাম কর্মসূচি রূপায়ণে নামে সরকারি অর্থ নয়ছয় করেছেন বলেও সুব্রতবাবুর অভিযোগ৷ গোটা প্রকল্পটাই ব্যর্থ হয়েছে৷ এই কাজে যে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি নিযুক্ত রয়েছে, তাদের অনেকগুলিই ভুয়ো৷ সুব্রতবাবু বলছেন, 'কাগজে-কলমে কোনও কোনও গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে সরকারি পয়সায় শৌচালয় তৈরি করা হয়েছে৷ কিন্ত্ত বাস্তবে ছবিটা বিপরীত৷ পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নিজে গিয়ে দেখে এসেছি, এ ধরনের সরকারি
পয়সায় নির্মিত শৌচালয় হয়েছে বলে যা দেখানো হয়েছে, তা আসলে গোয়ালঘর ও পাটকাটি রাখার গুদাম৷ এ নিয়ে পঞ্চায়েত অফিসাররা তদন্ত করে দেখবেন৷'

দশম শ্রেণির এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় রেখে পালাল দুষ্কৃতীরা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ডায়মন্ড হারবারে গতকাল সন্ধেয় ঘটনাটি ঘটেছে। ডায়মন্ড হারবার থানার উল্টোদিকে একটি খাবার হোটেলের দোতলায় নিয়ে গিয়ে ওই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়। 

ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুলপির তিন ছাত্রী বুধবার ডায়মন্ড হারবারে বেড়াতে গিয়েছিল। সন্ধেয় ডায়মন্ড হারবার থানার ঠিক উল্টোদিকে একটি হোটেলে খাচ্ছিল তাঁরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তখনই একজন ছাত্রীর পরিচিত দুই যুবক তাকে হোটেলের দোতলায় নিয়ে যায়। সেখানে তাকে তারা ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ। বাধা দিতে গেলে আটকে রাখা হয় ছাত্রীর দুই সঙ্গীকে। তারপর, নিগৃহীতাকে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে পালায় দুষ্কৃতীরা। 

ছাত্রীটিকে প্রথমে ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে পরিস্থিতি খারাপ হলে কলকাতায় আনা হয় তাকে। ছাত্রীর পরিবারের লোকের অভিযোগের প্রেক্ষিতে হোটেলটি বন্ধ করে দিয়েছে পুলিস। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, ওই হোটেলের দোতলায় দীর্ঘদিন ধরেই অসামাজিক কাজকর্ম চলত। থানার নাকের ডগায় এই ঘটনা ঘটায় প্রশ্ন উঠেছে পুলিসের ভূমিকা নিয়েও। 


ফের রাজ্য সরকারের তীব্র ভর্ৎসনা করল সুপ্রিম কোর্ট। পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে অভিযুক্তদের জামিন প্রসঙ্গে রিপোর্ট চেয়েছিল শীর্ষ আদালত।  

পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডের ঘটনায় ধৃত দুই অভিযুক্ত জামিনের আবেদন করেছিল কলকাতা হাইকোর্টে। কিন্তু হাইকোর্ট তাদের আবেদন নাকচ  করে দেয়। এর পর সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে অভিযুক্তরা। সেই মামলার শুনানিতে গতবছরের নভেম্বর মাসে হাইকোর্টের থেকে রিপোর্ট চায় সর্বোচ্চ আদালত। 

জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও জমা পড়েনি সেই রিপোর্ট। ফলত পিছিয়ে যায় শুনানি। আজ মামলাটির শুনানি শুরু হল। সম্পূর্ণ রিপোর্ট পেশ করতে পারেনি রাজ্য সরকার। ফলে রাজ্য সরকারকে তীব্র ভর্ৎসনা করে সুপ্রিম কোর্ট। সর্বোচ্চ আদালতে অসম্পূর্ণ কাগজ পেশ করার জন্য ভর্ৎসনা করা হয় রাজ্যের অ্যাডভোকেট অন রেকর্ডকে। 

আগামী ২৯ জানুয়ারি এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত। 


পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডকে সাজানো বলে কটাক্ষ করে আগেই বিতর্কে জড়িয়ে অস্বস্তিতে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার তাঁর সরকার বিড়ম্বনায় পড়ল সুপ্রিম কোর্টে। পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডে রাজ্য সরকারকে কার্যত ভর্ত্‍‍সনা করেছে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট সুপ্রিম কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট৷ রাজ্য সরকারের তরফে এই ধর্ষণকাণ্ড মামলায় ত্রুটিপূর্ণ নথিপত্র পেশ করা হয়েছে বলে সর্বোচ্চ আদালত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। আদালতের সময় নষ্ট করার জন্য প্রথমে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করে বিচারপতি এইচ এল গোখেল ও বিচারপতি জি এস সিঙ্ঘভির ডিভিশন বেঞ্চ৷ পরে সরকারের তরফে আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমা চাওয়ায় জরিমানা মকুব করে দেওয়া হয়৷ পাশাপাশি সোমবারের মধ্যে ত্রুটিমুক্ত নথি পেশ করতেও রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয় বেঞ্চ৷ এর জেরে পার্কস্ট্রিটকাণ্ডে ধৃত অভিযুক্ত সুমিত বাজাজের জামিনের আবেদনের শুনানি আজ পিছিয়ে যায়৷ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে মঙ্গলবার৷ আদালত সূত্রে খবর, আজ বিচারকের সামনে দেওয়া অভিযোগকারিণীর গোপন জবানবন্দি পড়তে শুরু করে বেঞ্চ৷ কিন্তু দেখা যায়, এই জবানবন্দিতে বেশ কয়েকটি জায়গায় লেখা ইল্লিজিবল বা দুষ্পাঠ্য৷ গোপন জবানবন্দির মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিতে এরকম ত্রুটি দেখেই ক্ষুব্ধ হয় আদালত৷ মুখ পোড়ে সরকারের।বিচারকের সামনে দেওয়া অভিযোগকারিণীর গোপন জবানবন্দি এ দিন ডিভিশন বেঞ্চ পড়তে শুরু করে৷ এই জবানবন্দিতে বেশ কয়েকটি জায়গায় লেখা- 'ইলেজিবল' অর্থাত্‍‍, দুষ্পাঠ্য৷ গোপন জবানবন্দির মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিতে এরকম ত্রুটি দেখে আদালত ক্ষুব্ধ হয় বলে জানিয়েছেন পার্কস্ট্রিটকাণ্ডে ধৃত অভিযুক্ত সুমিত বাজাজের আইনজীবী অভিজিত্‍‍ চট্টোপাধ্যায়। গোপন জবানবন্দির মতো গুরুত্বপূর্ণ নথিতে ত্রুটি থাকায় হতাশ পার্কস্ট্রিটকাণ্ডের অভিযোগকারিণীও৷ 
ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, এটা কী করে সম্ভব? গোপন জবানবন্দি যিনি টাইপ করেছেন, তিনি হয়ত ভুল করেছেন৷ কিন্তু, তা সুপ্রিম কোর্টে পেশ করার আগে রাজ্যের তরফে আর কেউ দেখলেন না? প্রশ্ন উঠেছে, এই ত্রুটির মাধ্যমে রাজ্য সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও গাফিলতিই কি  প্রকাশ পেল না? 

http://abpananda.newsbullet.in/state/34-more/32871-2013-01-24-11-14-15


তিন সদস্যের বিচারপতি জে এস ভার্মা কমিটি বুধবার ধর্ষণ বিরোধী আইনের ব্যাপক পরিবর্তন চাইলেও ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করল। তার বদলে গণধর্ষণের জন্য ন্যুনতম ২০ বছর এবং ধর্ষণ ও খুনের ক্ষেত্রে আমৃত্যু সশ্রম কারাদণ্ডের সুপারিশ জানিয়েছে এই কমিটি।

গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লিতে চলন্ত বাসে এক তরুণীর গণধর্ষণকে কেন্দ্র করে সারা দেশ প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছিল। দেশ জোড়া প্রতিবাদের জেরে ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। গতকাল এই কমিটির কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ৬৩০ পাতার রিপোর্ট পেশ করেছে।

নাবালক অপরাধের ক্ষেত্রে বয়সের সীমা কমিয়ে এনে নতুন যে আইনের দাবি উঠেছিল ভার্মা কমিটির রিপোর্টে তারও বিরোধিতা করা হয়েছে। এর সঙ্গেই ধর্ষণের শাস্তি হিসাবে রাসয়ানিক ভাবে যৌন ক্ষমতা হরণেও সম্মতি জানায়নি এই কমিটি।

শুধুমাত্র শাস্তির বিধান না দিয়ে ধর্ষণ সহ বিবিধ যৌন নিগ্রহ রোধের চেষ্টা অনেক বেশি জরুরি বলে ভার্মা কমিটি জানিয়েছে। যে কোনও যৌন নিগ্রহ সংক্রান্ত অপরাধের দ্রুত বিচার এবং অপরাধীদের শাস্তি প্রদান প্রয়োজন বলেও জানিয়েছেন বিচারপতি ভার্মা। এর সঙ্গেই বর্তমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলেও সমালোচনা করেন তিনি।

পুলিস, মিলিটারি বা সরকারী যে সমস্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা যৌননিগ্রহের সঙ্গে জড়িত তাদের ক্ষেত্রে আইনের কড়া পদক্ষেপের সুপারিশ জানিয়েছে ভার্মা কমিটি। এর সঙ্গেই যে সব অঞ্চলে আফস্পা চালু আছে সেখানে উর্দির আড়ালে থাকা ধর্ষকদেরও সাধারণ ফৌজদারি আইনের আওতাভুক্ত করার প্রস্তাবও করা হয়েছে এই কমিটির পক্ষ থেকে।


আগামীকাল এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ছাড়া হতে পারে আরাবুল ইসলামকে। সেক্ষেত্রে কালই তাঁকে আদালতে পেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। গত সপ্তাহে গ্রেফতার করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আরাবুল ইসলামকে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তাঁকে এখনও আদালতে তোলা যায়নি। রেজ্জাক মোল্লার ওপর আক্রমণের মামলায় জামিন পেলেও, বামনঘাটায় বামেদের মিছিলে হামলার ঘটনায় এখনও জামিন পাননি এই তৃণমূল নেতা। 

১৭ জানুয়ারি আরাবুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিস। লকআপে থাকাকালীন বুকে ব্যথার অভিযোগ করেন তিনি। পরদিনই রাতে তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে হাসপাতলে চিকিত্‍সাধীন তৃণমূলের এই প্রাক্তন বিধায়ক। এরই মধ্যে রেজ্জাক মোল্লার ওপর আক্রমণের মামলায় জামিন পেয়েছেন আরাবুল। তবে বামনঘাটায় বামেদের মিছিলে হামলার ঘটনায় তিনি এখনও জামিন পাননি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া না পাওয়ায় তৃণমূল নেতাকে আদালতে হাজির করানো যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল বোর্ড শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আরাবুল ইসলামকে না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর বমি হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিত্‍সকরা। স্বভাবতই এদিনও আরাবুল ইসলামকে পেশ করা যায়নি আদালতে।  

অন্যদিকে, কলকাতা হাইকোর্টে রেজ্জাক মোল্লার ওপর হামলা নিয়ে মামলার শুনানি ছিল বৃহস্পতিবার। রাজ্যের বাইরের কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর দাবিতে মামলা করেছিলেন  রেজ্জাক মোল্লার ছেলে মুস্তাক আহমেদ। তবে বৃহস্পতিবার তাঁদের পক্ষ থেকে এই মামলায় নতুন করে আবেদন জানানোর আর্জি পেশ করা হয় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে। আদালত এই আবেদন গ্রহণ করেছে। ফের নতুন করে মামলার আবেদন করা হবে।  


নেতাজির স্মৃতিসৌধ গড়া নিয়েও বিতর্কে জড়ালেন মুখ্যমন্ত্রী। সুভাষচন্দ্রের জন্মভিটে কোদালিয়ায় স্মতিসৌধ গড়বে রাজ্য সরকার। বুধবার নেতাজি ভবনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথা ঘোষণা করেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখ্যমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেছেন ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ। তাঁর স্পষ্ট ঘোষণা, "মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা থাকায় নেতাজির নামাঙ্কিত স্মৃতিসৌধ মেনে নেবেন না বাংলার মানুষ।" 

সোমবার ক্যানিংয়ে সভা সেরে ফেরার পথে নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জন্মভিটে কোদালিয়ায় গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। পরদিনই ওই বাড়িটিতে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসনের আধিকারিকেরা। বুধবার নেতাজির ১১৮তম জন্মদিবসে নেতাজি ভবনে আয়োজিত সরকারি অনুষ্ঠান মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেন, আগামী বছরেই কোদালিয়ায়  জন্মভিটেতে নেতাজির স্মৃতি সৌধ তৈরি করবে রাজ্য সরকার। 
 
মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পরই শুরু হয়ে যায় বিতর্ক। রেড রোডে নেতাজিমূর্তিতে মাল্যদান পর্ব শেষ হওয়ার পরপরই স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কর্মসূচির বিরোধিতা করা হবে বলে জানিয়ে দেন প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ। নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে ফরওয়ার্ড ব্লকের ঘোষিত অবস্থান জানা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। এরপরেও তিনি কীভাবে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কর্মসূচি ঘোষণা করলেন তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে নানা মহলে। বুধবার নেতাজির ১১৮তম জন্মদিবস উপলক্ষ্যে একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সকালে শক্তিসংঘ ক্লাবের তরফে বেলতলা গার্লস হাইস্কুল থেকে একটি পদযাত্রায়  অংশ নেন মুখ্যমন্ত্রী। এরপর রাজ্য সরকারের উদ্যোগে নেতাজি ভবনে শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। সেখানে নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রী। উপস্থিত ছিলেন নেতাজি কন্যা অনিতা পাফও। মুখ্যমন্ত্রী জানান আগামী বছরও নেতাজি ভবনেই হবে মূল সরকারি অনুষ্ঠান।  


একদা পরিবর্তনের দাবিতে বাম সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন শিল্পী সমীর আইচ৷ কিন্তু,ক্ষমতা বদলের পরও ফের তাঁকে পথে নামতে হয়৷ কখনও পার্কস্ট্রিট তো কখনও ব্যঙ্গচিত্র বা আমিনুলকাণ্ডের প্রতিবাদে৷ প্রশাসনের সমালোচনায় সরব হন শিল্পী সমীর৷ মোমবাতি মিছিলেও অংশ নেন তিনি৷ এর মাসুল অবশ্য তাঁকে দিতে হয়৷ সম্প্রতি, অতিথি হয়েও, অপমানিত হতে হয় আসানসোলের বার্ণপুর উত্সবে গিয়ে৷ এরপরই, সোমবার ক্যানিংয়ের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী নিশানা করেন সমীর আইচকে৷ কটাক্ষ করে তিনি বলেন, সমীর আইচ একদিন মিছিলে হেঁটেছিল বলেই পরিবর্তনপন্থী হয়ে গেলেন? নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীর গলায় অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর উল্টো সুর৷ তাঁর দাবি, সমীর অনেক মিছিলে হেঁটেছেন৷ অনেক সভায় গিয়েছেন৷ সমীর আইচ তৃণমূলপন্থী নন৷ তবে তিনি পরিবর্তনপন্থী তো বটেই৷ 

ক্ষুব্ধ ফব, বিভেদ চান না সূর্য
আর রেড রোড নয়, নেতাজি জয়ন্তীতে
লাখ লোকে এলগিন ভরাবেন মমতা
সৌজন্য দেখাতে গত বছর রেড রোডে নেতাজি-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে রাজ্য সরকারের আগে বাম নেতাদের শ্রদ্ধা জানানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি। আর এ বার রাজ্য সরকারের গোটা অনুষ্ঠানটিকেই নেতাজি ভবনে সরিয়েনিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! জানালেন, আগামী বছর থেকে অনুষ্ঠান হবে নেতাজি ভবনের বাইরে, এলগিন রোডে। রাস্তার উপরে। এবং সেই অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন এক লক্ষ মানুষ। রেড রোডে নেতাজি-মূর্তির পাদদেশ থেকে সরকারি অনুষ্ঠানের এ ভাবে সরে যাওয়া নিয়ে রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করলেন প্রবীণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশোক ঘোষ। বিধানসভার বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর বক্তব্য, ভেদাভেদ না করে এমন একটা অনুষ্ঠান এক সঙ্গে হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
দীর্ঘ দিন ধরেই নেতাজি-জয়ন্তীর সরকারি অনুষ্ঠান হয়ে এসেছে রেড রোডে। কিন্তু মাত্র দু'দিন আগে, সোমবার, এলগিন রোডে নেতাজি ভবনে অনুষ্ঠানের বরাবরের উদ্যোক্তা নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-কে জানানো হয়, সরকারি অনুষ্ঠানও এ বার সেখানে হবে। এবং থাকবেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। রিসার্চ ব্যুরোর ধারণাই ছিল না, সরকারি উদ্যোগে ঠিক কী হতে চলেছে সেখানে। আসলে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কোনও কোনও বছর সেখানে গেলেও সরকারি অনুষ্ঠানটি পালিত হয় রেড রোডেই। গত বছরও যেমন মমতা নেতাজি ভবনের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন, কিন্তু রাজ্য সরকার নেতাজি-জয়ন্তী পালন করেছিল রেড রোডে। ব্যতিক্রম হল এ বারই।
বুধবার নেতাজি-ভবনে রাজ্য সরকারের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী, রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই সদস্য ফিরহাদ হাকিম ও অরূপ বিশ্বাস, কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় ও স্থানীয় সাংসদ সুব্রত বক্সী। নেতাজি ভবনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী শুধু নেতাজির স্মরণে বক্তৃতাই দেননি, পুরোদস্তুর আয়োজকের ভূমিকাতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে! কখনও মাইক হাতে ভিড় সামলানোর চেষ্টা, কখনও পুলিশকে, কখনও চিত্র-সাংবাদিকদের ধমক সবই করেছেন তিনি।
খুদেদের সঙ্গে। নেতাজি ভবনে। পাশে সুভাষ-তনয়া অনিতা, সুগত বসু। —নিজস্ব চিত্র
অনুষ্ঠান নিয়ে সরকারের বেমক্কা সিদ্ধান্ত বদলের জেরে এ দিন দুপুর ১২টা নাগাদ নেতাজি ভবনের স্বল্প পরিসরে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি ভিড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা হয়। অনুষ্ঠানস্থলে চূড়ান্ত অব্যবস্থা। মুখ্যমন্ত্রী তখন ঘোষণা করলেন, "জায়গা খুব কম। যে-যেখানে আছেন, বসে পড়ুন।" কিন্তু মানুষ বসবেন কোথায়? দাঁড়ানোরই জায়গা নেই! তার মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, আগামী বছর থেকে অনুষ্ঠান হবে এলগিন রোডে, নেতাজি ভবনের বাইরে। 
এ বছরই কেন এলগিন রোডে রাস্তার উপরে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হল না, সে জন্য তথ্য ও সংস্কৃতি সচিব নন্দিনী চক্রবর্তীর প্রতি উষ্মাও প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, "আমাদের ক্ষমা করবেন। নন্দিনী চক্রবর্তীকে আমি এখনই নির্দেশ দিচ্ছি, পরের বার বাইরে মঞ্চ করবেন। এ বারও কিন্তু আমি বলেছিলাম। আপনারা কী করে আশা করেন, এই টুকু জায়গার মধ্যে এত মানুষের স্থান সঙ্কুলান হবে?'' সেই সময়ে 'খুদে নেতাজি' সেজে আসা ১১৭ জন কচিকাঁচাদের বাইরে যাওয়ার পথ করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মমতা বলেন, "যাও বাবু, লক্ষ্মী ছেলে হয়ে বাড়ি যাও। আজ সারা দিন 'জয় হিন্দ' করবে। নেতাজিকে মনে রাখবে।"
রেড রোডের অনুষ্ঠানে অবশ্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় গিয়েছিলেন। বাম নেতাদের সঙ্গে তাঁর সৌজন্য বিনিময় হয়। অশোক ঘোষের পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেন সুব্রতবাবু। মালা দিতে যান প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও। রেড রোডে নেতাজি মূর্তির পাদদেশে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে আনুষ্ঠানিক ভাবে 
ধন্যবাদ জানান বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। তবে সরকারি উদ্যোগে ময়দানে নেতাজি-জয়ন্তী উদ্যাপনের ব্যবস্থা না-হওয়া এবং সেখানে মুখ্যমন্ত্রীর না-আসার ঘটনায় উষ্মা প্রকাশ করেন অশোকবাবু। রেড রোডের অনুষ্ঠান এ বার কার্যত হয়েছে বামেদের উদ্যোগেই। 
নেতাজি ভবনে রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন ও মুখ্যমন্ত্রী একে অপরের প্রশংসা করেন। রাজ্যপাল বলেন, "আমি আশা করি, নেতাজির কাজ ও আদর্শে দেশবাসী অনুপ্রাণিত হবেন। এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে আহ্বান জানাচ্ছি।" আর মুখ্যমন্ত্রী বক্তৃতার শুরুতেই বলেন, "আমাদের রাজ্যপাল খুবই সক্রিয়। আমাদের প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি উপস্থিত থাকেন।" রাজ্যপাল পরে রেড রোডে গিয়ে নেতাজি মূর্তির পাদদেশে মালা দেন।
রাজ্যপাল রেড রোডে পৌঁছলে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করেন সূর্যকান্ত মিশ্র, বিমানবাবুও। এ বার রাজ্য সরকার নেতাজি মূর্তিতে কোনও অনুষ্ঠান না করা প্রসঙ্গে রাজ্যপাল বলেন, "আমিই তো সরকারের প্রধান। আমি এসেছি শ্রদ্ধা জানাতে।" পরে সূর্যবাবু বলেন, "আমরা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোঝানোর চেষ্টা করব, আবার কী করে এক মঞ্চেই অনুষ্ঠান করা যায়। নেতাজির মতো কারও জন্মদিনে রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়াক, এটা চাই না।"
কুশল বিনিময়: রেড রোডে নেতাজি-জয়ন্তীর অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
এবং সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বুধবার। ছবি: প্রদীপ আদক
অশোকবাবু জানান, রাজ্যপালকে যে ভাবে 'লুকিয়ে লুকিয়ে' এসে মালা দিয়ে চলে যেতে হচ্ছে, তা ভবিষ্যতে আর না-হওয়াই বাঞ্ছনীয়! ময়দানে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে সরকারি অনুষ্ঠান না-হওয়ায় ক্ষোভ গোপন করেননি অশোকবাবু। পূর্ত দফতর প্রতি বার রেড রোডে নেতাজি মূর্তিতে মালা দেওয়ার সুবিধার্থে সিঁড়ি তৈরি করে। এ বার তা হয়নি। সুব্রতবাবু বলেন, "কেন করেনি, তা আমি জানি না।"
রাজ্য সরকারের তরফে নেতাজি-জয়ন্তী পালনের শুরু এ দিন বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ বেলতলা গার্লস হাইস্কুলের সামনে প্রভাতফেরি থেকে। ওই প্রভাতফেরির উদ্যোক্তারাই ১১৭ জন খুদেকে নেতাজি সাজিয়ে নিয়ে যান। প্রভাতফেরি শেষ হয় নেতাজি ভবনে। প্রভাতফেরিতে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তাঁরা সকলে নেতাজি ভবনে ঢুকতে গেলে পুলিশ আটকায়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীই নেতাজি ভবনের সদর দরজায় দাঁড়িয়ে সকলকে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন। তাঁর কথায়, "নেতাজির জন্মোৎসব পালিত হবে আর নেতাজি ভবনে জনগণের পদধ্বনি হবে না, এটা হতে পারে না।"
তা হলে কি নেতাজি ভবনের অনুষ্ঠানও মমতা 'হাইজ্যাক' করে নিলেন? যেমন ক'দিন আগেই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষ যাত্রার দখল নিয়েছিলেন। নেতাজি রিসার্চ ব্যুরো-র পক্ষে সুগত বসু অবশ্য বলেন, "রিসার্চ ব্যুরো-র অনুষ্ঠান যথারীতি সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্তই হয়েছে। বেলা ১২টার পর পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের অনুষ্ঠান নেতাজি ভবনে করেছে, আমাদের সঙ্গে যৌথ ভাবে। সরকারের তরফে জানানো হয়, নেতাজির জন্ম মুহূর্তের সময়কে মনে রেখে সেই সময়ে তাঁরা শ্রদ্ধা জানাতে চান নেতাজি ভবনের মঞ্চেই।"

http://www.anandabazar.com/24cal1.html


আমিনুলকাণ্ডের প্রতিবাদে সমীর আইচের পথে নামাকেও সমর্থন করেছেন বিভাস চক্রবর্তী৷ মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষের প্রতিবাদে রাজ্য সরকারের ৫টি কমিটি থেকে ইস্তফা দেন শিল্পী সমীর আইচ৷ এ ব্যাপারে মমতাপন্থী অর্পিতা ঘোষ বলেন, অনেক জায়গায় সমীর আইচের সঙ্গে আন্দোলন করেছি৷ একসঙ্গে অনেকটা পথ হেঁটেছি৷ এমনকী প্রচারও করেছি৷ সমীর আইচের ইস্তফা দুঃখের৷ তবে, কোনও মন্তব্য একজন কী ভাবে গ্রহণ করছে, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ৷ 
বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, পার্কস্ট্রিট, ব্যঙ্গচিত্র বা আমিনুলকাণ্ড-সহ বিভিন্ন ঘটনায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে মুখ খোলার জেরেই কি তৃণমূলনেত্রীর কটাক্ষের লক্ষ্য হতে হয়েছে একদা পরিবর্তনকামী সমীর আইচকে?

http://abpananda.newsbullet.in/state/34-more/32843-2013-01-23-16-26-18

মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে `মর্মাহত` কিন্তু `বিস্মিত` নন তিনি। ২৪ ঘণ্টাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে  এমনটাই জানিয়েছেন চিত্রশিল্পী সমীর আইচ। বিধানসভা নির্বাচনের আগে  পরিবর্তন চেয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন  শিল্পী-সাহিত্যিকদের একাংশ। আজ সমীরবাবু বলেন, "প্রয়োজনে আবারও রাস্তায় নামবেন তাঁরা।"

আজকের মুখ্যমন্ত্রীর একসময়ের সহযোদ্ধা ছিলেন সমীর আইচ। সেকারণে মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে কিছুটা মর্মাহত তিনি। তবে ইদানিং মুখ্যমন্ত্রীর একাধিক বিতর্কিত মন্তব্যের প্রসঙ্গে টেনে সমীরবাবু জানান, এধরণের আচরণে আদৌ বিস্মিত নন তিনি। বছর দুয়েক আগে রাজ্যে রাজনৈতিক  পালাবদল চেয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন শিল্পী সাহিত্যিকদের একাংশ। বুধবার সমীরবাবুর বলেন, প্রয়োজনে আবারও রাস্তায় নামবেন তাঁরা।

http://zeenews.india.com/bengali/kolkata/samir-takes-on-mamata_10910.html 

রেজ্জাক মোল্লার ওপর হামলার ঘটনায় তদন্তের বিষয়ে মামলার শুনানি আজ । গত মঙ্গলবার, নিরপেক্ষ তদন্তের আবেদন জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন রেজ্জাকপুত্র মুস্তাক আহমেদ। প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুস্তাক আহমেদ নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে গোটা ঘটনার তদন্তের আবেদন জানিয়েছেন । আজ হাইকোর্টের বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে মামলার শুনানি হবে। 

ভাঙরে গত ৬ জানুয়ারি সিপিআইএমের প্রবীণ নেতা রেজ্জাক মোল্লার উপর হামলা হয়। হামলায় গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতেলে ভর্তি হন তিনি। তাঁকে হামলার মূল অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকে বহু টালবাহানার পর চলতি মাসের ১৬ তারিখ গ্রেফতার করা হয়। 

প্রবীণ সিপিআইএম বিধায়ককে মারধর ও বামনঘাটায় সিপিআইএম কর্মীদের ওপর আক্রমণের ঘটনায় গ্রেফতারের পর পুলিসি হেফাজতে থাকাকালীন আইসিসিইউতে ভর্তি হন আরাবুল। মুস্তাকের অভিযোগ, সেসময় আরাবুলকে জেরা করেনি পুলিস। 


আগামীকাল এসএসকেএম হাসপাতাল থেকে ছাড়া হতে পারে আরাবুল ইসলামকে। সেক্ষেত্রে কালই তাঁকে আদালতে পেশ করার সম্ভাবনা রয়েছে। গত সপ্তাহে গ্রেফতার করা হয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস নেতা আরাবুল ইসলামকে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি থাকায় তাঁকে এখনও আদালতে তোলা যায়নি। রেজ্জাক মোল্লার ওপর আক্রমণের মামলায় জামিন পেলেও, বামনঘাটায় বামেদের মিছিলে হামলার ঘটনায় এখনও জামিন পাননি এই তৃণমূল নেতা। 

১৭ জানুয়ারি আরাবুল ইসলামকে গ্রেফতার করেছিল কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার পুলিস। লকআপে থাকাকালীন বুকে ব্যথার অভিযোগ করেন তিনি। পরদিনই রাতে তাঁকে এসএসকেএমে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে হাসপাতলে চিকিত্‍সাধীন তৃণমূলের এই প্রাক্তন বিধায়ক। এরই মধ্যে রেজ্জাক মোল্লার ওপর আক্রমণের মামলায় জামিন পেয়েছেন আরাবুল। তবে বামনঘাটায় বামেদের মিছিলে হামলার ঘটনায় তিনি এখনও জামিন পাননি। কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া না পাওয়ায় তৃণমূল নেতাকে আদালতে হাজির করানো যাচ্ছে না। বৃহস্পতিবার মেডিক্যাল বোর্ড শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আরাবুল ইসলামকে না ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর বমি হচ্ছিল বলে জানিয়েছেন চিকিত্‍সকরা। স্বভাবতই এদিনও আরাবুল ইসলামকে পেশ করা যায়নি আদালতে।  

অন্যদিকে, কলকাতা হাইকোর্টে রেজ্জাক মোল্লার ওপর হামলা নিয়ে মামলার শুনানি ছিল বৃহস্পতিবার। রাজ্যের বাইরের কোনও নিরপেক্ষ সংস্থাকে দিয়ে তদন্ত করানোর দাবিতে মামলা করেছিলেন  রেজ্জাক মোল্লার ছেলে মুস্তাক আহমেদ। তবে বৃহস্পতিবার তাঁদের পক্ষ থেকে এই মামলায় নতুন করে আবেদন জানানোর আর্জি পেশ করা হয় বিচারপতি দীপঙ্কর দত্তের এজলাসে। আদালত এই আবেদন গ্রহণ করেছে। ফের নতুন করে মামলার আবেদন করা হবে।  


বারুইপুরে ফের বাইকবাহিনীর হামলা। হরিহরপুরে এক মহিলার হার ছিনতাই করে উধাও হল দুষ্কৃতীরা। পিছনে ধাওয়া করায় মহিলাকে লক্ষ্য করে গুলিও চালায় তাঁরা। গত কয়েকদিন পর পর তিনটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটলেও ধরা পড়েনি কেউই। ফলে রীতিমতো আতঙ্কিত এলাকার বাসিন্দারা।  ক্ষোভ বাড়ছে পুলিসি নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও।

গত সপ্তাহেই বারুইপুর এলাকায় ছিনতাই এবং গুলি চালানোর দুটি ঘটনা ঘটেছে। বুধবারও ভরদুপুরে একই কায়দায় হরিহরপুর এলাকায় অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী মহুয়া দে চক্রবর্তীর গলার হার ছিনতাই করল দুষ্কৃতীরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। হঠাতই বাইকে চেপে এসে তিন দুষ্কৃতী কোনওকিছু বুঝে ওঠার আগেই মহুয়াদেবীর গলা থেকে হার ছিনতাই করে  চম্পট দেয়। মহুয়াদেবী পেছনে ধাওয়া করলে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে দুষ্কৃতীরা। 

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছন বারুইপুরের এসডিপিও। গত সপ্তাহেই বারুইপুরে ছিনতাই এবং গুলি চালানোর দুটি ঘটনা ঘটেছে। পরপর এধরনের ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। 


