জয়পুর চন্ডীগড় একাকার হয়ে গেছে বাঙ্গালি সমাজবিজ্ঞানী ও সাবআলটার্ণ বুদ্ধিজীবীদের দৌলতে!সব শিয়ালের এক রা ! আম্বেদকরের Social Inclusion Doctrine ধবংস কর !
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ « roy1472
roy1472.wordpress.com/tag/মহাপ্রাণ-যোগেন্দ্রনাথ/Jan 28, 2013 – Posts about মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ written by j1472roy. ... বিশেষ করে নমঃশুদ্র,রাজবংশী, শুঁড়ি ও ধোবাদের প্রতি মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথের অবদান কি ছিল ? ... যেহেতুযোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এক সময় দিল্লীর অন্তর্বতী মন্ত্রী সভার আইন মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশনের নেতৃত্ব তাঁকে দেওয়া ...
মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ছিলেন সংগ্রামী নেতা - Gournadi.com
Jan 29, 2011 – জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার মৈস্তারকান্দি গ্রামের মহাপ্রানযোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের জন্মভূমিতে প্রতিষ্ঠিত 'মহাপ্রান যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্মৃতি ... অনুষ্ঠানসূচীর মধ্যে রয়েছে শনিবার সকালে পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডলের প্রতিকৃতিতে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ ও মাল্যদান, শ্রীমদ্ভগবত ...
ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল - দু'শ এগারো বছরের পথপরিক্রমা ...
www.gournadi.com/.../9762-ধান-নদী-খাল-এই-তিনে-মোগো-...Dec 28, 2012 – ... কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, কমরেড নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, কৃষক কুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ। একুশে ফেব্র"য়ারি ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস ...
articles - Gournadi.com
... নমঃশূদ্রের অবিসংবাদিত নেতা এম.এল.এ. মহাপ্রাণ যোগেন্দ্র নাথের উদ্যোগে তৎকালনি বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী মহামান্য এ.কে ফজলুল হক-এর ... তিনিই প্রথম সাশনতান্ত্রিক সভার সভাপতিত্ব করেন। এছাড়াও অবিভক্ত ভারত বাংলা প্রদেশের সাধারন আসন বৃহত্তর বাকেরগঞ্জের পূর্ব-উত্তর এলাকায় ভোটের মাধ্যমে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নির্বাচিত প্রথম এমএলএ।
যে অস্ত্রসম্ভার মার্কিন অর্থব্যবস্থার মুল ভিত্তি - United Black ...
Dec 16, 2012 – তারপর চন্ডাল আন্দোলন ও মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল হয়ে ভারতের বহুজন সমাজ নির্মাণের কাজ এগিয়েছে অবিভক্ত বাংলার তফসিলী, আদিবাসী ও মুসলমানদের হাত ধরে। আম্বেডকরকে সংবিধানসভায় নির্বাচিত করে বাংলার যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল। ভারতে তফসিলীদের, ওবিসিদের সবরকম সাংবিধানিক অধিকারের পিছনে বাংলা। অথচ ভারত ...
ধান-নদী-খাল এই তিনে মোগো বরিশাল - দু'শ এগারো বছরের পথপরিক্রমা ...
www.gournadi.com/.../9762-ধান-নদী-খাল-এই-তিনে-মোগো-...Dec 28, 2012 – ... কবি সুফিয়া কামাল, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা অগ্নিপুরুষ বিপ্লবী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ, কমরেড নলিনী দাস, মনোরমা মাসিমা অমৃত লাল দে, মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল, কৃষক কুলের নয়নমনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতসহ অনেক ক্ষণজন্মা নারী-পুরুষ। একুশে ফেব্র"য়ারি ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ নিয়ে বরিশালের রয়েছে গর্বিত ইতিহাস ...উপমহাদেশের বিভক্তি ও কিছু কথা | The Daily Sangram
www.dailysangram.com/news_details.php?news_id... - BangladeshJan 31, 2013 – মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (বাংলা) আই আই চুন্দ্রীগড় (বোম্বাই), সরদার আবদুর রব নিশতার (সীমান্ত), গজনফর আলি (পাঞ্জাব) ও লিয়াকত আলী খান ....এর দুই যুগ আগে মহাপ্রাণ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখের সাথে স্যার আবদুর রহীম, শেরে বাংলা ফজরুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখরা ...
Sri Sri Harichand Thakur Shridham Thakurnagar | Facebook
মহাপ্রাণ যোগেন্দ্রনাথ –রনজিত কুমার সিকদার ডঃ আম্বেদকর প্রকাশনীর বিষয়ঃ-লকুড় কমিটির সুপারিশের প্রতিবাদে যোগেন্দ্রনাথ ১৯৬৬ সালের একটি ঘটনা পশ্চিম বঙ্গে তফসিলী ... যেহেতুযোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এক সময় দিল্লীর অন্তর্বতী মন্ত্রী সভার আইন মন্ত্রী ছিলেন, সেহেতু প্রধান মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির কাছে ডেপুটেশনের নেতৃত্ব তাঁকে দেওয়া হয়।Nov 2, 2003 – এদের নেতা ছিল যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। যোগেন্দ্রনাথ পরে কায়েদে আযমের ইচ্ছায় অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্য হয়েছিলেন ও পরবর্তীকালে পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী হিসেবে সুদীর্ঘ সময় কাজ করেছেন। পাকিস্তানের নির্বাচনী প্রচারের সময় যোগেন্দ্রনাথ কি কারণে আসতে পারেননি তা জানা নেই। তখন আমরা রসরাজ মন্ডলকে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল ...