কালের পুরাণ

নেতা-নেত্রীদের মুখের ভাষা

সোহরাব হাসান | তারিখ: ০৪-০৩-২০১২


মার্চ ১৯৭১ আর মার্চ ২০১২-এর মধ্যে কত আকাশ-পাতাল পার্থক্য। একাত্তরের মার্চে স্বাধীনতা লাভের জন্য সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। আজ জাতি পুরো বিভক্ত। কোনো একটি জাতীয় ইস্যুতে প্রধান দুটি দল একমত হতে পারছে না। একদল যদি বলে সূর্য পূর্ব দিকে উঠবে, অন্য দল এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজবে। যেকোনো জাতির প্রধান শক্তি অর্থ বা অস্ত্রশক্তি নয়, জাতীয় মতৈক্য। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার পর সেই মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক দিনের জন্যও নয়। বিদেশি দখলদার কিংবা স্বদেশি সামরিক শাসক তাড়াতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি, কিন্তু দেশ পরিচালনা, সরকার পরিচালনা এমনকি নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারিনি। 'আমি যা চিন্তা করি, আমার দল যা ভাবে, সেটাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তা, সেটাই মহত্তম ভাবনা, এর বাইরে কিছু থাকতে পারে, মানুষ বিকল্প কিছু ভাবতে পারে', আমাদের মহান নেতা-নেত্রীরা তা স্বীকার করেন না। তাঁরা আলোচনায় বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন সংঘাতে। যুক্তিতে আস্থা রাখেন না, আস্থা রাখেন গালিগালাজে। তাঁরা সংসদ কার্যকর করেন না, রাজপথ দখলে রাখতে সদা সক্রিয় থাকেন। 
আমাদের মহান স্বাধীনতা এবার ৪১ বছরে পড়েছে। স্বাধীনতার এই মার্চে নেতা-নেত্রীদের ভাষণ ও আচরণ হতে পারত নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় ও অনুসরণীয়। সব রাজনৈতিক দল সম্মিলিত অথবা যুগপৎ বিপুল উদ্দীপনায় উদ্যাপন করতে পারত স্বাধীনতার মাসটি। নেতা-নেত্রীরা লাখো শহীদের কথা মনে রেখে অন্তত এই মাসটিতে তাঁরা গালিগালাজ বন্ধ রাখতে পারতেন। একে অপরকে আরেকটু সম্মান জানিয়ে কথা বলতে পারতেন। সম্ভবত সেটিই হতো শহীদদের প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন। তার বদলে সরকার ও বিরোধী দলের বিজ্ঞ নেতা-নেত্রীরা প্রচণ্ড ঘৃণা, প্রবল বিদ্বেষ, তীব্র হিংসা ছড়াচ্ছেন। প্রতিপক্ষকে অপমান করে আনন্দ পাচ্ছেন। অথচ যে আমজনতার নামে তাঁরা রাজনীতি করছেন, তাঁদের প্রাত্যহিক জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণা, কষ্ট ও গ্লানি তাঁদের স্পর্শ করছে না।
স্বাধীনতার ৪১তম বার্ষিকীতে রাজনীতিকেরা কি মনে রেখেছেন শহীদদের কথা? তাঁরা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে যে দেশটি স্বাধীন করে গেছেন, আমরা তাঁদের জন্য কী করেছি, কী দিয়েছি? তাঁরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে আদর্শকে সামনে রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের জন্য আপনারা কী করেছেন? তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে আপনাদের কেউ প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন, কেউ বিরোধী দলের নেতা। তাঁদের জন্যই তো এই রাষ্ট্র, এই জাতীয় সংসদ, এই মন্ত্রিসভা, এই সরকার ও এই বিরোধী দল। কিন্তু পাদপ্রদীপের নিচে যে ১৬ কোটি মানুষ, প্রতি পাঁচ বছর পর যাঁদের ভোটে আপনারা নির্বাচিত হন, তাঁদের জন্য কী করেছেন, কী করবেন?
দেশের রাজনীতি কি এভাবেই চলবে? একদল আরেক দলকে ঠেঙাবে? গালিগালাজ করবে? একজন আরেকজনের টুঁটি চেপে ধরবে? এভাবেই কি সরকারি ও বিরোধী দল যুদ্ধ জিইয়ে রাখবে? এভাবেই কি আমরা সর্বনাশের পথে হাঁটতে থাকব? মাননীয় নেতা-নেত্রীরা একবার চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, পাশের দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা, সরকারপ্রধানেরা কী করেছেন আর আপনারা কী করেছেন। 
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান রাজনীতিক। একনাগাড়ে তিন দশক ধরে দেশের বড় দুটি দলের নেতৃত্ব দেওয়া এবং দুই-দুই মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নজির গণতান্ত্রিক বিশ্বে বিরল। আমেরিকায় পরপর দুই মেয়াদের বেশি কেউ প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দলের প্রধান ছিলেন না। সোনিয়া গান্ধী দুই দশক ধরে দল পরিচালনা করলেও সরকারে যাননি। অন্তরাত্মার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদ বর্জন করেছেন। 
দেশের সব শ্রেণী ও পেশার মানুষ আপনাদের প্রতি যে আস্থা রেখেছেন, যে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন, আপনারা তার বিনিময়ে তাঁদের কী দিয়েছেন? আপনারা আর কিছু না পারুন অন্তত নতুন প্রজন্মকে হিংসা ও গালিগালাজ শেখাবেন না। অশালীন ভাষা শেখাবেন না। দেশজুড়ে আপনাদের যে লাখ লাখ সমর্থক আছেন, অন্তত তাঁদের কথা মনে রেখেই এমন কিছু বলবেন না, যাতে প্রতিপক্ষ আহত হয়, অপমানিত হয়। দেশের বরণীয় নেত্রী হয়েও যদি আপনারা একজন আরেকজনকে 'খবর আছে' হুমকি দেন, 'লুলা' করে দেওয়ার কথা বলেন, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ, আমজনতা কী শিখবে? সমাজে যে অসহিষ্ণুতা, অসংযম, মানুষের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধাবোধ—তার জন্য আপনারাও কম দায়ী নন।
রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য, না ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশের জন্য? সরকারের প্রধান দায়িত্ব দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো, না অন্যের হাসি কেড়ে নেওয়া? সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন, রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ—নির্বাহী, বিচার ও আইন বিভাগ—কারও ওপর কারও হস্তক্ষেপ কাম্য নয়। অথচ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের কথা শুনলে মনে হবে, মামলা, তদন্ত, বিচার—এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। কাউকে ধরে এনে শূলে চড়িয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
সরকারের মন্ত্রীরা দাবি করেন, আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের চেয়ে, আগের বিএনপি সরকারের চেয়ে দেশ ভালো চালাচ্ছেন। ভালো চালানোর জন্যই তো জনগণ ভোট দিয়ে আপনাদের ক্ষমতায় এনেছে। কিন্তু সেই ভালো যে কতটা ভালো, তা বিচার করার অধিকারও জনগণের আছে। 
আজকের মন্ত্রী-সাংসদেরা যেভাবে দম্ভ দেখাচ্ছেন, বিএনপির আমলে তাদের মন্ত্রী-এমপিরাও দেখাতেন। কোথায় তাঁরা এখন? আওয়ামী লীগের বড় গুণ, ক্ষমতায় গেলে সাধারণ মানুষের কল্যাণে কিছু কাজ করে। আর আওয়ামী লীগের বড় দোষ সমালোচনা একদম সহ্য করতে পারে না। কেউ সমালোচনা করলেই দেশ ও জনগণের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিএনপি-জামায়াতের দালাল বানানো হয়। আওয়ামী লীগের চরিত্রের মধ্যে এক ধরনের গোয়ার্তুমি আছে, যা তার অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে সংক্রমিত করছে। অস্বীকার করছি না, এই দেশের স্বাধীনতার জন্য আওয়ামী লীগেরই অবদান বেশি, তারা রাজপথে ও যুদ্ধক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে। তার অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগের বাইরে কেউ কিছু করেননি। ১৯৭১ সালে কতিপয় দালাল, রাজাকার, আলবদর ছাড়া সবাই যাঁর যাঁর অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। আওয়ামী লীগের নেতারা যখন নিজেদের দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের সিপাহশালার দাবি করেন, তখন তাঁরা যেন এ কথাও মনে রাখেন যে এই দলই খন্দকার মোশতাক আহমদ, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, ওবায়েদুর রহমান, শফিউল আলম প্রধান, কোরবান আলী, ইউসুফ আলীদের জন্ম দিয়েছে।
১২ মার্চ বিএনপির মহাসমাবেশ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কেন? এই এক দিনের কর্মসূচিতে কি সরকারের পতন ঘটে যাবে? শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবেন? তাহলে সরকারি মহলে এত তোলপাড় কেন? ১২ মার্চের কর্মসূচির পক্ষে বিএনপির নেতা-কর্মীরা যত না প্রচার করছেন, তার চেয়ে বেশি করছেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, 'শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করলে সমস্যা নেই। কিন্তু কর্মসূচির নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালালে খবর আছে।' এটি কি প্রধানমন্ত্রীসুলভ কথা হলো? বিএনপি কেন, যেকোনো দল বা ব্যক্তি কর্মসূচির নামে কোনো চক্রান্ত করলে, সন্তাসী কর্মকান্ড চালালে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব তা শক্ত হাতে দমন করা।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বিএনপির নেতা-কর্মীদের প্রতি কর্মসূচি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। মানুষ কোনটি সত্য ধরে নেবে? প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি, না তাঁর দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের আহ্বান? বিএনপির ১২ মার্চের মহাসমাবেশের আগে ও পরে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দল একাধিক কর্মসূচি দিয়েছে। তারা গণমিছিল করবে, মানববন্ধন করবে, মহাসমাবেশ করবে। মনে রাখবেন, একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালিত হলে এক দিনে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু পালিত না হতে পারলে তার রেশ অনেক দিন, অনেক মাস থেকে যাবে। 
আমরা বুঝি না, আওয়ামী লীগ দেশের জন্য এত কাজ করেছে, জনগণের এত উন্নতি করেছে, এত গণমুখী কর্মসূচি নিয়েছে, তারপরও তারা সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছে কেন? সামরিক শাসনামলে নির্বাচনী রায় বানচাল করা হয়েছে, বিএনপি আমলে প্রহসনমূলক নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলে সব নির্বাচন স্বচ্ছ হয়েছে, এটা নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগের কৃতিত্ব। প্রধানমন্ত্রী প্রায়শ একটি কথা বলেন, 'আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় জনগণ কিছু পায়, তারা ক্ষমতায় না থাকলে জনগণ কিছু পায় না।' এটা যদি সত্য হবে, তাহলে আওয়ামী লীগ এত ভয় পাচ্ছে কেন? তাদের বলা উচিত, নির্বাচন যেই সরকারের অধীনেই হোক না কেন আমরা ভয় পাই না। আমরা জনগণের জন্য কাজ করেছি, জনগণকে ভরসা করি। তাহলে বুঝতাম জনগণের প্রতি তাদের সত্যি সত্যি ভরসা আছে। 
তবে আওয়ামী লীগকে এও মনে রাখতে হবে যে তারা যে দুবার ক্ষমতায় এসেছে, সেই দুবারই নির্বাচন হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। বিএনপি যদি ২৫-৩০ বছর পরও ক্ষমতায় আসে, তখন আওয়ামী লীগ যে ফের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলবে না, তার নিশ্চয়তা কী? 
সংবিধানে লেখা আছে, 'বাংলাদেশ একটি প্রজাতন্ত্র।' কিন্তু এ কথা লেখা নেই, বাংলাদেশ একটি আওয়ামী লীগ বা বিএনপিদলীয় প্রজাতন্ত্র। ক্ষমতায় থাকতে দুই দলই মনে করে, গায়ের জোরে সবকিছু করা যাবে। আদালত যদি কাউকে মৃত্যুদণ্ডও দেয়, তাকে সসম্মানে জেল থেকে বের করে আনা হবে। আনা হচ্ছে। জাতীয় সংসদে কী হচ্ছে? বিরোধী দল নেই। তারপরও সরকারি দলের সাংসদেরা যে ভাষায় গালিগালাজ করেন, তা শুনলে ভদ্রলোকদের কানে আঙুল দিতে হয়। দল করলে, রাজনীতি করলে, ক্ষমতায় থাকলে কি সভ্যতা, ভব্যতা ও রুচি-সংস্কৃতি—সবকিছু বিসর্জন দিতে হয়? মাননীয় সাংসদেরা, মাননীয় মন্ত্রীরা, মাননীয় বিরোধী দলের নেতা-নেত্রীরা, আপনারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন, দেশবাসীর কাছে কী দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছেন? 
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-03-04/news/229665


তেজস্ক্রিয় ও আত্মঘাতী বাঙালি – ফারুক ওয়াসিফ

20 বার পঠিত

একজন ফন্দি আঁটছে, আজ রাতে কার মাংস খাবে। আরেকজন দ্বিধায় আছে, অপরের মাংস খাওয়ার চেয়ে নিজের হাত-পা খাওয়াই বেশি ভালো কি না। প্রথমজন খুন করল, দ্বিতীয়জন করল আত্মহত্যা। কিন্তু কার্যত, দুটোই আত্মঘাতী। নিজের প্রতি ঘৃণা বা হতাশায় নিজেকে খাওয়া আর হিংসার বশে অপরকে হত্যা করায় একদিকে থাকে মৃত মানুষ, অন্যদিকে থাকে খুনিমানুষ। যে মানুষ অন্য মানুষের মাংস খায়, তাদের বলে ক্যানিবাল। বাস্তবে ক্যানিবালিজম কোথাও ছিল কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কিন্তু পশ্চিমা সমাজে মুষ্টিমেয় কিছু তরুণ বিশ্বাস করে, ক্যানিবালিজম ভালো জিনিস। তারা নিশ্চয়ই বিকারগ্রস্ত।কিন্তু আমরা যারা পরস্পরের মাংস খেয়েচলছি, তারা কতটা সুস্থ?

ক্যানিবালিজম না থাকলেও 'সোশ্যাল ক্যানিবালিজম' নামে একটি কথা চালু আছে। অপরের ক্ষতি চাওয়া এর সামান্য রূপ। আর অসামান্য রূপটি হচ্ছে: অবিরত হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ ও গণপিটুনির হিড়িক। এসবই চলছে এখন বাংলাদেশে। মাস্তান কি বিবেকবান, পেশাদার কি দিলদার—সবাই যেন সহিংস হয়ে উঠছে। পরস্পরের মাংস খাওয়ার মতো তেজস্ক্রিয় ক্রোধ জমছে ব্যক্তি থেকে সমষ্টির মনের ভেতরে। কোনো এক ঘটনায় বেরিয়ে পড়ছে তার ভয়াবহতা। এ ব্যাপারে আধুনিক জগতে বাঙালিরাই অদ্বিতীয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রে নিয়মিতভাবে মার্কেটে, স্টেশনে ও স্কুলে গুলি করে হত্যালীলার কাহিনি শুনি। বর্ণবাদী যুগে আফ্রিকা ও আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের 'লিঞ্চিং'য়ে হত্যার কথাও জানি। কিন্তু আমাদের বিষফোঁড়াটা মনে হয় ভিন্ন প্রকৃতির। এর চিকিৎসা কত দূর করা যাবে জানি না, কিন্তু সমস্যাটাকে না বুঝে উপায় নেই। কারণ, সমস্যাটা আত্মঘাতী হয়ে উঠছে। অকারণে কে কখন কীভাবে কার শিকার হবে, তা কে বলবে?

আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের সূচনায় কোনো ঘণ্টা বাজে না। নীরবেই তা শুরু হয়ে যায়। এক চীনা জল্লাদের সাধনা ছিল, এমন সূক্ষ্মভাবে মানুষের কল্লা কাটা, যাতে শিকার টেরটিও না পায়। সাধনায় এমন নিখুঁত হয়ে উঠল তাঁর দক্ষতা যে, গলা কাটার পরও এক হতভাগা প্রশ্ন করে, 'কই, কিছু টের পাচ্ছি না তো।' জল্লাদ মহাশয় গর্বিত হাসি দিয়ে বললেন, 'জনাব, মাথাটা একটু ঝাঁকান, টের পাবেন।' ঝাঁকুনি দিতেই ধড়-মাথা আলাদা; নিহত লোকটি টেরও পেল না। ঝাঁকুনি ছাড়া আমরাও অনেক সময় বুঝি না, মাথাটা যথাস্থানে আছে কি নেই। গত কয়েক বছরে সামাজিক সহিংসতা, নৃশংসতা ও রাজনীতি-বহির্ভূত হানাহানি দেশকে ঝাঁকাচ্ছে। সমাজের ভেতরে মানুষের মনের গহিনে গভীর থেকে গভীরতর ব্যাধি বাসা বেঁধেছে, অথচ সমাজপতিদের হুঁশ নেই। এককথায় এই ব্যাধিরই প্রতীকী নাম 'নরমাংস ভক্ষণের ইচ্ছা' বা ক্যানিবালিজম।

জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'অপরের মুখ ম্লান করে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ নেই।' এই সাধ এখন রাজনীতির ক্ষমতাবানদের মধ্যেতো বটেই, সামাজিক সমতলেও দৃশ্যমান। এটা একধরনের সামাজিক নৈরাজ্য, যেখানে আইন অকেজো হচ্ছে, অনেক অপরাধেরই প্রতিকার থাকছে না। এ অবস্থায় নিছক ছেলেধরা সন্দেহের বশে প্রতিবন্ধী নারীসহ তিনজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে গাজীপুরে। প্রতিবন্ধী নারীর প্রতি নৃশংসতা কিংবা অপ্রকৃতিস্থ পুরুষের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া থেকে বোঝা যায় 'পাবলিক' নৃশংসতার মাত্রা কত ভয়াবহ এখন। এ সপ্তাহেই সুন্দরবনে এভাবে নিহত হয়েছে ছয় ডাকাত। নোয়াখালীতে বেশি করে, তবে সারা দেশেই ডাকাত, ছিনতাইকারী অভিযোগে হত্যার পাবলিক উৎসব দেখা যাচ্ছে। সেই সব উৎসবের দৃশ্যভিডিও করার লোক পাওয়া যায়, জীবন বাঁচানোর হাত পাওয়া কঠিন।

২০১১ সালের ৭ আগস্ট নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের উসকানিতে পুলিশের গাড়ি থেকে নামিয়েনিয়ে গণপিটুনি দিয়ে ১৬ বছরের এক কিশোরকে হত্যা করা হয়। খেয়াল করা দরকার, নোয়াখালীতেই কিন্তু গণপিটুনির ঘটনা সবচেয়েবেশি। যেমন ঢাকায় বেশিগৃহপরিচারিকা নির্যাতন। এই নৃশংসতার সঙ্গে ছাত্রলীগের গোলাগুলিতে নিহত শিশুর মৃত্যু, কিংবা ঢাকার পল্টনে ধর্ষণের পর হত্যা করে বাথরুমে লাশ পচানোর নৃশংসতার মিল অস্বীকার করা যাবে না। বান্ধবীএখানে বান্ধবীকে তুলে দিচ্ছে ধর্ষকবন্ধুদের হাতে। সবই আগ্রাসী আচরণ, সবই সহিংসতার শেষ সীমা তথা দলবদ্ধ হত্যালীলার বিবরণ।

অপরাধবিজ্ঞানী এসব ঘটনায় 'অভিযুক্ত' ছাড়া কারও দোষ দেখবেন না। তাঁদের চোখে এসব আইনশৃঙ্খলা সমস্যা, কঠিন শাস্তি দিলেই সব ঠিক।এককথায়সমাধান; আইন কঠোর করো, নতুন নতুন বাহিনী সাজাও। তাতেও লাভ হচ্ছে না। সমাজবিজ্ঞানী অপরাধী বাদে আর সবাইকে দুষবেন। বলবেন, শাস্তিতে সামাজিক ব্যাধি সারে না, এসব সহিংসতার বীজ রয়েছে আরও গভীরে, হাত দিতে হবে সেখানেই। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন গভীরে? সেটা কি ব্যক্তির মন, নাকি রাজনীতি-সংস্কৃতি-আইন ও আচার-ব্যবহারের মধ্যেই এর গোড়া খুঁজতে হবে। মনের সমস্যা ধরলে মনোচিকিৎসক আর কোয়ান্টাম মেথডই ভরসা। সমাজ-রাষ্ট্রের দোষে কেবল ব্যক্তিকে জেলে ভরেও লাভ নেই। সব মেথডই এখানে ফেলমারছে। কারণ, সামষ্টিক সমস্যার ব্যক্তিগত সমাধান অসম্ভব। উপসর্গছেড়ে তাই রোগের কারণে হাত রাখতে হবে।

প্রথম সমস্যা: বলপ্রয়োগ ছাড়া দ্বন্দ্ব মীমাংসার কোনো তরিকা তৈরি হয়নি বাংলাদেশে। বলপ্রয়োগের ক্ষমতার ওপর রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ইত্যাদি দাঁড়িয়ে থাকে। শাসনের যুক্তি ও প্রয়োজনীয়তা দিয়ে বলপ্রয়োগকে গ্রহণযোগ্য করাতে হয় তাদের। কিন্তু পুলিশ, র‌্যাব আইনবহির্ভূত পন্থায় চললে, রাষ্ট্রের ওই বলপ্রয়োগের বৈধতা খোয়া যায়।

আইনি-বেআইনিসবাই যখন একই আচরণ করে, তখন ন্যায়-অন্যায়ের ভেদ ঘুচে যায়। এ রকম অবস্থার প্রধান দুটি লক্ষণ হলো, অপরাধের দায়মুক্তি ও নৃশংসতা। এরই নাম জোর যার মুলুক তার। তিন নম্বর লক্ষণ হলো অধিকারহীনতা ও অস্বাধীনতা। মানুষ কোথাও যখন উপযুক্ত সেবা পায় না, রাস্তাঘাট থেকে অফিস-আদালতে কেবলই রেষারেষি আর ভোগান্তি যেখানে, যেখানে বাজারের অস্থিরতা জীবন ও সংসারকে আরও অস্থির করে, সেখানে মানুষ উত্তেজিত থাকবেই। এই উত্তেজনার সঙ্গে যোগ হয়েছে কাঠামোগত ভয়। রাজনৈতিক সংকট, হানাহানি ও সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার এবং ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতি, ক্রসফায়ার ও দুর্ঘটনার ভয়। বারবার ঘটার দৌলতে আর মিডিয়ার পৌনঃপুনিক প্রচারে এ রকম ভয় কখনো কোনো এলাকার মানুষের মনে ঘনীভূত হলে অবস্থা ফেটে পড়ে। ঢাকার পাশে গাজীপুরে ও কোনাবাড়ীতে ছেলেধরার গুজব এভাবেই স্থানিক ভয়ের আবহ সৃষ্টি করে রেখেছিল। এ রকম পরিস্থিতিতেই আমিনবাজারের কেবলার চরে ডাকাত সন্দেহে পাঁচ ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। উভয় ঘটনাতেই উত্তেজনায় টানটান অবস্থাকে বিস্ফোরিত করায় ভূমিকা রেখেছিল 'ছেলেধরার' বা 'ডাকাতের' গুজব। এই গুজব কে ছড়িয়েছে, তা পুলিশ খুঁজুক। কিন্তু সামাজিক বিপর্যয়ের যে সতর্কসংকেতটি এসব গুজবের মধ্য দিয়ে উঠে আসছে, তা পাঠ করার সাহস আমাদের থাকা উচিত।

নিরাপত্তাহীনতা, অনিশ্চয়তা, মানবিক মূল্যবোধের বিলয় এবংযোগাযোগহীনতার বিভিন্ন রকম চেহারাই সমাজে হাজির আছে। সামাজিক সহিংসতা এর একটা প্রকাশ। এর সঙ্গে ঔপনিবেশিক পরাধীনতার মিল অস্বীকার করা যাবে না। যখন অধিকাংশের সঙ্গে অল্প মানুষের বিরোধ বাড়ে, যখন অবিচারই নিয়ম হয়ে দাঁড়ায়, যখন প্রতিবাদেরও সুযোগ থাকে না, তখন হয় বিদ্রোহ ঘটে নতুবা ক্ষোভ-বিক্ষোভ অবদমিত হয়ে আত্মঘাতী পথে চালিত হয়। এক ভদ্রলোকের শান্ত বিড়ালটা প্রতিবেশীর বেয়াড়া বিড়ালের খামচানি সইতে সইতে একদিন নিজেও সহিংস হয়ে উঠল। কিন্তু শত্রু বিড়ালটাকে নয়, সে খামচাতে গেল তার প্রভুকে। সমাজ মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে বলে, ট্রান্সফারড অ্যাগ্রেশন বা 'লক্ষ্য বদলে যাওয়া প্রতিহিংসা'। জেলখানার বন্দীরা মরিয়া হয়ে কারাগার ভাঙতে না পারলে মাথা ভাঙে আরেক বন্দীর। বাংলাদেশের সামাজিক স্তরে এ রকম মরিয়াপনা দেখা যাচ্ছে। একদিকে রাজনীতি অপরাধীদের সংখ্যা বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে অপশাসন মানুষের সহনশীলতায় চিড় ধরাচ্ছে।

অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান আলজেরীয় বিপ্লবী ফ্রানজ ফ্যানোর বরাত দিয়ে একে বলছেন ইন্টারমিডিয়েট ভায়োলেন্স বা মধ্যবর্তী পর্যায়ের সহিংসতা। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সহিংসতা আরও ব্যাপক পর্যায়েসামাজিক সহিংসতা হয়ে উঠছে। ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয়সহিংসতার মাঝামাঝি পর্যায়এটা। যে সমাজে মানুষ বিপ্লবের মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চায়না বা পারে না, সেখানে এমন আলামত বেশি দেখা যায়। সমাজদেহে জমা বিষাক্ত রক্ত এভাবে পুঁজ হয়েবেরোয়। এর কোনো একটা এসপার-ওসপার না হলে পুঁজ ও ঘা দেখা দিতেই থাকবে। রাষ্ট্রের বয়স ৪২ বছর হলেও শতবছর পেরিয়েগেলেও আমাদের সমাজে বড় রকমের সংস্কার হয়নি। এরই বিকার হয়তো আমরা দেখছি।

পুনশ্চ: গত রাতে শুনি, অন্য বাড়ি থেকে একটি মেয়ের চিৎকার আসছে। সাড়া দিইনি দায়িত্ব নিতে হবে বলে এবং ভয়েও বটে। কোনো দিন আমার বাড়ি থেকেও এ রকম আওয়াজ বেরোতে পারে। বিবিধ ভয় আর অপমান জমতে জমতে কোনো দিন হয়তো আমিও আঘাত করব আমারই মতো কাউকে। যার যার আশ্রয়ে বসে আওয়াজ শুনে যাওয়া কিংবা আঘাতের শিকার বা আঘাতকারী হওয়ার বাইরে আরও কিছু বোধ হয় আমাদের করার আছে। আর্ত মানুষের চিৎকার তো বাড়ছেই।

ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
farukwasif@yahoo.com

http://www.bodlejaobodledao.com/archives/45452


দিল্লীর নারী ধষর্ণে মর্মভেদী আর্তনাদপ্রিন্ট কর
সোনা কান্তি বড়ুয়া, টরন্টো থেকে   
মঙ্গলবার, ০৮ জানুয়ারি ২০১৩

 

 কামাগ্নির বশে মানুষ এমনতরো পশু এবং নিষ্ঠুর হল কেন? সত্য মেব জয়তের দেশে বিগত ১৬ ই ডিসেম্বর ২০১২ রাতে নয়া দিল্লীর চলন্ত বাসে ওঠে প্রথমে জনঅরণ্যের নরদেহধারী গুন্ডারা ছাত্রীর ছেলে বন্ধুকে আহত করে তারপর ২৩ বছরের মেডিক্যাল ছাত্রীকে পাঁচ জন নরপশু সন্মিলিত ভাবে লোমহর্ষকর ধর্ষণ করার পর উলঙ্গ করে বাস থেকে ফেলে দেয়। অহো ! মানবতার কি মর্মভেদী আর্তনাদ! অসহ্য বেদনা এবং নানা অত্যাচারে ধর্ষিতা ছাত্রীর সারা দেহ রক্তাক্ত মানব পশুর বিভীৎস দংশনে ।

 একজন পুলিশ ও মেয়েটি কে রক্ষা করতে এলো না; তেত্রিশ কোটি দেবতার ভারতবর্ষে। সৃষ্ঠি কি ডুবিল আজি প্রলয়ের গভীরে? তার দেহ মন জুড়ে ব্যাথা ও সীমাহীন বেদনার যোগফলে উক্ত পশু মানুষদের প্রতি বিপুল ধিক্কার। আমৃত্যু দুঃখের তপস্যার এই জীবন নিয়ে মানুষ  মানুষের প্রতি বিশ্বাস করে ভুল হয়ে গেল। মনুষ্য জাতির প্রতি কোন বিশ্বাস আর অবশিষ্ঠ র'লো না। অন্ধকার চারিদিকে ঘিরে ফেলেছে উক্ত ম্যাডিক্যাল ছাত্রীকে ।  ভবিষ্যতে ডাক্তার হবার আজন্মের সাধ চিরতরে বিলীন হয়ে গেল। পশু মানুষের কি মা বোন নেই? যেখানে সভ্যতার  আলো  জ্বলে সেই রাজধানীর বুকে সীমাহীন অত্যাচার অনাচারের আঁধার। জড়িয়ে ধরে আছি যে সমাজকে, সেই মানব সমাজ আমার নয়। ভদ্রবেশী বর্বর পশুমানব তাদের ক্ষণিকের  লোভ লালশার তৃষ্ণারাশি চরিতার্থ করতে গিয়ে , একজন অপাপবিদ্ধা জীবন্ত মেয়েকে পাশবিক অত্যাচার করতে করতে তার জীবন শেষ করে দিল। মাতৃজাতিকে কলঙ্কিত করতে গিয়ে নিজের বন্দে মাতরম বা মা বসুন্ধরা কে অপমানিত করেছে। সভ্য মানুষের শহরে মেয়েরা কি লেখা পড়া করতে পারবে না? পুলিশ প্রশাসন এবং রাষ্ঠ্রের দায়িত্ব কি? উত্তাল দিল্লীর মহা জনতার দাবী : 'আমরা জনঅরণ্যের নরদেহধারী পাঁচটি ধর্ষক দানবদের ফাঁসি চাই।' রাজধানী দিল্লীর পুলিশ প্রশাসন সেল ফোনের যুগে কিছুই জানে না । উক্ত ছাত্রী কে প্রথমে দিল্লীর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল এবং তিনি সেখানে মারা গেলেন। কিন্তু ধর্ষিত ছাত্রীর ধর্ষন ও মৃত্যুর জন্যে ভারত সরকারই দায়ী। জনতা কে রক্ষা করাই ভারতের রাষ্ঠ্রশক্তির দায়িত্ব এবং কর্তব্য। দিল্লীর উত্তাল জনতার মন বলে,

"মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,

সন্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,

অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান। "

যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে,

পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে। 

মানুষের পরশের প্রতিদিন ঠেকাইয়া দূরে

ঘৃণা করিয়াছ তুমি মানুষের প্রাণের ঠাকুরে!

বিধাতার রুদ্ররোষে দূর্ভিক্ষের দ্বারে বসে

ভাগ করে খেতে হবে সকলের সাথে অন্নপান। " . . 

বিপুল মানব সমুদ্রে আত্মসংযম করতে না পারলে ডোপামিন নামক মানব দেহের একটি হরমোনই সন্ত্রাস এবং ধর্ষণের জন্য দায়ী। ধর্মের নাম দিয়ে ধর্মান্ধ মন্ত্রদাতা পন্ডিত, রাজনৈতিক স্থানীয় নেতা, সন্ত্রাসী, পুরোহিত এবং শাসকগণ গোপনে মেয়ে ধর্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত দেবদাসী প্রথা আজ ও বন্ধ হয় নি। দৈনিক পত্রিকা, সিনেমা এবং দূরদশনের পর্দায় শিক্ষা এবং ধর্মের নামে আত্মসংযম শিক্ষা প্রদানের সুযোগ হলে হয়তো নারী ধর্ষণ কিছুটা হলে ও কমবে। তবে চোরে বা নরপশুরা না শোনে ধর্ম কথা। পত্রিকায় ভারতের  রাজধানী দিল্লীর নারী ধর্ষণচক্র এবং মহাভারতের অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ঠ্রের রাজসভায় রাজবধূ দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ সম্বন্ধে আমরা মহাভারতে পড়েছি। উক্ত বস্ত্র হরনের বিচারের বানী আজ ও নীরবে নিভৃতে কাঁদে। হিন্দু ভারতের ধর্মান্ধ সমাজপতিগণ মনুর আইন মেনে চলে এবং পতœী স্বামীর বস্তু বলে  মহাভারতে পিতামহ ভীস্ম দ্রৌপদীকে বলেছিলেন। নারী শুধু ভোগের সামগ্রী মহবস্তু নয়; জনতা মহাভারতের পাপীষ্ঠ পরমপরার ধর্ষণের মহামারি থেকে মুক্তি পেতে  মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে হরে নারী পুরুষের পরিপূরক মাতৃজাতি এবং মানব সন্তান। নারী বা মাতৃজাতি ধর্ষণে পুরুষের পশুত্ব লাভে পুরুষেরই কলঙ্ক।

জাতিভেদ প্রথায়  গরীব শূদ্র ও দলিত মেয়েদেরকে ধর্ষণ করে ধর্মের নামে হালাল পদ্ধতি :

গরীব এবং দলিত মেয়েদেরকে নিয়ে ধর্মান্ধদের দেবদাসী প্রথায় পুরোহিত এবং মেয়ে চালানকারীদের অশুভ জোট পুলিশ ধরেছে কি?  আইনের শাসনে রাজধানী দিল্লীর পুলিশ এবং বিভিন্ন নগর প্রতিরক্ষা বাহিনীরা এক ঘন্টার ও অধিক সময় যাবত উক্ত বাসটা কোথাও থামছে না দেখে কোন কর্তব্য পালন না করে কি শুধু মহামন্ত্রীদের রক্ষায় ব্যন্ত?  রাজধানী দিল্লী কি মগের মুল্লুক?  এই জন্যে ভারতীয় রাষ্ঠ্রশক্তিই দায়ী। সাধারণ মানুষের জীবন ধারনই অভিশাপ কিন্তু মন্ত্রি মহোদয়ের মেয়ের পাশে সিকিউরিটি বিরাজমান। চতুর ধর্মান্ধ ব্রাহ্মণ জন শিক্ষার নামে কল্পিত ভগবানের চাবি নিয়ে এই ভাবে জাতিভেদ প্রথা দিয়ে  নর নারায়ণকে দলিত বানিয়েছে । কোন ও ব্রাহ্মণ শূদ্রকে হত্যা করলে কুকুর বিড়াল হত্যার সমান পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন (মনুস্মৃতি ১১/ ১৩২)। কতিপয় নরদেহধারী দানব মানবতাকে ধ্বংস করার ফলে দিল্লীতে নারী ধর্ষণ করে মেরেছে।

ধনীরা গরীব দলিত মেয়েদেরকে ধর্ষণ করলে ভারতীয় পুলিশ বা রাষ্ঠ্রশক্তি কি শাস্তি দিয়েছে ? পাপ বাপকে ও ছাড়বে না। প্রসঙ্গত: ব্রাহ্মণ বা ক্ষত্রিয় পুরুষেরা হাজার হাজার বছর যাবত দলিত মেয়েদেরকে ধর্ষণ করেছে দিনের পর দিন। আইনের শাসন নেই এবং ধর্ষনের পশ্চাৎপটটি ভয়াবহ, একটি সুপ্রাচীন জাতিভেদ প্রথা নিয়ে জাতির পাঁচ হাজার বছরের চলমান বিভীষিকায় দিল্লীর চলন্ত বাসে মেডিক্যাল ছাত্রী  ও জাতির কুল কুমারী ধর্ষিত হল। ছিঃ! ভারতীয় পুলিশ প্রশাসন! ছিঃ !  আইনের শাসনে এই কি ভারতীয় সভ্যতার অবদান? ভারতীয় ধর্মান্ধ শক্তির ক্ষুধিত আষ্ফালন সহ উক্ত অমানবিক কারনে আপাপবিদ্ধা হাজার হাজার যুবতী মেয়ের কত আশা অনন্ত পিপাসার স্বপ্ন চিরতরে শেষ হয়ে গেল। 

বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীর ধর্ষণ চক্রের বিভীষিকাময় সংবাদ পড়ে আমাদের মহাভারতের কথা মনে পড়ে গেল। অতীতে একদা ঋষি  পরাশর মুনি  সত্যবতী নামক যুবতী মেয়ের নৌকায় বসে নদীর অপর পারে যাবার পথে প্রথম দেখায় ঋষির কামনার অগ্নিজ্বলে উঠে এবং শেষ পর্যন্ত উভয়ের দৈহিক মিলনে মহাভারতের লেখক বেদব্যসের জন্ম হয়। ধর্মের নাম দিয়ে  মহাভারতে সত্যবতী তাঁর ছেলে মহাভারত রচয়িতা ঋষি বেদব্যাস কে (সত্যবতীর বিয়ের আগের গোপন ছেলে)তপোবন থেকে মাত্র কয়েকদিনের জন্য হস্তিনাপূরের রাজ প্রাসাদে আমন্ত্রন করে এনে তিনজন অচেনা নারী কে ধর্ষণ বা  মধুচন্দ্রিমা যাপন করার আদেশ দিলেন গর্ভবতী করার মানসে।  'অন্যায় ন্যায় হল, অসত্য সত্য হল, অধর্মযুদ্ধ হল ধর্মযুদ্ধ (নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী, দেশ, কলকাতা, নভেম্বর ০১, ১৯৯৭)। "

অনেকে ধর্মীয় দেবীদেরকে সকাল বিকাল ঘরে এবং মন্দিরে পূজা করলে ও সরকারি হিসেব বাস্তবে মেয়ে শিশুর প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা থেকেই ভারতীয় দম্পতিরা গর্ভস্থিত  নারী শিশুর ভ্রুন হত্যা করে মানবতার সর্বনাশ ডেকে আনছে। গৌতমবুদ্ধ শ্রীমালা সূত্রে ব্যাখ্যা করে বলেছেন মেয়ে শিশু ইচ্ছা করলে দান শীল ভাবনা সহ দশ পারমি যথাযথ ভাবে পালন করলে ভবিষ্যতে (আগামি জন্মে কঠিন সাধনায়)  বুদ্ধ হতে পারবেন। পুরোহিত ব্রাহ্মণ কি পরম পূজনীয় বুদ্ধের বাণী জনতাকে বিশ্লেষন করে বলবেন? ধোঁকাবাজি এবং নারী ধর্ষণ ভারত সহ বিশ্বের সামাজিক ব্যাধি এবং ইহা মানবজাতির রক্তের দোষ বা জিনগত ভয়ঙ্কার নেশা থেকে বাঁচতে "মন চায় চক্ষু না চায়" ধ্যান করতে হবে। মানুষ সত্য, মঙ্গল ও সুন্দরের প্রতীক। কারন আধুনিক ভারতীয় জনতা সহ বিশ্বসমাজে মানুষ বিশ্রামের সময় হারিয়েছে । হারিয়েছে জীবনের প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা।

লজ্জা নিরারনের জন্যে মানুষ কাপড় পরে। বলতে লজ্জা হয়, পুজার বেদীতে লিঙ্গ বা যোনী না রেখে শিবের (অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্ব) ধ্যানী মূর্তি রাখাই উত্তম মঙ্গল। দূরদর্শনের পর্দায় কামোদ্দীপক সিনেমা সহ ধর্মের নামে দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণের লোমহর্ষকর দৃশ্যের আলোকে কিশোর বয়সের সাইকোলোজিতে লিঙ্গ ও যোনী পূজার প্রভাবই  বাসে নারী ধর্ষণের মহামারি রোগ বৃদ্ধি করেছে। ভারতজুড়ে কামশাস্ত্রের নামে ধর্মান্ধ নেতা, জমিদার, সিনেমার মালিক ও সমাজপতিদের ভ্রষ্ঠাচার  বন্ধের জন্যে ভারতের রাষ্ঠ্রশক্তি নীরব কেন?

সবার প্রশ্ন ভারতে দলিত এবং নারীর মানবাধিকার আছে কি? আমাদের দক্ষিন এশিয়ায় গৃহ সমূহে আগে পুরুষেরা আহার করেন, পরে মেয়েরা আহার করেন। শুরু হল বিভেদ জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে। হিন্দু শাস্ত্রের মহামন্ত্র 'লোকা সামাস্তা সুখিনো ভবন্তু ' বাদ দিয়ে ভারতীয় সমাজের হিন্দু পুরোহিত (গীতা ৮/ ১৩ এবং ১৮ / ৪১ থেকে ৪৪)  এবং শাসকগণ সন্মিলিত ভাবে ধর্মের নাম দিয়ে (১) ব্রাহ্মণ (২)ক্ষত্রিয় (৩) বৈশ্য (৪) শূদ্র বা দলিত চতুবর্ণ সৃষ্ঠি করে অখন্ড মানব জাতিকে হিংসা বিদ্বেষ দিয়ে খন্ড বিখন্ড করেছেন।  ভারতীয় ভ্রষ্ঠাচারের মূলকারন জাতিভেদ প্রথার অভিশাপ।  মানবাধিকারের আলোতে আইনতঃ অপরাধ হলো, মানুষ মানুষকে চন্ডাল বা বিধর্মী বলে ঘৃণা করা । দেশ পত্রিকার লেখক দীপঙ্কর রায়ের মতে,  "গীতায় একজন বুদ্ধিমান আরেকজন অপেক্ষাকৃত অল্প বুদ্ধিমানকে হত্যায় প্ররোচিত করছেন। এই প্ররোচনার ফলে মানুষ নিহত হয়েছিলেন অগণ্য। এর পর হাজার বছর ধরে সেই প্ররোচনামূলক গ্রন্থটিকে একটি জাতির মহান গ্রন্থ বলে জাহির করে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি অর্থাৎ কায়েমি স্বার্থকে টিকিয়ে রাখার চেষ্ঠা চলেছে (দেশ, কোলকাতা, জুন ২২, ১৯৯১)।" হিন্দু সমাজে মানবাধিকার না থাকায় ভারতের জাতীয় পতাকায় গৌতমবুদ্ধের অহিংসা পরমধর্ম সম্বলিত রাষ্ঠ্রীয় স্মারক চিহ্ন অশোকচক্র বিরাজমান ।

 হাজার বছর যাবত ভারতে দুঃখের দহনে করুন রোদনে তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছে ২৫ কোটি দলিত জনগণ

বিগত ১১ই মে, ২০১২ আনন্দবাজার পত্রিকায় সংবাদ শিরোনাম ছিল, "পাঠ্যে কার্টুন, সংসদে তুলকালাম।" ভারতীয় রাজ্যসভায় ভারতরত্ন্ব আম্বেদকরকে আক্রমন করতে কার্টুনে জওহরলাল নেহেরুর চাবুক নিয়ে এতো হাঙ্গামা কীসের? মানবতাকে বাদ দিয়ে জাত ও ধর্ম দিয়ে তো আজ আর মানুষের মগজ ধোলাই করা যায় না।  কারন ৬৩ বছর পূর্বে ভারতের সংবিধান প্রনেতা ভারতরতœ ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরকে অপমান করতে যে কার্টুন রচিত হয়েছিল সেই কার্টুন আবার ২০০৬ সালে  ভারতীয় নবম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের সিলেবাসে সংযোজিত হওয়ার কারনে দলিত বিধায়কগণ অপমানিত হয়েছেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট ঘরে পোষে জাতিভেদ প্রথার চোর, আর ও কহে জোর, এ বড় কুটিনী ঘাগী। হিংস্র রাজনীতির পান্ডাগণ যদি কয় মিছা অতিশয় / ভারতীয় জন গণ মনে জাগে ধান্ধা।" বৈদিক সভ্যতা  অহিংসা পরম ধর্ম ত্যাগ করে মানব বা ব্রাহ্মণ হয়ে মহামানব ডঃ আম্বেদকরকে এভাবে অপমান করতে পারে কি?   সর্বভারতীয় মহান নেতা এবং স্বাধীন ভারতীয় সংবিধান প্রণেতা ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরকে প্রহারের কার্টুনে জওয়ারলাল নেহেরুর হাতে চাবুকের প্রতিবেদন ।  কট্টর হিন্দুত্ববাদীগণ কর্তৃক উক্ত কার্টুনে জওহরলাল নেহেরুর হাতে চাবুক দিয়ে  আম্বেদকরকে প্রহার করার কল্পিত অপমান বজ্রাঘাত  তুল্য। হিন্দু জাতির কলঙ্গ জাতিভেদ প্রথায় সর্বপ্রথম ২৮শে আগষ্ট ১৯৪৯ সালে আম্বেদকরকে অপমান করে উক্ত কার্টুন ভারতীয় হিন্দু সমাজের মগজ ধোলাই করতে কেশব শংকর পিল্লাই তার সম্পাদিত "শংকর সপ্তাহিকীতে "।

খৃষ্ঠপূর্ব ১৫০০ বছর পূর্বে ঋগে¦দের (প্রথম বেদ) (১/১০৫/৮ ও ১০/৩৩/২) মতে বৈদিক ধর্ম পন্থী আর্য্যদের রাজা ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস করেন ।  প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধদর্শনের বিভিন্ন প্রসঙ্গ বৈদিক সাহিত্যে বিরাজমান এবং প্রাচীন উপনিষদের বিভিন্ন উপদেশ বৌদ্ধধর্ম থেকে নকল করা হয়েছে বলে গৌতমবুদ্ধ ত্রিপিটকের (মধ্যম নিকায়ের ৭৫ নন্বর) মাগন্দিয় সূত্রে ব্যাখ্যা করেছেন।  বৈদিক উপনিষদ সাহিত্য সহ বিভিন্ন পুরাণ কাহিনীতে বৌদ্ধধর্মকে নকল করে হিন্দুধর্ম করা হয়েছে এবং হিন্দু শাসকগণ)। সচিত্র প্রতিবেদন পাঠে দলিত জনতা রবি ঠাকুরের কবিতায় জেনেছেন, .

তখন ভারতীয় দলিত সমাজ হিন্দুরাজনীতির কুচক্রে সাত পাঁকে বাঁধা থাকায় হিন্দুধর্মের অপব্যবহারের (জাতিভেদ প্রথা) বিরুদ্ধে মাথা তুলতে পারেন নি। আজ দলিত জাতি মানুষ হয়েছেন এবং দলিত মহাজনতার গণ অসন্তোষের আগুন ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রবেশ করে উক্ত নবম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের পরামর্শদাতাদ্বয় যোগেন্দ্র যাদব এবং সুহাস পাইশিকারকে চাকুরী থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন।  রাজনীতিবিদগণকে বেদ বেদান্ত উপনিষদ / দেয়না এদের আলো /  মনটা এদের ভীষণ জঠিল / কুটিল কঠিন কালো। মানুষ নামক অত্যাচারী হিন্দু পান্ডা ও কার্টুনিষ্ঠ কেশব শংকর পিল্লাই, নবম শ্রেণীর পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের কর্মকর্তা যোগেন্দ্র যাদব এবং সুহাস পাইশিকার হিন্দুরাজনীতির সুতনয় বটে, গণতান্ত্রীক ভারতে তারা শুধু আম্বেদকরের মতো মহামানবকে অত্যাচার করে এবং তারা মগজে বিকার, চিন্তায় পাপী।   পা   চাটা পান্ডাগণ ব্রাহ্মণ্যরাজনীতির লাঠিয়াল। মহামানব আম্বেদকরপন্থী ভারতীয় পার্লামেন্টের বিধায়কগণ রাজ্যসভায় বলেন, "বার বার তুমি অত্যাচারী ঘুঘু সেজে খেয়ে যাও ধান /  এইবার ঘুঘু অত্যাচারী কার্টুনিষ্ঠের দল তোমাদের অত্যাচারের করবো অবসান। সরলতায় সাধুতায়, ধর্ম প্রীতি ও প্রেমের পুন্য বাঁধনে সাচ্চা কোমল বান্দা নও তোমরা।" ধর্মীয় রসের হাঁড়িতে রাজনীতিকে মজাদার করতে ভারতীয় শাসকগণ সহ ব্রাহ্মনেরা জাতিভেদ প্রথাকে যোগ করে যে দলিত বা চন্ডালের বিস্ফোরণ ঘটেছিল, তারই অপমানজনক দিকটি হল  কার্টুনিষ্ঠ কেশব শংকর পিল্লাই তার স্বপ্নজগতে ভারতের সংবিধান প্রণেতা ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরকে প্রহার করতে  চাবুক হাতে জওহরলাল নেহেরুর চিত্র বিরাজমান। "শাসনে যতই ঘেরো, আছে বল দূর্বলেরো (বা দলিতদেরো)।"

হিংসামূলক জাতিভেদ প্রথায় জীবসেবার স্থান নেই। "রাশি রাশি বৌদ্ধমন্দির ধ্বংস করে হিন্দু মন্দিরে বদলানো হয়েছিল (সম্পাদকীয়, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট, ১৯৯৩) দক্ষিন এশিয়া জুড়ে।"   সম্প্রতি ভারতীয়  লোকসভায় স্বর্গীয় সর্বভারতীয় নেতা ও ভারতীয় সংবিধান প্রণেতা ভারতরতœ ডঃ আম্বেদকরের অপমানজনক কার্টুন নিয়ে তোলপাড় হয় । ভারতের নবম শ্রেণীর সমাজ পাঠ শীর্ষক গ্রন্থে বাবা সাহেব আম্বেদকরের নামে কটূক্তিমূলক কার্টুন ভারতীয় সংখ্যা গরিষ্ট হিন্দু রাজনীতির দাদাগণের ক্রোধ, লোভ, বাসনা, ঈর্ষা এবং অহংকার প্রভৃতি মনোবিকার সমূহের পরিচয়ে  ভারতরতœ ডঃ আম্বেদকরকে মারতে জওহরলাল নেহেরুর হাতে চাবুক এবং উক্ত কার্টুন বৈদিক জাতিভেদ প্রথায় 'দলিত এবং চন্ডাল নির্যাতনের ' ইহা এক বিভীৎস চিত্র।   ভারতের পূজনীয় ব্যক্তিত্বকে কার্টুন দিয়ে অপমান করা কি ভারতীয় গণতন্ত্রের জন্য গৌরবজনক?  ব্রাহ্মণগণ বিদেশী তুর্কী বা গ্রীকদের সাথে সসন্মানে কথা বলেন, কিন্তু একই অঞ্চলের গরীর মানুষদেরকে  হিন্দুধর্মের অপব্যবহার করে দলিত বা চন্ডাল বানিয়ে তাদেরকে পদে পদে অপমানিত করেন।  মানুষজাতির স্বজন হয়ে মুখে হিন্দুপন্ডিতগণ বলেন, "লোক সামাস্তা সুখিনো ভবন্তুু ;" কাজে ' মনুর আইন ' নিয়ে সর্বহারা গরীব জনতাকে ' চন্ডাল এবং দলিত ' বানিয়ে হাজার হাজার বছর পর্যন্ত মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে। জনতার প্রশ্ন: কয়লা ধুয়ে ও ময়লা গেল না কেন? পূজনীয় ব্যক্তির পূজা না করে ভারতের সভ্য সমাজে তো সংবিধান প্রণেতার কার্টুন তৈরী করে তাঁকে চাবুক দিয়ে উত্তম মধ্যম দেবার নীতিমালা ছিল না। বাংলাভাষা বৈদিক বা আর্যদের সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয় নি। বিবর্তনবাদী সাইকোলোজি অনুসারে, বাংলা ভাষা পালি ভাষার বিবর্তিত রুপ এবং স্থান কাল ও পাত্র পরিবর্তনশীল।

ডঃ আম্বেদকর সহ ভারতীয় পার্লামেন্ট ভারতের সংবিধানে  বৈদিক সভ্যতাজাত জাতিভেদ প্রথাকে" বেআইনি ঘোষণা করেন এবং ভারতের রাষ্ঠ্রীয় প্রতীকে বৌদ্ধ সম্রাট অশোকের "অশোক চক্র" (বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মচক্র) সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এইভাবে অহিংসার কাছে হিংসার পরাজয় এবং দলিতদের কাঁধে বন্দুক রেখে হিন্দুরাজনীতি চক্র ভবিষ্যতে কখনও উক্ত দলিত এবং চন্ডালদিগকে (গীতায় ৪ অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোক) আর বোকা বানানো যাবে না। দলিত বা দরিদ্র নারায়ণকে অপমান করার নাটকের কার্টুনে মানবতার শিরচ্ছেদ এবং ভারতীয় হিন্দুধর্মে স্বামী বিবেকানন্দের "জীব সেবা করে যে জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর" কোথায় হারিয়ে গেল? মানবাধিকারে সমৃদ্ধ ভারতীয় সংবিধানে হিন্দুধর্ম বা গীতার জাতিভেদ প্রথার কোন স্থান নেই। ১৯৫০ সালে ডঃ আম্বেদকর ভারতীয় সংবিধান রচনা সুসম্পাদন করার পর  ১৯৫৬ সালের ১৪ই অক্টোবর বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকর ৫০ হাজার দলিত জনতা নিয়ে ভারতের পুণা শহরে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন  করেন। রাজনীতির দাদাগণকে বুঝিয়ে দিলেন, "জন্মে কেহ শ্রেষ্ঠ বা ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মে মানুষ উত্তম বা অধম হয় না।"

বৌদ্ধধর্মের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং কাশ্যপবুদ্ধের বৌদ্ধধর্মকে বৈদিক রাজা ইন্দ্র ধ্বংস করেছিল:

 হিন্দু বর্ণাশ্রম বিরোধী সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  ব্রাহ্মণদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে 'সাম্যবাদ' নামক বই লিখেছিলেন এবং গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদন করে ঘোষণা করলেন,  "তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ অনন্তকালস্থায়ী মহিমা বিস্তার পূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ত প্রসারিত রূপে বলিলেন, "আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদেরকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্র সাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ শুদ্র সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী, সকলের উদ্ধার সদাচরণে। বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। যাগযজ্ঞ মিথ্যা। বেদ মিথ্যা, সূত্র মিথ্যা, ঐহিক সুখ মিথ্যা, কে রাজা, কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর। (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২ থেকে ৩৮৩, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, কলকাতা)।

লেখক এস. বড়–য়া,  প্রবাসী  রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বিবিধ গ্রন্থ প্রণেতা ও কলামিষ্ট।

http://www.news-bangla.com/index.php?option=com_content&task=view&id=10574&Itemid=26

অনিঃশেষ দেশভাগের কথকতা : সুধা কি সাদিয়ার কথা শুনছে

শেয়ালদা আর গোয়ালন্দ তেমুন আছে ভাই
আমি যামু আমার দেশে, সিধা রাস্তা নাই।

গত বছরের ১৬ নভেম্বর সমকালের সম্পাদকীয় পাতায় 'ভারতে অবিশ্বাসের হাওয়া' নামে সুধা রামচন্দ্রনের একটি নিবন্ধের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বিষয় : ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাসমূহে মুসলমানদের নিয়োগে অলিখিত বাধা বিষয়ে ভারতীয় সংবাদ ম্যাগাজিন আউটলুকের একটি রিপোর্ট। দুদিন পর একটি প্রতিক্রিয়া আসে। শিরোনাম : 'দুর্দিনেও জানাচ্ছি শুভেচ্ছা; অসাম্প্রদায়িকতার!' এর লেখক ঢাকার পল্লবীর একটি মহিলা মাদ্রাসার দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী শেখ সাদিয়া তাসনীম। সাদিয়া তার ভাষায় 'প্রবল আন্তরিক শুভেচ্ছা বা কৃতজ্ঞতা' জানাবার জন্যই কলম ধরেছে। এর জন্য উপযুক্ত ভাষাও তার জানা নেই, 'কারণ এর আগে কখনো আমার কাউকে তীব্র আন্তরিকতা জানানো হয়নি। এজন্য তাকে (সুধাকে) আমার মনের তীব্র আন্তরিকতাসহ শুভেচ্ছা বা কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা আমি পাচ্ছি না।' বোঝা যায় সাদিয়া লেখাটি পড়ে এমন আপ্লুত যে, তার 'তীব্র' ও 'প্রবল' আন্তরিকতাকে কৃতজ্ঞতা না শুভেচ্ছা হিসাবে প্রকাশ করবে তা সে বুঝতে পারছে না। মুহূর্তটি আমার কাছে অনন্য ও ঐতিহাসিক মনে হয়। কারণ, মাদ্রাসার এক ছাত্রী_ যাকে সাধারণভাবে ভাবা হয় অবরোধবাসিনী, রক্ষণশীল এমনকি মৌলবাদী (?) বলে_ যখন তার প্রতিবেশী দেশের আরেক নারীকে অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে অসাম্প্রদায়িকতার জন্য অভিভাদন জানায়, বটেই তা আপ্লুত হওয়ার মত ঘটনা। কারণ প্রতিবেশী তার পড়শির সঙ্গে কথা বলতে চাইছে এবং চিনছে ও জানছে।

প্রতিবেশীতার ধারণার মধ্যে একটা স্ববিরোধ আছে। প্রতিবেশী মানে যার সঙ্গে বেশি মাখামাখি আবার প্রতিবেশী সে-ই, যার সঙ্গে নিত্য লাগালাগি। ভারত বাংলাদেশের তেমনই প্রতিবেশী। ভারত-বাংলাদেশের আলোচনা দুটি দেশ ও দুটি রাষ্ট্রের সম্পর্কের আলোচনা, অর্থাত তা রাজনৈতিক সম্পর্কের আলোচনা। ব্যক্তিগত ও মানবিক মাত্রা সেখানে অনুপস্থিত। যেমন অনুপস্থিত থাকে কে মুসলমান আর কে হিন্দু তার উল্লেখ। ভারত ঘোষিতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হলেও ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকেরা মনে করে তাদের দেশ হিন্দুপ্রধান, যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশী মনে করে তারা মুসলিম দেশের বাসিন্দা। ভিন্নমতের লোক উভয় দেশেই আছে, সেটা ভাল। কিন্তু ভালর থেকেও বেশি জরুরি হলো এই মনে করার ভেতরের মর্মটা বুঝে দেখা। সুধা আর সাদিয়ার লেখায় তারই ইঙ্গিত। 

সুধা লিখেছে, 'সম্প্রতি সংবাদপত্রে ভারতের কিছু কিছু গোয়েন্দা সংস্থায় মুসলিমদের নিয়োগ বন্ধ থাকার ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষা ও চাকুরিতে মুসলিমদের ক্ষীণ উপস্থিতি সর্বজনবিদিত, তারওপর সরকারি সংস্থা থেকে পরিকল্পিত ভাবে তাদের বাদ রাখা ভেবে দেখার মতো ব্যাপার। এটা কেবল দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী আদর্শের বরখেলাপই নয়, ভারতের নিরাপত্তার ওপরও এর অভিঘাত পড়বে।' মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যে সুধার উদ্বেগ থেকে তাকে মনে হয় না যে তিনি 'হিন্দু' অবস্থান থেকে কথা বলছেন, বরং তার অবস্থান রাষ্ট্রের 'নিরাপত্তা' এবং 'দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও বহুত্ববাদী আদর্শের' পক্ষে। 

সেকারণে তার চোখে পড়েছে যে, 'মুসলমানদের প্রতি অবিশ্বাস আরো অনেক বিস্তৃত ও গভীর। কেবল প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বই নয়, আরো অনেক ক্ষেত্র থেকেও তাদের দূরে রাখা হয়। ভারতে ১০০ কোটি ১০ লক্ষ জনসংখ্যার ১৩.৪ শতাংশ হলো মুসলিম। কিন্তু চাকুরি ও শিক্ষায় কী সরকারি আর কি বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই তাদের স্থান জনসংখ্যার হারের থেকে অনেক কম। এক অদৃশ্য হাত তাদের কোটাকে ৩.৫-এর মধ্যেই আটকে রেখেছে। ভারতে ভাল থাকা বলতে যা বোঝায়, তার জাতীয় মানদণ্ডের অনেক নীচে পড়ে আছে মুসলিমরা। এবং তথ্যপ্রমাণ বলছে এই বৈষম্য মোটেই কমছে না বরং বাড়ছে।' এটুকু বলার জন্য যে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টি ও সতসাহস লাগে, তা সুধার আছে। কিন্তু একটু খোঁজ-খবর রাখা পাঠকমাত্রই জানেন, ভারতের সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এমন লোকের সংখ্যা নিতান্তই কম। অরূন্ধতি রায়ের কথা বলা যায়, তিনি কাশ্মীরে জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কাশ্মীর তার কাছে ভারতের অঙ্গ নয়। সম্প্রতি তিনি ভারতীয় শাসকদের জঙ্গিনিধন হিড়িকের বলি দিল্লির এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আফজাল গুরুর ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। তিনি এবং আরো ক'জন মিলে গুজরাট গণহত্যার জন্য উসিলা হিসেবে ব্যবহৃত গোধরা ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনা তদন্তে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট খতিয়ে দেখিয়েছেন যে, ঐ ঘটনায় মুসলমানদের হাত থাকা তো দূরের কথা, স্বয়ং বিজেপি গং-এর জড়িত থাকার নজির আছে। দিল্লি পার্লামেন্ট ভবনে আত্মঘাতী হামলার বিষয়টি নিয়েও তাঁদের অবস্থান মূলধারার মিডিয়ার বিপরীতে। 

এরকম আরো প্রতিবাদী আছেন। সাদিয়ার কথা থেকেই বোঝা যায়, ভারত তার কাছে সাম্প্রদায়িক হিন্দুর দেশ, সেখানে তার ভাষায় উন্মুক্ত ও নিরপেক্ষ মনের ব্যাক্তি প্রায় নেই-ই। তাই সরল বিশ্বাস নিয়ে সে লিখতে পারে, 'রবি ঠাকুর যেমন অসাম্প্রদায়িক ছিলেন তেমনি সুধাদাও একজন। কারণ আমাদের দেশের ৮০%-৮৫% মুসলমান এবং এখানে হিন্দু, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীগণ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করছে। এখানে যদি কোনো মুসলমান অন্য কোনো ধর্মের মানুষকে এমন কোনো কথা বা কাজ করে, যা তার ইগোতে লাগে তবে সবাই সেটা নিয়ে বেশ সমালোচনা করে বলে, এ দেশ সাম্প্রদায়িক, এ দেশের মানুষেরা সাম্প্রদায়িক। অথচ প্রতিবেশী দেশ ইন্ডিয়াতে যখন ঘরে আগুন লাগিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় তখন কেন সেদেশকে কেউ সাম্প্রদায়িক বলে না? কেন সেদেশের মুসলমানরা চাকরি ও শিক্ষায় সরকারি-বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতা দেখাতে পারছে না? কেন বিএসফের লোকেরা আমার দেশের বিডিআর হত্যা করলে, অপহরণ করলে, পুশইন করলে, গবাদি পশু নিয়ে গেলে প্রতিবাদ হয় না?... মুসলমানরা নিজ ধর্ম পালন করলে সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদি হয় অথচ অন্য কোনো ধর্মাবলম্বী তার ধর্ম পালন করলে সে সাম্প্রদায়িক নয়; মৌলবাদী নয়, কেন? আমার সব সময় মনে হতো শুধু মুসলমানরাই অসাম্প্রদায়িক জাতি। আর এই অসাম্প্রদায়িকতা আমি শিখেছি আমার পরিবার এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে। কিন্তু শুধু মুসলমানরাই যে অসাম্প্রদায়িক তা ভুল প্রমাণিত করলেন সুধাদা দেখালেন হিন্দুদের মধ্যেও আছে মুসলমানের মতো উন্মুক্ত এবং নিরপেক্ষ মনের ব্যাক্তি।' 

সাদিয়া খেয়াল করেনি, ভারতের মুসলমানদের যে অবস্থার কথা সে বেদনার সঙ্গে উল্লেখ করেছে, তাকি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়েরও সাধারণ অবস্থা নয়? তারপরও সাদিয়ার কয়েকটি প্রশ্ন মনের ভেতর কাঁটা হয়ে খচখচ করে। কেন সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ কেবল মুসলমানদের বিরুদ্ধেই তোলা হবে যখন ভারতেও মুসলমান বিদ্বেষ ও নিধন আছে? কেন বিএসএফ নিয়মিতভাবে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা করেও নিষ্কলুষ থাকতে পারে? কেন ধার্মিক মুসলমান মাত্রই সাম্প্রদায়িক বা মৌলবাদী হবে? কেন বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা ও গুজরাট গণহত্যার পরও ভারত অসাম্প্রদায়িক আর বাংলাদেশের পরিচয় হয় সাম্প্রদায়িক? সাদিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে আনাড়ি বা অনভিজ্ঞ বলা যায়, কিন্তু তার ভেতরে উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক বাস্তবতার যে পাঠ আছে, তাকে নিতান্তই বেঠিক বা দুষ্ট চিন্তা বলা যায় কি? কিন্তু কী বিষ্ময় যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর হালে সুধা রামচন্দ্রন ছাড়া আর কোনো অসাম্প্রদায়িক ভারতীয় বা বাংলাদেশী হিন্দু তার কাছে অচেনা। এটা কীভাবে হলো? এটা কি কেবল সাদিয়ারই ব্যর্থতা। এর কারণ কি কেবলই তার মাদ্রাসা শিক্ষা? নাকি বাংলাদেশী সমাজের সুপ্ত দেশে টিকে থাকা সাম্প্রদায়িক মনোভাবও এর জন্য দায়ি। সাদিয়া তার অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা পেয়েছে 'পরিবার এবং শিক্ষকদের কাছ থেকে'। তা-ই যদি হয়ে থাকে তবে তারাও তাকে সচেতন করেননি যে, 'শুধু মুসলমানরাই অসাম্প্রদায়িক জাতি' নয়? শেখাননি যে, জাতি ও ধর্ম সমার্থক নয়। এক জাতির মধ্যে একাধিক ধর্ম থাকতে পারে, তার উদাহরণ বাঙালি ও আরবরা। আবার এক ধর্মের মধ্যে একাধিক জাতি থাকার নজির সকল ধর্মেই আকছার। সাদিয়ার দুর্ভাগ্য যে, সে এ শিক্ষা তার সমাজ-রাষ্ট্র থেকে পায়নি। যেমন দুর্ভাগ্য ভারতের অসংখ্য আধুনিক ও স্মার্ট তরুণদের_ যারা তাদের 'শিক্ষক ও অভিভাবকদের' মন্ত্রণায় বিজেপির হয়ে হিন্দুত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বাবরি মসজিদ ভেঙ্গেছে, গুজরাটে গণহত্যা করে মুসলমান মেরেছে। আর সেই নরঘাতক মোদী নিজেই যে অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাজ্যের পুলিশ-প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির নের্তৃত্বে নৃশংস ভাবে দাঙ্গা ঘটিয়েছে, তার লিখিত ও ভিডিও প্রমাণ হাজির হওয়ার পরও মোদী আবার বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে ভোটে জিতে আসে এবং ভারতের মূলধরারা বড় বড় মিডিয়ার ভাষ্যে, মোদী আগে খারাপ কাজ করলেও এখন তো ভাল হয়েছে এবং রাজ্যে উন্নয়ন বইয়ে দিচ্ছে। সুধা রামচন্দ্রনের লেখা পড়ে সাদিয়ার ভুল ভাংছে। কিন্তু সুধা যাদের ইঙ্গিত করে বলেন : অনেক হিন্দুই বিশ্বাস করেন যে, সত্যিকারভাবে মুসলমানরা ভারতীয় নয়। তাদের ভাবা হয় 'বহিরাগত', কয়েক শত বর্ষ আগের ভারত আক্রমণকারীদের বংশধর। ১৯৪৭-এর দেশভাগ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই হিংসা আরো বাড়ে। ভারতীয় মুসলিমদের ভাবা হয় পাকিস্তানপন্থি এবং এখন তাদের দেখা হয় সম্ভাব্য সন্ত্রাসবাদী হিসাবে।' যেমন ভারতের তেহেলকা ম্যাগাজিন তাদের চলতি সংখ্যার প্রচ্ছদ কাহিনীতে দেখিয়েছে যে, আহমেদাবাদ-বেঙ্গালুরু বোমার পর এবং আরো আগে থেকেই প্রমাণ ছাড়াই মুসলিমদের গ্রেফতার ও শাস্তি দেয়া হচ্ছে সন্ত্রাসী বলে। গুজরাতে সন্ত্রাস দমন আইন টাডায় গ্রেফতার হওয়া বেশিরভাগই হলো মুসলিম এবং বিশেষত তারা, যারা ২০০২ এর গণহত্যার পর ক্ষতিগ্রস্থদের সাহায্য করেছিল। এরকম কয়েকটি ঘটনা উন্মোচন করে তেহেলকা দেখিয়েছে যে, শাস্তিপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই নির্দোষ। তাদের অভিযোগ এটা পরিকল্পিতভাবেই করা হচ্ছে। এ অবিশ্বাস ও ভুল কে ভাঙ্গাবে? সাদিয়ার কথা কি তারা শুনবে? 

কেবল তা-ই নয় যে, সাদিয়া যে প্রশ্নগুলো তুলেছে তার অসাম্প্রদায়িক উত্তর ভারত ও বাংলাদেশের আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক মহল থেকে দিতে হবে। সুধার লেখা সাদিয়ার মনে যে আলো ও আশাবাদ জাগ্রত করেছে, তার শক্তিতেই কি মুসলমানের প্রতিবেশী বাংলাদেশী হিন্দু সমাজ ও বাংলাদেশের প্রতিবেশী হিন্দুপ্রধান রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে রচিত হতে পারে না? পারে, যদি রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক ও আধিপত্য ও সবিধাবাদী নিয়ন্ত্রণের বাইরে, কিছু কিছু প্রচারমাধ্যমের ছদ্মবেশী সাম্প্রদায়িকতার প্রভাবের বাইরে দাঁড়িয়ে সুধা ও সাদিয়ারা পরস্পর কথা বলে, পরস্পরকে জানে। সাদিয়া বাংলাদেশের তরুণ সমাজের প্রতিনিধি নয়। সে মাদ্রাসায় পড়ে, হয়তো বোরখাও পড়ে, তার সিলেবাস আধুনিক নয়। 

অন্যদিকে বাংলাদেশের তরুণ সমাজের তুখোড় চরিত্ররা আধুনিক, সনাতন মূল্যবোধের ধার তারা ধারে না, তারা বলিউডি সিনেমার ভক্ত। মুসলমান বা হিন্দু নিয়ে তারা খুব একটা ভাবিত কিনা জানা যায় না। সাদিয়ার সঙ্গে তাদের বনবে না। কিন্তু সে যে ব্যাক্তিত্ব ও জিজ্ঞাসা প্রকাশ করেছে তা কি ঐ 'আধুনিকদের' মধ্যে খুব বেশি আছে? কেবলই বোরখা দেখলে ভেতরের মানুষটাকে কখনোই জানা হবে না। জানা যাবে না যে, অবরোধ ভাঙছে, বরফ গলছে। সাদিয়া মাদ্রাসার ভেতরের সেই স্বাভাবিক সপ্রাণ মানুষের অস্তিত্বই জাহির করেছে। সেই সপ্রাণতাকে গ্রহণ করা ও এগিয়ে নেয়ার কর্তব্য তাদেরও; যারা নিজেদের অসাম্প্রদায়িক মনে করেন। 

তা যতদিন না হবে, ততদিন উপমহাদেশের রাষ্ট্র পর্যায়ে শুধু নয়, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে কেবল নয়, ব্যক্তির মনেও মধ্যেও অন্তহীনভাবে দেশভাগ চলতেই থাকবে। আমরা যতই ভাবি, দেশভাগের দাগ আমরা ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসেই ফেলে এসেছি, তাকে মিথ্যা করে দিয়ে বারবার তা আমাদের সামনে এসে দাঁড়াবে। দেশ ভাগ শেষ করে সমাজকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে তা শেষ হবে আমাদের প্রত্যেকের মনের ব্যবচ্ছেদে, হিংসার কূপে ডুবে গিয়ে। 

 

বিষয়বস্তুর স্বত্বাধিকার ও সম্পূর্ণ দায় কেবলমাত্র প্রকাশকারীর...

http://www.somewhereinblog.net/blog/farukwasifblog/28830551


১৩ ই আগস্ট, ২০০৮ রাত ৯:০০ |

মাওবাদী হিংসা এবং সরকার পরিকল্পিত সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে কিছু বিবৃতি

খবরোলা

সম্প্রতি ভারত সরকার ভারতেরই অভ্যন্তরে সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ঘটছে UAPA র মত কালা কানুনের প্রয়োগ। আঘাত হানছেন মাওবাদীরাও। মরছেন মানুষ। প্রতিবাদ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন দেশ-বিদেশের বিশিষ্ট নাগরিক, সাধারণ মানুষ,অ্যাক্টিভিস্টরা। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন ভূমিপুত্রেরাও। এবারের খবর্নয়ে রইলো কিছু ঝলক। 


আদিবাসী গণসংগঠন 

১) "Campaign for Survival and Dignity (CSD)" বা "জীবন ও মর্যাদার প্রচারমঞ্চ' ভারতের ১০টি প্রদেশে, জঙ্গলের অধিকার নিয়ে লড়ছেন যেসব বিভিন্ন আদিবাসী, উপজাতি ও অর®ণ্যের ভূমিপুত্র ভুক্ত গোষ্ঠী, তাদেরকে একত্রিত করে তৈরি একটি গণসংগঠন। দেশের উপজাতি অঞ্চলে ও জঙ্গল এলাকাতে রাষ্ট্রকর্তৃক যে সামরিক অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ঘোষণা করা হয়েছে, তার প্রতিবাদে স্পষ্ট বক্তব্য রাখলেন এনারা। এনাদের মূল বক্তব্য, মাওবাদী দমনের আড়ালে, এই অমানবিক সরকারী আক্রমণ আসলে আদিবাসীদের ওপর আক্রমণ। এর মুখ্য উদ্দেশ্য প্রতিবাদী কন্ঠগুলোকে অবরোধ করা, এবং এখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ কুক্ষিগত করা। সরকারী বয়ান অনুযায়ী এই অভিযানের ফলে যেসব জায়গায় অরাজকতা ও রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি রয়েছে, তা দূর হবে এবং রাষ্ট্র এবার তার কাজ করতে পারবে। আদিবাসী, উপজাতিরা কিন্তু বলছেন,এই প্রচার সর্বৈব মিথ্যে। আসলে এই সব জায়গায় রাষ্ট্র একটু বেশি মাত্রায়ই উপস্থিত, আর তাই বেআইনী ভাবে ৩ লাখ মানুষকে উচ্ছেদ করে দিতে পারে বনদপ্তর, তাই আদিবাসীদের "জল জঙ্গল ও জমি' র সাংবিধানিক অধিকার সম্পূর্ণ উপেক্ষিত হয়, তাই প্রতি দিনই আরো বেশি করে মানুষ পুলিশের হাতে মার খায়, খুন হয় বা জেলে যায়। এই যদি রাষ্ট্রের অনুপস্থিতির নমুনা হয়, তাহলে তার উপস্থিতির সম্ভাবনা তো রীতিমতন আতঙ্কজনক। সেই উপস্থিতির প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের উচ্ছেদ,সামরিক শাসনের কায়েমীকরণ। 

ওনাদের এই লড়াই কিন্তু আদৌ উন্নয়নের বিরোধে না,স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে এই বিবৃতিতে। মানুষের এই লড়াই গণতন্ত্র ও মর্যাদা রক্ষা করতে। আদিবাসী সুরক্ষার জন্য যা যা আইন আছে এবং সম্প্রতি বিভিন্ন গণআন্দোলনের ফলে যেসব নতুন আইন এসেছে, তাতে জীবন, জীবিকা, জমি ও জঙ্গলের অধিকারের লড়াই ও তার ফলে মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আরো মজবুত হওয়ার কথা। কিন্তু এই আইনগুলো মান্য হয় তাদের অবাধ লঙ্ঘনের মাধ্যমে। মনে রাখা দরকার প্রকৃত উন্নয়ন সবার সম্পদ ও উৎপাদনের অধিকারকে আর দৃঢ় করে। সামরিক বাহিনী নিয়ে গায়ের জোরে উন্নয়নের দাবী শুধু অবাস্তবই না,হাস্যকর। 

সরকার যদি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য চিন্তিত হবে , তো, সবচেয়ে আগে মাইনিং গুন্ডা, জঙ্গলের গুন্ডা, ও সালওয়া জুডুমের মত উগ্র টহলদারী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাহিনী পাঠানো উচিত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে দমন করা দূরস্থান,পুলিশই এদের মদতদার। নিরাপত্তার এই যে ধারণা রাষ্ট্র প্রচার করছে তার সাথে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কিভাবে বড় ব্যবসায়ীরা চুরি, প্রাকৃতিক সম্পদ লুঠ করতে পারে তাই নিশ্চিত করার জন্য এই অভিযান। তাই, বিশাল মুনাফার লক্ষ্য নিয়ে মাইনিং, পরিকাঠামো, রিয়াল এস্টেট, জমি দখল - এসবকেই মানুষের প্রয়োজনে উন্নয়ন বলে তুলে ধরা হচ্ছে। বিশাল পরিমানে আন্তর্জাতিক ও সরকারী অর্থ চালান করা হচ্ছে তথাকথিত বন-পরিকল্পনার পেছনে, যার জন্য স্থানচ্যুত হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। ইউপিএ আজ শশব্যস্ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর সাথে চুক্তি স্বাক্ষরে, যার ফলে খনি ও জমি বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, প্রশস্ততর হচ্ছে শোষণের পথ। কিন্তু এই জঙ্গল, জমি, জল, খনিজ কোথায়? এগুলো সবই জঙ্গল ও আদিবাসী অঞ্চলে, যেখানে মানুষ সংগঠিত হয়েছে কখনো সিপিআই(মাওবাদী) দের তলায়, কখনো কোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, কখনো স্বত:স্ফূর্ত স্থানীয় আন্দোলনে কখনো বা যে কোনো উপায়ে লড়াই করে নিজের বাড়ি, জীবন, সম্পদ বাঁচাতে। 

"মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান' আসলে এই সবরকম প্রতিরোধকেই দমন এবং রাষ্ট্রের ক্ষমতার অপব্যবহার, নৃশংসতা ও অবিচারকে আড়াল করার মুখোশ মাত্র, স্পষ্টভাবেই জানিয়েছে এই গণসংগঠন। একটি খুব বেসিক প্রশ্ন তুলেছেন এনারা, সামরিক বাহিনী কিভাবে বুঝবে কে মাওবাদী আর কে নয়? 