নির্বাচন কমিশনের সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে শুক্রবার একতরফাভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করল রাজ্য সরকার। পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের এই অনড় মনোভাবের জেরে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্ক। সরকারের এই সিদ্ধান্ত অসাংবিধানিক বলেই মনে করেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ ব্যানার্জি। তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে রাজনৈতিক বিরোধীরাও।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দাবি ছিল, অবাধ এবং সুস্থ নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর পাহারায় তিন দফায় হোক পঞ্চায়েত নির্বাচন। তবে নির্বাচনের কমিশনের সবকটি প্রস্তাবই নাকচ করে দিল রাজ্য সরকার।
এর পরেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয় প্রতিক্রিয়ার ঝড়। সংবিধানের ২৪৩ কে ধারা অনুযায়ী পঞ্চায়েত নির্বাচনের বিষয়ে সর্বোচ্চ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনরই। রাজ্য সরকার একতরফাভাবে নির্বাচনের দিন ঘোষণা করে সংবিধানের সেই ধারাকেই খর্ব করছে। এমনটাই মত হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতী প্রসাদ ব্যানার্জির।
রাজ্য সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তের জেরে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিতর্কও। কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের অভিযোগ, পঞ্চায়েত ভোটকে প্রহসনে পরিণত করতে চাইছে রাজ্য সরকার। তাঁর দাবি, সরকারের এই চক্রান্ত মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে কংগ্রেস।
রাজ্য সরকারের এই অনড় মনোভাবের প্রেক্ষিতে অবশ্য এখনই কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে রাজি হননি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি বলেছেন, পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা হয়েছে দেখলাম। নির্বাচন পরিচালনার সাংবিধানিক দায়িত্ব যাঁদের তাঁরা কী বলেন তা দেখে প্রতিক্রিয়া জানাব।
রাজ্য সরকার যেভাবে পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিনঘোষণা করেছে তা অবৈধ। এমনটাই মত বিজেপির রাজ্য সভাপতির রাহুল সিনহার। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার ইঙ্গিতও দিয়েছেন তিনি।
রাজ্য সরকারের এই সিদ্ধান্তে বিতর্কের ঝড় বিভিন্ন মহলেও। গার্ডেনরিচকাণ্ডের জেরে ছমাসের জন্য সব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এই অবস্থায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ছাড়াই দু`দফায় এতোবড় পঞ্চায়েত ভোট সুষ্ঠুভাবে আদৌ করানো সম্ভব কিনা তা নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
অন্যদিকে, পঞ্চায়েত ভোটে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সমস্ত প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়ার ঘটনাও আগে কখনও ঘটেনি। তাই প্রশ্নের মুখে রাজ্য সরকারের এই নজিরবিহীন আচরণও।
Palash Biswas, lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia.
Palash Biswas, lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia.
http://youtu.be/lD2_V7CB2Is
today from Kolkota and, told he supports the idea of forming SAARC type of 'Peoples' Level International Forum' of the Indigenous Peoples, Dalits and Other Backward communities to advance their rights to social justice and economic development in the entire South Asia.
He also lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia.
http://www.youtube.com/watch?v=lD2_V7CB2Is
--
यह तेलतुंबड़े के खिलाफ हस्तक्षेप और तथाकथित मार्क्सवादियों का षडयंत्र है !
भारतीय बहुजन आन्दोलन के निर्विवाद नेता अंबेडकर ही हैं
भावनात्मक कार्ड खेलकर आप तर्क और विज्ञान को तिलांजलि नहीं दे सकते
कुत्सा प्रचार और प्रति-कुत्सा प्रचार की बजाय एक अच्छी बहस को मूल मुद्दों पर ही केंद्रित रखा जाय
Reply of Abhinav Sinha on Dr. Teltumbde
तथाकथित मार्क्सवादियों का रूढ़िवादी और ब्राह्मणवादी रवैया
हाँ, डॉ. अम्बेडकर के पास दलित मुक्ति की कोई परियोजना नहीं थी
अम्बेडकरवादी उपचार से दलितों को न तो कुछ मिला है, और न ही मिले
अगर लोकतन्त्र और धर्मनिरपेक्षता में आस्था हैं तो अंबेडकर हर मायने में प्रासंगिक हैं
हिन्दू राष्ट्र का संकट माथे पर है और वामपंथी अंबेडकर की एक बार फिर हत्या करना चाहते हैं!
- because of the hatred for the Brahmanism, Ambedkar failed to understand the conspiracy of colonialism
- All experiments of Dalit emancipation by Dr. Ambedkar ended in a 'grand failure'
- Ambedkar's politics does not move an inch beyond the policy of some reforms
- दलित मुक्ति को अंजाम तक पहुँचाने के लिए अम्बेडकर से आगे जाना होगा
- ब्राह्मणवाद के विरुद्ध अपनी नफरत के कारण अंबेडकर उपनिवेशवाद की साजिश को समझ नहीं पाये
- अंबेडकर के सारे प्रयोग एक ''महान विफलता'' में समाप्त हुये – तेलतुंबड़े
Protesting Dalit Hindu Persecution:
Pakistan's First Law Labour Minister's Resignation Letter
May 2, 2002
Full TEXT OF THE RESIGNATION LETTER BY:
Mr. J.N. Mandal,
Minister for Law and Labour,
Government of Pakistan
On 8th October, 1950
My Dear Prime Minister,
It is with a heavy heart and a sense of utter frustration at the
failure of my life-long mission to uplift the backward Hindu masses of East
Bengal that I feel compelled to tender resignation of my membership of
your Cabinet. It is proper that I should set forth in detail the
reasons, which have prompted me to take this decision in this important
juncture of the history of Indo-Pakistan Sub-continent.
(1) Before I narrate the remote and immediate causes of my resignation,
it may be useful to give a short background of important events that
have taken place during the period of my co-operation with the League,
Having been approached by a few prominent League leaders of Bengal in
February 1943, I agreed to work with them in the Bengal Legislative
Assembly. After the fall of the Fazlul Haque Ministry in March 1943, with a
party of 21 Scheduled Caste M.L.As, I agreed to co-operate with Khwaja
Nazimuddin, the then leader of the Muslim League Parliamentary party who
formed the Cabinet in April 1943. Our co-operation was conditional on
some specific terms in the such as the inclusion of three Scheduled
Caste Ministers in the Cabinet, sanctioning of a sum of Rupees five lakhs
(Rs. 500,000) as annual recurring grant for the education of the
Scheduled Castes, and unqualified implementation of the communal ratio rules
in the matter of appointment to Government services.
(2) Apart from those terms, the principal objectives that prompted me
to work in co-operation with Muslim League was, first that the economic
interests of the Muslim in Bengal generally were identical with those
of the Scheduled Castes. Muslims were mostly cultivators and labourers,
so were members of the Scheduled Castes. One section of Muslims was
fishermen, so was a section of Scheduled Castes as well and, secondly,
that the Scheduled Castes and Muslims were both educationally backward. I
was persuaded that my co-operation with the League and its Ministry
would lead to the undertaking on a wide scale of legislative and
administrative measures which, while promoting the mutual welfare of the vast
bulk of Bengal's population and undermining the foundations of vested
interest and privilege, would further the cause of communal peace and
harmony. It may be mentioned here that Khwaja Nazimuddin took three
Scheduled Caste Ministers in this Cabinet and appointed three Parliamentary
Secretaries from amongst the members of my community.
SUHRAWARDY MINISTRY
(3) After the general election held in March 1946, Mr. H.S. Suhrawardy
became the leader of the League Parliamentary Party and formed the
League Ministry in April 1946. I was the only Scheduled Caste member
returned to the Federation ticket. I was included in Mr. Suhrawardy's
cabinet. The 16th day of August of that year was observed as "The Direct
Action Day" by the Muslim League. It resulted, in a holocaust.. Hindus
demanded my resignation from the League ministry. My life was in peril. I
began to receive threatening letters almost every day. But I remained
steadfast to my policy. Moreover, I issued an appeal through our journal
"Jagaran" to the Scheduled Caste people to keep themselves aloof from
the bloody feud between the Congress and the Muslim League even at the
risk of my life. I cannot but gratefully acknowledge the fact that I was
saved from the wrath of infuriated Hindu mobs by my Caste Hindu
neighbours. The "Noakhali Riot" followed the Calcutta carnage in October 1946.
There, Hindus including Scheduled Castes were killed and hundreds were
converted to Islam. Hindu women were raped and abducted. Members of my
community also suffered loss of life and property. Immediately after
these happenings, I visited Tipperah and Feni and saw some riot-affected
areas. The terrible sufferings of Hindus overwhelmed me with grief, but
still I continued the policy of co-operation with the Muslim League.
Immediately after the massive Calcutta Killing, a no-confidence motion
was moved against the Suhrawardy Ministry. It was only due to my efforts
that the support of four Anglo-Indian Members and four Scheduled Caste
members of the Assembly who had hitherto been with the Congress could
be secured, but for which the Ministry would have been defeated.
(4) In October 1946, most unexpectedly came to me through Mr.
Suhrawardy the offer of a seat in the Interim Government of India. After a good
deal of hesitation and being given only one hour's time to take my
final decision, I consented to accept the offer subject to the condition
only that I should be permitted to resign if my leader, Dr. B. R.
Ambedkar disapproved of my action. Fortunately, however, I received his
approval in a telegram sent from London. Before I left for Delhi to take over
as Law Member, I persuaded Mr. Suhrawardy, the then Chief Minister of
Bengal, to agree to take two Ministers in his Cabinet in my place and to
appoint two Parliamentary Secretaries from the Scheduled Caste
Federation Group.
(5) I joined the Interim Government on November 1, 1946. After about a
month when I paid a visit to Calcutta, Mr. Suhrawardy apprised me of
the communal tension in some parts of East Bengal, especially in
Gopalganj Sub-division, where the Namasudras were in majority, being very high.
He requested me to visit those areas and address meetings of Muslims
and Namasudras. The fact was that Namasudras in those areas had made
preparations for retaliation. I addressed about a dozen of largely attended
meetings. The result was that Namasudras gave up the idea of
retaliation. Thus an inevitable dangerous communal disturbance was averted.
(6) After a few months, the British Government made their June 3
Statement (1947) embodying certain proposals for the partition of India. The
whole country, especially the entire non-Muslim India, was startled.