এই অভিযানের ফলে, দীর্ঘ, রক্তাক্ত ও নৃশংস গেরিলা যুদ্ধের বলি হবেন হাজার হাজার মানুষ। ঠিক যে ফলাফল দেখা গেছে ভারতের ইতিহাসে প্রতিটি "নিরাপত্তা রক্ষার অভিযান'-এ, কাশ্মীর থেকে নাগাল্যান্ড অবধি। কাজেই প্রশ্ন ওঠে, কেন? এবং এখনই কেন? এই নিরাপত্তা কাদের জন্য? কাদের হয়ে? যদি না আসল উদ্দেশ্য "মাওবাদী নিধন' না হয়ে,আসলে এইসব এলাকায় লাখ লাখ সেনা, অস্ত্র ও যন্ত্র মোতায়েন হয়। 

তাই এনাদের মতে, এই উদ্দেশ্যের নাগরিক সমাজে "মাওবাদী সমর্থক' দের অনুপ্রবেশ ইত্যাদি গুজবের উন্মত্ত প্রচার। সরকারের দীর্ঘ ইতিহাস আছে যে কোনো ধরণের প্রতিরোধকে মাওবাদী বা নকশাল তকমা লাগানোর। এদের মতে, মাওবাদীদের রাজনীতি, তাদের অবস্থান য®থেষ্টই প্রকাশিত। যা গোপন, তা হল এদের ব্যক্তিপরিচয়, ও সামরিক কায়দা। এবং ওনারা যাঁরা এইসব এলাকায় কাজ করেন তাঁরা মাওবাদীদের "চোরা অনুপ্রবেশ' নামক ভূতকে ভয় পাননা। মাওবাদীদের অবস্থান ও এনাদের অবস্থান যে আলাদা তা পরিষ্কার হওয়া উচিৎ। তাই এনাদের মতে মাওবাদী নাম নিয়ে এই ভীতি প্রদর্শন আসলে সমস্ত প্রতিরোধ ও গণতান্ত্রিক প্রতিবাদকে দমন করার জন্য। 

এনারা বক্তব্য শেষ করছেন এই মর্মে যে, ভারতের শ্রমিক, কৃষক, আদিবাসী, দলিত এবং অন্যান্য নিপীড়িত বর্গের কাছে শান্তি ও সুবিচার পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হল মানুষের গণতান্ত্রিক আন্দোলন। যার জন্য চাই গণতান্ত্রিক জায়গা, যা একটি অঞ্চলকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করে কখনই সম্ভব না। জঙ্গল অঞ্চলে শান্তির খুব প্রয়োজন এই মুহুর্তে, যা শুধুমাত্র বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সৎ ও গণতান্ত্রিক আলোচনার দ্বারাই সম্ভব। এবং এটি সম্ভব করতে হলে, প্রথমেই তাঁরা দাবী করছেন এই অভিযান প্রত্যাহার। সরকার যদি বলতে চায় যে সে সত্যিই মানুষের অধিকার ও নিরাপত্তার দায় নিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, তাহলে তার কার্যপদ্ধতি যেন আইন, বিচার ও গণতন্ত্রের নিয়ম মেনেই হয়। 

সূত্র : http://sanhati.com/articles/1828/ 


২) ভারত সরকারের সামরিক অভিযান চালানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করতে চেয়ে সংহতি একটি প্রতিবাদ-পত্র ভারতের গণ-আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের সাথে আলোচনাক্রমে রচনা করে ও স্বাক্ষরকারী সকলের কাছে প্রচার করে। এই পত্রটি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। এই প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছেন জাতীয় স্তরে অরুন্ধতী রায়, সন্দীপ পাণ্ডে, অমিত ভাদুড়ি, আনন্দ পট্টবর্ধন, সুমন্ত ব্যানার্জি, মহাশ্বেতা দেবী ও সুমিত সরকারের মত বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছাড়াও আরো শ'খানেক মানুষ। আন্তর্জাতিক স্তরে সমর্থন জানিয়েছেন নোম চমস্কি, ডেভিড হার্ভে, হাওয়ার্ড জিন, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, জন বেলামি ফস্টার, মাইকেল লেবোউইৎস, মীরা নায়ার ও আরো বহু বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ ও গণ-আন্দোলনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিত্ব। এই প্রতিবাদ পত্রের মাধ্যমে এনারা জানাচ্ছেন ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলিতে ভারত সরকারের এই সামরিক অভিযান ঘোষণার ফলে তাঁরা যথেষ্টই উদ্বিগ্ন। যে উদ্বেগ অনেকাংশেই আদিবাদী জনসংগঠন CSD র বক্তব্যের প্রতিফলিত, দেশের দরিদ্রতম অঞ্চলে বিপুল সংখ্যক মানুষের বাস্তু, জীবন ও জীবিকা হারাবার উদ্বেগ, নির্বিচারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হবার উদ্বেগ। এখনই পুলিশ, আধাসামরিক, এবং সরকারী মদতে তৈরি যেসব অসামরিক সশস্ত্র বিদ্রোহ-বিরোধ বাহিনীর অত্যাচার চলছে এই অঞ্চলে, তাতে তৈরি হয়েছে এক গৃহযুদ্ধকালীন অবস্থা। ছত্তিসগড় ও পশ্চিমবঙ্গে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ, বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কয়েকহাজার। সরকার প্রস্তাবিত এই নতুন অভিযানে এই মানুষগুলোর লাঞ্ছনা, দারিদ্র্য, অসহায়তা যে শুধু আরো বাড়বে তাইই না, এই অবস্থা ছড়িয়ে যাবে দেশের অন্যান্য অলেও, আশংকা স্বাক্ষরকারীদের। 

তাঁরা মনে করছেন নব্বইএর দশকের গোড়া থেকে ভারতের রাষ্ট্রব্যবস্থা যে নয়া-উদারনীতি গ্রহণকারী শাসন পরিকল্পনা নেয় তার জন্য একদিকে বেড়েছে আদিবাসীদের মধ্যে অভাবনীয় দারিদ্র্যের যন্ত্রণা আর অন্যদিকে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন। প্রাকৃতিক সম্পদে ও সামাজিক সম্পত্তির উপর আদিবাসীদের যেটুকু এক্তিয়ার ছিল তাও আক্রান্ত হয়েছে ক্রমান্বয়ে,কখনো খনি, শিল্প বা তথ্য-প্রযুক্তি পার্ক স্থাপনের মতো "উন্নয়নমূলক' কাজের কারণে, কখনো বা বিশেষ আর্থিক অঞ্চল বা এস-ই-জেড বানাবার প্রয়োজনে। লক্ষ্যণীয়, সরকার দেশের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই আক্রমণ চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে, তা খনিজ, বনজ, জলজ সম্পদে সমৃদ্ধ। ঠিক এই অঞ্চলগুলোর ওপরেই বহুজাতিক কর্পোরেশনসমূহের বহুদিনের নজর। শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে গিয়ে এই সমস্ত এলাকার অধিবাসীরা যে মরণপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন তাতে কিছুটা হলেও সরকারী মদতপুষ্ট কর্পোরেশনগুলি পিছু হটেছে। তাই স্বাক্ষরকারীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে এই বর্তমান যুদ্ধঘোষণা আদতে অনেকাংশেই এই বহুজাতিক সংস্থাগুলির অবাধ লুন্ঠনের পথ প্রশস্ত করার প্রকরণ মাত্র। 

পত্রটিতে উল্লেখ করা হচ্ছে যে, একদিকে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বিভেদ, অন্যদিকে গরীব ও প্রান্তিক মানুষের ন্যায়সঙ্গত অহিংস প্রতিবাদের প্রতি চরম উদাসীনতা বা তার রাষ্টীয় দমনের কারণে আজ এই রাজনৈতিক হিংসা, ক্ষোভ ও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু তার সমাধানের মোকাবিলা না করে ভারতের রাষ্ট্রশক্তি এর সামরিক সমাধানে ব্যস্ত। "গরীবি হঠাও' এর বদলে "গরীব হঠাও' হয়ে উঠেছে তার কাজের মূলমন্ত্র। এই আক্রমণ ভারতীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিতে চরম আঘাত হানতে চলেছে। এই সামরিক অভিযানের সাময়িক সাফল্যের নিশ্চয়তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও, সাধারণ মানুষের উপর তার অভিঘাত খুবই বিপর্যয়কারী হবে, নি:সন্দেহে। পৃথিবীর বিভিন্ন বিদ্রোহ-আন্দোলনের ইতিহাস কিন্তু তাই বলে। 

প্রতিবাদ পত্রটি এনারা শেষ করেছেন ভারত সরকারের কাছে অনুরোধ জানিয়ে যে, সরকার যেন অবিলম্বে সেনা প্রত্যাহার ও এই জাতীয় সামরিক অভিযান - যার ফলে গৃহযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে দেশের সবচেয়ে গরীব মানুষগুলির দুর্দশা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে তথা বহুজাতিক কর্তৃক প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুন্ঠনের পথ প্রশস্ত করবে - এই পরিকল্পনা বাতিল করে। 

সূত্র : http://sanhati.com/excerpted/1824/ 


ফিলিপিনসের আদিবাসী গণসংগঠন 

৩) ফিলিপিনসের কর্ডিলেরা পিপলস অ্যালায়েন্স, ওখানকার আদিবাসী মানুষদেরকে নিয়ে একটি তৃণমূল সংগঠন। তাঁরা জানালেন, একইরকম অবস্থার সম্মুখীন প্রতিনিয়ত তাঁরাও হচ্ছেন। এক্ষেত্রে দায়ী হল ফিলিপিনসের সামরিক বাহিনী। তাদের অত্যাচারে এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশী অ্যাক্টিভিস্ট, মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী ভূমিপুত্র প্রাণ হারিয়েছেন। ভারতের আদিবাসীবহুল এলাকায় চলা রাষ্টীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এঁরা মানবাধিকার কর্মী ও আদিবাসী গণসংগঠনের বক্তব্যের সঙ্গে ঐক্যমত্য প্রকাশ করেছেন। 

সূত্র : http://sanhati.com/articles/1842/ 


সিটিজেন'স ইনিশিয়েটিভ ফর পিস 

৪) গত ২০-শে অক্টোবর দিল্লীতে সিটিজেন'স ইনিশিয়েটিভ ফর পিস-এর জাতীয় কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, এতে অংশগ্রহণ করেন জাস্টিস পি সাওয়ান্ত, সন্দীপ পান্ডে, অধ্যাপক হরগোপাল প্রমুখ মানবাধিকার কর্মী ও সমাজসেবী। পাশাপাশি ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বিভিন্ন সাধারণ মানুষ বক্তব্য রাখেন, যাঁরা মাওবাদী দমনের নামে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে সরাসরি ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। কনভেনশন-এর মাধ্যমে সরকার ও মাওবাদীদের কাছে আশু রূপায়ণের জন্য ৬-টি দাবী রাখা হয়: ১) প্রথমে সরকারকে মাওবাদী ও অন্যান্য নকশাল অধ্যুষিত এলাকায় রাষ্ট্রীয় দমন চালানোর থেকে নিবৃত্ত হতে হবে। ২) সিপিআই (মাওয়িস্ট) এবং অন্যান্য নকশাল দলগুলিকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঘাত হানা বন্ধ করে যুদ্ধবিরতির পরিস্থিতিতে পৌঁছতে হবে। ৩) সাধারণ মানুষের ওপর কোনও ধরণের আক্রমণ চলবে না এবং দুপক্ষকেই তাদের জীবনের দায়িত্ব নিতে হবে। ৪) সরকার ও মাওয়িস্টদের মধ্যে নি:শর্ত আলোচনা শুরু করতে হবে। ৫) হিংসা-উপদ্রুত এলাকায় সিভিল রাইটস অরগানাইজেশন ও মিডিয়াকে বিনা বাধায় ঢুকতে দিতে হবে। ৬) সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা এবনং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারকে নিশ্চয়তা দিতে হবে। এবং এর জন্যে সকলকে একসাথে কাজ করতে হবে। 

সূত্র : http://indianvanguard.wordpress.com/2009/10/25/stop-offensive-hold-unconditional-dialogue-call-from-national-convention-of-citizens-initiative-for-peace/ 


পি ইউ সি এল, জন হস্তক্ষেপ, পি ইউ ডি আর ইত্যাদি 

৫) এর চারদিন বাদেই নতুন দিল্লিতে আরো একটা মিটিং ডাকা হয় , বিভিন্ন ব্যক্তি (সুরেন্দ্র মোহন, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রাজেন্দ্র সাচার, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক রণধীর সিংহ, অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল আর এইচ তাহিলিয়ানি, অরুন্ধতী রায়, প্রশান্ত ভূষণ, গৌতম নওলাখা, জি এন সাইবাবা প্রমুখ) ও সংগঠন (পি ইউ সি এল, জন হস্তক্ষেপ, পি ইউ ডি আর প্রভৃতি) এর পক্ষ থেকে। উল্লেখ্য, ছিলেন সি পি আই এর এ বি বর্ধন ও। উদ্দেশ্য, মাওবাদী ও নক্সালপন্থীদের বিরুদ্ধে সেনা ও বিমান বাহিনীর ব্যবহারের বিরোধিতা করে জনমত তৈরী। বলা হয় যে, যদিও সরকার মুখে বলছে তারা এই পরিপ্রেক্ষিতে সেনা নামানোর বিরোধী, কিন্তু আসলে ৬৫০০০ এরও বেশী "স্পেশ্যাল ফোর্স' কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে সেনার তত্ত্বাবধানেই। এর সাথে আছে "রাষ্ট্রীয় রাইফেল' ও আইটিবিপি। হেলিকপ্টার আর বায়ুসেনাকে তৈরী করা হচ্ছে আঘাত হানার জন্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী চিদাম্বরম যে "ক্যাপচার, হোল্ড, ডেভেলপ' নীতি নিয়েছেন মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলির জন্য, তা আমেরিকার আফগান নীতির মতই, যেখানে "উন্নয়ন' আসে সবার শেষে। এর আড়ালে মানুষকে তার জীবন-জীবিকা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। এর সাথে আছে কালা আইনের প্রয়োগ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার, অত্যাচার, নকল এনকাউন্টার এবং হত্যা। প্রধানমন্ত্রী সংসদে ১৮/০৬/২০০৯ এর বক্তৃতায় বলেছেন যে "দেশের খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলে বাম উগ্রপন্থার বিকাশের ফলে দেশে লগ্নীর পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে', অর্থাৎ এই "বাম উগ্রপন্থা'-ই হোলো উন্নয়ন, তথা দেশের খনিজ সম্পদ বড়ো পুঁজিপতি বা বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার পথে মূল বাধা। ঐ অঞ্চলে যে মানুষেরা থাকেন, তাঁদের এই উন্নয়নের ফলে উৎখাত করে জীবিকাচ্যুত করা হবে, চরম দুর্দশা আর ক্ষুধার মধ্যে ঠেলে দেওয়া হবে। দেশের নাগরিকদের বিরুদ্ধে এই সেনা ও বিমানবাহিনীর ব্যবহারের এই ঘটনা ন্যক্কারজনক। দেশকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত থাকার কথা যে সেনাবাহিনীর, তাদের কখনোই দেশবাসীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামানো উচিৎ না। সরকার সেনাবাহিনীকে দিয়ে যে ভূমিকা পালন করাতে চায়, দেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপ্রিয় মানুষেরা তার বিরোধী। 

সূত্র : http://radicalnotes.com/journal/2009/10/25/no-to-armed-forces-against-naxalites/ 


পি ইউ ডি আর : মাওবাদী কার্যকলাপ প্রসঙ্গে 

6) Peoples Union for Democratic Rights, Delhi (PUDR) এর পক্ষ থেকে নিন্দা করা হল মাওবাদীদের কাজকর্মের ও। খুব জোরের সঙ্গে তাঁরা জানিয়েছেন যে দারোগা (ইন্সপেক্টর) ফ্রান্সিস ইন্দুয়ারকে নির্দয় ভাবে হত্যা করাটা প্রশ্নাতীত ভাবে একটি ঘৃণ্য কাজ। তাঁরা বলেন,যেকোনো যুদ্ধকলীন হত্যাই অপরাধ, দুপক্ষেরই উচিত বন্দীকে অক্ষত রাখা, কিন্তু দু:খের বিষয়,একদিকে সরকার,অন্যদিকে মাওবাদীরা হত্যালীলার পুনরাবৃত্তি করে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন নিজেই স্বীকার করেছেন যে মাওবাদীদের সমর্থক হলেন সমাজের দরিদ্রতম মানুষেরা,তখন তো তাদের বিরুদ্ধে যেকোনো রকম পদক্ষেপ গ্রহণের আগে ভারত সরকরের একবার ভেবে দেখা উচিত। তাই দুপক্ষের প্রতি এঁদের আবেদন,অবিলম্বে যুদ্ধের অবসান এবং প্রকৃত হত্যাকারীদের বিচার। এরপরেও যদি এরা যুদ্ধকে অব্যাহত রাখতে চায় তবে যেন Geneva Convention J Protocol III মেনেই যুদ্ধ করে। PUDR অসন্তোষ প্রকাশ করে সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকাতেও। তাদের মতে সংবাদ মাধ্যম অনেক সময়েই এই সমস্ত বিষয়ের বিপক্ষে বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলির প্রেরিত প্রেস স্টেটমেন্টকে প্রকাশিত হতে দেয়না, অথচ পরে এদেরকেই ধিক্কার জানায় এই বলে যে অসরকারি দল গুলির নারকীয় হত্যার বিরুদ্ধে এরা সরব নয়। তাই সংবাদ মাধ্যমের কাছে অনুরোধ জানানো হয়েছে মিথ্যা রটনার যন্ত্র না হয়ে উঠতে, কোনো পক্ষের অপরাধকেই যেন গোপন না করতে। 

সূত্র : http://sanhati.com/news/1826/ 


বিনায়ক সেন 

৭) মাওয়িস্টদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের প্রশ্নে কি মানবাধিকার কর্মীরা নীরব, বিনায়ক সেনের কাছে এই প্রশ্ন রেখেছিলেন CNN-IBNLIVE -এর রূপশ্রী নন্দা। উত্তরে বিনায়ক সেন খুব স্পষ্টভাবে জানালেন যে মানবাধিকার কর্মী হিসেবে তাঁরা সব ধরনেরই হিংসার নিরসন চান, কারণ কোনও সমস্যার সমাধানেই হিংসা সঠিক পথ হতে পারেনা। সেই কারণেই ফ্রান্সিস ইন্দুয়ারের হত্যাকাণ্ডের পর সমস্ত ফোরামে তাঁরা নিন্দা করেছেন। কিন্তু উল্টোদিকে, বিনায়ক সেন ততোধিক স্পষ্টভাবে এও মনে করিয়ে দিতে চান,রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও কিন্তু সমানে চলছে। তাঁরা মাওয়িস্টদের হিংসাকে বৈধতা দিচ্ছেন না কিন্তু সেটাকেও আসলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের প্রেক্ষাপট থেকে দেখার চেষ্টা করছেন। মাওয়িস্টদের হয়ে সহিংস কাজগুলি আদতে কিছু দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া মানুষের বাঁচার চেষ্টা, যে মানুষগুলিকে জোর করে সরিয়ে রাখা হচ্ছে তাঁদের বাঁচার অবলম্বন বনজ ও প্রাকৃতিক সম্পদ থেকে। বিনায়ক সেন বললেন যে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং অবধি বলছেন যে দরিদ্র ও নিপীড়িত জনগণের সমর্থন পাচ্ছে মাওয়িস্টরা, আর ঐ মানুষগুলো স্রেফ নিজেদের বাঁচার তাগিদেই তাদের সমর্থন করেন। এই আসল সমস্যাটাকে নিরসন করতে হবে। হিংসা কেবলমাত্র এর একটা বহি:প্রকাশ। কিন্তু আবারও, তাঁর মতে সমস্ত ধরনের হিংসাকে বন্ধ করার মধ্যে দিয়েই কোনও শান্তিপূর্ণ সুষ্ঠ সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব, তাই তিনি সমাজের সবধরণের সবধরনের মানুষের কাছে আবেদন জানাচ্ছেন মাওয়িস্ট ও সরকার এই দুপক্ষের হিংসার বিরুদ্ধেই সোচ্চার হতে। 

সূত্র : http://ibnlive.in.com/news/state-maoist-violence-must-end-binayak-sen/102977-3.html 


আরও কিছু বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবীর বিবৃতি 

৮) ভারতের বিভিন্ন রাজ্য জুড়ে সিপিআই (মাওয়িস্ট) যে সশস্ত্র রাজনীতি চালাচ্ছে তা মাও জে দং-এর মতবাদের প্রকৃত অনুসরণ নয় এবং এই হিংসার রাজনীতির ফলশ্রুতিতে গণতান্ত্রিক আন্দোলনগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ব্যাহত হচ্ছে কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থ। এক যৌথ বিবৃতিতে একথা জানালেন ইরফান হাবিব, অমিয় কুমার বাগচী,প্রভাত পটনায়ক, উৎসা পটনায়েক, তিস্তা শেতলাবাদ প্রমুখ ৪০ জন বেশ কিছু বুদ্ধিজীবী ও সমাজসেবী। মাওয়িস্টদের রাজনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার দাবী তুলেছেন তাঁরা। মাওবাদী সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে ২৭-শে অক্টোবর তাঁরা দিল্লীতে মিলিত হন। এর পাশাপাশি তাঁরা শাসকশ্রেণী ও রাষ্ট্রযন্ত্রের মাধ্যমে মাওয়িস্ট দমনের নামে সাধারণ মানুষের উপর নেমে আসা অত্যাচারের প্রতিবাদ করেন। তাঁদের মতে রাজনৈতিকভাবে মাওবাদীদের মোকাবিলা করবার জন্যে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। যে নিওলিবারেল অর্থনীতির মাধ্যমে আদিবাসীদের শোষণ ও বঞ্চনা বেড়ে চলেছে তা প্রত্যাহার করে রাজ্য সরকারগুলের মাধ্যমে সেখানকার প্রকৃত উন্নয়নের ব্যবস্থা করতে হবে। সালবা-জুদুম বা মাওবাদী দমনের নামে সাধারণ মানুষকে অত্যাচার বা হত্যা করা থেকে রাষ্ট্রকে বিরত হতে হবে বরং প্রকৃত অর্থে যারা মাওবাদের নামে হিংসা ছড়াচ্ছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে এবং যে সব মাওবাদী হিংসার পথ ছেড়ে দিতে আগ্রহী, তাঁদের সঙ্গে সরকারকে আলোচনায় বসার উদ্যোগ নিতে হবে। 

সূত্র : www.pragoti.org/node/3678 


পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীরা 

৯) পশ্চিমবঙ্গেও মাওবাদীদের হিংসাত্মক কাজকর্মের নিন্দা করেছেন শঙ্খ ঘোষ,প্রতুল মুখোপাধ্যায়,নবারুণ ভট্টাচার্য্য,মহাশ্বেতা দেবী, বিভাস চক্রবর্তী, জয় গোস্বামী, শাঁওলী মিত্র, অপর্ণা সেন, কৌশিক সেন, নব দত্ত, জয়া মিত্র, পুণ্যব্রত গুণ সহ প্রায় ৫০ জন বুদ্ধিজীবী। বলেছেন, বিরোধী মতবাদ পোষণকারীদের প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে হিংসাত্মক কার্যকলাপ চালালে সেটা পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের এতদিনকার এরাজ্যে চালিয়ে আসা গণতন্ত্র বিরোধী কাজকর্মের মতন ই হয়ে দাঁড়ায়, এবং এইধরণের কাজকর্ম ভবিষ্যতে সিপিএম ও সরকারের আরো পার্টি ও প্রশাসনিক সন্ত্রাসকে বৈধতা দেবে। গত ২৮ শে সেপ্টেম্বর অনীক পত্রিকার সম্পাদক দীপঙ্কর চক্রবর্তী কর্তৃক প্রকাশিত এই বিবৃতিতে "জাতীয়তাবাদী' কেন্দ্রীয় সরকার ও নিজেদের "কম্যুনিস্ট' দাবী করা রাজ্য সরকারের যৌথ উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী জনজাতির উপর সন্ত্রাস চালানোরও তীব্র নিন্দা করা হয়। 

সূত্র : http://sanhati.com/front-page/1083/#51 


প্রসঙ্গ লালগড় : যাদবপুর ছাত্র সংগঠন 

ছত্রধরবাবুকে জেরা করে পুলিশ নাকি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কুড়িজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম জেনেছে, জানতে পেরেছে দুজন অধ্যাপকের নামও, যাঁরা প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ছত্রধরবাবু এবং/অর্থাৎ মাওবাদীদের সাথে যোগাযোগ রেখে চলতেন, এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ। সেই সঙ্গে তাদের বক্তব্য যে এই "অপরাধী'দের প্রত্যেকের ওপর নজর রাখছে পুলিশ, প্রয়োজন হলে এদের জেরা ইত্যাদি করা হবে। এই প্রসঙ্গে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র সংগঠন "ডি এস এফ' সরাসরিই লালগড় আন্দোলনের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে। তাদের মূল বক্তব্য হল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ লালগড়ের আন্দোলনের রূপে ফেটে পড়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাধীনতার ষাট বছর পরেও মানুষগুলো পেটভরে খেতে পায় না দুবেলা, স্কুল নেই, চিকিৎসার বন্দোবস্ত নেই-- মানুষের বাঁচার যে ন্যূনতম উপকরণগুলো, সেগুলো পায় না ওখানকার মানুষ। প্রতিষ্ঠিত ভোটবাজ দলগুলোর ভোটের আগে দেখা পাওয়া যায় প্রতিশ্রুতির মালা গলায়--আর বাকি সময়টায় দেখা পাওয়া যায় অত্যাচারী পুলিশ বাহিনীর। জল-জঙ্গল-জমির ওপর মানুষের অধিকারের প্রশ্নটাই তাই সেখানে আক্রান্ত। শালবনীর ঘটনার পর পুলিশি অত্যাচার এই স্তূপাকার বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটিয়েছে মাত্র। আর দীর্ঘদিনের অত্যাচার আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে আজ মানুষ মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে -- তখন কেন্দ্র-রাজ্য সরকার পাঠিয়েছে যৌথ বাহিনী। বেয়নেট-লাঠি-গুলির এই অভিযানের পক্ষে রায় দিয়েছে সিপিএম, রায় দিয়েছে কংগ্রেস-তৃণমূল-বিজেপি। এপ্রসঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছে তারা। লালগড়ে যৌথবাহিনীর অভিযানের এই গোটা পর্বে লালগড় সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার স্কুলগুলো বন্ধ ছ'মাসেরও বেশী সময় ধরে, কারণ পুলিশ স্কুলগুলোতে ক্যাম্প করে আছে। ফলে স্কুলে যাওয়া, পড়াশোনা করা বন্ধ এলাকার বহু ছাত্র-ছাত্রীর। স্কুল খোলার দাবী নিয়ে এসে একদিন পুলিশের লাঠিপেটাও খেয়েছে ছাত্র-ছাত্রীরা। "আইনের শাসন বজায় রাখার' অজুহাতে ছাত্র-ছাত্রীদের ভবিষ্যত নিয়ে ছিনিমিনি খেলাকে ধিক্কার জানিয়েছে তারা। 

তারা মনে করছে যেভাবে লালগড়ে যৌথবাহিনী পাঠিয়ে দমন করা হচ্ছে মানুষের লড়াইকে-- তেমনই গোটা সমাজ জুড়ে মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠকে দমন করার চেষ্টা করা হচ্ছে ভয় দেখিয়ে আর মাওবাদী তকমা লাগিয়ে। তারা স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে লালগড় আন্দোলন নিয়ে মতপ্রকাশ করতে পারাটা একজন নাগরিকের গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তাদের মতে মতপ্রকাশের অধিকার যেমন মাওবাদীদের আছে, তেমনি তৃণমূলের কিম্বা অন্যান্যদের আছে, ঠিক ততটাই আছে সিপিএমেরও। এর প্রত্যেকটাই খর্ব করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তারা। তারা এর পাশাপাশি এও জানিয়েছে লালগড় আন্দোলনকে সমর্থন করা মানে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের সমস্ত কার্যক্রমকে সমর্থন করা নয়। 

এই সূত্রেই ডিএসএফের পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছে-- 
"লালগড় আন্দোলনের দাবীগুলো মেনে নিয়ে সরকারকে অবিলম্বে যৌথবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। 
UAPA সহ অন্যান্য কালা কানুন প্রত্যাহার করতে হবে। 
গণাঅন্দোলনের কর্মী ছত্রধর মাহতোর অবিলম্বে মুক্তি চাই। 
গোটা সমাজ জুড়ে এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষকদের ভয় দেখিয়ে মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার খর্ব করার চেষ্টা বন্ধ হোক। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিবৃতি প্রত্যাহার করুক প্রশাসন।' 


প্রসঙ্গ লালগড় : র‌্যাডিকাল সোসালিস্ট 

ওদিকে ছত্রধর মাহাতো গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে র‌্যাডিকাল সোসালিস্টরা জানালেন যে, কোনো রকম গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া পুলিশ-সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির নেতার গ্রেপ্তার শুধুমাত্র নিন্দনীয়ই নয়, একটি আদ্যন্ত বেআইনি কাজও বটে। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগহীন ভাবে সংবাদ মাধ্যমের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিলেন। গত জুন মাসের ১৩ তারিখের আগে অবধি সরকার এবং জনগণের কমিটির মধ্যে নিয়মিত কথাবার্তা চলেছে। তাই এঁদের মতে ছত্রধরের বিরুদ্ধে আনা ২০টি অভিযোগই পুলিশের নিজস্ব ছকে তৈরি। ছত্রধরের ১ কোটি টাকার জীবনবিমা রয়েছে বলে একদিকে তাঁর চরিত্রের উপর কালিমা লেপনের চেষ্টা করা হয়েছে, অন্যদিকে লালগড়ের জনগণের আন্দোলন মাওবাদী সন্ত্রাসীদের দ্বারা সাহায্যপ্রাপ্ত বলে প্রচার করে এই আন্দোলনের সমর্থকদের ভয় পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু এই অভিযোগের কোনোটাই আদালতে দাঁড় করানো যায়নি। ছত্রধর মাহাতোকে আদালতে হাজির করার আগে সরকারি পক্ষের এইভাবে জনগণ ও আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা একটি গুরুতর অপরাধ ছাড়া আর কিছুই না। ৩ রা অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যসচিব জনিয়েছেন লালগড়ের অন্দোলনকে সমর্থন জানানো আইনত নিষিদ্ধ। গণ-সমর্থনকে রোখার জন্য এটা একটা হাতিয়ার। রাডিক্যাল সোসালিস্টদের বক্তব্য, সরকার এক খেলা খেলে চলেছিলো। প্রতিদিন এক এক জনের নাম এসে পৌঁছিয়েছে সংবাদ মাধ্যমের কাছে। কোনো দিন হয়েতো কোনো লেখিকার নাম, আবার পরদিন হয়েতো কোনো মানবাধিকার-কর্মীর নাম। উদ্দেশ্য একটাই, এদের সবাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়া। তাই রাডিক্যাল সোসালিস্টদের দাবি অবিলম্বে পুলিশ-সন্ত্রাস বিরোধী জনগণের কমিটির বিরুদ্ধে আনা সমস্ত অভিযোগের প্রত্যাহার এবং এই ঘটনায় বন্দীদের সবার মুক্তি। মানবাধিকারবাদী যাঁরা পুলিশ এবং সরকারের দ্বারা অভিযুক্ত হয়েছেন তাঁদের সকলের প্রতি এরা সহমর্মী হয়ে সম্পূর্ণ ঘটনার নিন্দা করেন। 

সূত্র : http://sanhati.com/front-page/1083/#53 

বুদ্ধপূর্ণিমা ২০১২

বুদ্ধের বাণী একুশ শতকে আরও প্রাসঙ্গিক

সুকোমল বড়ুয়া | তারিখ: ০৬-০৫-২০১২


  • বুদ্ধের মূর্তির সামনে ভক্তরা

    বুদ্ধের মূর্তির সামনে ভক্তরা

  • বাংলাদেশে বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন

    বাংলাদেশে বুদ্ধপূর্ণিমা উদ্যাপন

1 2 3 4

আজ থেকে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে, ৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে এমনি এক শুভ তিথিতে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। বুদ্ধত্ব লাভ করেন ৫২৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, তাঁর মহাপরিনির্বাণ ঘটে ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে। তাঁর জন্ম ও বুদ্ধত্ব লাভের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে এমন একটি ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার বাণী সম্পূর্ণ অহিংস ও মানবতাবাদী। বৌদ্ধধর্ম একটি বিশ্বজনীন অহিংস, মানবতাবাদী ধর্ম। এ ধর্মের বাণীগুলো মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ। মানবতা এবং মানবিক গুণাবলির বহিঃপ্রকাশই এই ধর্মের বিশেষত্ব।
শুরু থেকেই মানবকল্যাণে মহামতি বুদ্ধের কণ্ঠে মহাপ্রেমের মহাবাণী উৎসারিত হয়েছিল। বুদ্ধত্ব লাভের পর পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের তিনি বলেন, 'হে ভিক্ষুগণ, বহুজনের হিতের জন্য, বহুজনের সুখ ও মঙ্গলের জন্য এমন ধর্ম প্রচার করো, যেই ধর্মের আদি, মধ্য এবং অন্তে কল্যাণ; সেই অর্থযুক্ত, ব্যঞ্জনযুক্ত পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশিত করো।'
'সকল প্রাণী সুখী হোক। ভয়হীন ও নিরুপদ্রব হোক।' এই বাণী প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল বুদ্ধের কণ্ঠে। সূত্রনিপাত গ্রন্থের মৈত্রীসূত্রে বলা হয়েছে: 'সভয় বা নির্ভয়, হ্রস্ব বা দীর্ঘ, বৃহৎ বা মধ্যম, ক্ষুদ্র বা স্থূল, দৃশ্য অথবা অদৃশ্য, দূরে অথবা নিকটে যে সকল জীব জন্মগ্রহণ করেছে বা জন্মগ্রহণ করবে, সে সকল প্রাণী সুখী হোক।'
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল: মুক্তির জন্য ঈশ্বর বা পরনির্ভরশীল না হওয়া, এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়া। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন, 'হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।' এ বাণীর মধ্যেই রয়েছে সর্বজীবের মুক্তি ও কর্মস্বাধীনতার পূর্ণ আশ্বাস।
বুদ্ধের শিক্ষায় অধ্যাত্ম জীবনে মানুষের মুক্তির পাশাপাশি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধের কথাও গুরুত্ব পেয়েছে। সামাজিক মর্যাদা ও শিক্ষার গুরুত্বকে তিনি খাটো করে দেখেননি। তিনি জানতেন, প্রকৃত শিক্ষাই মানুষের মনকে বড় করে, ভালো-মন্দ বিচার করার শক্তি দেয়। তিনি মনে করতেন, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বা অতিরিক্ত ভোগলিপ্সা নির্বাণ লাভের অন্তরায়; তা থেকে দুঃখমুক্তি আসে না।
মহামানব বুদ্ধের বিশ্বজনীন মুক্তির ব্যাকুলতা এবং মানবতাবাদী ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। আজ পৃথিবীব্যাপী ক্রোধ, সহিংসতা, জিঘাংসা, দুঃখ দেখলে মনে হয়, বুদ্ধের অহিংস বাণীর কত প্রয়োজন। বুদ্ধ চেয়েছিলেন মানবসমাজকে সর্ববিধ দুঃখের হাত থেকে উদ্ধার করতে। তিনি আন্তর্জাতিক, দেশ ও জাতির গণ্ডি অতিক্রম করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের দুঃখ-বেদনার কথা ভেবেছিলেন। বুদ্ধের চিন্তাধারাকে প্রাচীনকালে ভারতীয় ও গ্রিক দার্শনিকেরা এবং পরবর্তীকালে রুশো, গান্ধী ও মাও জেদং স্বাগত জানিয়েছিলেন।
বুদ্ধ অধ্যাত্ম বা বৈরাগ্য জীবনের মুক্তির পাশাপাশি সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এবং বিশ্বজনীন মুক্তি ও নিরাপত্তা চেয়েছিলেন। বস্তুত বুদ্ধের এই মুক্তিদর্শন আধ্যাত্মিক জগৎ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পূর্ণতাসহ জাগতিক সব প্রকার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যকে পূর্ণ করে। তাই বিশ্বের সাম্যবাদীরা বুদ্ধের সমাজ ও অর্থনৈতিক মুক্তির এই চেতনাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। বুদ্ধ ধনবাদী তথা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে যেমন উৎসাহিত করেননি, তেমনি বর্ণ ও বৈষম্যবাদী সমাজকেও কখনো স্বাগত জানাননি। কারণ, বুদ্ধ জানতেন, ধনবাদ কিংবা পুঁজিবাদ কখনো মানুষের জীবনে সামগ্রিক সুখ আনতে পারে না। বুদ্ধ চেয়েছেন মধ্যম পন্থার মাধ্যমে 'সকলের জন্য অধিক সুখ প্রতিষ্ঠা'।
বৌদ্ধসমাজ দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সব মানুষের ধর্মীয় অধিকারলাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। তাঁর জীবনদর্শনে চিন্তা ও মননের স্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মূল্যবোধ বিকাশের সব বিষয় অমিত প্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি সমাজের বহু আক্রান্ত মূল্যবোধকে বল্গাহীনভাবে দেখেননি। বুদ্ধ তাঁর জীবনদর্শনে ও শিক্ষামূলক আদর্শে অতিমানবিক বা অতিপ্রাকৃতিক জীবনকে গ্রহণ করেননি। তাঁর উন্নততর জীবনে অনাড়ম্বর ও বৈচিত্র্যহীন সংযত আচরণ, আদর্শ ব্যক্তিত্ব ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও সংবেদনশীল বিনয়নীতি সামগ্রিক জীবনে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়।
প্রকৃত জীবন গঠনের মানসে শীলের গুরুত্ব বৌদ্ধধর্মে সর্বত্র বা সংযত আচরণকে তিনি বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়েছেন। এ জন্য বৌদ্ধধর্মে পঞ্চশীলে আছে প্রাণীবধ বা হিংসা না করা, চৌর্যবৃত্তি না করা, মিথ্যা কথা না বলা, ব্যভিচার বা যৌনাচার না করা, কোনো প্রকার মাদকদ্রব্য সেবন না করা প্রভৃতি। এগুলো হলো সুন্দর আচরণবিধি, যা সৌজন্য, ভদ্রতা, মানবতা, সহিষ্ণুতা, পরোপকার, মার্জিত রুচি, দায়িত্ব-কর্তব্যবোধসহ সৃজনশীল কর্ম, সাম্য, মৈত্রী প্রভৃতি আদেশ-উপদেশের নির্দেশনা। এসব মানবিক গুণের অনুশীলনকে বুদ্ধ উৎসাহিত করেছেন। এসব গুণের সমাবেশেই একটি মানুষের জীবন যেমন সুন্দর ও পরিপূর্ণ হয়, তেমনি সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনও জননীতি, জন-আদর্শে পরিপূর্ণ ও সমৃদ্ধিশালী হয়। অতএব, বুদ্ধের বহুমাত্রিক কল্যাণময়তা এভাবে মানবগোষ্ঠীকে মঙ্গলের পথে আসতে আহ্বান জানায়। বিশ্বশান্তি ও বিশ্বমানবতা গঠনে প্রেরণা জোগায়।
বৌদ্ধধর্ম বলছে, বিজ্ঞানের আবিষ্কার আপাতদৃষ্টিতে সুখ-সমৃদ্ধময় মনে হলেও মানব কিংবা জীবকুলকে জরা, ব্যাধি, মৃত্যু থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। তাই বুদ্ধ বলেন, 'আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের মতো আর কোনো মার্গ নেই; চতুরার্য্যের সমান আর কোনো সত্য নেই।' কিন্তু বিজ্ঞানের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের কোনো বিরোধ নেই। বরং বৌদ্ধধর্ম সত্যিকার অর্থে বিজ্ঞানসম্মত ধর্ম। তবে ভোগবাদী বিজ্ঞান ও লোকোত্তর বিজ্ঞানের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। ভোগবাদী বিজ্ঞান মানুষকে অমঙ্গলের পথে নিয়ে যায়। ভোগবাদী বিজ্ঞানের অপব্যবহারের ফলে আজ বিশ্বে যুদ্ধ, আণবিক বোমা ও মারণাস্ত্র ব্যবহূত হচ্ছে। এগুলো বিশ্বশান্তির হাতিয়ার হতে পারে না। 
মহামতি বুদ্ধের মতো আজ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও বলছেন, মানুষের দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা, হিংসা-বিদ্বেষ থেকেই মারাত্মক ব্যাধির সৃষ্টি হয়। এ জন্য বুদ্ধ লোভ-লালসাহীন ভাবনার কথা বলেছেন; উদগ্র কামনা-বাসনাপূর্ণ ভাবনা ত্যাগ করতে বলেছেন। এতেই মানুষের প্রকৃত মানসিক শান্তি আসতে পারে।
পৃথিবীর মানুষ আজ যুদ্ধ, হানাহানি, রক্তপাতের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাও কাজ করে, শঙ্কা হয় পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের। কেন? বৌদ্ধদর্শনে এর উত্তর পাওয়া যায় অতি সহজে। বুদ্ধ বলেন, ক্রোধ, লোভ, দ্বেষ, মোহ, কামনা-বাসনা থেকেই এসব অশান্তি এবং যুদ্ধবিগ্রহের উদ্ভব। লোভ, দ্বেষ ও ক্রোধের বশবর্তী হয়ে পরস্পরের প্রতি যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছি। একে অপরকে আক্রমণ করে চলেছি। একে অন্যকে ধ্বংস করার জন্য প্রবৃত্ত হচ্ছি। এটা ব্যক্তিজীবনকে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত করে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেশ তথা গোটা বিশ্বকে। ক্ষোভ বা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যায় সত্যি; কিন্তু এর ভয়াবহ পরিণতি যে গোটা বিশ্বের নিরীহ মানুষকে দিতে হয়, সেই বোধ যুদ্ধবাজ শাসকদের নেই। যারা এমন চরিত্রের, তাদের উদ্দেশে বুদ্ধের বাণী এ রকম: 'যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার যোদ্ধাকে পরাস্ত করা বড় কথা নয়, যে নিজেকে অর্থাৎ নিজের রিপুসমূহকে দমন করতে পেরেছে, সেই প্রকৃত জয়ী।'
আমরা অন্যকে জয় করতে চাই বিভিন্ন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। অথচ আমাদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে নিজেকে জয় করতে চাই না। এর চেয়ে অগৌরবের বিষয় আর কী হতে পারে? যুদ্ধ মানবসভ্যতার এক অভিশাপ। মানুষের মেধার আবিষ্কার মানুষকে হত্যা করার জন্য নয়, মানবজাতিকে ধ্বংস করার জন্য নয়। সম্রাট অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করার আগে কলিঙ্গ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন। সেই যুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর মনকে দারুণভাবে আহত করেছিল। বুদ্ধের অমৃতবাণী তাঁর অশান্ত হূদয়ে শান্তির বারতা এনেছিল। বুদ্ধের বাণীটি ছিল এ রকম: 'অপ্রমাদ অমৃতের পথ, প্রমাদ মৃত্যুর পথ। অপ্রমাদীরা অমর, যাঁরা প্রমত্ত তাঁরা মৃতের ন্যায়।' মহামতি বুদ্ধের এ রকম মানবতাবাদী মতবাদ ও অহিংসনীতি বিশ্বের সব মানবগোষ্ঠীকে এক অভিন্ন বিশ্বমৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হতে উজ্জীবিত করে।
হিংসা, হানাহানি, ষড়যন্ত্র, এমনকি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার অস্থির এই একুশ শতকে বুদ্ধের বাণী আগের চেয়েও বেশি প্রাসঙ্গিক।
'সব্বে সত্তা সুখীতা ভবন্তু'—বিশ্বের সকল জীব সুখী হোক। সকলেই মঙ্গল লাভ করুক। বাংলাদেশ সমৃদ্ধময় হোক। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। 'নিব্বানং পরমং সুখং'—নির্বাণ পরম সুখ, নির্বাণ পরম শান্তি।
ড. সুকোমল বড়ুয়া: সভাপতি, বিশ্ব বৌদ্ধ ফেডারেশন, বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।
sukomalbaruapalidu@gmail.com