For the sake of truth I must admit that I had always considered the
demand of Pakistan by the Muslim League as a bargaining counter. Although I
honestly felt that in the context India as a whole Muslims had
legitimate cause for grievance against upper class Hindu chauvinism, I held the
view very strongly indeed that the creation of Pakistan would never
solve the communal problem. On the contrary, it would aggravate communal
hatred and bitterness. Besides, I maintained that it would not
ameliorate the condition of Muslims in Pakistan. The inevitable result of the
partition of the country would be to prolong, if not perpetuate, the
poverty, illiteracy and miserable condition of the toiling masses of both
the States. I further apprehended that Pakistan might turn to be one of
the most backward and undeveloped countries of the South East Asia
region.
LAHORE RESOLLUTION
(7) I must make it clear that I have thought that an attempt would be
made, as is being done at present, to develop Pakistan as a purely
'Islamic' State based on the Shariat and the injunctions and formularies of
Islam. I presumed that it would be set up in all essentials after the
pattern contemplated in the Muslim League resolution adopted at Lahore
on March 23, 1940. That resolution stated inter alia that (1)
"geographically contiguous areas are demarcated into regions which should be
constituted with such territorial readjustments as may be necessary, that
the areas in which the Muslims are numerically in majority as in the
north- Western and eastern zones of India, should be grouped to constitute
independent States in which the Constituent units shall be autonomous
and sovereign " and (2) " adequate, effective and mandatory safeguards
should be specifically provided in the Constitution for minorities in
these units and in these regions for the protection of their religious,
cultural, economic, political, administrative and other rights and
interests in consultation with them." Implicit in this formula were (a) that
North western and eastern Muslim zones should be constituted into two
Independent States, (b) that the constituent units of these States
should be autonomous and sovereign, (c) that minorities guarantee should be
in respect of rights as well as of interest and extend to every sphere
of their lives, and (d) that Constitutional provisions should be made
in these regards in consultation with the minorities themselves. I was
fortified in my faith in this resolution and the professions of the
League Leadership by the statement Quaid-e-Azam Mohammed Ali Jonah was
pleased to make on the 11th August 1947 as the President of the Constituent
Assembly giving solemn assurance of equal treatment for Hindus
Muslims alike and calling upon them to remember that they were all
Pakistanis. There was then no question of dividing the people on the basis of
religion into full- fledged Muslim citizens and gummies being under the
perpetual custody of the Islamic State and its Muslim citizens. Every one
of these pledges is being flagrantly violated apparently to your
knowledge and with your approval in complete disregard of the Quaid-e-Azam's
wishes and sentiments and to the detriment and humiliation of the
minorities.
PARTITION OF BENGAL
(8) It may also be mentioned in this connection that I was opposed to
the partition of Bengal. In launching a campaign in this regard I had to
face not only tremendous resistance from all quarters but also
unspeakable abuse, insult and dishonour. With great regret, I recollect those
days when 32 crores of Hinduism opposed my cations, but I remained
undaunted and unmoved in my loyalty to Pakistan. It is a matter of gratitude
that my appeal to 7 million Scheduled Caste people of Pakistan evoked a
ready and enthusiastic response from them. They lent me their unstinted
support sympathy and encouragement.
(9) After the establishment of Pakistan on August 14, 1947 you formed
the Cabinet, in which I was included and Khwaja Nazimuddin formed a
provisional Cabinet for East Bengal. On August 10, I had spoken to Khwaja
Nazimuddin at Karachi and requested him to take 2 Scheduled Caste
Ministers in the East Bengal Cabinet. He promised to do the same sometime
later.
What happened subsequently in this regard was a record of unpleasant
and disappointing negotiations with you, Khwaja Nazimuddin and Mr. Nurul
Amin, the present Chief Minister of East Bengal. When I realised that
Khwaja Nazimuddin was avoiding the issue on this or that excuse, I
became almost impatient and exasperated, I further discussed the matter with
the Presidents of the Pakistan Muslim League and its East Bengal
Branch. Ultimately, I brought the matter to your notice. You were pleased to
discuss the subject with Khwaja Nazimuddin in my presence at your
residence. Khwaja Nazimuddin agreed to take one Scheduled Caste Minister on
his return to Dacca. As I had already become skeptic about the
assurance of Khwaja Nazimuddin, I wanted to be definite about the time limit. I
insisted that he must act in this regard within a month, failing which
I should be at liberty to resign. Both you and Khwaja Nazimuddin agreed
to the condition. But, alas! You did not perhaps mean what you said.
Khwaja Nazimuddin did not keep his promise. After Mr. Nurul Amin had
become the Chief Minister of East Bengal, I again took up the matter with
him. He also followed the same old familiar tactics of evasion. When I
again called your attention to his matter prior to your visit to Dance
in 1949, you were pleased to assure me that a Minority Minister would be
appointed in East Bengal, and you asked 2-3 names from me for
consideration. In stat deference to your wish, I sent you a note stating the
Federation Group in the East Bengal Assembly and suggesting three names.
When I made enquiries as to what had happened on your return from Dacca,
you appeared to be very cold and only remarked: "Let Nurul Amin return
from Delhi". After a few days I again pressed the matter.
ANTI-HINDU POLICY
(10) When the question of partition of Bengal arose, the Scheduled
Caste people were alarmed at the anticipated dangerous result of partition.