বুদ্ধপূর্ণিমা ও বুদ্ধবাণীর তাৎপর্য
দিলীপ কুমার বড়ুয়া
আজ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা। জন্ম, বুদ্ধত্বলাভ এবং মহাপরিনির্বাণ (মৃত্যু)—বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক মহামানব গৌতম বুদ্ধের জীবনে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সংঘটিত হয়েছিল। তাই বৈশাখী পূর্ণিমাকে বুদ্ধপূর্ণিমাও বলা হয়। বিশ্ব বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কাছে দিনটির আবেদন অনন্যসাধারণ। 
সিদ্ধার্থ গৌতম ছিলেন রাজপুত্র। সর্বজীবের মঙ্গল ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথ অন্বেষণের জন্য পরিবার-পরিজন, রাজপ্রাসাদের বিলাসী জীবন, স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা ও রাজসিংহাসনের মায়া ত্যাগ করে তিনি পথে নেমেছিলেন। সুদীর্ঘ ছয় বছর কঠোর সাধনায় লাভ করেন বোধি, খ্যাত হন বুদ্ধ নামে। আবিষ্কার করেন চার আর্য সত্য: জগতে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায় আছে। দুঃখ নিরোধের উপায় হিসেবে তিনি নির্দেশ করেন আটটি অঙ্গসমন্বিত পথ আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ: সৎ দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ ব্যবহার, সৎ জীবিকা, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ চিন্তা এবং সাধু ধ্যানে চিত্তকে নিবিষ্ট করা। এ পথই শান্তির পথ। এ ছাড়া তিনি আবিষ্কার করেন জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের কারণ প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্ব। এ তত্ত্বের মূল নীতি হলো: ওটা থাকলে এটা হয়, ওটার উৎপত্তিতে এটার উৎপত্তি, ওটা না থাকলে এটা হয় না, ওটার নিরোধে এটার নিরোধ হয়।
এই তত্ত্ব অনুযায়ী, পৃথিবীর সবকিছুই কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং শর্তসাপেক্ষ। জড়জগৎ ও মনোজগৎ—নীতির দ্বারা পরিশাসিত হয়। ১০টি কারণে জন্ম, মৃত্যু ও দুঃখের সৃষ্টি হয়। তাই প্রতীত্যসমুৎপাদ তত্ত্বকে দ্বাদশ নিদানও বলা হয়। এসব নিদান বা কারণ হচ্ছে: ১. অবিদ্যা ২. সংস্কার ৩. বিজ্ঞান ৪. নাম-রূপ ৫. ষড়ায়তন ৬. স্পর্শ ৭. বেদনা বা অনুভূতি ৮. তৃষ্ণা ৯. উপাদান ১০. ভব বা উৎপত্তি ১১. এবং ১২. জন্ম, জরা, ব্যাধি, দুঃখ ইত্যাদি। এই ১২টি কারণ শর্ত সাপেক্ষে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। একটির কারণে অপরটি উৎপন্ন হয়, একটির নিরোধে অপরটির নিরোধ হয়। এই তত্ত্ব বিশ্লেষণে দেখা যায়, অবিদ্যার কারণে সংস্কার, সংস্কারের কারণে বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের কারণে নাম-রূপ, নাম-রূপের কারণে ষড়ায়তন, ষড়ায়তনের কারণে স্পর্শ, স্পর্শের কারণে বেদনা, বেদনার কারণে তৃষ্ণা, তৃষ্ণার কারণে উপাদান, উপাদানের কারণে ভব, ভবের কারণে জন্ম এবং জন্মের কারণে মানুষ জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, অপ্রিয়সংযোগ, প্রিয়বিচ্ছেদ, ঈপ্সিত বস্তুর অপ্রাপ্তিজনিত দুঃখ প্রভৃতি ভোগ করে। বর্ণিত কারণসমূহ একটির কারণে অপরটির ধ্বংস হয়। ফলে অবিদ্যা বিদূরিত হলে সংস্কার বিদূরিত হবে, এমনিভাবে জন্ম নিরোধ করা গেলে জরা, ব্যাধি এবং মৃত্যু-দুঃখ নিরোধ হবে। 
বুদ্ধ উপর্যুক্ত দর্শন এমন একসময় প্রচার করেছিলেন, যখন প্রাচীন ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী জাতিভেদ প্রথার নিগড়ে আবদ্ধ, অসাম্য-অনাচার সর্বস্বতার দ্বারা দারুণভাবে বিপর্যস্ত, ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং বিশ্বাসরূপী সংস্কারের বেড়াজালে শৃঙ্খলিত ছিল। তিনি মানুষকে কোনো প্রকার বন্ধনে আবদ্ধ করেননি, বিশ্বাসরূপী শৃঙ্খল দ্বারাও বাঁধেননি। অধিকন্তু দিয়েছিলেন বুদ্ধি ও বিবেকের স্বাধীনতা। তাই তিনি নিজেকে ত্রাণকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করেননি। বরং উপস্থাপিত হয়েছেন পথপ্রদর্শক হিসেবে। তাঁর উপদেশ ছিল 'নিজের দীপ প্রজ্বলিত করে নিজেই নিজের মুক্তির পথ পরিষ্কার করো, অন্যের ওপর নির্ভর কোরো না।'
বুদ্ধ কখনো জন্মকে প্রাধান্য দেননি, প্রাধান্য দিয়েছেন কর্মকে। তাই তাঁকে বলতে দেখি, 'জন্মের দ্বারা কেউ চণ্ডাল হয় না, কর্মের দ্বারাই চণ্ডাল হয়।' তাঁর ধর্ম কর্মপ্রধান, আপনি আচরি ধর্ম, অনুশীলন ও মননের ধর্ম। এ ধর্মে অদৃষ্টবাদ ও বাহ্যিক আড়ম্বরতার কোনো স্থান নেই। যে যেরূপ কর্ম করবে, সে সেরূপ ফল ভোগ করবে। নৈতিকতা এ ধর্মের অন্যতম আদর্শ। সমগ্র ত্রিপিটক অধ্যয়ন করলেও বৌদ্ধ হওয়া যায় না, যদি না তার নৈতিক চরিত্রের দৃঢ়তা থাকে। বুদ্ধ বলেছেন, 'তিনিই প্রকৃত বৌদ্ধ (ভিক্ষু), যাঁর চিত্ত বিশুদ্ধ, নৈতিকতায় প্রোজ্জ্বল, লোভ-দ্বেষ-মোহ হতে মুক্ত এবং সত্যদৃষ্টি বা প্রজ্ঞার ওপর প্রতিষ্ঠিত।' 
একজন বৌদ্ধকে অশুভ কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে, বিরত থাকতে অন্যকে উৎসাহিত বা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করতে হবে। অপর দিকে শুভ বা মঙ্গলজনক কর্ম করতে হবে এবং অপরকেও উৎসাহিত করতে হবে। অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য বৌদ্ধদের শীল পালন করতে হয়। তন্মধ্যে প্রধান পাঁচটি শীল পঞ্চশীল নামে পরিচিত। এই পাঁচটি শীল হচ্ছে: ১. প্রাণী হত্যা থেকে বিরত থাকা ২. অদত্ত বস্তু গ্রহণ না করা বা চুরি না করা ৩. ব্যভিচার থেকে বিরত থাকা ৪. মিথ্যাচার থেকে বিরত থাকা এবং ৫. মাদকদ্রব্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। পৃথিবীতে সব দুঃখ, অশান্তি, অন্যায় ও উপদ্রবের মূলে আছে এই পাঁচটি অপকর্ম। হত্যা, চুরি, ব্যভিচার ও মাদক সেবন—বর্তমান বিশ্বের বিরাট সমস্যা। এই সমস্যা মানুষকে শঙ্কিত করে তুলেছে। সভ্যতাকে করছে বিপন্ন। অথচ বুদ্ধ নির্দেশিত পঞ্চশীল এবং আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুশীলন করলে সহজেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি লাভ করা যায়। বুদ্ধ ব্যক্তিজীবনের উৎকর্ষের মধ্য দিয়ে সামাজিক উৎকর্ষ সাধন করতে চেয়েছিলেন। বুদ্ধের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রে ছিল মানুষ। অধিবিদ্যাসংক্রান্ত বিষয়ে তিনি নির্লিপ্ত থাকতেন। জগৎ শাশ্বত না অশাশ্বত, ধ্রুব না অধ্রুব এসব অধিবিদ্যাসংক্রান্ত প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলতেন, 'কোনো ব্যক্তি শরাহত হলে আগে সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলা উচিত, নাকি কে শরটি নিক্ষেপ করল, কোন্ দিক থেকে শরটি এল প্রভৃতি আগে অনুসন্ধান করা উচিত? জগৎ-সংসার দুঃখের ফণায় বিকীর্ণ, জরাতরঙ্গে উদ্বেল এবং মৃত্যুর উগ্রতায় ভয়ংকর। এসব প্রশ্নের চেয়ে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা ও উপায় অনুসন্ধান করাই উত্তম।' মানুষের দুঃখমুক্তিই ছিল তাঁর অভীপ্সা। সমাজ যাদের পতিত হিসেবে উপেক্ষা করেছে, তিনি তাদের উপেক্ষা করেননি। তিনি পতিতকে টেনে তুলে, পথভ্রান্তকে পথ প্রদর্শন করে সমাজে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবাইকে তাঁর ধর্মে স্থান দিয়ে তিনি মনুষ্যত্বের জয়গান করেছেন। তিনি নিজেকে এবং তাঁর ধর্মকে সামপ্রদায়িকতার গণ্ডি ও সংকীর্ণতার মধ্যে আবদ্ধ রাখেননি। তাঁকে বলতে দেখি, 'গঙ্গা, যমুনা... প্রভৃতি নদী যেমন সাগরে মিলিত হয়ে নাম হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয়, চণ্ডাল প্রভৃতি আমার ধর্মে প্রবেশ করে নাম হারিয়ে ফেলে, এখানে সকল মানুষ এক।' বুদ্ধ প্রতিষ্ঠিত সংঘে বিভিন্ন শ্রেণী ও সমপ্রদায়ের লোক ছিল, যারা আপন মহিমা ও কৃতিত্বে সংঘের মধ্যে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত ছিল। তাঁর সর্বজনীন বাণীর সুধারস বারাঙ্গনার জীবনকেও পঙ্কিলতামুক্ত করেছিল।
বিশ্বের সব প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও করুণা প্রদর্শন তাঁর প্রচারিত ধর্মের অনন্য দিক। তাঁর অমৃত বাণী বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রাণী থেকে বৃহত্তম প্রাণীকে পর্যন্ত রক্ষার প্রেরণা জোগায়। তাঁর হাতে ছিল মানবপ্রেমের বাঁশরি, কণ্ঠে ছিল মৈত্রী ও করুণার অমৃত বাণী এবং লক্ষ্য ছিল সত্য ও ন্যায়ের ধর্ম বিতরণ। তাঁকে বলতে দেখি, 'সাধক ভিক্ষু! মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে সকল প্রাণীর প্রতি অপ্রমেয় মৈত্রীভাব পোষণ করবে। মাতা যেমন তার একমাত্র পুত্রকে নিজের জীবন দিয়ে রক্ষা করে, সেরূপ সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী ও ভালোবাসা প্রদর্শন করবে। কাউকে আঘাত কোরো না। শত্রুকে ভালোবাসা দিয়ে আপন করে নেবে।' বিশ্বের সকল প্রাণীর প্রতি বুদ্ধের মমত্ববোধ সর্বকালের মানুষের মনে এক গভীর আবেদন সৃষ্টি করেছে। এই মহামন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে সম্রাট অশোক সম্যকভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, 'রাজ্য জয়, যুদ্ধ, নিপীড়ন, যাগযজ্ঞ-বলি সত্যিকারের ধর্ম হতে পারে না।' তাই তিনি হিংসানীতি পরিহার করে মৈত্রী-ভালোবাসার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে রাজ্যজয়ের পরিবর্তে ধর্মজয়ের পথ গ্রহণ করেছিলেন। বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের বিশেষত্ব হলো মৈত্রীভাবনা, যা বৌদ্ধমাত্রই অত্যাবশ্যকভাবে পালনীয়। মৈত্রীভাবনার মূল মন্ত্র হলো: 'সকল প্রাণী সুখী হোক, শত্রুহীন হোক, অহিংসিত হোক, সুখে কাল যাপন করুক।'
মানুষ আজ ধ্বংসাত্মক খেলায় মত্ত। সমগ্র বিশ্বে আজ সংঘাত, সন্ত্রাস, পারস্পরিক অবিশ্বাস, সমপ্রদায় ও জাতিগত ভেদাভেদ এক ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। পারস্পরিক সমঝোতার অভাবে পাশাপাশি রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি। ইতিপূর্বে অনেক যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। তাতে জাতিগত লাভ হয়নি কিছুই। বরং সভ্যতা ও সংস্কৃতি হয়েছে বিপন্ন। শান্তিকামী মানুষ আর যুদ্ধ চায় না, সামপ্রদায়িক ও জাতিগত ভেদাভেদ চায় না। শান্তি চায়। শান্তি চায়। শান্তি চায়। 
আজকের এই শুভ বুদ্ধপূর্ণিমা দিবসে আমাদের প্রত্যাশা—শান্তির জয়গানে ভরে উঠুক বিশ্ব। 'সকল প্রাণী সুখী হোক'। 
ড. দিলীপ কুমার বড়ুয়া: অধ্যাপক, চেয়ারম্যান, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

বুদ্ধের শিক্ষায় শান্ত হোক পৃথিবী
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া
হাজার বছরের পবিত্রতা ও মানবমুক্তির বার্তা নিয়ে আবারও ফিরে এল পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। পৃথিবীতে নতুন অরুণোদয়ে আবারও যোগ হলো একটি বুদ্ধ নববর্ষ। পৃথিবীব্যাপী বুদ্ধের নীতি ও আদর্শ সামনে রেখে, বুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা উদ্যাপন করছেন পবিত্র বুদ্ধপূর্ণিমা। এটি সমগ্র পৃথিবীর বৌদ্ধদের কাছে সর্ববৃহৎ পবিত্র ও পুণ্যময় ধর্মীয় উৎসব। 
আড়াই হাজার বছরেরও বেশি আগে বুদ্ধ যে জীবনকে তুচ্ছ মনে করে ফেলে গিয়েছিলেন, সেই তুচ্ছ জীবন আজ অনেক বড় হয়ে উঠেছে সুখপ্রত্যাশীদের কাছে। বুদ্ধের জীবনপ্রবাহে কোনো রকম উত্তেজনা ছিল না। কোনো রকম আরাম-আয়েশ ছিল না। কোনো রকম মোহ ছিল না। অলৌকিক ক্ষমতার বিকাশ ছিল না। তিনি অন্ধকারদর্শী ধর্মের জগৎ থেকে মানুষকে সৎ, ন্যায় ও বাস্তবতার পথ প্রদর্শন করছিলেন। মানুষের অধিকারের প্রতি বুদ্ধ সজাগ ছিলেন। এখন প্রশ্ন জাগে, প্রাচীন ভারত তাহলে কি ধর্মদর্শনে সমৃদ্ধ ছিল না? সমৃদ্ধ ছিল বটে। কিন্তু বর্ণবৈষম্য, জাত-পাতের ভেদাভেদ, ছুঁতমার্গের প্রাবল্যে ভেসে চলা ভারতকে একমাত্র জাগ্রত হওয়ার পথে নিয়ে এলেন বুদ্ধ নিজেই। বুদ্ধ বলেন, 'গঙ্গা, যমুনা...প্রভৃতি বড় নদী বিভিন্ন দিক থেকে উৎপন্ন হয়েও যেমন সমুদ্রে মিলে গিয়ে তাদের স্বতন্ত্র সত্তা হারিয়ে ফেলে, তেমনি ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র প্রভৃতি তাঁর ধর্মে এসে জাতি ও গোত্র হারিয়ে ফেলে।' এখানে তদানীন্তন জাতিভেদ প্রথার মূলে তিনি কুঠারাঘাত করে প্রচলন করেছিলেন সাম্যনীতির। তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে এক করে দেখছেন। নারীও যে সাধনার মাধ্যমে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন, তা-ও তিনি বলেছিলেন। তাঁর ধর্মে অস্পৃশ্য পতিতা, নিপীড়িত নারী যেমন আছেন, তেমনি রয়েছে ধনী-গরিব, উঁচু-নিচু সবার সহাবস্থান।
বুদ্ধের ধর্ম মানবকল্যাণের ধর্ম। জীবনকে সুন্দর পথে, পরিশুদ্ধতার পথে, শান্তির পথে এবং মনকে পবিত্র করার জন্য রয়েছে বুদ্ধের নীতিমালা। এগুলো পরিপালনের মাধ্যমে মানুষ পারিবারিক জীবনে, সামাজিক জীবনে, সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় জীবনে সুখ ও শান্তির পরশ পাবে। বর্তমান বিশ্বে চলছে হিংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা ও নিষ্ঠুর অমানবিক কার্যকলাপ। ফলে লোভ, দ্বেষ এবং মোহ আশ্রিত প্রদুষ্ট চিত্তের জগতে সৃষ্টি হচ্ছে নিন্দিত ও গর্হিত অমানবিক কার্যাবলি যুদ্ধ, সংঘাত মারামারি, সন্ত্রাস ইত্যাদি। আধুনিক সভ্যতার মধ্যে যে নৈতিক অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে, তাতে বুদ্ধবাণী মূল্যায়নের সময় এসেছে। প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য যে সংঘাত হচ্ছে প্রতিনিয়ত, তাতে অশান্তি ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বুদ্ধ বলেন, 'শত্রুতার দ্বারা কখনো শত্রুতার উপশম হয় না। মিত্রতার দ্বারাই শত্রুতার উপশম হয়।'
বুদ্ধ সত্য ও সুন্দর জীবনযাপনের ক্ষেত্রে নিজেকেই সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন। প্রত্যেক মানুষের মধ্যে যে আত্মশক্তি রয়েছে, সেই শক্তির বিকাশ সাধনের কথা বলেছেন বুদ্ধ। তিনি বলেন, 'নিজেই নিজের উদ্ধার সাধন করো। নিজেই নিজেকে পরীক্ষা করো। মানুষ নিজেই নিজের প্রভু, নিজেই নিজের আশ্রয়। বণিক যেমন তার সুন্দর অশ্বকে বশে রাখে, তুমিও সেরূপ নিজেকে বশে রাখো।' তিনি আরও বলেন, 'অন্যের শরণ নিয়ে লাভ নেই। নিজের শরণ নাও, নিজেকে আত্মদীপ করে জ্বালিয়ে তোলো।' একাকী পথচলার সময় পায়ে কাঁটা বিদ্ধ হলে তা পথিককেই তুলে নিতে হবে। এগুলো কালজয়ী বাণী।
সর্বকালকে অতিক্রম করতে সক্ষম এ বাণী। এগুলোই মানুষকে সঠিক পথের সন্ধান দিতে পারে। নব নব চেতনায় জাগ্রত করে তুলতে পারে সমাজের বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে। সুতরাং মানুষকে লোভ, দ্বেষ ও মোহের আবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজের প্রচেষ্টার প্রয়োজন। জীবনে সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য আপন শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। মহান বুদ্ধ সেই আপন শক্তিকে কাজে লাগিয়ে প্রকৃতির কোলে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষমূলে গভীরভাবে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। এ সময় তিনি চরম সত্যকে আলিঙ্গন করেছিলেন। এখানে তিনি ইতিহাসকে গৌরবান্বিত করেছেন। আর ভারতকে করেছেন মহিমামণ্ডিত। তিনি মহাসত্যের জন্য দুস্তর পথ পাড়ি দিলেন। নির্বাণ লাভের আনন্দে অবগাহন করলেন। 
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন ভাষায় অগণিত মানুষ বুদ্ধকে স্মরণ করেন। কিছুই না হোক, শৌর্য, বীর্য, প্রাজ্ঞতা এবং অন্ধকার থেকে সরে আসার জন্য তাঁর প্রার্থনা একান্তই অপরিহার্য। প্রতিনিয়ত মানুষ বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিবাদী ও বুদ্ধিবৃত্তিক কথায় বিশ্বাসী। জ্ঞানীমাত্রই কোনো কিছু স্বীকার করতে হলে ভাবের আবেগ অপেক্ষা যুক্তির আশ্রয় নেন। বুদ্ধের শিক্ষার অন্যতম উপাদান যুক্তিবিচারের মাধ্যমে পথচলা। তিনি অন্ধভাবে কোনো কিছু গ্রহণ বা বিশ্বাস করতে বলেননি।
অনৈক্য পরাজয়ের কারণ। প্রত্যেক মানুষের স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। এই গণতান্ত্রিক অধিকার যখনই বাধাগ্রস্ত হয়, সেখানেই দেখা দেয় অসন্তোষ। বুদ্ধ তাঁর প্রবর্তিত সংঘে গণতান্ত্রিক নিয়ম চালু করেছিলেন। বুদ্ধের সময়ে রাজা অজাতশত্রু প্রথম দিকে বৈশালীর লিচ্ছবীদেরকে পরাজিত করতে পারেননি। কারণ, তারা গণতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা দেখাত আর ঐক্যবদ্ধভাবে তা পালন করত। বুদ্ধভাষিত সপ্ত অপরিহানীয় নীতির মধ্যে দুটি নীতিতেই গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে। যেমন: ক. সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি নির্ধারণ করা এবং খ. নির্ধারিত কর্মসূচি সম্মিলিতভাবে সম্পাদন করা। সমাজ, সংগঠন, রাষ্ট্রে যত দিন গণতন্ত্র ও ঐক্য বজায় থাকবে, তত দিন তাদের কোনো রকম পরাজয় হবে না।
আজ পৃথিবীতে আবার খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বুদ্ধের মানবতার, বিনয় (নিয়মনীতি), সাম্য, মৈত্রী, করুণা, মুদিতা, উপেক্ষা, ত্যাগ, উদারতার। বুদ্ধ যে পথ প্রদর্শন করেছিলেন—লোভান্ধ, দ্বেষান্ধ, মোহান্ধ ও ক্রোধান্ধ মানুষ আজ তা থেকে অনেক অনেক দূরে। মানুষ যদি নিজের আশ্রয় কোনো অন্ধকারের পরিবর্তে আলোকশিখায় দৃশ্যমান হয়, তবে তাকে সে মানবে না—এমন কথা কখনো বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না। বুদ্ধের অনির্বাণ চেতনা অন্তরে জাগ্রত করার মাধ্যমে মানুষ পেতে পারে অমৃতের সন্ধান। অন্তরের ক্রোধ ও রিপুগুলোকে জয় করা সভ্যতার জন্য খুবই অপরিহার্য। এটা আমরা সবাই বুঝতে পারলেও জয় করতে পারি না কখনো। এ জন্য শান্ত পৃথিবীর স্বার্থে ও অহিংসাময় সমাজব্যবস্থার স্বার্থে বুদ্ধেরই প্রয়োজন; প্রয়োজন তাঁর শিক্ষার একান্ত অনুশীলন; প্রয়োজন তাঁর শান্তির অমৃত নিধির অন্বেষণ—প্রকৃতপক্ষে তাঁর যথার্থ অনুসরণ।
বিমান চন্দ্র বড়ুয়া: সহযোগী অধ্যাপক, পালি অ্যান্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং একাডেমিক কাউন্সিলর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

http://www.prothom-alo.com/detail/news/255552

অরণ্যে রোদন

বাংলার কোন মুখ বিশ্বকে দেখাব

আনিসুল হক | তারিখ: ২৩-১০-২০১২


এখন যদি আপনি গুগল করেন 'বাংলাদেশ' শব্দটা লিখে, অন্য কয়েকটা জিনিসের সঙ্গে যা পাবেন, তা হলো নিউইয়র্কে বাংলাদেশি তরুণ আটকের খবর। ২১ বছরের ওই তরুণ নাকি নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক ভবন বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নিয়েছিল। এই খবরটা প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে? এক. উদ্বেগ। উৎকণ্ঠা। শঙ্কা। সর্বনাশ! এ কী খবরের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম জড়িয়ে গেল! প্রবাসী বাংলাদেশিরা না আবার নানা ধরনের চাপ, হয়রানি, অতিরিক্ত নিরাপত্তা তল্লাশি, সন্দেহের ঘেরে পড়ে যান। আমাদের ছেলেমেয়েদের না বিদেশে পড়তে যেতে অসুবিধা হয়। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য না ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই রকম ঘৃণ্য অমার্জনীয় কাজের সঙ্গে বাংলাদেশের তরুণ যুক্ত হতে গেল কেন? দুই. সন্দেহ। বাংলাদেশের একজন তরুণ এই কাজ করতে পারে? এটা কি সম্ভব? তিন. ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। বাংলাদেশের কোনো তরুণের পক্ষে এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়, কাজেই এটা একটা ষড়যন্ত্র। 
অর্থাৎ বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই এ ধরনের খবরের সঙ্গে বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হোক, তা চায় না। যখন উচ্চারিত হয়, তখন বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ সেটা মেনে নিতে পারে না, বিশ্বাস করতে চায় না। এর কারণ কী? কারণ, বাংলাদেশের মানুষ মোটের ওপর খুবই শান্তিপ্রিয়। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধবাজ নয়, তারা তাদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের কোনো পর্যায়েই কখনোই পররাজ্যে হামলা করেনি। এখানে সব ধর্মই শান্তির কথা বলে, সম্প্রীতির কথা বলে। আর এ দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে সুফি-সাধকদের মাধ্যমে, যাঁরা বলে গেছেন প্রেমের কথা, যাঁদের সাধনা মরমি সাধনা। এখনো এই দেশের অনেক মাজারে হিন্দু-মুসলমাননির্বিশেষে হাজির হয়, শিরনি দেয়। কাজেই কোথাও বোমা ফুটলে, কোথাও মানুষের প্রাণহানি ঘটতে দেখলে বাংলাদেশের মানুষের মন কেঁদে ওঠে। কাজেই বাংলাদেশের একজন নাগরিক কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত থাকতে পারে, এটা বিশ্বাস করতে আমাদের কষ্ট হয়।
এফবিআই ফাঁদ পেতে যে কৌশলে ওই তরুকে হাতেনাতে ধরেছে, খোদ আমেরিকাতেই সে কৌশলের সমালোচনা করা হয়েছে, হচ্ছে, আমরা এখন বিভিন্ন কাগজের মাধ্যমে তা জানতে পারছি। ব্যাপারটা এখনো বিচারাধীন। আর আমেরিকার গ্র্যান্ড জুরি বলবে আদৌ এই মামলা চলবে কি না। কাজেই বিচারাধীন কোনো বিষয় নিয়ে এবং ব্যাপারটা সম্পর্কে খুব বেশি না জেনে আমাদের পক্ষে কোনো মন্তব্য করা সংগত হবে না। তবে একটা আফসোস নিশ্চয়ই আমাদের হচ্ছে, ওই তরুণটির মনে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছে, এটা জানার পর তাকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় কৃত্রিম সহযোগিতা না করে কি কাউন্সেলিং করা যেত না? একটা উর্বর বীজতলায় আপনি সন্ত্রাসবাদের বীজ ফেলবেন নাকি উদার মানবিকতা, অহিংসা, সম্প্রীতির বীজ ফেলবেন?
আমরা সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের ঘোরতর বিরোধী। আমরা বারবার প্রচার করব প্রাচ্যের অহিংসাবাদের বাণী। বলব, ভালোবাসো, ঘৃণা কোরো না; বুকে টেনে নাও, আঘাত কোরো না। হিংসা কেবল হিংসা ডেকে আনে। ভালোবাসাই জন্ম দেয় ভালোবাসার।
ও ভাই ভয়কে মোরা জয় করিব হেসে,
গোলাগুলির গোলেতে নয় গভীর ভালোবেসে।
ভালোবাসায় ভুবন করে জয়,
সখ্যে তাহার অশ্রুজলে শত্রুমিত্র হয়
সে যে সৃজন পরিচয়।
বলছি, একটা উর্বর তৈরি বীজতলায় আপনি কিসের বীজ বপন করবেন, সম্প্রীতির নাকি বিদ্বেষের। আর পৃথিবীর কাছে আপনি আপনার দেশের কোন ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চান, একটা শান্তিবাদী দেশের, নাকি যে দেশের কোনো না কোনো নাগরিক সন্ত্রাসের সঙ্গে যুক্ত, সেই দেশের?
আমি মনে করি, আমাদের দেশের শিক্ষার মধ্যে, আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বেশ একটা সমস্যা আছে। আমাদের দেশে আমরা খুব নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করে থাকি। একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য আছে আমাদের মধ্যে। একদিকে বাঙালিদের সমালোচনায় বাঙালিদের মতো মুখর আর কেউ আছে কি না সন্দেহ। বাঙালি হুজুগে, বাঙালি দুর্বল, বাঙালি দুর্মুখ—এটা আমরা নিজেরা প্রচার করি সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে আমরাই শ্রেষ্ঠ, এই ধরনের একটা মনোভাবও আমাদের আছে। আর আমরা বহুত্বে একদম বিশ্বাস করি না। আপনি বিশ্বের যেকোনো দেশের রাজধানীতে যান, দেখবেন, নানা রঙের, নানা আকারের মানুষ। কেউ সাদা, কেউ কালো, কারও নাক বোঁচা, কারও নাক খাড়া। আমাদের ঢাকা শহরে আমরা শুধু একই ধরনের চেহারা দেখে থাকি। লেখক শাহরিয়ার কবির আমাকে একটা গল্প বলেছিলেন। বিদেশে কোনো একটা অনুষ্ঠানে 'ধনধান্য পুষ্পভরা' গানটা গাওয়া হচ্ছিল। তাতে ওই যে পঙিক্ত আছে: এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি—সেটার অনুবাদ শুনে শ্রোতারা আপত্তি করেছিল। বলছিল, তোমরা এ কী গান গাইছ? নিজেদের শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করা তো নাৎসিবাদ!
আমাদের স্কুল-কলেজে আমরা তো এ ধরনের শিক্ষাই দিই। আমরাই শ্রেষ্ঠ। আমাদের ভাষা শ্রেষ্ঠ। আমাদের সাহিত্য শ্রেষ্ঠ। আমাদের ধর্ম শ্রেষ্ঠ। আমাদের মতবাদ শ্রেষ্ঠ। আমাদের জাতি শ্রেষ্ঠ। আমার ধারণা, এই উচ্চমন্যতা এসেছে হীনম্মন্যতা থেকে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে মার খেতে খেতে, পরাজিত হতে হতে এখন আমরা আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে উচ্চমন্যতাকে বর্ম হিসেবে ধারণ করে নিয়েছি।
অন্যদের মতও যে মত, অন্যদের বিশ্বাসও যে বিশ্বাস, সব মত, সব পথই যে শ্রদ্ধেয়, সবাই মিলেই যে এই পৃথিবীতে বিরাজ করতে হবে, এই কথাটা আমরা কিন্তু খুব কম সময়েই উচ্চারণ করি। 
তার ফল মাঝেমধ্যে হয়ে পড়ে খুব মারাত্মক। আমরা কোনো এক ছুঁতোয় হামলে পড়ি রামু-উখিয়ার বৌদ্ধমন্দিরে ও বসতিতে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে ক্রিকেটে হেরে আমরা তাদের বাসে ঢিল ছুড়ি।
আর আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে গুরুতর গলদ আছে। আমরা কেবল নোট পড়িয়ে, এমসিকিউয়ের উত্তর শিখিয়ে ভালো ফল আদায় করার চেষ্টায় রত। ছাত্রছাত্রীরা আর কবিতা পড়ে না, গল্প পড়ে না, তারা কেবল প্রশ্নের উত্তর শেখে। আগে সবাই হরে-দরে ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চাইত, এখন পড়ে এমবিএ-বিবিএ। সাহিত্য, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, কলা না পড়লে একটা ছেলের মনটা উদার হবে কী করে? স্মরণ করিয়ে দিতে চাই শিকাগোর সিয়ারস টাওয়ারের নিচে আবক্ষ মূর্তির সঙ্গে খোদিত প্রকৌশলী এফ আর খানের উক্তি, 'একজন প্রযুক্তিবিদের অবশ্যই তার আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে জানতে হবে। আর জীবন হলো শিল্প, নাটক, সংগীত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মানুষ।'
নিউইয়র্কে এফবিআইয়ের ফাঁদে ধরা পড়া ছেলেটি যদি সত্যি সত্যি এ রকম একটা ভয়ংকর অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে কি আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করে দেখতে হবে না, কোন শিক্ষা, কোন সংসর্গ, কোন পরিস্থিতি তাকে অপরাধী করে তুলল?
আমরা বহুদিন থেকে শুনে আসছি, নিষিদ্ধঘোষিত একটা রাজনৈতিক সংগঠন দেশের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চৌকস ছেলেমেয়েদের টার্গেট করে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। আর কোন কোন স্কুলে জাতীয় সংগীত গাওয়া নিষেধ, সেসবের খবরও তো আমরা মাঝেমধ্যে পাই।
আমি অতি-সরলীকৃত করে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে পড়ে বেরিয়েছেন, শিল্পে-সংস্কৃতিতে-সমাজসেবায় প্রগতির চর্চায় ভালো করছেন, এই রকম বহুজনের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় আছে। কিন্তু ওই স্কুলে বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারি টেস্ট দিতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল, সেটা আরেকবার বলি। আমি আগের বারের বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই ছিলাম। পরের বারেরটা তবু দিতে গেছি। প্রিলিমিনারি টেস্টে পেনসিল দিয়ে গোল্লা ভর্তি করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। এটা কম্পিউটারের মাধ্যমে নিরীক্ষা করা হয়। তো ওই উত্তরপত্রে নাম সই করতে হয়। আমি সই করেছি বাংলায়। কারণ, আমার স্বাক্ষর সব সময় বাংলাতেই আমি দিয়ে থাকি। ওই রুমের পরিদর্শক এসে আমার উত্তরপত্রে স্বাক্ষর দিতে গিয়ে বললেন, আপনি বাংলায় সাইন করেছেন কেন? এটা তো কম্পিউটারে দেখা হবে, কম্পিউটার তো বাংলা পড়তে পারে না। আমি তাঁকে বললাম, কম্পিউটার বাংলা কিংবা ইংরেজি কোনোটাই পড়তে পারে না। আর আমার স্বাক্ষর একটাই আর তা বাংলা। আমার খাতা যদি বাতিল হয়, তো আমার হবে। কারণ, এর আগের বারও আমি পাস করেছি, এই বাংলা সাইন দিয়েই। আমি নিজে একজন প্রকৌশলী। আর এই উত্তরপত্র বুয়েটেই যাবে। আপনি আমার এই বাংলা সাইনটাই রাখতে দিন। কারণ, আমার ইংরেজি সাইন নেই।
তিনি কিছুতেই আমার খাতায় সই করবেন না। আমিও রেগে গেলাম। হইচই বেধে গেল। তিনি চিৎকার করতে লাগলেন, পরীক্ষা হলে একজন সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছে। পুলিশ চলে এল।
সে অনেক দিন আগের কথা। এই গল্প আমি রস+আলোয় লিখেওছি। যতবার মনে পড়ে, ততবার হাসি। কিন্তু একটা পরাজিতের বেদনাও আমার হয়। কারণ, উনি আমাকে ইংরেজিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেছিলেন।
আমার খুব উদ্বেগ হয়, এই শিক্ষকেরা শিশুদের কী শেখান? আমি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি, অন্য শিক্ষকেরা যেন এই রকম না হন। বা অন্য বিষয়ে যেন এই শিক্ষকও এই ধরনের একগুঁয়েমি প্রদর্শন না করেন।
আমাদের শিক্ষার্থীদের আমরা যেন উদার মানবিকতাবোধের সন্ধান দিই। সন্ত্রাসের নয়, সম্প্রীতির শিক্ষা দিই। সামপ্রদায়িক বিভেদ নয়, বহু মত, বহু পথের সঙ্গে সম্প্রীতিময় সহাবস্থানের আদর্শে দীক্ষিত করি।
আমাদের জাতীয় সংগীতটি কিন্তু অপূর্ব। জাতীয় সংগীতে আমরা ভালোবাসার কথা বলি, সৌন্দর্যের কথা বলি, শ্রেষ্ঠত্বের বড়াই করি না। আমরা বাইরের জগতের কাছেও আমাদের ভালোবাসার বার্তা নিয়েই হাজির হতে চাই। বাংলার মানুষের শান্তিপ্রিয়তার বার্তাই আমরা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিতে চাই।
কিন্তু আমাদের দেশের সঠিক ভাবমূর্তি তুলে ধরার ব্যাপারে সরকারের দিক থেকে বা জাতীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে আমার জানা নেই। বরং আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এমন সব কাণ্ড ঘটিয়ে থাকেন, যাতে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাহেবকে আমরা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার কাজে ব্যবহার করতে পারতাম। তা না করে তাঁকে নানাভাবে হয়রানি করে আমরা কার মুখ উজ্জ্বল করলাম? আমাদের বিরোধী দলের নেতারা সুযোগ পেলেই বিদেশিদের কাছে আমাদের সরকারের নিন্দা করেন। সেটা করতে গিয়ে তাঁরা যে দেশেরই ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেন, সেটা কি তাঁরা জানেন? পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের উজ্জ্বল দিকগুলোই যেন আমরা তুলে ধরি। আর নিজেদের দুর্বলতাগুলোর সমালোচনার মাধ্যমে সেসব যেন আমরা কাটিয়ে উঠতে পারি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-10-23/news/300121