Representation on their behalf were made to Mr. Suhrawardy, the then
Chief Minister of Bengal who was pleased to issue a statement to the
press declaring that none of the rights and privileges hitherto enjoyed by
the Scheduled Caste people would be curtailed after partition and that
they would not only continue to enjoy the existing rights and
privileges but also receive additional advantages. This assurance was given by
Mr. Suhrawardy not only in his personal capacity but also in his
capacity as a Chief Minister of the League Ministry. To my utter regret it is
to be stated that after partition, particularly after the death of
Quaid-e-Azam, the Scheduled Castes have not received a fair deal in any
matter. You will recollect that from time to time I brought the grievances
of the Scheduled Castes to your notice. I explained to you on several
occasions the nature of inefficient administration in East Bengal. I
made serious charges against the police administration. I brought to your
notice incidents of barbarous atrocities perpetrated by the police on
frivolous grounds. I did not hesitate to bring to your notice the
anti-Hindu policy pursued by the East Bengal government especially the police
administration and a section of Muslim League leaders.
SOME INCIDENTS
(11) The first incident that shocked me took place at a village called
Digharkul near Gopalganj where on the false complaint of a Muslim,
brutal atrocities were committed on the local Namasudras. The fact was that
a Muslim who was going in a boat attempted to throw his net to catch
fish. A Namasudra who was already there for the same purpose opposed to
throwing of the net in his front. This was followed by some altercations
and the Muslim got annoyed who went to a nearby Muslim village and made
a false complaint that he and a woman in his boat had been assaulted by
the Namasudras. At the time, the S.D.O. of Gopalganj was passing in a
boat through the canal who without making any enquiry accepted the
complaint as true and sent armed police to the spot to punish the Namasudra.
The armed police came and the local Muslims also joined them. They not
only raided some houses of the Namasudras but mercilessly beat both men
and women, destroyed their properties and took away valuables. The
merciless beating of a pregnant woman resulted in abortion on the spot.
This brutal action on the part of the local authority created panic over a
large area.
(12) The second incident of police repression took place in early part
of 1949 under P.S. Gournadi in the district of Barisal. Here a quarrel
took place between two groups of members of a Union Board. One Group
which was in the good book of the Police conspired to punish the
opponents on the plea of attack on the Police Station, the O.C., Gournadi
requisitioned armed forces from headquarters. The Police, helped by the
armed forces, then raided a large number of houses in the area, took away
valuable properties, even from the houses of absentee-owners who were
never in politics, far less in the Communist Party. A large number of
students of many High English Schools were Communist suspects and
unnecessarily harassed. This area being very near to my native village, I was
informed of the incident. I wrote to the District Magistrate and the
S.P. for an enquiry. A section of the local people also prayed for an
enquiry by the S.D.O. But no enquiry was held. Even my letters to the
District authorities were not acknowledged. I then brought this matter to
the notice of the highest Authority in Pakistan, including yourself but
to no avail.
WOMEN FOR MILITARY
(13) The atrocities perpetrated by the police and military on the
innocent Hindus, especially the Scheduled Caste of Harbinger in the Dist. of
Sleet deserve description. Innocent men and women were brutally
tortured, some women ravished, their houses raided and properties looted by
the police and the local Muslims. Military pickets were posted in the
area. The military not only oppressed these people and took away stuffs
forcibly from Hindus houses, but also forced Hindus to send their
women-folk at night to the camp to satisfy the carnal desire of the military.
This fact also I brought to your notice. You assured me of a report on
the matter, but unfortunately no report was forthcoming.
(14) Then occurred the incident at Nachole in the District of Rajshahi
where in the name of suppression of Communists not only the police but
also the local Muslims in collaboration with the police oppressed the
Hindus and looted their properties. The Santhals then crossed the border
and came over to West Bengal. They narrated the stories of atrocities
wantonly committed by the Muslims and the police.
(15) An instance of callous and cold-blooded brutality is furnished by
the incident that took place on December 20, 1949 in Kalshira under
P.S. Mollarhat in the District of Khulna. What happened was that late at
night four constables raided the house of one Joydev Brahma in village
Kalshira in search of some alleged Communists. At the scent of the
police, half a dozen of young men, some of whom might have been Communists,
escaped from the house. The police constable entered into the house and
assaulted the wife of Joydev Brahma whose cry attracted her husband and
a few companions who escaped from the house. They became desperate,
re-entered the house, found 4 constables with one gun only. That perhaps
might have encouraged the young men who struck a blow on an armed
constable who died on the spot. The young men then attacked another constable
when the other two ran away and raised alarm which attracted some
neighbouring people who came to their rescue. As the incident took place
before sunrise when it was dark, the assailants fled with dead body before
the villagers could come. The S.P. of Khulna with a contingent of
military and armed police appeared on the scene in the afternoon of the
following day. In the meantime, the assailants fled and the intelligent
neighbours also fled away. But the bulk of the villagers remained in their
houses, as they were absolutely innocent and failed to realise the
consequence of the happening. Subsequently the innocents of the entire
village encouraged the neighbouring Muslims to take away their properties.
A number of persons were killed and men and women were forcibly
converted. House- hold deities were broken and places of worship desecrated
and destroyed. Several women were raped by the police, military and local
Muslims. Thus a veritable hell was let loose not only in the village of
Kalshira which is half miles in length with a large population, but
also in a number of neighbouring Namasudra villages. The village Kalshira
was never suspected by the authority to be a place of Communist
activities. Another village called Jhalardanga, which was at a distance of 3
miles from Kalshira, was known to be a centre of Communist activities.
This village was raided by a large contingent of police on that day for
hunt of the alleged Communists, a number of whom fled away and took
shelter in the aforesaid house of village Kalshira which was considered to
be a safe place for them.
(16) I visited Kalashira and one or two neighboring villages on the
28th February 1950. The S.P., Khulna and some of the prominent League
leaders of the district were with me. When I came to the village Kalshira,
I found the place desolate and in ruins. I was told in the presence of
S.P.that there were 350 homesteads in this village; of these, only
three had been spared and the rest had been demolished. Country boats and
heads of cattle belonging to the Namasudras had been all taken away. I
reported these facts to the Chief Minster, Chief Secretary and Inspector
General of Police of East Bengal and to you.
(17) It may be mentioned in this connection that the news of this
incident was published in West Bengal Press and this created some unrest
among the Hindus there. A number of sufferers of Kalshira, both men and
women, homeless and destitute had also come to Calcutta and narrated the
stories of their sufferings which resulted in some communal
disturbances in West Bengal in the last part of January.
CAUSES OF THE FEBRUARY DISTURBANCE
(18) It must be noted that stories of a few incidents of communal
disturbance that took place in West Bengal as a sort of repercussion of the
incidents at Kalshira were published in exaggerated form in the east
Bengal press. In the second week of February 1950 when the Budget Session
of the East Bengal Assembly commenced, the Congress Members sought
permission to move two-adjournment motion to discuss the situation created
at Kalshira and Nachole. But the motions were disallowed. The congress
Member walked out of the Assembly in protest. This action of the Hindu
Members of the Assembly annoyed and enraged not only the Ministers but
also the Muslim leaders and officials of the Province. This was perhaps
one of the principal reasons for Dacca and East Bengal riots in
February 1950.
(19) It is significant that on February 10, 1950 at about 10 O'clock in
the morning a woman was painted with red to show that her breast was
cut off in Calcutta riot, and was taken round that East Bengal
Secretariat at Dacca. Immediately, the Government servants of the Secretariat
struck work and came out in procession raising slogans of revenge against
the Hindus. The procession began to swell as it passed over a distance
of more than a mile. It ended in a meeting at Victoria Park at about
12O'clock in the noon where violent speeches against the Hindus were
delivered by several speakers, including officials. The fun of the whole
show was that while the employees of the Secretariat went out in
procession, the chief Secretary of the East Bengal Government was holding a
conference with his West Bengal counterpart in the same building to find
out ways and means to stop communal disturbances in the two Bengals.
OFFICIALS HELPED LOOTERS
(20) The riot started at about 1 p.m. simultaneously all over the city.
Arson, looting of Hindu shops and houses and killing of Hindus,
wherever they were found, commenced in full swing in all parts of the city. I
got evidence even from the Muslims that arson and looting were
committed even in the presence of high police officials. Jewellery shops
belonging to the Hindus were looted in the presence of police officers. They
not only did not attempt to stop loot, but also helped the looters with
advice and direction. Unfortunately for me, I reached Dacca at 5
O'clock in the afternoon on the same day, in Feb.10,1950.To my utter dismay,
I had occasion to see and know things from close quarters. What I saw
and learnt from first hand information was simply staggering and
heart-rending.
BACKGROUND OF THE RIOT
(21) The reasons for the Dacca riot were mainly five:
(i) To punish the Hindus for the daring action of their representatives
in the Assembly in their expression of protest by walking out of the
Assembly when two adjournment motions on Kashira and Nachole affairs were
disallowed;
(ii) Dissensions and difference between the Suhrawardy Group and the
Nazimuddin in the Parliamentary Party were becoming acute;
(iii) Apprehension of launching of a movement for re-union of East and
West Bengal by both Hindu and Muslim leaders made the East Bengal
Ministry and the Muslim League nervous. They wanted to prevent such a move.
They thought that any large scale communal riot in East Bengal was sure
to produce reactions in West Bengal were Muslims might be killed. The
result of such riot in both East and East Bengal, it was believed, would
prevent any movement for re-union of Bengals.
(iv) Feeling of Antagonism between the Bengalee Muslim and non-Bengalee
Muslim in East Bengal was gaining ground. This could only be prevented
by creating hatred between Hindus and Muslims of East Bengal. The
language question was also connected with it and
(v) The consequences of non-devaluation and Indo-Pakistan trade
deadlock to the economy of East Bengal were being felt most acutely first in
urban and rural areas and the Muslim League members and officials wanted
to divert the attention of the Muslim masses from the impending
economic breakdown by some sort of jehad against Hindus.
STAGGERING DETAILS - NEARLY 10,000 KILLED
(22) During my nine days' stay at Dacca , I visited most of the riot-
affected areas of the city and suburbs. I visited Mirpur also under
P.S.Tejgaon. The news of the killing of hundreds of innocent Hindus in
trains, on railway lines between Dacca and Narayanganj, and Dacca and
Chittagong gave me the rudest shock. on the second day of Dacca riot, I met
the Chief Minister of east Bengal and requested him to issue immediate
instructions to the District authorities to take all precautionary
measures to prevent spreading of the riot in district towns and rural
areas. On the 20th February 1950, I reached Barisal town and was astounded
to know of the happenings in Barisal. In the District of Hindus killed.