সন্ত্রাস নয় জনগণই শেষ কথা বলবে

দীপক দাশগুপ্ত

সি পি আই (এম) নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের এরাজ্যে সাড়ে তিন দশকের শাসনের নজিরবিহীন ঘটনায় দেশী, বিদেশী শাসক শোষক শ্রেণীগুলি ও তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্র দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিস্ত তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, বি জে পি-সহ বিচ্ছিন্নতাবাদী মৌলবাদী শক্তিগুলি তীব্র ক্রোধ বিদ্বেষ ও আক্রোশের জ্বালায় দিশেহারা। বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ঐ শ্রেণীগুলির শোষণের স্বার্থহানি ঘটার কারণে বামফ্রন্ট সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র তারা শুরু করেছিলো। মরিচঝাঁপির ঘটনা থেকে শুরু করে ১৯৮১-র ৩রা এপ্রিলের কংগ্রেস পার্টি আহুত ১২ ঘণ্টার বন্‌ধের নামে এরাজ্যের সাধারণ মানুষের ও সরকারী সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য কংগ্রেসী দুষ্কৃতীকারীদের দ্বারা সংগঠিত বীভৎস হত্যা ও ধ্বংসলীলা, ইন্দিরা গান্ধীর নিহত হওয়ার ঘটনায় সারা রাজ্যের কংগ্রেসী দুষ্কৃতকারীদের সন্ত্রাস সৃষ্টির ষড়যন্ত্র। রাজীব গান্ধীর হত্যাকাণ্ডের পরে কংগ্রেস দলে আশ্রিত সমাজবিরোধীরা শোকপ্রকাশের নামে সারা রাজ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিলা। এমনকি বহু স্থানে পার্টি দ্বারা নির্মিত ''শহীদ স্তম্ভ'' ভেঙে আক্রোশ ও হিংসা সংগঠিত করা হয়েছিলো। আরও বলা প্রয়োজন অনেক কংগ্রেস নেতা (যারা এখন টি এম সি) ঐ সময় প্রায়ই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের মাধ্যমে রাজ্য সরকার ভেঙে দিয়ে রাজ্যে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করার হুমকি দিতেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের পরিণামে কংগ্রেসের একাংশ কংগ্রেস পরিত্যাগ করে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস জন্মলগ্ন থেকে রাজ্যে অশান্তি ও সন্ত্রাস সৃষ্টিতে কাজ সংগঠিত করতে থাকে।

তৃণমূল কংগ্রেসের ''পাঁশকুড়া লাইন''

তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাস সৃষ্টির ষড়যন্ত্র ১৯৯৮ সালের এরাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রকাশ হয়। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জয়লাভে রাজ্যের বহু জেলায় বিশেষভাবে তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর, বাঁকুড়া ও হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলি তৃণমূল কংগ্রেসের দ্বারা ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস হয়। উক্ত জেলাগুলির বহু কমরেড তৃণমূলী দুষ্কৃতকারীদের সশস্ত্র আক্রমণে নিহত হন। বহু কমরেড দীর্ঘ দু'বছরের বেশি সময় নিজের বাসস্থান এলাকা থেকে বিতারিত হয়ে অন্যত্র বসবাস করতে থাকেন। হাজার হাজার কর্মী নেতাদের নামে মিথ্যা মামলা রুজু হয়। অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘ সময় কারান্তরিত থাকে। ঐ সময়ে অনুষ্ঠিত পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে গুণ্ডামি, সন্ত্রাস, রিগিং ও ছাপ্পা ভোট সংগঠিত করে প্রহসনে পরিণত করে তৃণমূল কংগ্রেস। বামফ্রন্ট প্রার্থীকে ঐ নির্বাচনে সশস্ত্র তৃণমূলী দুষ্কৃতীদের আক্রমণ ও জবরদস্তি ও গুণ্ডামির দ্বারা পরাস্ত করানো হয়। ধনীদের বাজারি আনন্দ বর্ধন করে থাকে যে সংবাদপত্র তারা অভূতপূর্ব তৃণমূলী সন্ত্রাস ও গুণ্ডামির তথাকথিত জয়কে ''জনগণের জয়'' হিসাবে দেখাতে সচেষ্ট ছিলো। ১৯৯৮ থেকে দু'হাজার সাল পর্যন্ত রাজ্যের জনগণ তৃণমূলী সন্ত্রাসকে ''বাজারি আনন্দের'' মাধ্যমে তথাকথিত ''মুক্ত সংগ্রাম'' ও ''স্বাধীনতা সংগ্রাম'' হিসাবে এবং ঐ তিন জেলার সন্ত্রাস সৃষ্টির নায়কদের বীর ''মুক্তি যোদ্ধা'' আখ্যা দিয়ে আনন্দ সংবাদে ছাপিয়ে ঐ মহত্তমদের আত্মতৃপ্তি লাভ করতে দেখা গিয়েছিলো সেদিন। পরবর্তী সময়ে জনগণের অভিজ্ঞতা তাদের বীরত্বপূর্ণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের দরুন তথাকথিত স্বাধীনতা সংগ্রামী তৃণমূলী সশস্ত্র দুষ্কৃতকারীদের গর্তে ঢুকে পড়তে দেখা গিয়েছিলো।

কিন্তু অন্ধকারের জীবেরা সর্বদা যেমন সুযোগ বুঝে দংশন করার চেষ্টা করে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতকারীরাও তা করে ছিলো। তৃণমূল কংগ্রেস সংগঠন হিসাবে গড়ে ওঠার পরই যেকোনো পরিস্থিতি ও সুযোগে সি পি আই (এম) তথা বামফ্রন্ট সরকারের উপর আক্রমণ করেছে। রাজ্যের সমস্ত প্রতিক্রিয়াশীল ও কায়েমী স্বার্থবাদী শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যের বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র চালিয়েছে। সর্বোপরি এরাজ্যের উন্নয়ন বিরোধিতা চালিয়েছে।

শিল্পায়ন কর্মসূচীর বিরোধিতায় তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদীরা

এরাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় তৃণমূল কংগ্রেসের বাধা দান, তার জন্য হিংসা ও সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় এরাজ্যে রাজ্য সরকারের সহযোগিতায় নন্দীগ্রামে কেন্দ্রীয় সরকারের ''কেমিক্যাল হাব'' প্রকল্প গড়ে তোলার প্রয়াসকে তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদী ও সমস্ত দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির মহাজোট সরকার ও পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিদের ওপর আক্রমণ, সি পি আই (এম)-র ওপর আক্রমণ, পার্টিকর্মীদের হত্যা, তাদের এলাকা থেকে বিতাড়িত করা, বাড়িঘর ভাঙচুর করা, রাস্তাকাটা ইত্যাদি চালিয়ে ঐ শিল্প প্রকল্পের পরিকল্পনা বানচাল করে দেয়। সিঙ্গুরে নির্মীয়মাণ অটোমোবাইল শিল্প বা একলাখি টাকার ''ন্যানো'' হিসাবে খ্যাত শিল্প কারখানা বিশৃঙ্খলা, গুণ্ডামি, অরাজকতা সৃষ্টি দ্বারা তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদীরা বন্ধ করে দেয় এবং তা এরাজ্য থেকে গুজরাটে নিয়ে যেতে তার মালিক শিল্পপতি ''রতন টাটা''-কে বাধ্য করে। একইভাবে গেঁওখালিতে জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানা গড়ে তোলার কর্মসূচী তৃণমূল কংগ্রেস গুণ্ডামি ও সন্ত্রাস চালিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালে ৩রা জানুয়ারি থেকে সন্ত্রাস চালাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের সন্ত্রাসের জন্য সি পি আই (এম)-র ঐ সময় ৩৫ জন কমরেডকে শহীদের মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস সি পি আই (এম) কর্মী-নেতাদের হত্যার কাজে মাওবাদী সমাজবিরোধীদের সহযোগিতা নিয়েছে।

লোকসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতি ও তৃণমূল-মাওবাদীদের সন্ত্রাস

পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস-কংগ্রেস জোট বামফ্রন্টের তুলনায় কয়েকটি আসনে বেশি জয়লাভ করার ফলে এ রাজ্যের সুস্থ পরিস্থিতি ও শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পরিবেশ ধ্বংস করে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের এবং পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের এই জয়ে উল্লসিত সংবাদমাধ্যম ও গণ-মাধ্যম রাজ্যে বাম-শাসনের পরিবর্তনের জন্য ব্যাপক প্রচার চালানো শুরু করে এবং ঐ দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়ার শক্তি তৃণমূল নেত্রীকে ভাবী মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তুলে ধরে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যের দাগী আসামী, অপরাধী, খুনী, সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের সংগঠিত করে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস ও মাওবাদীরা পূর্ব মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, কোচবিহার, হাওড়া, হুগলী, দক্ষিণ দিনাজপুর, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাগুলিতে নারকীয় সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শতাধিক বামকর্মী, নেতাদের হত্যা করেছে। সারা রাজ্যে সি পি আই (এম)-র বহু আঞ্চলিক, জোনাল পার্টি অফিস ওরা দখল করেছে, ভাঙচুর চালিয়েছে, জিনিসপত্র ও টাকা লুট করেছে।

জঙ্গলমহলের তিনটি জেলা যথাক্রমে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় মাওবাদীদের সঙ্গে একযোগে তৃণমূল কংগ্রেস প্রায় তিনশত কর্মী-নেতাকে হত্যা করেছে। ঐ জেলার বামপন্থী অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলগুলির কয়েক হাজার বাম সমর্থক-কর্মীকে তাদের বাসস্থান ও কর্মস্থল থেকে বিতারিত করেছিলো। রাজ্যের কলেজগুলিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অছাত্র ও বহিরাগত দুষ্কৃতীদের দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের ছাত্র পরিষদ খুন সন্ত্রাস চালিয়ে অশান্ত ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। হাওড়া জগদ্বন্ধু কলেজের ছাত্রকর্মী কমরেড স্বপন কোলেকে নৃশংসভাবে তৃণমূলী জল্লাদরা হত্যা করেছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, তৃণমূলী জল্লাদরা লোকসভা নির্বাচনের দিন থেকে আজ পর্যন্ত হাওড়া জেলায় বামফ্রন্টের সাতজন কর্মীকে হত্যা করেছে। উদয়নারায়ণপুর, আমতা প্রভৃতি স্থানে ব্যাপক সন্ত্রাস সৃষ্টি করে চলেছে।

তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা একদিকে এ রাজ্যে সন্ত্রাসের দায় সি পি আই (এম) ও বামপন্থীদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, অপরদিকে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ করতে যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে প্রথম থেকে তৃণমূল নেত্রী সোচ্চার। এ সম্পর্কে ওদের প্রধান নেত্রী, রেলমন্ত্রী নিজে প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বারবার ঐ দাবি পেশ করেছে। এ দাবিতে তৃণমূলী সাংসদরা খুবই তৎপর। দিল্লিতে এসে মিছিল করেছেন এবং ওদের বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে এ রাজ্যে সি পি আই (এম)-র তথাকথিত সন্ত্রাসের গল্পের কাহিনী বলে এসেছেন। তৃণমূল-মাওবাদীরা রাজ্যে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে এবং যথারীতি ফ্যাসিস্ত হিংসার মিথ্যাচার চালিয়ে সন্ত্রাসের দায় সি পি আই (এম)-র ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এই ষড়যন্ত্র ও জালিয়াতি ১৯৭১ সালে সংগঠিত কংগ্রেসের গুণ্ডামি ও খুনের রাজনীতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। ঐ বছরে নির্বাচনের প্রাক্কালে শ্রদ্ধেয় জননেতা কমরেড হেমন্ত বসুকে নকশাল-কংগ্রেসের মস্তানরা হত্যা করে এবং সি পি আই (এম)-র ওপর খুনের দায় চাপিয়ে দিয়েছিল। যদিও কিছুদিন পরেই প্রমাণ হয়ে যায় যে, সি পি আই (এম) হত্যাকারী নয়।

সি পি আই (এম) তথা বামফ্রন্ট প্রথম থেকে তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদী যৌথ ষড়যন্ত্র, আক্রমণ ও সন্ত্রাস সম্পর্কে প্রকাশ্যেই অভিযোগ উত্থাপন করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের কাছেও তারা এ সম্পর্কে বিস্তৃত রিপোর্ট পেশ করে জানিয়েছে।

বলা বাহুল্য, প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং মাওবাদীদের সম্পর্কে প্রায়ই অনেনক হুমকি দিয়ে থাকেন। কিন্তু মনমোহনজী ও চিদাম্বরমজী কখনই তাঁদের জোট শরিক তৃণমূল কংগ্রেস-এর মাওবাদীদের সঙ্গে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ও কয়েক শত বামপন্থী কর্মীকে নৃশংসভাবে হত্যা করার বিরুদ্ধে একটাও বাক্য ব্যয় করেননি। আর তার জোট শরিক তৃণমূলের এই অপরাধ বন্ধ করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেননি।

মাওবাদী তৃণমূল কংগ্রেসের আঁতাত ও এ রাজ্যে বামপন্থী কর্মীদের হত্যা করার বিরুদ্ধে ড. মনমোহন সিং, চিদাম্বরমজীরা মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা ইউ পি এ-র চেয়ারপার্সন সোনিয়া গান্ধীরা তৃণমূল-মাওবাদীদের আঁতাত সম্পর্কে কি সন্দিহান? না কি, সারা দেশে মাওবাদীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও, বামফ্রন্টকে অস্থির করা ও উচ্ছেদ করার লক্ষ্যে তৃণমূলের পক্ষ থেকে দেশের আভ্যন্তরীণ বিপদ হিসাবে চিহ্নিত মাওবাদীদের কাজে লাগানোর প্রশ্নে কোনো আপত্তি করছেন না ইউ পি এ-২ সরকারের যাতে অস্তিত্বের সঙ্কট সৃষ্টি না হয়, সে কারণে তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেত্রীর সমস্ত রকমের অপকর্ম জানা সত্ত্বেও জোটের সরকারের মধ্যে তাকে রেখে দিতে প্রধানমন্ত্রী ও সোনিয়া গান্ধী তৃণমূলকে তোষামোদ চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পারিষদবর্গের দুর্বল অবস্থান ও বলিষ্ঠতাহীনতার ফলে তৃণমূল কংগ্রেসকে মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ/ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে চলেছে। এর সুযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অশুভ শক্তি বামপন্থীদের হত্যা ও এ রাজ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করতে বেপরোয়া।

প্রসঙ্গত, ২০০৮ সালের ৮ই নভেম্বর, শালবনীতে সুবৃহৎ ইস্পাত শিল্প প্রকল্প নির্মাণের জন্য শিলান্যাস হয়েছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিলান্যাস করে লক্ষাধিক মানুষের জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন। ইউ পি এ-১-এর ইস্পাত দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ানও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

শিলান্যাস ও জনসভার পরে ফেরার সময় মাওবাদী-তৃণমূলী দুষ্কৃতীরা মাইন বিস্ফোরণ ঘটায়, মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যার উদ্দেশ্যে, যদিও কোনক্রমে মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রক্ষা পেয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের জীবনহানি ঘটেনি। এরপর থেকে শালবনী, গোয়ালতোড়, লালগড় এলাকার ওপর মাওবাদী-তৃণমূলীদের দ্বারা ব্যাপক আক্রমণ চালানো হয়। আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্যে ''পুলিসি সন্ত্রাস বিরোধী কমিটি'' নামে এক মঞ্চ তৈরি করে মাওবাদীরা। এরপরই পুলিসি সন্ত্রাসবিরোধী কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলনের নামে হিংসা, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজে গ্রামের মানুষকে জোর করে শামিল করে। তাদের দিয়ে গ্রামের রাস্তা কাটা, গাছ কেটে রাস্তায় ফেলে রাখা স্থানীয় মানুষজনকে জোর-জবরদস্তি করে মিছিল সভা-সমাবেশে শামিল করা, চাঁদার নামে হাজার হাজার টাকা তোলা আদায় চলতে থাকে। কেউ আপত্তি জানালে হত্যা করাসহ অভূতপূর্ব সন্ত্রাস জারি করে তারা। বামফ্রন্ট দ্বারা পরিচালিত রাজ্য সরকারের কোনো মন্ত্রী, অফিসার, সি পি আই (এম)-র কোনো নেতা-কর্মীর ঐ অঞ্চলে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

তৃণমূল নেত্রী ও অন্যান্য নেতানেত্রীরা ও তাদের অনুগামী বিদ্বজ্জনরা পুলিসি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটির নেতা ছত্রধর মাহাতোসহ অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে বহুবার সভা করেছেন। এবং তাদের নানাভাবে সাহায্য দিয়ে চলেছেন। তৃণমূলকর্মীরা অনেকেই ঐ কমিটির নেতৃত্বে লালগড়ে সাধারণ গরিব আদিবাসী মানুষ এবং সি পি আই (এম) কর্মী-নেতাদের ওপর খুন সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। ওখানকার পঞ্চায়েতগুলির অফিস খুলতে দেয়নি মাওবাদী-তৃণমূলী ও তাদের প্রকাশ্য মঞ্চ সন্ত্রাস বিরোধী কমিটির দুষ্কৃতকারীরা। ফলে গ্রামের উন্নয়নমূলক কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, রাজ্য সরকারের প্রথম থেকে জনস্বার্থের কর্মসূচী ও প্রকল্পসমূহকে কার্যকর করতে দেয়নি মাওবাদী তৃণমূলী সমাজবিরোধী শক্তি। ঐ অশুভশক্তির আক্রমণে জঙ্গলমহলের স্কুলগুলির বহু শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী ছাত্রদের সামনে খুন হয়েছেন বা আহত হয়েছেন।

সন্ত্রাস নয়, জনগণই শেষ কথা বলবে

তৃণমূল-মাওবাদীদের সন্ত্রাস কি ইতিহাসের গতি নির্ধারণ করবে? তৃণমূল নেত্রী যেমন ভাবছেন লাগাম ছাড়া সন্ত্রাসের ভেতর দিয়ে কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের রক্তস্নাত পথ ধরে ক্ষমতায় বসতে চাইছে। যেমন একদিন হিটলার, মুসোলিনী ফ্রাঙ্কো, চিমার কাইজেকরা কমিউনিস্ট নিধনপর্ব চালিয়ে শাসন ক্ষমতায় পৌঁছে ছিলেন।

পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের কালা দিনগুলি যেমন তৃণমূল নেত্রীর পূর্বসূরি সিদ্ধার্থ রায় তার কংগ্রেসী দুষ্কৃতীদের ব্যবহার করে এরাজ্যে ১২০০ কমিউনিস্টের রক্তে হোলি খেলে। ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা সর্বৈব সত্য ও তা চরম সত্য। হিটলার, মুসোলিনী, চিয়াং-কাইশেকরা দেশ বরেণ্য নেতা হিসাবে ইতিহাসে স্থান পায়নি। ফ্যাসিস্ত নায়ক হিসাবে তারা আঁস্তাকু‍‌ড়ে নিক্ষেপিত, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় এরাজ্যের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষের সামনে শ্রদ্ধা ও মর্যাদার আসনে নেই। তারা ঘৃণ্য স্বৈরতন্ত্রী ও ফ্যাসিস্ত খলনায়ক রূপে রয়ে গেছেন।

তৃণমূল নেত্রী এরাজ্যের শাসন ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করতে পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেছেন। পূর্বেই লেখা হয়েছে পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে এরাজ্যে চারশো সি পি আই (এম) ও বামপন্থী কর্মীদের হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করে। ব্যাপক সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে তৃণমূল নেত্রী রাজ্য শাসনের দায়িত্ব নিতে চাইছেন। যাতে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি তার দেশী-বিদেশী শাসক প্রভুদের তুষ্ট করতে পারেন। পঞ্চদশ লোকসভা নির্বাচন পরবর্তী প্রায় তিন বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের সন্ত্রাস সৃষ্টি সত্তরের দশকের অন্ধকারময় দিনগুলির পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তনের সাইন বোর্ড-এর আড়ালে সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসকে ফিরিয়ে আনতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদীরা। গণতন্ত্র, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তা ও ব্যক্তির স্বাধীন সত্তার অবসান ঘটানোর জন্য ''পরিবর্তনের'' আড়ালে মানুষকে তৃণমূল কংগ্রেস, মাওবাদী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্রীড়নকে পরিণত করতে চাইছে তৃণমূল কংগ্রেস — কংগ্রেস জোট। কিন্তু স্বৈরতন্ত্রী ফ্যাসিবাদ, সন্ত্রাসবাদ অস্ত্রের ঝনঝনানিতে সাধারণ মানুষকে সাময়িক দাবিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা এবং আমাদের সকলের অভিজ্ঞতা, স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাস বেশিদিন মানুষকে তাদের শাসানি, হুমকি আর অস্ত্রের সামনে নতজানু করে রাখতে পারে না। মানুষ শেষ পর্যন্ত ভয় পরিত্যাগ করে সাহসের ওপর ভর করে ঘুরে দাঁড়ায় অত্যাচারী সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে। আর তখন ঐ বীরপুঙ্গবের দল পালাবার পথ পায় না। তৃণমূল কংগ্রেস মাওবাদীদের বিরুদ্ধে এখন যেমন জঙ্গলমহলের মানুষ গণ-প্রতিরোধ গড়ে তুলে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। পশ্চিম-পূর্ব মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা, বর্ধমান, বীরভূম, মুর্শিদাবাদসহ বিভিন্ন জেলার সাধারণ মানুষও তাদের ভয়ভীতি দূর করে তৃণমূল কংগ্রেসের জল্লাদদের বিরুদ্ধে গড়ে তুলেছেন গণ-প্রতিরোধের ব্যারিকেড।

সাধারণ শান্তিকামী গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জয় অনিবার্য। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির প্রতীক তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস জোটকে পরাস্ত করে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গড়ে তুলতে এরাজ্যের মানুষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। রাজ্যে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হলেই রাজ্যে শান্তি, শৃঙ্খলা, গণতন্ত্র সুরক্ষিত করা সম্ভব হবে।

http://ganashakti.com/bengali/features_details.php?featuresid=448

রক্তস্নাত বিজয় পতাকা আর কতো রক্তাক্ত হবে?

ব্লগারের প্রোফাইল ছবি

হরতাল, সন্ত্রাস, অবরোধ চলছে। বিজয়ের মাসে বিজয়ের আনন্দ- হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও, গাড়ি ভাংচুর আর নানা প্রকার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে একেকটা দিন। আহত হচ্ছে পুলিশ, রক্তাক্ত হচ্ছে পথচারী, পুলিশ ও আমজনতার সামনে নিহত হচ্ছে অসহায় মানুষ!

স্বার্থান্ধ মানুষের বর্বরতা, নির্মমতা, হিংসা, প্রতিহিংসা, ঘৃণা- বিদ্ধেষ ও নিষ্ঠুরতার তীব্র আক্রোশ যে কতোটা ভয়াবহ এবং নৈরাজ্যময় হয়ে উঠেছে তা প্রায় প্রতিদিন গোটা জাতি এবং বিশ্ব বিবেক অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছে, প্রত্যক্ষ করছে প্রতিদিনের সংবাদপত্র এবং টেলিভিশনের পর্দায়।
সরকার ও সরকারি প্রশাসনের কর্মকর্তা, কর্মচারী, আইন প্রয়োগকারী ও রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যর অসহায়ত্ব এবং নীরবতা, নিস্ক্রিয়তা যে কারো চোখে পড়ার মতো। তবুও আমজনতার ধৈর্যের বাঁধ ভাংছেনা? তারা এখনও মুখ গুঁজে সব হজম করে চলেছে, কিন্তু আর কতোদিন? কতোকাল এমনটা চলবে? লাখো শহীদের রক্তস্নাত বিজয় পতাকা আর কতো তাদের ওই কলংকিত ও অপবিত্র হাতে রক্তাক্ত হবে, রক্তাক্ত হতে থাকবে বারংবার?
৯ ডিসেম্বর অবরোধ-হরতালের মধ্যে নিরীহ ক্ষুদে ব্যবসায়ী বিশ্বজিতের করুণ আর্তনাদ, আকুতি, মিনতি মানুষনামী ওইসব পশুদের বিবেককে এতোটুকু স্পর্শ করেনি? বিশ্বজিতের মৃত্যু বিশ্ববিবেককে বিশ্বজুড়ে তাই বিপুলভাবে নাড়া দিয়েছে, দিয়েছে গভীর লজ্জাও! ১০ ডিসেম্বর ছিলো বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। সেদিন সবাই আমরা জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক হত্যার বিচার- দাবিতে মানবন্ধন করেছি। আর বিশ্বজিতের লাশের পাশে দাঁড়িয়ে মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার প্রশ্নে, মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নে, দেশের এই অরাজকতার দৃশ্যে কতোটুকুই বা শিক্ষা নিয়েছি? শাসক- শোষক ও অত্যাচারীর নগ্ন হামলা আর রাজনীতির নামে হরতাল, অবরোধ করে মানুষ হত্যা করা, আমজনতাকে জিম্মি করে দলীয় স্বার্থ রক্ষা করা, যুদ্ধপরাধীর পক্ষে কথা বলা, হরতাল ডাকা, নৈতিক ও সরাসরি সমর্থন দিয়ে গোটা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতায় বিশাসী মানুষদেরকে অবজ্ঞা করা-এতসব অপকর্ম, অপৎপরতা এবং জঙ্গীবাদী কার্যক্রম সহ্য করা-আর কতোকাল? সময় এসেছে আমজনতার ঐক্যা গড়ার, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষদের সংঘঠিত হওয়ার, ওইসব রাজাকারি আদর্শের মানুষদেরকে রুখে দাঁড়াবার! প্রতিহত করার। কারণ, "বিএনপি-জামাত- শিবির-জঙ্গী/রাজাকারি আত্মার নিবিঢ় সঙ্গী/ জেগেছে আবার তারা একাত্তরের ভঙ্গিতে/ উল্লাসে মেতেছে তাই পাক হানাদারী সঙ্গীতে/"- বহু আকাংখিত, প্রত্যাশিত-বিজয়ের মাসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হতে চলেছে। এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে তারা নগ্ন হামলা চালাচ্ছে। হরতাল, অবরোধ দিচ্ছে, পুলিশ পেটাচ্ছে, পুলিশকে রক্তাক্ত করছে, মানুষকে পুড়িয়ে মারছে। জাতীয় সম্পদ নষ্ট ও ধবংস করছে। এরাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধি অপশক্তি। এটা আজ দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। ওদেরকে উৎখাত করা, ওদেরকে প্রতিহত করা তাই প্রত্যেক সচেতন বিবেকবান মানুষের নৈতিক ও ঈমানী দায়িত্ব এবং কর্তব্য। জয় হোক গণমানষের, জয় হোক মানবতার এবং জয় হোক বাংলার। এবারের বিজয় দিবসের এটাই প্রত্যাশা।

http://www.amarblog.com/Rahat-Ali/posts/156512


আসুন, গণতন্ত্রের চর্চা করি

মোজাফ্ফর আহমদ | তারিখ: ০৪-১১-২০১০

গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের কথকতার শেষ নেই। অথচ গণতন্ত্রকে আমরা আমাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণে যে ধারণ করি না তা রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের কর্ণধারদের নানা কর্ম ও উচ্চারণে আজ পরস্ফুিট। গণতন্ত্রকে জীবনদর্শন হিসেবে কজন বিবেচনা করেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। গণতন্ত্রের নানা নানা আলোচনা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও ধনবিজ্ঞানের আলোচনায় আছে। গণতন্ত্রের চুম্বক সংজ্ঞা কিন্তু তিনটি শব্দের সমাহার—লিবার্টি, ইকুয়ালিটি ও ফ্রাটারনিটি। বাংলায় স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব। এই শব্দত্রয়ের পেছনের ধারণা—সব মানুষ স্রষ্টার কাছ থেকে সমান সম্ভাবনা নিয়েই জন্মে, কিন্তু তার প্রস্ফুটন অসাম্য। এটা সামাজিক বিভাজন, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশীদারিহীনতা ও হূদয়হীনতার কারণেই ঘটে থাকে। আমাদের মতো দারিদ্র্যপীড়িত, কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার দেশে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
স্বাধীনতা কথাটি নানা সংগ্রাম, বিপ্লব ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে উচ্চকিত হলেও এটির নিগূঢ় অর্থ প্রায়শই বোধগম্য নয়। স্বাধীনতা শব্দটির সঙ্গে একটি শর্তবোধক শব্দও সংযুক্ত থাকে, সেটি হলো দায়িত্বশীলতা বা দায়বদ্ধতা। আজ 'বাজিকরদের' যে স্বাধীনতা বা জনপ্রতিনিধিদের যে আচরণ, তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই যোজক শব্দটির—যা স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলে—ব্যত্যয় ঘটছে বললে অত্যুক্তি হবে না। যে ব্যক্তি তার কর্মে বিবেকের উচ্চারণ শুনতে পায় না, তার কাছে মনুষ্যকর্মের নানা সীমাবদ্ধতা পরিদৃশ্য হয় না এবং নৈতিকতার উচ্চতর বিবেচনায় স্বাধীনতা ও অধিকারের নামে কৃত অনেক কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। বিজ্ঞান আমাদের যুক্তিবাদী হতে শিখিয়েছে। সেখানেও যুক্তি ও ব্যবহারিকভাবে যা ভালো বলে প্রমাণিত তাকেই গ্রহণীয় বলে বিবেচনা করা হয়েছে। কেবল অজ্ঞ বা ক্ষমতাদর্পী মানুষই নিজেকে নির্ভুল মনে করে।
মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কোনো মানুষ এককভাবে বা দলীয়ভাবে স্বাধীন হতে পারে না বা অধিকার ভোগ করতে পারে না। যেহেতু সব মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়, তাই সব মানুষের জন্য স্বাধীনতা একটি অনস্বীকার্য অধিকার। সে অধিকার খর্ব করার যেকোনো প্রচেষ্টা স্বাধীনতাকেই খর্ব করে। সম্প্রতি বিচার বিভাগের কর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যে আইন পাস হয়েছে, সেটি গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ও অধিকারকেই ক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীনতা রক্ষায় তাই নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়।

২.
সাম্য নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমাদের দেশে সম্পদের বৈষম্য বেড়েছে। তথ্য থেকে প্রতীয়মান হয়, 'জনপ্রতিনিধিদের' অধিকাংশের সম্পদের পরিমাণ আমাদের জাতীয় মাথাপিছু আয়ের কয়েক শ গুণ; কখনো কখনো কয়েক হাজার গুণ। এ থেকে বোঝা যায়, ক্ষমতার অলিন্দে যাঁরা আছেন, তাঁরা মালিক বনে গেছেন; তাঁরা প্রকৃত মালিকের ক্ষমতা হরণ করেছেন। সমতাভিত্তিক সমাজের সৃষ্টি হয় সমান সুযোগের বর্তমানত্বে। সব মানুষ স্বাধীন হয়েই জন্মায়—গণতন্ত্র যেহেতু এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে, সেহেতু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও গণতান্ত্রিক মননের মানুষের কর্মের একটি সূত্র হলো, সব মানুষের জন্য সমান সুযোগের সৃষ্টি করা। এটা দয়া নয়, দায়িত্ব। আমরা অভাজনদের নানাভাবে দয়াদাক্ষিণ্য দেখিয়ে সন্তোষ পেতে চাই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে সমতার মর্মবাণী সব মানুষের জন্য সমানভাবে পৌঁছে দিতে যে সার্বিক কাঠামোগত পরিবর্তন, তাকে বাস্তব করতে তেমন উদ্যোগ নিতে অপারগ হই। আমাদের দেশে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর যে তীব্র প্রয়োজন, তার ভিত্তিতে যে বিষম সমাজ, সেই সমাজ পরিবর্তনের চিন্তা আমাদের নেই। সে জন্য সামাজিক স্তরায়ণের এক তীব্র সংশ্লেষে অসমতার বাস্তবতায় ক্ষমতার দাপটের সঙ্গে অক্ষমের ঘৃণা ও দূরত্ব সৃষ্টি করে চলেছে। পুষ্টিহীনতা, পথশিশু, স্বাস্থ্যসেবার বঞ্চনা, শিক্ষায় দীনতা, বস্তুতান্ত্রিকতা, বিত্তের সামাজিক প্রাবল্য, মুনাফার তীব্র আকর্ষণ—এ সবই অসুস্থ ও অসম সমাজের প্রতিফলন। গণতন্ত্রকে এসবের বিপক্ষেই শক্ত অবস্থান নিতে হয়। কিন্তু এর বাস্তবতা আমাদের দেশে মেনে নেওয়া ও দয়াদাক্ষিণ্যের যে প্রবণতা, সেটা গণতান্ত্রিক মননের প্রকাশ হতে পারে না।

৩.
গণতন্ত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো সৌভ্রাতৃত্ব। আমাদের সাংঘর্ষিক রাজনীতি, দখলদারির কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা, বিত্ত ও ক্ষমতার শারাফতি, ক্ষমতাধরের অন্যায়কে মেনে নেওয়া, অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া বিঘ্নিত করা—এমনি সবকিছুই যে সৌভ্রাতৃত্ব মতভিন্নতা মেনেও অন্যের অধিকারের জন্য জীবনদানের অঙ্গীকারকে গণতন্ত্রের ভিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তাকে অস্বীকারের নামান্তর। মানুষ সামাজিক জীব, কিন্তু যে সমাজ মানুষের অধিকারকে সমুন্নত রাখে না, ক্ষমতার দর্পে মানবিক সম্পর্ককে বিনষ্ট করে, যে সমাজ ভালোবাসায় মানুষে মানুষে দায়বদ্ধ বন্ধন সৃষ্টি করে না, সে সমাজ মানুষের কল্যাণে ব্রতী হয় না, সে সমাজ মানুষের দুঃখ বিনাশে সচেষ্ট হয় না বরং নানা কর্মের মধ্যে অন্যের জন্য দুঃখ-কষ্ট সৃষ্টি করে। যে সমাজে মানুষ নিঃস্ব হওয়ার প্রক্রিয়া উচ্চ করে অন্যকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আঘাত করার মাধ্যমে আনন্দ লাভ করে সে সমাজে গণতান্ত্রিকতা সৃষ্টি হতে পারে না। মানুষে মানুষে সহমর্মিতার আন্তরিকতা শত মতভিন্নতার মধ্যে যে মনন ও মানসিকতার জন্ম দেয়, সেটিই যুক্তিবাদ ও পরমতসহিষ্ণুতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিকতার ভিত রচনা করে। আমাদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী যে মানসিকতা, ক্ষমতার প্রতি যে তীব্র আকর্ষণ, অন্যায় সুযোগ-সুবিধা লাভের যে ক্রিয়াকর্ম, সেসবই গণতান্ত্রিক সৌভ্রাতৃত্বের বিপরীতে অবস্থান করে। সে জন্য সংবাদমাধ্যমে সমালোচনা বা নাগরিক সমাজের ভিন্নমত আক্রমণের শিকার হয়। যাঁরা গণতন্ত্রের পথে চলতে চান, তাঁদের পথ হয়ে ওঠে কণ্টকাকীর্ণ। কর্ম আমাদের বিভাজিত করছে, ধর্মও আজ আমাদের বিভাজিত করছে। বিত্ত আমাদের স্তরায়িত সমাজ সৃজন করছে, শিক্ষা আমাদের অসম অবস্থানে উপনীত করছে। এ জন্যই সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, সহমর্মিতা আজ এত কাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠছে, তা না হলে যে সামাজিক পুঁজি আমাদের উন্নয়নকে সম্ভব করে, যে সামাজিক বন্ধন আমাদের উজ্জীবিত করে, যে সামাজিক সহিষ্ণুতা আমাদের শান্তিময় করে তোলে, তার অভাবে গণতান্ত্রিক অবস্থান সৃষ্টি অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আমরা আমাদের নিত্যকার ঘটনা ও উচ্চারণের যে প্রকাশ দেখি, সেখানে কি গণতন্ত্রের এই ভিতকে মজবুত অবস্থানে দেখি? আমাদের দুর্ভাগ্য যে ইতিবাচক উত্তর দেওয়া সত্যবাদী স্পষ্টভাষীর জন্য সম্ভব হয় না।

৪.
গণতন্ত্রে জনগণের সার্বক্ষণিক উপস্থিতি প্রয়োজন। এই উপস্থিতির মাধ্যম হলো নাগরিক সমাজের আলোচনা, সংবাদপত্রে ঘটনার বিবেচনা, মতভিন্নতার উপস্থাপনা, ক্ষমতাধরের সব কর্মের তথ্য ও বিবেচনার স্বচ্ছতার দাবি ও মানবিক অধিকার সংরক্ষণের সদাজাগ্রত অবস্থান। এ না হলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, বিচারালয়ের ন্যায়িক অবস্থান, ভোটাধিকারের সুব্যবস্থা, সংসদের আলোচনার পুনরালোচনা, জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধ অবস্থান—কিছুই নিশ্চিত করা যায় না। আমাদের নাগরিক সমাজের সচেতনতা বাড়লেও দলগত আনুগত্য তাকে সব সময় সত্য উচ্চারণের সাহস জোগায় না। প্রশাসনে আজ যে ভীতি, বিচারালয়ে আজ যে অস্থিরতা, নির্বাচনে আজ যে লুকোচুরি, সংসদে আজ যে স্থবিরতা—এসব আমাদের সুস্থ গণতন্ত্রের পথ রচনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এখনো বৃহৎ জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছি। অস্ত্র ও বিত্তের প্রভাবে আজ যে নির্বাচন, সেটি এক অনুগত মেধাহীন প্রতিনিধি সৃষ্টি করছে, যাঁরা নিজেদের স্বার্থ পূরণে ব্যস্ত, জনস্বার্থে তাঁদের দৃষ্টি ও কর্ম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কম। এই মেধাহীনতা সার্বিক উন্নয়ন আর কর্মচঞ্চল জনগোষ্ঠীর জন্য নেতৃত্ব প্রদানে ব্যর্থ বলেই গণতন্ত্র এমন স্থবিরতায় নিপতিত। দক্ষতা ও সৃজনশীলতায় এই গণতন্ত্র ঋদ্ধ হয়ে ওঠেনি, তাই সবার জন্য সমান অধিকার, আইনের শাসন, নিরপেক্ষ প্রশাসন—এ সবই এখনো স্বপ্ন হয়েই থেকেছে। প্রভাববলয়ের আধিপত্য সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে মাঙ্গলিক অবস্থান সৃষ্টিতে আজ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, দুর্নীতির বিস্তার-প্রসার ও গভীরতা নানা অর্জনকে ব্যর্থ করে দিয়েছে।

৫.
গণতন্ত্রকে ধারণ করতে হলে গণতান্ত্রিক মনন ও মানসিকতার প্রয়োজন। মানুষের অনন্য পরিচয় হলো তার মন আছে। তার বিবেক আছে। বিবেক হলো মূল্যবোধের ধারক। অন্য জীবের থেকে মানুষের ভিন্নতা অর্থবহ হয় যখন তার নিত্যকার কর্মে সৃজনশীলতার মধ্যে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে সে যুক্তি, আদর্শ, আশা, স্বপ্ন, দূরদর্শিতা, আচরণ ও উচ্চারণ ধারণ করে অন্যের সঙ্গে। ভিন্নতা সত্ত্বেও একাত্ম হতে পারে, হিংসা পরিহার করে সহমর্মী হতে পারে, অসুন্দরকে চিহ্নিত করে সুন্দরকে ধারণ করতে পারে, বিভিন্নতা সত্ত্বেও বিচ্ছিন্নতাকে পরিহার করে মৌল চাহিদার ঊর্ধ্বে এক উন্নত জীবনের সৃষ্টিতে সবাইকে নিয়ে ব্রতী হতে পারে। মানুষের জীবন এ কারণেও বিশিষ্ট। একত্র হতে পারা তো নানা প্রাণীর যূথবদ্ধতায় দৃশ্যমান। একাত্মতা, একাগ্রতা, ভিন্নতা সত্ত্বেও সহাবস্থান, ভিন্নমতকে যথার্থ বিবেচনা, ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে বৃহৎ স্বার্থকে ধারণ করতে পারাই মানুষকে অনন্য করে, গণতন্ত্রকে সংহত করে। সহযোগিতা, সহমর্মিতা, আলোচনা, সমঝোতা আমাদের একাত্মতাকে বাস্তব রূপ দিয়ে থাকে। প্রাণীর মৌল প্রবণতার ঊর্ধ্বে উঠতে পারার মধ্যেই মনুষ্যত্বের বিকাশ আর মনুষ্যত্বই গণতন্ত্রকে প্রস্ফুটিত করে। আমাদের চারপাশে আজ প্রাণিজীবনের প্রাবল্য দেখি, মনুষ্যত্বের বিকাশ স্তিমিত বলেই গণতন্ত্রায়ণ বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। আমরা সমাজে ভালোবাসার পরিবর্তে সন্ত্রাস ও ভীতির প্রসার দেখতে পাই ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে। মানুষ কিন্তু ভীতি নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি, অন্যের ক্ষমতার দাপট ও বিচারের নির্লিপ্ততা তাকে ভীত করে তুলেছে। ভয়ভীতির সমাজে গণতন্ত্রের বীজ উপ্ত হয় না। সমাজে আজ হিংসা, দ্বেষ, ক্রোধ, ঘৃণা, সন্দেহের মতো সব নেতিবাচক ধ্বংসাত্মক উপস্থিতি গণতন্ত্রের ইতিবাচক দিক প্রেম, সাহস, বিশ্বাস, সহযোগ, যূথবদ্ধতা ইত্যাদিকে বিচ্ছুরিত হতে বাধাগ্রস্ত করছে। মনে রাখতে হবে, স্বৈরাচার ভীতির সৃষ্টি করে, সন্দেহের উদ্রেক করে, সাহসের সংহার করে, অজ্ঞতার অন্ধকার সৃষ্টি করে। গণতন্ত্র বিশ্বাসের জন্ম দেয়, সুস্থ অবস্থানের স্বপ্ন তৈরি করে, সাহসী উচ্চারণের অবস্থানে উপনীত করে, মতভিন্নতায় ভীতি সৃষ্টি করে না, জ্ঞানের স্ফুরণ ঘটায়। আমাদের যাত্রা কি ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে যুক্তিবাদী সাহসিকতার পথে? আমরা কি মৌল চাহিদার ঊর্ধ্বে স্বপ্নীল সুন্দরের অভিযাত্রায় ব্রতী? নিত্যকার হিংসা, বঞ্চনা ও ঘৃণার যে চিত্র, তা আমাদের সংশয়গ্রস্ত করে তুলছে।

৬.
এমনি গণতান্ত্রিক মননের সৃষ্টি করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও সামাজিক পরিবেশ। যেহেতু গণতন্ত্র সৃজন ও সুরক্ষা সবার যৌথ দায়িত্ব, সে জন্য সবার জন্য সমান মানের শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। শিক্ষালয়ে যূথবদ্ধ কর্ম ও সৃজনশীলতার যে সুযোগ, সেটিই সমাজে গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। শিক্ষায় যুক্তিবাদী আবহ ও মতভিন্নতার অবস্থান তাই প্রতিযোগী ও সহমর্মিতার গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের শেকড় গেড়ে দেয়। শিক্ষালয়ে জ্ঞানের যে আধার, সহশিক্ষা ও সংস্কৃতির যে উন্মেষ, তার মাধ্যমেই সৃজনশীল গণতান্ত্রিকতার জন্ম হয়। শিক্ষার মাধ্যমে যে নিরীক্ষাধর্মী মনন সৃষ্টি হয়, নানা কর্মে যে উৎসাহের জন্ম হয়, বিচার-বিবেচনার যে যুক্তিবাদিতা ধারণ করতে হয়, তাই গণতান্ত্রিকতাকে সুবিদিত করে, উৎসারিত করে। বই-পুস্তকের শিক্ষা ছাড়াও শিক্ষার্থীর মন ও মননে অন্তজ শিক্ষাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেটিও জীবনে সে ধারণ করবে। যেভাবে আজ শিক্ষালয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়, সেটা কিছুটা হলেও সীমাবদ্ধ ও কৃত্রিম, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক যে প্রসারতার জন্ম, যে বুদ্ধিবৃত্তির জন্ম হয়, যে যুক্তিবাদিতা গ্রহণীয় হয়ে ওঠে, যে একাত্মতা ও অন্যের জন্য হিতবাদিতার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, সেগুলোই পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করে। এ দেশে বিভাজিত শিক্ষা, সীমাবদ্ধ শিক্ষা, পুস্তকনিবিষ্ট শিক্ষা, শিক্ষককেন্দ্রিক শিক্ষা তেমনি চেতনার সৃষ্টিতে অনেকটাই ব্যর্থ। বিভাজিত সমাজের বিভাজিত সুযোগ শিক্ষার অসীম সম্ভাবনার উৎসরণকেও সীমাবদ্ধ করে মেধার যথাযথ সুযোগ সৃষ্টিতে বিঘ্ন ঘটিয়ে একটি অতৃপ্ত সংঘবদ্ধ অথবা পরমুখাপেক্ষী যে জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি করে, তারা আত্মবিশ্বাসী না হতে পারায় গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় অংশগ্রহণে অপারগ হয়।
৭.
গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। এ কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্ক গণতন্ত্রে এক প্রয়োজনীয় মাত্রা নির্দেশ করে। এখানে রাজা-প্রজার সম্পর্ক নয়, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক নয়, মানুষে মানুষে সমসম্পর্কই গণতন্ত্রকে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছে। ধর্ম, বর্ণ, বিত্ত, মেধা, শিক্ষা, দক্ষতা, ভাষা ইত্যাদির ভিন্নতা সত্ত্বেও গণতন্ত্রে সমসম্পর্ককে মূল্য দিতে হয়। সে জন্য পক্ষপাতিত্ব, প্রতিকূল ধারণা, ঘৃণা, সংস্কার, বৈষম্য, বিবদমানতা—এ সবই গণতান্ত্রিক সম্পর্কের বিপরীতে অবস্থান করে। এসব কারণে মানুষে মানুষে সম্পর্কের যে ঘাটতি, সেটা গণতন্ত্রের জন্য ঘাটতি বলে বিবেচিত হয়। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এসব কারণে সৃষ্ট যে দূরত্ব ও সম্পর্কহীনতা বিদ্যমান, তার ফলে পারস্পরিক সম্পর্কে আজ এক বিশাল গণতান্ত্রিক ঘাটতি বিরাজ করছে। সে জন্য যে শব্দাবলি, শারীরিক ভাষা ও উচ্চারণ আমরা শুনি, পড়ি অথবা দেখি, সে সবই গণতান্ত্রিকতার মাপকাঠিতে গ্রহণীয় নয়। এ জন্য প্রতিটি মানুষকে মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা, সম্মানীয় ও সমতুল্য বলে ধারণ করা, নিজের কথা ও আচার-আচরণে দায়িত্বশীল হতে চেষ্টা করা এবং অন্যের অবস্থানে নিজেকে স্থাপন করে সেভাবে অন্য সম্পর্কে উক্তি করা আমাদের গণতান্ত্রিক সম্পর্ক নির্মাণ করতে পারে। বাস্তবে তারই অভাব রয়েছে। গণতন্ত্রে আমরা সবার জন্য সম-অবস্থানকে মৌলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছি, সে কারণে গণতন্ত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতেই হতে হবে, না হলে না-বাস্তব এক অবস্থার সৃষ্টি হয়, যা শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রকে বিনাশ করে।
নির্বাচিত হিটলার জাতি ও রক্তের গুণে নিজেদের বিশুদ্ধ জাতি হিসেবে বিবেচনা করে জার্মানি ও ইউরোপ শুধু নয়, পৃথিবীতে এক অন্যায় সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিলেন, যার অভিঘাত থেকে আমরা এখনো মুক্ত হতে পারিনি। 

৮.
গণতন্ত্রে তাই সুবিবেচক নেতৃত্বের গুরুত্ব সহজেই অনুমেয়। সে নেতৃত্ব সবাইকে নিয়ে ভাবে। নিজে, নিজের গোষ্ঠী বা নিজের দলের ওপরে তাঁরা সব মানুষকে স্থান দেন। সে নেতৃত্ব দূরদর্শী, কেবল বর্তমান তাঁদের বিবেচনায় থাকে না, তাঁদের সব কর্ম ও উচ্চারণে তাঁরা সুন্দর ভবিষ্যৎ রচনায় সৃজনশীল থাকেন। তাঁরা সুন্দর মন ও মননের অধিকারী হন। তাঁদের বিশ্লেষণক্ষমতা যেমন তীক্ষ, তেমনি সম্পর্ক গড়ার আন্তরিকতায় তাঁরা ঋদ্ধ। সমস্যা তাঁদের বিচলিত করে না; কারণ, সমস্যা সমাধানের মধ্যে তাঁরা কল্যাণধর্মী অবস্থান সৃষ্টি করার সুযোগ পেয়ে যান। তাঁদের মধ্যে রসবোধ উত্তম বলেই সম্পর্ক নির্মাণে তাঁরা পটু। তাঁদের মানসিক শক্তি অদম্য এবং মানুষের কল্যাণের মাধ্যমে তাঁদের শক্তির নবায়ন ঘটে। তাঁদের জ্ঞানের আধার সীমাহীন এবং জ্ঞান আহরণের ক্ষমতাও সীমাহীন, যে কারণে সহজেই অনুধাবন ও অনুসন্ধানে তাঁরা বিশেষ দক্ষতা রাখেন। তাঁদের সততা এমনি অনুকরণীয় যে তাঁদের উচ্চারণ সহজেই গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। তাঁদের মানুষের জন্য ভালোবাসা গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বে সুসম্পর্কের যে বন্ধন সৃষ্টি করে, তা-ই সমতাধর্মী দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিকতাকে সঞ্জীবিত রাখে। মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত উক্তি যে 'আমি দ্রুততার সাথে জনতার মাঝে একাত্ম হব, কারণ আমি তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছি, তাদের পথের দিশারি হয়েছি।' Lao tsu খ্রিষ্টপূর্বকালে অনুধাবন করেছেন, মানুষ তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে গ্রহণ করলেই নেতা হওয়া যায় না, বরং মানুষ যখন বিবেচনায় তাদের নেতৃত্বের ধারণাকে ও কর্মকে নিজের বলে গ্রহণ করতে পারে, সেই বিচারে উত্তীর্ণ নেতৃত্বই যোগ্য নেতৃত্ব।
আমাদের দেশে ভাড়া করা মানুষের ঢলে হাততালির যে নেতৃত্ব, কিছু পাওয়ার জন্য যে আনুগত্য, সেটি যোগ্য গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ব্যর্থ। গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের উদারতা, মহানুভবতা, দূরদর্শিতা ও মাঙ্গলিক বিচিন্তা আজ দৃশ্যমান নয়। নাগরিক সচেতনতাই সেই নেতৃত্ব সৃষ্টি করে।

৯.
আমাদের দেশে গণতন্ত্র ভঙ্গুর, এর পরিচয় আমরা বারবার পেয়েছি। আমরা নানা দেশে গণতন্ত্রের উত্তরণ যেমন দেখেছি, তেমনি অনেক দেশেই দেখেছি সংকটপূর্ণ ও সংশয়গ্রস্ত গণতান্ত্রিক অবস্থানও। আমরা জানি, গণতান্ত্রিকতার মধ্যে যে মুক্তি ও স্বাধীনতা, সেটি পৃথিবীর নানা দেশের ইতিহাসে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে। সমাজ বিবর্তনের সঙ্গে জ্ঞানের স্ফুরণ যে সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে, তার স্থিরতা ও উল্লম্ফন সম্ভব হয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকতার কারণে, যার মাধ্যমে উন্নয়নের সাফল্যে বিভিন্ন স্তরের মানুষ অংশীদার হয়ে উঠেছে। কিন্তু বিবর্তনের মধ্যেও সংকটের আবর্ত নানাভাবে আবির্ভূত হয়েছে। গণতন্ত্রের সংকট নানাভাবে নানা কারণে এসেছে। পরিবর্তনের নামে বিপ্লব-ভাবনায় সহিংসতা নানা সময়ে দেখা দিয়েছে, তার ফলে গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। বিপ্লবের তাড়না ছাড়াও ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাহীনের দ্বন্দ্বমুখর অবস্থান নানা সময়ে গণতন্ত্রকে সংকটের আবর্তে ফেলে দিয়েছে। আমাদের দেশে এ অবস্থা বিভিন্ন সময়ে উচ্চকিত হয়েছে; কারণ, ক্ষমতা হলো সবকিছু পাওয়ার দায়বদ্ধতাহীন এক প্রশস্ত পথ। গণতন্ত্রের সংকটের আবহে অগণতান্ত্রিক শাসনের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে।
গণতন্ত্র না হওয়ার একটি কারণ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ও সুযোগের বিষম সম্ভাবনা। আমরা সংসদীয়ভাবেই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব ক্ষমতা একটি কেন্দ্রে ন্যস্ত করেছি। সাংবিধানিক এই দুর্বলতা এ দেশে প্রশাসনিক অদক্ষতা সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে সরকারের প্রসার ও বিস্তার এমনই ঘটেছে যে ছোট সরকারে, দক্ষ সরকারে, কার্যকরী সরকারে আমরা আর আস্থা রাখিনি। এই কেন্দ্রীভবনের ফলে মতভিন্নতায় আমরা সহিষ্ণু হয়ে উঠিনি, মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক গণতান্ত্রিকতাকে লালন করে, সে সম্পর্ক আমরা গড়ে না তুলে বরং তার বৈপরীত্যকে লালন করে চলেছি, ফলে গণতন্ত্র যা মানুষের অধিকারকে নিশ্চিত করে, সে থেকে নানাভাবে আমরা দূরে সরে গিয়েছি। অর্থনৈতিক গণতান্ত্রিকতা ও সার্বিক সামাজিক ন্যায়বিচার আজ কেবল স্তুতিবাক্যে পরিণত হয়েছে। 
সরকারের বিশালতা ও অস্বচ্ছ পরিচালনা ক্ষমতার কেন্দ্রীভবনের যে প্রবণতা সৃষ্টি করেছে, তার ফলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ক্ষমতাবলয়ের বাইরে এক সংঘবদ্ধ অবস্থানে চলে গেছে। ফলে অনেক সময়ই অনিশ্চয়তা, জটিলতা, বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি ও অক্ষমতা নানাভাবে নানা বিষয়ে দৃশ্যমান হয়। গণতান্ত্রিকভাবে অংশীদারি ও বিকেন্দ্রীকরণ এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব করে তুলতে পারে, কিন্তু আমরা ক্ষমতা সব সুযোগের উৎস—এই ধারণা থেকে কেন্দ্রীভবনকেই নানাভাবে বেছে নিয়েছি, যার ফলে গণতান্ত্রিক দায়বদ্ধ সম্পর্কভিত্তিক আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান দৃঢ় হতে পারছে না। 
সরকারের বিশালতা যেহেতু আমলানির্ভরতা বাড়িয়ে দেয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ক্ষমতাবলয়ের বাইরে এক অতৃপ্ত পরিমণ্ডলের সৃষ্টি করে; তখন দক্ষতা নয় আনুগত্য প্রাধান্য পায়, অদক্ষতা অগণতান্ত্রিকতার জন্ম দেয়। যেহেতু ক্ষমতা সব সুযোগের উৎস, সে কারণে রাজনীতি সুযোগের বলয়ে যাওয়ার একটি পথ হয়ে দাঁড়ায়, যার ফলে অর্থনীতিতেও কেন্দ্রিকতার প্রবণতা বাড়ে এবং পরিতোষণার মানসিকতা সর্বব্যাপী হয়ে পড়ে। এই সীমাবদ্ধতাই গণতান্ত্রিক পথকে অবরুদ্ধ করে ফেলে। 
গত শতাব্দীর শুরুতে সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধারণায় যে দর্শন উদ্দীপ্ত মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, তা হলো, সব মানুষের সমান অধিকার এবং কোনো সুবিধাভোগীর জন্য বিশেষ অধিকার নয়। আজ যখন সাংসদদের মধ্য থেকে বিশেষ সুবিধা ও বিশেষ অধিকারের উচ্চারণ শুনি, তখন তাঁদের গণতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়েই সংশয় জাগে। আমরা জানি, মুক্তিযুদ্ধ যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল, সে মন ও মনন আজ বর্তমান নেই। সমতাভিত্তিক উন্নয়নের পরিবর্তে যখন আমরা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক উন্নয়নের ধারাকে প্রাধান্য দিয়েছি এবং জনস্বার্থের ধারণা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থের কাছে অবদমিত হয়েছে, তখনই জনগণকে স্বার্থের ভিত্তিতে বিভাজিত হতে দেখেছি এবং ক্ষুদ্র স্বার্থের উত্থান রাষ্ট্রশক্তি নিয়ন্ত্রণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেই প্রতিযোগিতায় সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জনে চারিত্রিক গুণের বদলে বিত্ত বিশেষ স্থান করে নিয়েছে, আর বিত্ত অর্জনে সুনীতি আজ দুর্নীতির কাছে অবদমিত হয়ে পড়েছে। আর দুর্নীতির প্রভাববলয় রাজনীতি। প্রশাসন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিষ্ঠানসমূহ, নতুন প্রজন্মকে পথনির্দেশনার শিক্ষালয়সমূহ, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাকে আজ নীতিহীনতার শিকারে পরিণত করেছে। প্রতিষ্ঠা অর্জনের ব্যক্তিতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা সে কারণে জনস্বার্থ উন্নয়নের সহায়ক হয় না বলেই ব্যক্তি ও বস্তুতান্ত্রিক রাজনীতি আমাদের গণতন্ত্রের বিকাশকে রুদ্ধ করেছে। আমরা জনস্বার্থের যুক্তিবাদিতা পরিহার করেছি বস্তুতান্ত্রিক ভোগবাদিতা দিয়ে চালিত হওয়ার কারণে। পারস্পরিক সম্পর্কে আজ গণতান্ত্রিক ঔদার্য তিরোহিত হয়েছে। আমাদের উন্নয়ন-চিন্তায় আজ আর্থসামাজিক সমতা সাধনের রাজনীতি পরিহার করা হয়েছে বলেই সমাজ বিনির্মাণে আজ আধিপত্যবাদের বিস্তার ঘটেছে; যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িত হয়েছে দুর্নীতির জট। প্রতিষ্ঠা লাভের অসম প্রচেষ্টার যে রাজনীতি, সেটা গণতান্ত্রিকতা উদ্দীপ্ত করে না, অংশীদারিকে মূল্য দেয় না বরং কেন্দ্রীভবন, বিশেষ সুযোগ, বিশেষ ব্যবস্থা, তাৎক্ষণিকতাকেই উসকে দেয়। এ থেকে দীর্ঘ পথযাত্রায় মাঙ্গলিক কিছু ঘটার সম্ভাবনা কম থাকে বলেই ক্ষমতাবলয়ের বাইরের মানুষের কিছু দান, অনুদান অথবা ভীতি প্রদর্শনের প্রশাসন ও সংস্কৃতি সৃষ্টি হয়, গণতন্ত্রের চর্চা ও দায়বদ্ধতার জন্ম হয় না। সে জন্য জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি আজ রাজনৈতিক চেতনায় দৃশ্যমান নয় এবং এ কারণেই গণতান্ত্রিক চেতনায় নানা রকমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। গণতান্ত্রিকতার বাস্তবায়নে জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি ও তার ফলিত ধারণাকে উজ্জীবিত করতে আজ ব্যক্তিস্বার্থভিত্তিক ও পরিতোষণায় উদ্দীপ্ত যে ক্ষমতার অবকাঠামো সৃষ্টি করেছি, তার বিশেষ গুণগত পরিবর্তনের প্রয়োজন, যার জন্য যে পুঁজিবাদী মতবাদ নিয়ে আমাদের উন্নয়ন-ধারণার সৃষ্টি, তার জাতীয় সমতা দর্শনের আলোকে কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। বিশেষ অবস্থান, বিশেষ অবস্থা, বিশেষ ক্ষমতা ও বিশেষ সুযোগের অবলুপ্তি ঘটতে হবে। বস্তুতান্ত্রিকতার মননে গঠিত নানা প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তন প্রয়োজন হবে। আর্থসামাজিক সমতা দর্শনের সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত বা নীতিনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিস্বার্থের সংঘাত আছে এবং থাকবে। গণতন্ত্র যদি বৃহত্তর জনস্বার্থকে ধারণ না করতে পারে, যদি সমসুযোগের অবস্থানকে বাস্তবে রূপ না দিতে পারে, তাহলে দায়বদ্ধ গণতন্ত্র ও নীতিভিত্তিক সমতার সহাবস্থান নিশ্চিত হতে পারে না, ফলে সমাজে ও রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজমান থাকবে। আমরা এই সহাবস্থানকে নিশ্চিত করতে অপারগ হয়েছি। আমাদের রাজনীতি ও অর্থনীতির আজকের ব্যর্থতা এখানেই। গণতন্ত্রকে সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে ব্রতী না করা গেলে দায়বদ্ধ নীতিনিষ্ঠ আর্থসামাজিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ে। সে কারণে সংবিধিবদ্ধ রাজনীতি কেবল নির্বাচনের বিষয় নয়, জনগণকে ক্ষমতায়িত করার সার্বিক ব্যবস্থা। গণতন্ত্র কেবল বিধিমালা দিয়ে রচিত হয় না, প্রাতিষ্ঠানিকতা দিয়ে তাকে রক্ষা করা যায় না, গণতন্ত্রকে মন ও মননে, চিন্তা ও চেতনায়, আচার ও আচরণে ধারণ করতে হলে ক্ষমতায়িত জনগণের উচ্চারণকে সর্বদাই বিবেচনায় নিতে হবে। এ জন্য জনগণকে ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে রাগ-অনুরাগের ওপরে স্থান দিতে হবে।

১০.
সংবিধিবদ্ধ গণতন্ত্র আজ নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে পড়ছে, সেখানে জনকল্যাণকে স্বতঃসিদ্ধ ভাবার কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র অংশীদারি বিকেন্দ্রীভূত দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই জনকল্যাণকে অর্থবহভাবে ধারণ করতে পারে। যে ব্যবস্থায় বিশেষ অবস্থান ও বিশেষ ব্যবস্থা গুরুত্ব পায়, সেখানে গণতান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটে না। আইনের শাসন ও আইনের সামনে সবাই সমান—এই তত্ত্বের পেছনে এক নির্ভীক জ্ঞানী দূরদর্শী সামাজিক মননের অধিকারী বিচারকের চরিত্রের ধারণা আছে। আমরা আমাদের বিচারব্যবস্থায় এমনি দৃঢ়চিত্ত, ন্যায়নিষ্ঠ অবস্থানের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের গণতন্ত্রে, বিধিবিধানেও ঐকমত্য সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছি এবং বিভিন্ন বিষয়ে এমন দ্বন্দ্বমুখর অবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে যে গণতন্ত্রের সার আজ কিছু বিধিবিধানের কাছে সমর্পিত, জনকল্যাণের কাছে নয়। আইন ও বিধিবিধানের প্রয়োজনীয়তা গণতান্ত্রিকতার মূল কথা। তা ছাড়া ওসবের অন্তর্নিহিত মূল্য তেমন কিছু নেই।
আমাদের দেশে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বেশ লক্ষণীয়। ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রের বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। আমলাতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমলাতন্ত্র তখনই গণতন্ত্রকে সমুন্নত রাখে, যখন জনগণের অংশীদারির সার্বভৌম অবস্থানকে তাদের ক্রিয়াকর্মে গ্রহণ করে। আমাদের আমলাতন্ত্রের একটি ইতিহাস আছে, যে ইতিহাস আধিপত্যবাদকে ধারণ করে। সে জন্য আমাদের আমলাতন্ত্র ক্ষমতার কেন্দ্রিকতায় স্বস্তি বোধ করে। আমলাতন্ত্র আজ বিশাল, তাদের কর্মের নিশ্চয়তাও আছে এবং আজ যখন ক্ষমতাবলয়ে তারা অনুগত, বুদ্ধিদাতা, কাজে লিপ্ত, তখন দায়বদ্ধতার জনমুখিনতা দৃশ্যমান থাকে না এবং গণতন্ত্রের প্রাণ অনেক সময়ই চেতনাহীন হয়ে পড়ে। আজ ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বার্থবাদিতা যখন রাজনীতিকে জনমুখী করে না, তখন আমলাতন্ত্র অনেক সময় তাদের সাধারণভাবে নিয়মসিদ্ধ অবস্থানে কর্মতৎপর থাকে না বা থাকতে পারে না। এর সঙ্গে দুর্নীতির নানা সংশ্লেষ এবং বিভাজিত আমলাতন্ত্রের নানা অন্তর্দ্বন্দ্ব গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের উদ্যমকে বিনষ্ট করছে। ফলে জনগণের টাকার অপচয় ঘটছে। অনুগত কিন্তু কর্মসম্পাদনে অপারগ আমলাতন্ত্র সমাজের অস্থিরতায় স্বাভাবিক ভূমিকা রাখতে পারছে না। ঔপনিবেশিক ধারণা বহন করে তারা স্থানীয় সরকারকে যথাযথ মর্যাদা ও সহায়তা না দিতে সাংসদদের সহযোগী হয়ে উঠেছে। অথচ ক্ষমতায়িত জনগণই গণতান্ত্রিকতার ধারক, তাদের স্থানীয় সরকারই স্থানীয় সমস্যা ও উন্নয়নের জন্য দায়বদ্ধ। গণতান্ত্রিক অবস্থার উন্নতির জন্য আমলাতন্ত্রের সাবেকি ধারণার পরিবর্তন ঘটতে হবে। যেহেতু এই পরিবর্তন আমলাতন্ত্রের শীর্ষে গ্রহণীয় নয় এবং কেন্দ্রিকতায় তাদের ক্ষমতার প্রকাশ ঘটে, সে কারণে গণতান্ত্রিক বিকাশে বিধিবিধানের নিগড়ে আমলাতন্ত্র অধিপতি সাংসদদের সহায়তায় বাধার প্রাচীর নির্মাণ করে। উন্নত গণতন্ত্রে আমরা স্থানীয় সরকারের যে বিকাশ দেখি, সেখানে রাজনীতিতে কেন্দ্রীভবনের ধারণা সীমাবদ্ধ হয়েছে এবং আমলাতন্ত্রের অধিপতি-সহায়ক মানসিকতাও পরিবর্তিত হয়েছে।

১১.
অংশীদারির চেতনা আজ কেবল রাজনীতিতে নয়, বিভিন্ন ধরনের সংগঠনেও গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ হিসেবে আজ ব্যবস্থাপনায় এক স্বীকৃত বিষয়। এর ফলে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হয়। অংশীদারির বিকাশে স্থানীয় সরকারের গুরুত্ব একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই অংশগ্রহণ, আলোচনা, মতভিন্নতা সত্ত্বেও সহমর্মিতা, সাযুজ্য, সমসুযোগের বিকাশ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির শেকড় গড়ে দেয়। অংশীদারির দাবিতে ব্রিটেনে যখন শ্রমিক সংস্থার উত্থান সে দেশের রাজনীতিতে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়, তখনই সংশোধনবাদী শ্রমিকভিত্তিক রাজনীতি সে দেশে শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ও বিকেন্দ্রীকরণের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সুস্থ গণতন্ত্রের ধারা সৃষ্টি করে। কারণ, কোনো গোষ্ঠীস্বার্থের প্রাধান্য গণতন্ত্রকে দুর্বল করে তোলে। নির্বাচনেও সচেতনভাবে ভোটের সমর্থন পরিবর্তিত হয়। উন্নয়নের ধারায় নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটে। সে চেতনা কেবল কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে ধারণ করলে গণতন্ত্র সমুন্নত থাকে না, তাকে বিস্তৃতভাবে জনচেতনায় ছড়িয়ে দিতে স্থানীয় সরকার ও তার নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। সমাজে নতুন নতুন চেতনা ও নতুন নতুন সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়, সে চেতনা ও সম্ভাবনাকেই ধারণ করে উন্নয়নের গতিধারাকে বেগবান করা সম্ভব। সমসুযোগ ও সমমানের শিক্ষা শ্রেণীবিভাজনের পরিবর্তন ঘটায়, নগরের সংশ্লেষে গ্রামীণ সমাজের পরিবর্তন ঘটে, শিল্পায়নের ধারায় শিল্প-শ্রমিকের সংহত বিকাশ ঘটে, কৃষির উন্নয়নে এর বিপণনধারায় নতুন পুঁজির বিকাশ ঘটে। এমনি পরিবর্তনকে জনগণের উন্নয়নের ধারায় সমতাধর্মী সমাজ নির্মাণে দায়বদ্ধ ক্ষমতায়িত স্থানীয় সরকার গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে ও কেন্দ্রীভূত সরকারের গোষ্ঠীপ্রধানকে প্রতিহত বা সীমিত করে। স্মরণ করা দরকার, আমরা এ দেশে এতকাল যে স্থানীয় সরকার দেখেছি সেটি হলো, প্রশাসনের তৈরি, প্রশাসনের অনুগত ও অধীন স্থানীয় সরকার। এ পথে গণতান্ত্রিকতার বিকাশ ঘটে না। গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণে স্থানীয় সরকারকে স্থানীয় সমস্যা ও উন্নয়ন নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ গণতান্ত্রিক অংশীদারির মাধ্যমে কার্যকর করতে হবে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের বিস্তৃত নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থায় নিজেদের আর্থিক ও প্রশাসনিক স্বশাসনের অধিকারী থাকবে, যদিও এ ক্ষেত্রে জবাবদিহির ব্যবস্থাও কার্যকর হতে হবে। আমরা লক্ষ করেছি, স্থানীয় সরকারকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ স্বশাসনের অধিকার দিতে সাংসদ ও আমলাতন্ত্রের অনীহা প্রবল। এ দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় শাসনের মাধ্যমে গোষ্ঠী-প্রাধান্য সৃষ্টি করে গণতন্ত্রকে সংহত করা সম্ভব নয়। এ কারণেই সংবিধানের চেতনায় স্থানীয় সরকারকে প্রকৃত অর্থে ক্ষমতায়িত করে গণতন্ত্রের বিকাশ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

১২.
গণতন্ত্রের আলোচনা যা করা হলো তা সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু যে বিষয়গুলোর অবতারণা করা হয়েছে, সেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা বলেছি, গণতন্ত্রের চুম্বক হলো স্বাধীনতা, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব। এসবের অবস্থান যত বিস্তৃত ও দৃঢ় হবে, গণতন্ত্র তত কার্যকর হবে। আমাদের বিভাজিত সমাজের বিপরীতে অর্থ ও অস্ত্রের প্রবল উপস্থিতির বিপরীতে সুষম সমাজ নির্মাণ কঠিন ও দীর্ঘকালীন কার্যক্রম। কিন্তু গণতান্ত্রিক চেতনার প্রকাশ এখন থেকেই হওয়া প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ও সার্বিকভাবে প্রশাসনের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে রাজনৈতিক দলের ভেতরে, গণতন্ত্রের উচ্চকিত উপস্থিতি কেবল প্রাতিষ্ঠানিক নয়, রাজনৈতিক দলের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীভবন। এর ফলে মতভিন্নতার প্রকাশ হবে, কিন্তু সংলাপ ও আলোচনায় সমঝোতার সৃষ্টি হবে, যার ভিত্তি সুবিধাবাদিতা নয়। অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ও আচরণে আজ যে ঘৃণা ও হিংস্রতা দেখা যায়, তা থেকেও আমাদের উত্তরণ প্রয়োজন। এখানেও প্রকাশ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্যে মতভিন্নতার অবস্থানকে মেনে নিতে হয়। আমাদের বৃহৎ দুটি দলে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক চিন্তায় বিশেষ পার্থক্য নেই। কেবল ক্ষমতার সংশ্লেষ ও ইতিহাস তাদের মধ্যে যে সাংঘর্ষিক অবস্থানের সৃষ্টি করেছে, তার দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে গণতন্ত্র ঝুঁকিতেই থেকে যাবে। এদিকে আমাদের সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতাতেই রয়েছে।

১৩. 
গণতন্ত্রে অন্যায়-অবিচার-অশুভের বিরুদ্ধে, ন্যায় ও সুবিবেচনার পক্ষে জনগণের উচ্চারণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই বাকস্বাধীনতা আর্থ-রাজনৈতিক অধিকারের একটি মৌল স্তম্ভ। স্তুতিবাদ বা তোষামোদ জন-অধিকারকে সংহত করে না। বস্তুনিষ্ঠ আলোচনাই গণতান্ত্রিকতার জনভিত্তি রচনা করে। সচেতনতা তাই অপরিহার্য। সচেতন নাগরিক দেশপ্রেম ও জনস্বার্থে সর্বদা সোচ্চার হলেই আর্থ-রাজনৈতিক অধিকার গণতান্ত্রিক সমাজে অর্জন করা যায়। সংবাদপত্র জনসচেতনতা সৃষ্টি ও জনগণের উচ্চারণকে শ্রুত করতে সহায়তা করে। ব্যবসায়িক স্বার্থ বা গোষ্ঠীবিবেচনা গণমাধ্যমের ভূমিকাকে বেপথু করতে পারে। কিন্তু সংবাদপত্র ও অন্যবিধ গণমাধ্যম জনস্বার্থকে ধারণ করে ন্যায়নিষ্ঠ ও বস্তুনিষ্ঠ হলেই গণতান্ত্রিক ধারণা প্রবল হয়। গণতন্ত্রচর্চায় জনগণের উচ্চারণকে তুলে ধরতে গণমাধ্যম বাকস্বাধীনতার কার্যকর বাহন হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এর নানা স্খলন দেখি। সেখান থেকে উত্তরণে সচেষ্ট হতে হবে।

১৪. 
গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতন্ত্রকে ধারণ করেই জনগণ ক্ষমতায়িত হতে পারে। কিন্তু গণতন্ত্রকে গোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন এবং কেবল নির্বাচনসর্বস্ব করা জনকল্যাণে সহায়ক নয়। আসুন, আমরা সচেতনভাবে আমাদের কর্মে, উচ্চারণে ও আচার-আচরণে জনকল্যাণের জন্য গণতন্ত্রের চর্চা করি, গণতন্ত্রকে সংহত করি।
 মোজাফ্ফর আহমদ: অর্থনীতিবিদ, সভাপতি, সুজন

http://prothom-alo.com/detail/date/2012-12-19/news/106669

নীরক্তকরবীর মালা/কনক জ্যোতি

রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসা

সমাজবদ্ধ মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তা বন্ধনকে কখনোই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের আসল রূপ; প্রধান পরিচিতি চিহ্ন। সেই পরিচয়ের বন্ধনই পরিবারে-পরিবারে এবং মানুষে-মানুষে মৈত্রী গড়েছে; মানব-জীবন-প্রবাহকে ছন্দে ও গতিতে বেঁধে রেখেছে। এর বাইরে রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় বড়জোর মানুষের দ্বিতীয় পরিচয় হতে পারে। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিচয়কেই আজকাল বড় করে দেখা হচ্ছে। এরই ভিত্তিতে মানুষকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। (কম মেধার পক্ষকে মাথায় আর বেশি মেধার প্রতিপক্ষকে পায়ের নিচে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।) ব্যক্তি স্রেফ কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক পার্টি করে বলেই ঘৃণিত, বঞ্চিত এবং পরিত্যাজ্য- এই আজব সূত্র সত্যিই মর্মান্তিক; অভিনব ও হিংসাত্মক। প্রয়োজনে কারও নীতি বা মতাদর্শকে অপছন্দ করা যেতেই পারে, অনেকেই সেটা করেও থাকেন, কেউ কেউ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করেন। তাই বলে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক সত্তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। এটাও তো ভুলে থাকা যায় না যে, পবিত্র বাইবেলই বলেছে যে, 'পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর'।

অতএব ঘৃণা কোথায়, কতটুকু, কার বিরুদ্ধে করা হবে, সেটারও একটি মানদন্ড থাকা দরকার। অন্ধভাবে ঘৃণায় আকীর্ণ হওয়ার নাম মনুষ্যত্ব নয়। সবাইকে মনে রাখতে হয় যে, দলের কর্মী বা সমর্থকের খোলসটার ভেতরের একজন মানুষ কারও ছেলে বা মেয়ে বা পিতা বা স্বামী বা শিক্ষক বা প্রতিবেশি বা অন্য কিছু। রাজনৈতিক মোড়কে কোনও মানুষকে আগাগোড়া মুড়ে ফেলে তাকে বিবেচনা করা একদেশদর্শিতা। এমনটি করা হলে সেটা হবে মূঢ়তা ও মনুষ্যত্বের অপমান। রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে বয়কট করা হলে বা তার প্রতি ঘৃণা ছড়ালেই কি নিজেদের শক্তিশালী করা সম্ভব হবে? এতে সমাজজীবনের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সৌজন্য অতি নিচের তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। এমন সমাজে মুক্ত চিত্তে মানব বসবাস কি করে সম্ভব হবে?