I visited almost all riot-affected areas in the District. I was simply
puzzled to find the havoc wrought by the Muslim rioters even at places
like Kasipur, Madhabpasha and Lakutia, which were within a radius of
six miles from the District town and were connected with motor able
roads. At the Madhabpasha Zaminder's house, about 200 people were killed and
40 injured. A Place, called Muladi, witnessed a dreadful hell. At
Muladi Bandar alone, the number killed would total more than three hundred,
as was reported tome by the local Muslims including some officers. I
visited Muladi village also, where I found skeletons of dead bodies at
some places. I found dogs and vultures eating corpses on the riverside. I
got the information there that after the whole-scale killing of all
adult males, all the young girls were distributed among the ringleaders of
the miscreants. At a place told Kaibartakhali under P.S. Rajapur, 63
persons were killed. Hindu houses within a stone's throw distance from
the said Thana office were looted, burnt and inmates killed. All Hindu
shops of Babuganj Bazar were looted and then burnt and a large number of
Hindus were killed. From detailed information received, the
conservative estimate of casualties was placed at 2,500 killed in the District of
Barisal alone. Total casualties of Dacca and East Bengal riot were
estimated to be in the neighbourhood of 10,000 killed. I was really
overwhelmed with grief. The lamentation of women and children who had lost
their all including near and dear ones melted my hearts. I only asked
myself. "What was coming to Pakistan in the name of lslam".
NO EARNEST DESIRE TO IMPLEMENT DELHI PACT
(23) The large-scale exodus of Hindus from Bengal commenced in the
latter part of March. It appeared that within a short time all the Hindus
would migrate to India. Aware cry was raised in India. The situation
became extremely critical. A national calamity appeared to be inevitable.
The apprehended disaster, however, was avoided by the Delhi Agreement
of April 8. With a view to reviving the already lost morale of the
panicky Hindus, I undertook an extensive tour of East Bengal. I visited a
number of places in the districts of Dacca, Barisal, Faridpur, Khulna and
Jessore. I addressed dozens of largely attended meeting and asked the
Hindus to take courage and not to leave their ancestral hearths and
homes. I had this expectation that the East Bengal Govt. and Muslim League
leaders would implement the terms of the Delhi Agreement. But with the
lapse of time, I began to realise that neither the East Bengal Govt.
nor the Muslim League leaders were really earnest in the matter of
implementation of the Delhi Agreement. The East Bengal Govt. was not only
much to set up a machinery as envisaged in the Delhi Agreement, but also
was not willing it take effective steps for the purpose. A number of
Hindus who returned to native village immediately after the Delhi
Agreement were not given possession of their homes and lands, which were
occupied in the meantime by the Muslims.
MOULANA AKRAM KHAN'S INCITATIONS
(24) My suspicion about the intention of League leaders was confirmed
when I read editorial comments by Moulana Akram Khan, the President of
the Provincial Muslim League in the "Baisak" issue of a monthly journal
called Mahammadi. In commenting on the first radio-broadcast of Dr.
A.M. Malik, Minister for Minority Affairs of Pakistan, from Dacca Radio
Station, wherein he said, "Even Prophet Mahammed had given religious
freedom to the Jews in Arabia", Moulana Akram Khan said, "Dr. Malik would
have done well had he not made any reference in his speech to the Jews
of Arabia. It is true that Jews in Arabia had been given religious
freedom by Prophet Mahammed; but it was the first chapter of the history.
The last chapter contains the definite direction of prophet Mahammed
which runs as follows :-"Drive away all the Jews out of Arabia". Even
despite this editorial comment of a person who held a very high position in
the political, social and spiritual life of the Muslim community, I
entertained some expectation that the Nurul Amin Ministry might not be so
insincere. But that expectation of mine was totally shattered when Mr.
Nurul Amin selected D.N. Barari as a Minister to represent the
minorities in terms of the Delhi Agreement which clearly states that to restore
confidence in the mind of the minorities one of their representatives
will be taken in the Ministry of East Bengal and West Bengal Govt.
NURUL AMIN GOVT'S. INSINCERITY
(25) In one of my public statement , I expressed the view that
appointment of D.N. Barari as a Minister representing the minorities not only
did not help restore any confidence, but, on the contrary, destroyed all
expectations or illusion, if there was any in the minds of the
minorities about the sincerity of Mr. Nurul Amin Govt. my own reaction was that
Mr. Nurul Amin's Govt. was not only insincere but also wanted to defeat
the principal objectives of the Delhi Agreement. I again repeat that
D.N. Barari does not represent anybody except himself. He was returned to
the Bengal Legislative Assembly on the Congress ticket with the money
and organisation of the Congress. He opposed the Scheduled Caste
Federation candidates. Some time after his election, he betrayed the Congress
and joined the Federation. When he was appointed a Minister he had
ceased to be a member of the Federation too. I know that East Bengal Hindus
agree with me that by antecedents, character and intellectual
attainments Barari is not qualified to hold the position of a Minister as
envisaged in the Delhi Agreement.
(26) I recommended three names to Mr. Nurul Amin for this office. One
of the persons I recommended was an M.A., LL.B., Advocate, Dacca High
Court. He was Minister for more than 4 years in the first Fazlul Huq
Ministry in Bengal. He was chairman of the Coal Mines Stowing Board,
Calcutta, for about 6 years. He was the senior Vice-President of the
Scheduled Caste Federation. My second nominee was a B.A.,LL.B. He was a member
of the Legislative Council for 7 years in the pre-reform regime. I
would like to know what earthly reasons there might be for Mr. Nurul Amin
in not selecting any of these two gentlemen and appointing instead a
person whose appointment as Minister I strongly objected to for very
rightly considerations. Without any fear of contradiction I can say that
this action of Mr. Nurul Amin in selecting Barari as a Minister in terms
of the Delhi Agreement is conclusive proof that East Bengal Govt. was
neither serious nor sincere in its profession about the terms of the
Delhi Agreement whose main purpose is to create such conditions as would
enable the Hindus to continue to live in East Bengal with a sense of
security to their life, property, honour and religion.