হাল আমলে 'আমরা' এবং 'ওরা'-এই বিভাজন করে বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে যে ঘৃণা ও হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে, সেটা শুভতার লক্ষণ নয়। ঘৃণা থেকে হিংসা থেকে ক্রমে ক্রমে সংঘর্ষ ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হতে সময় লাগে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ সমাজের বিষবৃক্ষ  উৎপাটন; রোপণ নয়। একদা 'শ্রেণীশত্রু' খতমের নামে অতি-উগ্র কমিউনিস্টদের মাধ্যমে প্রতিপক্ষ  নিধনের যে রাজনৈতিক-সামাজিক রক্তলীলা শুরু হয়েছিল বিশ্বের কোথাও কোথাও, পরে প্রমাণ হয়েছে, সেই হিংসাদর্পী আচরণ ছিল আদর্শিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক দিক থেকে মহাভুল। এখন বিশ্বে সকলের জন্যে হিতকর গণতন্ত্র দেশে দেশে নিজের স্থান করে নিয়েছে। গণতন্ত্রের কাঠামো ও বিধি-ব্যবস্থায় পরমত ও অন্যদলের প্রতি ঘৃণ্য অস্ত্র ও হিংস্র কার্যাবলির প্রয়োগ আরও আত্মঘাতী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অমানবিক ও অসৌজন্যমূলক কোনও আচরণ করা হলে সেটা ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে; শক্তি ও মহত্ত্ব প্রদর্শন করে না।

'মুখে মধু হৃদে বিষ' বড় নেতার চারিত্রধর্মও নয়। রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আনুগত্যের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজন বা বিভক্ত করা আরও বিষস্পর্শী অপকর্ম। 'আমরা' আর 'ওরা' ভিত্তিক বিষাক্ত-বিভেদ তৈরি করা হলে, এরই ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ও শাস্তি বিধান করা হলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার কোথায় থাকবে? কেবলমাত্র রাজনৈতিক তুল্যমূল্যের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন করা হলে মানুষের মৌলিক সত্তা ও পরিচয় খন্ডিত হবে; বহুমতের বিনাশ ঘটবে; মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব নিহত হবে; গণতন্ত্র, সু ও সুশীল শাসন ভূলুণ্ঠিত হবে। এই অবস্থায় ঘৃণা ও হিংসা আরও বাড়বে এবং একদল অসৎ, দুর্নীতিবাজ বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তপ্ত ও উত্তেজক করে ফাঁকতালে সুবিধা লুটে নেবে।

ঘৃণা ও হিংসার আগুনকে লেলিহান দাবানলে পরিণত করে প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখার পন্থাও আদিম, অবৈজ্ঞানিক ও অকার্যকর। হিটলারের কথা মনে করিয়ে আজকের ঘৃণা-বিস্তারী এবং হিংস্রতা-পিয়াসীদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতেই পারে। বলা বাহুল্য, এমনটি মনে করিয়ে দেওয়ার সঙ্গত কারণ ঘটেছে। যাদের চোখ-কান খোলা, তারা চারপাশেই এমন অনেক কিছু দেখতে পাচ্ছেন। এর ফলে সভ্যতা, মনুষ্যত্ব ও শুভতার বিনাশের কথাও আতঙ্কের সঙ্গে ভাবছেন বিবেকী মানুষজন। এমন অবস্থা গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের সমান্তরালে লাগসই নয়। ইতিহাসের মুখ চেপে সেই সত্য কথাটি দমিয়ে রাখা যাবে না।

প্রতিটি কাজের পিছনেই একটি দর্শন থাকে। থাকে নৈতিকতার একটি বিষয়। কিন্তু যে বা যেসব কাজ কেবল ঘৃণা ও হিংসার বশবর্তী হয়ে এবং ক্ষমতার দম্ভে করা হয়, তার পেছনে দার্শনিকতা বা নৈতিকতা নামে আসলেই কি কিছু থাকতে পারে? একদলীয় স্বৈরতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ ইত্যাদি মানববিরোধী মতবাদেরও একটি দর্শন বা প্রণোদনা রয়েছে। কিন্তু ঘৃণা আর হিংসার দর্শন কি? এটা তো ফ্যাসিবাদের চেয়েও নিকৃষ্ট।

ঘৃণা ও হিংসার মনস্তত্ত্ব লুক্কায়িত রয়েছে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিকৃতিতে, হীনমন্যতায়,  ক্ষুদ্রতায়, খলতায় এবং অসুস্থতায়। ঘৃণ্য ও হিংস্র রূপ কখনোই কোনও সুস্থতার পরিচায়ক নয়। এজন্যে প্রয়োজন শরীর-বৃত্তিয় পরিচর্যা। ব্যক্তিগত জীবনে কোনও নর বা নারীর এহেন সমস্যার সমাধান ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়ে সুরাহা করা যায়। কিন্তু সেই অসুস্থ নর বা নারী যদি ব্যক্তিগত আড়াল ছিঁড়ে সমাজে বের হয়ে এসে সমাজ ও রাজনীতিতে এহেন ঘৃণা উৎপাদনকারী ও হিংসা উদ্রেগকারীতে পরিণত হয়, তাহলে তার বা তাদের ব্যাপারে কি করা যায়?

সবারই জানা যে, সমাজের অধিকাংশ মানুষই শান্তিকামী এবং এরা ঘৃণা ও হিংসা চায় না। যখন ঘৃণা-হিংসার পূজারীরা সকলের মাথার উপরে বসে যায়, তখন সেটারও তো একটি প্রতিবিধান থাকা দরকার। সুনাগরিকদের মিলিত চিন্তায় প্রতিষেধক বের করাই কাম্য।

বাংলাদেশ বহু দীর্ঘ ইতিহাসের পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসে পৌঁছেছে। এতটুকু পথ অতিক্রম করতে দাঙ্গা, হাঙ্গামা, হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা, রক্তপাতের বহু অধ্যায়কেও অতিক্রম করে আসতে হয়েছে। এগুলো অতীতের কালো দাগ। এ রকম অনেক কালো অধ্যায়, দুঃশাসন, স্বৈরতন্ত্রের পর আজ যে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সেটা এদেশবাসী প্রতিটি নাগরিকের সুস্থ, সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ জীবন-যাপনের গ্যারান্টি। কোন ব্যক্তি, দল বা নেতা মানুষের এই মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না ঘৃণা ও হিংসার আশ্রয় নিয়ে। ব্যক্তি বা দলের হিংসা ও ঘৃণার কাছে জনমানুষ জিম্মি হতে পারে না। প্রতিপক্ষ ও অন্যায় আচরণের শিকার হতে পারে না। অতএব রাজনৈতিক ঘৃণা ও হিংসার চর্চাকারীদের ভাবতে হবে, পক্ষ বা প্রতিপক্ষের কেউই এ সমাজ এবং সমাজ সংহতির বাইরের কেউ নন। পারিবারিক-সামাজিক আত্মীয়তায় আবদ্ধ আমরা সকলেই। নানা মত ও পথের মাধ্যমে ভিন্নমত ও পার্থক্য সত্ত্বেও সবাইকে নিয়েই আমাদের বসবাস করতে হয় এবং সবাইকে নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানে 'আমরা' এবং 'ওরা' নামের কোনও বিভাজনের সুযোগ নেই।

মনে রাখা ভালো, তিনটি তীক্ষ্ণ আবেগ মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে-ভালোবাসার প্রত্যাশা, জ্ঞানানুসন্ধান ও মানুষের প্রতি মমতা। সকলকেই ব্যক্তিমানুষ হিসাবে ভালোবাসার সন্ধান লাভের চেষ্টা করতে হয়; কারণ তা সুখ এনে দেয়। এই সুখ এত বড় যে, সুখের জন্যে জীবনের বৃহৎ অংশও জলাঞ্জলি দিতে হয়। বার্টান্ড রাসেল (১৮৭২-১৯১৪) আত্মজীবনীতে বলেছেন: 'পরিশেষে আমি খুঁজেছি, ভালোবাসার সংযুক্তিতে আমি অতীন্দ্রিয় কল্পনায় স্বর্গের রূপরেখার ছবি এঁকেছি, যা দরবেশ ব্যক্তি ও কবিরা কল্পনা করেন।' ফলে ভালোবাসা ও মানবপ্রেমের গুরুত্ব সহজেই প্রণিধানযোগ্য। কারণ মানুষই পারে ভালোবাসা জাগাতে-নিজের জন্যে এবং অপরের জন্যেও। কিন্তু মানুষ নামে পরিচয় দেবো আর ঘৃণা ও হিংসার মাধ্যমে বিকৃত ও পাশবিক উল্লাসে মদমত্ত হয়ে নৃত্য করবো-মানব পরিচয়ের সঙ্গে এর চেয়ে অসঙ্গতি আর কি হতে পারে! সম্ভবত এখন সময় এসেছে মানুষকে নিজের মানব-সত্তার দিকে তাকিয়ে দেখার এবং নিজের মানবিক সত্তাকে পবিত্রতার সঙ্গে রক্ষা করার জন্যে মানবচর্মের ঘৃণাকামী ও হিংস্রাশ্রয়ীদের চরমভাবে পরিত্যাগ করার। ঘৃণায় প্রজ্বলিত ও হিংসায় উন্মত্ত পরিস্থিতিতে নিজের ঐতিহাসিক মানব-অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে কিছুটা তৎপর তো প্রকৃত মানুষদের হতেই হবে? নইলে সব কিছু ঘৃণার আগুনে আর হিংসার বিষবা ছারখার হয়ে যাবে।

http://www.dailysangram.com/news_details.php?news_id=88133


কেন এই নৃশংসতা?
মঙ্গলবার, ১১ ডিসেম্বর ২০১২

ড. মাহফুজ পারভেজ: এক সময় বলা হতো, 'সরকারের শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিরোধীরা লাল সন্ত্রাস করে।' এখন বিভিন্ন দলের প্রতিযোগিতামূলক সহিংসতাকে কিভাবে ব্যাখ্যা করা হবে? যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচি, বিশেষ করে অবরোধ বা হরতালে শক্তির মহড়ায় প্রকম্পিত হচ্ছে পুরো সমাজ। মধ্যযুগীয় নৃশংস তাণ্ডবে অস্ত্রসজ্জিত ক্যাডাররা নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর। রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ; এমন কি বিশ্বজিৎ দাসের মতো একজন সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণ দর্জিও। যার যেখানে শক্তি বেশি, সে-ই সেখানে চালাচ্ছে তাণ্ডবতা এবং নির্মম নৃশংসতা। একজন ধর ধর বললেই সঙ্গী-সাথীরা আক্রমণের ট্রেনিং পাওয়া হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ছে। রাজনীতির মাঠে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই যে আক্রমণ বা প্রতিআক্রমণ, বলপ্রয়োগ, অস্ত্রের মহড়া, পেশির দাপট, রক্তাক্ত আঘাতের ধারা এবং নৃশংস পাশবিক উল্লাসÑএসবের সমাজতাত্ত্বিক বা মনস্তাত্ত্বিক কারণ কি? এর জন্য দায়ী কারা? গণতন্ত্রের নামে চর-দখলের মতো মাঠ-দখল বা আদিম হিংস্রতায় প্রতিপক্ষ নিধনের সংস্কৃতি এসে আমাদের মধ্যে এই আধুনিক সময়েও কিভাবে উপস্থিত হলো? কোনও কারণ ছাড়া তো কিছু ঘটে না। তাহলে সমাজে যে প্রবলভাবে নৃশংসতা ছড়িয়ে পড়ছে; কর্মী-সমর্থকরা উগ্র-মূর্তি ধারণ করছে; নানা ধরনের অস্ত্র নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেÑ এর কারণ কি?
রোববারের অবরোধে সারা দেশে কি ঘটেছে, সেটার পুনরুল্লেখের দরকার নেই। টিভি ও সংবাদপত্রের বিবরণে সব কিছুই জানা হয়ে গেছে। শুধু আমরাই জানি নি; সারা পৃথিবীও জেনে গেছে। নিহত, আহত, অস্ত্রবাজি, ভাঙচুর, সংঘর্ষ, আগুন, রক্তপাত, নৃশংস আক্রমণ ইত্যাদিতে চিহ্নিত হয়ে আছে দিনটি। রাজপথ ছিল বিভিন্ন দলের দখলে। ধাওয়া-পাল্টা-ধাওয়ায় আতঙ্কিত। হিংসা এবং প্রতিহিংসার লেলিহান আগুনে দগ্ধ। মনে হয়েছে, কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না। আফ্রিকার আদিম উপজাতিগুলো যেমন একদল আরেক দলকে তাড়িয়ে ফেরে, সেভাবেই হানা দেয়া হয়েছে। শক্তি, হিংসা ও ঘৃণায় তল্লাশি করা হয়েছে প্রতিপক্ষকে। হাতের কাছে পেলে নৃশংসতার তাণ্ডবে আক্রমণ করা হয়েছে। বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। প্রবল অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে কর্মী ও সমর্থকরা প্রতিপক্ষ নিধনের সহিংস উৎসব পালন করেছে। এই হিংসা ও নৃশংসতার শেষ কোথায় কেউ জানে না।  
জনগণ ছিল জিম্মি। সব সময়ই সাধারণ মানুষ পরিস্থিতির শিকার হন। বহু নিরীহ মানুষ, যারা দল করে না, তারাও নিগৃহীত হয়েছেন। প্রাণভিক্ষা চেয়েও বাঁচতে পারে নি পথচারী দর্জি বিশ্বজিৎ। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক হিংসা ও নৃশংসতার আগুন ক্রমে ক্রমে সাধারণ মানুষকেও পুড়িয়ে ফেলবে। এর থেকে বাঁচার উপায় কি? জনগণ তো শান্তির জন্য, নিরাপত্তার জন্য, নিশ্চিত থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। বিভিন্ন দলকে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতায় বসতে দেয় শান্তি-শৃঙ্খলা, সমঝোতা, সংলাপ ও সুশাসনের জন্য। হিংসা আর নির্মম নৃশংসতার আগুনে পুড়ে মরতে তো চায় না মানুষ?
রাজনীতির প্রধান কাজই হলো মানুষকে রক্ষা করা। যে ধারায় রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও সহিংসতা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষের কি হবে? সামাজিক শান্তি ও সৌহার্দ্যরে কি হবে? সবাই মিলে একসঙ্গে থাকার পরিবেশের কি হবে? রাজনৈতিক হিংসা ও আক্রমণের গতিমুখ এখনই বন্ধ করা না হলে সেটা সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে যাবে; অবিশ্বাস, হিংসার আগুন জ্বলে উঠবে। আর আগুনের ধর্মই হলো, সে কাউকে রেহাই দেয় না।
৯ তারিখ সহিংস অবরোধ হয়েছে। আজ ১১ তারিখ পালিত হচ্ছে হরতাল। হরতালেও আশঙ্কা করা হচ্ছে সংঘর্ষ ও রক্তপাতের। মাঝখানের ১০ তারিখ ছিল বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এ দিনে নেতৃবৃন্দ মানুষের অধিকার, মর্যাদা ও শান্তির জন্য বাণী দিয়ে থাকেন। গতকালও তারা যথোপযুক্ত বাণী প্রদান করেছেন। তাদের গতকালের মানবাধিকার বিষয়ক বাণী আজকে হরতালের মাঠের কর্মীরা শুনবে তো? নেতৃবৃন্দের কথা যদি কর্মী-সমর্থকরা না শোনে এবং অতীতের মতো নৃশংসতার তাণ্ডবে আজকেও সব কিছু রক্তাক্ত করে ফেলে, তাহলে কে আর এদের সামলাতে পারবে! এরাই হয়তো ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে এক সময় মালিককেও বধ্ করে ফেলবে।

http://www.mzamin.com/details.php?nid=MzM5NTU=&ty=MA==&s=Mzg=&c=MQ==


মানুষের পরিচয়
শুক্রবার, ২৯ জুন ২০১২

ড. মাহফুজ পারভেজ: মানুষের সামাজিক পরিচয় ও আত্মীয়তার বন্ধনকে কখনই অস্বীকার করা যায় না। সেই পরিচয়গুলোই মানুষের আসল রূপ; প্রধান পরিচিতি চিহ্ন। সেই পরিচয়ের বন্ধনই মানুষে মানুষে মৈত্রী গড়েছে; মানবজীবন প্রবাহকে ছন্দে ও গতিতে বেঁধে রেখেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শগত পরিচয় বড়জোর মানুষের দ্বিতীয় পরিচয় হতে পারে। কিন্তু এই দ্বিতীয় পরিচয়কেই আজকাল বড় করে দেখা হচ্ছে। ব্যক্তি স্রেফ কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক পার্টি করে বলেই ঘৃণিত, এই আজব সূত্র সত্যিই মর্মান্তিক; অভিনব ও হিংসাত্মক। প্রয়োজনে কারও নীতি বা মতাদর্শকে অপছন্দ করা যেতেই পারে, অনেকেই সেটা করেও থাকেন, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে নিন্দা করেন। তাই বলে ব্যক্তি মানুষের মৌলিক সত্তাকে তো অস্বীকার করা যায় না। এটাও তো ভুলে থাকা যায় না যে, পবিত্র বাইবেলই বলেছে যে, 'পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর'। অতএব ঘৃণা কোথায়, কতটুকু, কার বিরুদ্ধে করা হবে, সেটারও একটি মানদণ্ড থাকা দরকার। অন্ধভাবে ঘৃণায় আকীর্ণ হওয়ার নাম মনুষ্যত্ব নয়। সবাইকে মনে রাখতে হয় যে, দলের কর্মী বা সমর্থকের খোলসটার ভেতরের একজন মানুষ কারও ছেলে বা মেয়ে বা পিতা বা স্বামী বা শিক্ষক বা অন্য কিছু। রাজনৈতিক মোড়কে কোন মানুষকে আগাগোড়া মুড়ে ফেলে তাকে বিবেচনা করা একদেশদর্শিতা। এমনটি করা হলে সেটা হবে মূঢ়তা ও মনুষ্যত্বের অপমান। সামাজিকভাবে প্রতিপক্ষকে বয়কট করা হলে বা তার প্রতি ঘৃণা ছড়ালেই কি নিজেদের শক্তিশালী করা সম্ভব হবে? এতে সমাজজীবনের সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সৌজন্য অতি নিচের তলানীতে গিয়ে ঠেকবে। 'আমরা' এবং 'ওরা'-এই বিভাজন করে বাংলাদেশের সমাজ ও জনজীবনে যে ঘৃণা ও হিংসার বীজ বপন করা হচ্ছে, সেটা শুভতার লক্ষণ নয়। ঘৃণা থেকে, হিংসা থেকে ক্রমে ক্রমে হত্যা ও সন্ত্রাসের বাতাবরণ তৈরি হতে সময় লাগে না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাজ সমাজের বৃষবৃক্ষ উৎপাদন; রোপণ নয়। একদা 'শ্রেণীশত্রু' খতমের নামে যে রক্তলীলা শুরু হয়েছিল বিশ্বের কোথাও কোথাও, পরে প্রমাণ হয়েছে, সেই হিংসাদর্পী আচরণ ছিল মহাভুল। গণতন্ত্রে পরমত ও অন্যদলের প্রতি ঘৃণ্য অস্ত্র ও হিংস্র কার্যাবলীর প্রয়োগ আরও আত্মঘাতী। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অমানবিক ও অসৌজন্যমূলক কোন আচরণ করা হলে সেটা ক্ষুদ্রতা ও দুর্বলতাকেও প্রকাশ করে; শক্তি ও মহত্ত প্রদর্শন করে না। 'মুখে মধু হৃদে বিষ' বড় নেতার চরিত্রধর্মও নয়। রাজনৈতিক বিশ্বাস বা আনুগত্যকে ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজন বা করা হলে, 'আমরা' আর 'ওরা' ভিত্তিক বিভেদ তৈরি করা হলে, সুযোগ-সুবিধা বণ্টন ও শাস্তি বিধান করা হলে মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার কোথায় থাকবে? কেবলমাত্র রাজনৈতিক তুল্যমূল্যের ভিত্তিতে মানুষের মূল্যায়ন করা হলে মানুষের মৌলিক সত্তা ও পরিচয় খণ্ডিত হবে; বহুমতের বিনাশ ঘটবে; মানবিক মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্ব নিহত হবে; গণতন্ত্র, সু ও সুশীল শাসন ভূলুণ্ঠিত হবে। এই অবস্থায় ঘৃণা ও হিংসা আরও বাড়বে এবং একদল অসৎ, দুর্নীতিবাজ বিদ্যমান পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে ফাঁক তালে সুবিধা নেবে। ঘৃণা ও হিংসার আগুনকে দাবানলে পরিণত করে প্রতিপক্ষকে দাবিয়ে রাখার পন্থাও আদিম, অবৈজ্ঞানিক ও অকার্যকর। হিটলারের কথা মনে করিয়ে আজকের ঘৃণা বিস্তারি এবং হিংস্রতা পিয়াসীদের সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া যেতে পারে। 
mahfuzparvez@gmail.com

http://www.mzamin.com/details.php?nid=MTEyMDc=&ty=&s=19&c=


ধারাবাহিক বিশেষ উপন্যাস

পাতালপুরের রাজকন্যা ও চাষির ছেলে রুমান


।। আবদুল হালীম খাঁ ।।
[শেষ পর্ব]
গতকাল বিকেলে রুমানের বাড়ি যাবার কথা ছিল। কিন্তু সে কিছুই বলেনি। আজ সকালেও কিছু বলছে না। যথারীতি খাওয়া-দাওয়া সেরে সে শুয়ে পড়লো। রাবেয়া বেগম বিষয়টা লক্ষ্য করলেন। যেতে না চাইলে তাকে তাকিদ দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া ঠিক নয়। তিনি ভাবতে লাগলেন-ওর হলো কি? ওর শরীর কি খারাপ হলো? কতদিন যাবত মা বাবা ছেড়ে এসেছে। না জানি ওর মনে কত কষ্ট হচ্ছে। তিনি রুমানের বিছানার পাশে গিয়ে ডাক দিলেন-
বাবা রুমান, রুমান!
রুমানের কথা নেই।
রুমান, তোমার কি হয়েছে?
তবু সাড়া নেই।
বাবা রুমান তোমার কি মায়ের কথা মনে পড়েছে?
রুমান তবু নির্বাক।
এবার তিনি লাবণিকে ডাকলেন। লাবণি দৌঁড়ে এসে বললো কি হয়েছে মা?
রুমানকে কত ডাকছি। অথচ কথা বলছে না। কি হলো ওর?
লাবণি ডাক দিলো-ভাইয়া, রুমান ভাইয়া.....
রুমান আসলে ঘুমে নেই। ঘুমের মতো শুয়ে ভাবছে :
আমি যে পৃথিবীতে বাস করি সেটা মানুষের বসবাসের উপযোগী নেই আর। সেখানে হিংস্র জন্তু-জানোয়ারে ভরে গেছে। সেখানে সকল রকম অন্যায় অনাচার, অনিয়ম, চুরি-ডাকাতি, দুর্নীতি, জোর-জুলুম, লুট-পাট, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, খুন আর যুদ্ধ। সেখানে অভাব অভিযোগ আর হাজারো সমস্যা। সেখানে বেকার ভাসমান রুগ্ন ও আহত লোকের চিৎকার। সেখানে হিংসা, ঘৃণা, ক্রোধ, ক্ষুধার্ত শিশু নরনারীর আর্তনাদ। সেখানে অর্থ সম্পদ না থাকার কারণে কেউ কেউ দুঃখ কষ্ট ভোগ করছে। আবার কেউ কেউ সম্পদের কারণে দুঃখ কষ্ট ভোগ করছে। এমনকি দস্যুদের হাতে নিহত হচ্ছে। সেখানে কারো মনে সুখ নেই। শান্তি নেই। যারা ছলে বলে কৌশলে একবার সামাজিক মর্যাদা ও সম্মানের উচ্চতম শিখরে আরোহণ করছেন, দু'দিন পরে তারা আবার জনতার হাতে লাঞ্ছিত ও ঘৃণা ধিক্কারে জর্জরিত হচ্ছেন।

আর আমি এখন যে জগতে আছি, এ জগতেই মানুষের কাম্য-বসবাসের উপযোগী। এখানে কারো কোনো কিছুর অভাব নেই। কারো প্রতি কারো হিংসা ঘৃণা বা অভিযোগ নেই। এখানে অন্যায় অনাচার অনিয়ম বলতে কিছু নেই। কারো কোনো সমস্যা নেই। এখানে খুন, সন্ত্রাস ও যুদ্ধের নাম নেই। এখানে আছে স্নেহ, প্রেম, আদর, সোহাগ ভালোবাসা। আছে শ্রদ্ধা, সম্প্রীতি সম্মান, মায়া-মমতা। এখানে নেই রোগ শোক মহামারী বিপদাপদ। এখানে সবখানে আছে শান্তি আর সুখ। এদেশ ছেড়ে কেমনে সেই ধ্বংসের জগতে যাই? যেখানে রাবেয়া বেগমের মতো মা আছেন। লাবণির মতো বোন আছে। ব্যানকলির মতো মামা আছে। সে দেশ ছেড়ে হিংসা ঘৃণার কর্দমাক্ত স্থানে কেমনে যাই?


আবার ওদিকে মা বাবা রয়েছেন পৃথিবীতে। তাদের ছেড়ে কেমনে থাকি? ইচ্ছে করছে আজ বাড়ি গিয়ে মা বাবাকে দেখে আগামী দিনই খালাম্মা এবং লাবণির কাছে চলে আসি। যদি সত্যি তাই চলে আসতে পারতাম তা হলে কতই না ভালো হতো। কতই না আনন্দ পেতাম। 
কিন্তু তা কি সম্ভব? আমার মনের এ দ্বন্দ্ব সমস্যার কথা কি খালাম্মার কাছে বলা যাবে? কেমনে কলবো? বললে খালাম্মা কি মনে করবেন? হয়তো তিনি মনে করবেন-ছেলেটা তো একেবারেই ছেলে। আচ্ছা লাবণির কাছে বললে কেমন হয়।

খালাম্মার কাছে না বললে কি উপায় আছে। তিনি আমাকে কত আদর করেন, কত ভালোবাসেন। তাকে না বলে এমন মন খারাপ করে থাকলে তিনিও তো কষ্ট পাচ্ছেন। রুমান শুয়ে শুয়ে ভাবছে আর ভাবছে। রাবেয়া বেগম রুমানের নির্বাক বিষণ্ণ মুখ দেখে দারুণ চিমত্মায় পড়ে গেলেন। কী কারণে ওর মনে এতো কষ্ট? কী ওর সমস্যা? নিশ্চয়ই ওর সমস্যা একটা আছে। আমরাই তো ওকে ধরে রেখেছি। ওর বাবা-মা না জানি কত চিমত্মা করছে।
তিনি আবারো প্রাণের সবটুকু দরদ ঢেলে রুমানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন-বাবা রুমান ওঠো। তোমার কি সমস্যা বলো। তোমার সব সমস্যাই আমি দূর করে দেবো। বাবা, বলো। দ্যাখো তুমি কথা বলছো না দেখে লাবণিও কথা বলছে না। সকাল থেকে মন ভার করে আছে। বাবা রুমান....
রুমান আর নিরব থাকতে পারলো না। বললো-
খালাম্মা।
বলো বাবা।
খালাম্মা।
বলো বাবা বলো।
রুমান বিছানা থেকে ওঠে বসলো। তারপর মাথানত করে এতোটুকু শিশুর মতো কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বললো, খালাম্মা আমি ভীষণ দোটানায় পড়ে গেছি।
কী রকম?

এখন আমার আপনাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছে না। আবার মা-বাবাকে ছেড়েও থাকতে পারছি না। গতকাল থেকে চিমত্মাই করছি। এখন কি করবো বলুন।
পাগল ছেলে আমার! এ জন্য মন এতো খারাপ করে আছো।
খালাম্মা ও লাবণির চিমত্মার মেঘ কেটে গেল এবার।
তারা খুশিতে দু'জনে এক সঙ্গে হেসে ওঠলো।

http://www.weeklysonarbangla.net/news_details.php?newsid=760


স্বাধীনতার চেতনা ও তার স্বরুপ

লিখেছেন আহমেদ রিজভী ১০ ডিসেম্বর ২০১২, রাত ১০:০৫

সারাদেশে এক ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা । পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, একটি বিশেষ দল ও তাদের সমর্থক গোষ্ঠীর লোকজন ছাড়া নেহায়েত একজন নাগরিক হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে এ জনপদে বেঁচে থাকার অধিকারও যেন আর কারো নেই । দেশে শাসন নয় চলছে ত্রাসন । ক্ষমতাসীনরা শুরু করেছে দিনে দুপুরে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, সন্ত্রাস, আগুন ও ভাংচুরের এক ভয়াবহ তান্ডব যেন সাক্ষাত্‍ দোযখ । ক্ষমতাসীন শক্তি দেশ জুড়ে এক অলিখিত যুদ্ধ ঘোষণা করেছে । আর এই যুদ্ধে এরা রাষ্ট্র শক্তির সীমাহীন অপপ্রয়োগ করে চলেছে । বিরুধী মতাবলম্বী ও সাধারণ জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র শক্তির পাশাপাশি দলীয় হায়েনাদের । নিরীহ বিশ্বজিত্‍ দাসের নির্দয় ও নির্মম হত্যাকান্ড এসমস্ত অপকর্মের সামান্য উদাহরণ মাত্র । জেনেশুনে ইচ্ছাকৃতভাবে শুধুমাত্র ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার ঘৃণ্য অভিসন্ধি নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে স্বাধীনতার পক্ষ শক্তি-বিপক্ষ শক্তি নামে এক অভিশপ্ত চেতেনাবোধের । আর এই শয়তানী মতবাদের প্রচার ও প্রসারে অত্যন্ত নগ্নভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে এক শ্রেণীর মিডিয়াকে । অভিশপ্ত এ চেতনার ধোয়া তোলে দিন দিন জাতিকে বিভক্ত, হিংসা ও হানাহানি প্রবণ করে তোলা হচ্ছে । ভাইকে লেলিয়ে দেযা হচ্ছে অপর ভাইয়ের বিরুদ্ধে । যারা সত্য তোলে ধরতে চায় তাদের টুটি চেপে ধরা হচ্ছে । সংবিধান কতৃক স্বীকৃত বাকস্বাধীনতা তথা মতপ্রকাশের অধিকারকে, সভা সমাবেশের অধিকারকে এই অভিশপ্ত চেতনার নামে করা হচ্ছে অবরুদ্ধ । বিষাক্ত এই চেতনার নামে দেশ জুড়ে চলছে হত্যা, গুম, সন্ত্রাস ও জ্বালাও পোড়াও । সর্বক্ষেত্রে সীমাহীন ব্যর্থতার পরও ক্ষমতাসীনরা তা স্বীকার করতে প্রস্তুত নয় । পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতা দূর্নীতি আর জালিয়াতির অভিয়োগ থেকে আত্মরক্ষার জন্য তারা একটি মাত্র ঢালকে অত্যন্ত কদর্য্যভাবে ব্যবহার করছে । আর তা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধের / মানবতাবিরুধী অপরাধের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র তত্ত্ব । অথচ সবাই জানে শেয়ারবাজার লুট করেছে কারা । কাদের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে কালো বিড়ালরা । কারা পদ্মা সেতু নির্মাণ দূর্নীতির সাথে জড়িত । হলমার্ক কেলেংকারীর নাটের গুরু কারা । কারা দেশব্যাপী সীমাহীন হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাস, লুটপাট ও দখলবাণিজ্য ইত্যাদী কায়েম করেছে । স্বাধীনতার স্বঘোষিত চেতনাধারীরা নয় কি ? অথচ ক্ষমতাসীনদের এ অনাচার, অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যারাই আওয়াজ তোলছে, যারাই প্রতিবাদ করছে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী স্বাধীনতা বিরুধীদের দোসর ইত্যাদি আখ্যায়িত করে নির্মম-নির্দয়ভাবে হত্যা, গুম, ধর্ষণ ও নির্যাতন করা হচ্ছে । ইতোমধ্যে গুম করা হয়েছে বিরুধীদলীয় বেশ কয়েক নেতাকর্মীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষকে । অতঃপর নালা নর্দমা ও বনে জঙ্গলে হতভাগ্যদের লাশ পাওয়া যাচ্ছে, কারোত কোন খবরই নেই বেঁচে আছে কি মরে গেছে । কি যে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা বলার মত কোন ভাষা বা শব্দ কোন ভাষায় বা অভিধানে আছে কিনা সন্দেহ ! সুপরিকল্পিত ভাবে জঘণ্য এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে । বসবাসের জন্য দিন দিন অযোগ্য করে তোলা হচ্ছে অপার সম্ভাবনাময় উর্বর এই জনপদটিকে । এই হিংসা এই সন্ত্রাস ও এ সমস্থ নানাবিদ অপকর্মকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পৃষ্টপোষকতা করা হচ্ছে কিসের স্বার্থে ? কাদের স্বার্থে ? ক্ষমতাসীনরা কি ভূলে গেছে নাকি তারা জানেনা এদেশের প্রতিটি মানুষ এ দেশের নাগরিক ? তাদের কি জানা নাই প্রতিটি বিরুধী দলীয় কর্মী বা সরকারদলীয় কর্মী কারো ভাই কারো সন্তান বা কারো না কারো আত্মীয় ? তবে কেন ক্ষমতাশীনরা দেশের প্রতিটা মানুষের মনে প্রতিটা জনপদে হিংসা ও বিভেদকে উসকে দিচ্ছে ? এসমস্থ করে এরা কিসের চেতনা বাস্তবায়ণ করতে চায় ? স্বাধীনতার চেতনা ? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ? ? ? তবে এই হত্যা, সন্ত্রাস, গুম, জ্বালাও পোড়াও ও সীমাহীন লুটপাট এবং দূর্নীতি ই স্বাধীনতার চেতনা মুক্তি যুদ্ধের চেতনা ? ক্ষমতাশীনদের কাছে এর জবাব চাই । জাবাব দিতে হবে অবশ্যই দিতে হবে । আজ আপনারা মসনদে আসীন তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন কিন্তু মনে রাখবেন মসনদ কারো জন্য চিরস্থায়ী নয় । যখন ঐ মসনদ থাকবে না, তখত ও তাজ থাকবে না, যখন সিংহাসন থেকে আস্তাকুরে নিক্ষিপ্ত হবেন তখন এই জনপদের প্রতিটি মানুষ এমন কি প্রতিটি ধূলি কণার কাছে আপনাদেরকে জবাব দিহী করতে হবে কেননা এটাই ইতিহাসের বিচার যদিও তা খুবি নির্দয় ও নির্মম ।

http://www.sonarbangladesh.com/blog/classicpost/138929


No comments:

Post a Comment