GOVT. PLAN TO SOUEEZE OUT HINDUS
(27) I would like to reiterate in this connection my firm conviction
that East Bengal Govt. is still following the well-planned policy of
squeezing Hindus out of the Province. In my discussion with you on more
than one occasion, I gave expression to this view of mine. I must say that
this policy of driving out Hindus from Pakistan has succeeded
completely in West Pakistan and is nearing completion in East Pakistan too. The
appointment of D.N. Barari as a Minister and the East Bengal
Government's unceremonious objection to my recommendation in this regard strictly
conform to name of what they call an Islamic State. Pakistan has not
given the Hindus entire satisfaction and a full sense of security. They
now want to get rid of the Hindu intelligentsia so that the political,
economic and social life of Pakistan may not in any way be influenced by
them.
EVASIVE TACTICS TO SHELVE JOINT ELECTORATE
(28) I have failed to understand why the question of electorate has not
yet been decided. It is now three years that the minority Sub-Committee
has been appointed. It sat on three occasions. The question of having
joint or separate electorate came up for consideration at a meeting of
the Committee held in December last when all the representatives of
recognised minorities in Pakistan expressed their view in support of joint
Electorate with reservation of seats for backward minorities. We, on
behalf of the Scheduled Castes think this matter again came up for
consideration at a meeting called in August last. But without any discussion
whatsoever on this point, the meeting was adjourned sine die. It is not
difficult to understand what the motive is behind this kind of evasive
tactics in regard to such a vital matter on the part of Pakistan's
rulers.
DISMAL FUTURE FOR HINDUS
(29) Coming now to the present condition and the future of Hindus in
East Bengal as a result of the Delhi Agreement, I should say that the
present condition is not only unsatisfactory but absolutely hopeless and
that the future completely dark and dismal Confidence of Hindus in East
Bengal has not been restored in the least. The Agreement is treated as
a mere scrap of paper alike by the East Bengal Government and the
Muslim League.
That a pretty large number of Hindu migrants, mostly Scheduled Caste
cultivators are returning to East Bengal is no indication that confidence
has been restored. It only indicates that their stay and rehabilitation
in West Bengal, or elsewhere in the Indian Union have not been
possible. The sufferings of refugee life are compelling them to go back to
their homes. Besides, many of them are going back to bring movable articles
and settle or dispose of immovable properties. That no serious communal
disturbance has recently taken place in East Bengal is not to be
attributed to the Delhi Agreement. It could not simply continue even if there
were no Agreement or Pact.
(30) It must be admitted that the Delhi Pact was not an end in itself.
It was intended that such conditions would be created as might
effectively help resolve so many disputes and conflict existing between India
and Pakistan. But during this period of six months after the Agreement,
no dispute or conflict has readily been resolved. On the contrary,
communal propaganda and anti-India propaganda by Pakistan both at home and
abroad are continuing in full swing. The observance of Kashmir Day by
the Muslim League all over Pakistan is an eloquent proof of communal
anti-India propaganda by Pakistan. The recent speech of the Governor of
Punjab (Pak) saying that Pakistan needed a strong Army for the security
of Indian Muslims has betrayed the real attitude of Pakistan towards
India. It will only increase the tensions between the two countries.
WHAT IS HAPPENING IN E. BENGAL TODAY
(31) What is to the condition in East Bengal? About fifty lakhs of
Hindus have left since the partition of the country. Apart from the East
Bengal riot of last February, the reasons for such a large-scale exodus
of Hindus are many. The boycott by the Muslims of Hindu lawyers, medical
practitioners, shopkeepers, traders and merchants has compelled Hindus
to migrate to West Bengal in search of their means of livelihood.
Wholesale requisition of Hindu houses even without following due process of
law in many and non-payment of any rent whatsoever to the owners have
compelled them to seek for Indian Shelter, Payments rent to Hindu
landlords was stopped long before. Beside, the Ansars against whom I received
complaints all over are a standing menace to the safety and security of
Hindus. Interference in matters of education and methods adopted by the
Educational Authority for Islamisation frightened the teaching staff of
Secondary Schools and Colleges out of their old familiar moorings. They
have left East Bengal. As a result, most of the educational
institutions ago the Educational Authority issued circular to Secondary Schools
enjoining compulsory participation of teachers and student of all
communities in recitation from the Holy Koran before the school work
commenced, Another circular requires Headmasters of schools to name the
different blocks of the premises after 12 distinguished Muslims, such as,
Jinnah, Iqbal, Liaquat Ali, Nazimuddin, etc. Only very recently in an
educational conference held at Dacca, the President disclosed that out of
1,500 High English Schools in East Bengal, only 500 were working. Owing to
the migration of medical practitioners there is hardly any means of
proper treatment of patients. Almost all the priests who used to worship
the household deities at Hindu houses have left. Important places of
worship have been abandoned. The result is that the Hindus of East Bengal
have got now hardly any means to follow religious pursuits and perform
social ceremonies like marriage where the services of a priest are
essential. Artisans who made images of goddesses have also left. Muslims
have replaced Hindu Presidents of Union Boards by coercive measures with
the active help and connivance of the police and Circle Officers.
Muslims have replaced Hindu Headmasters and Secretaries of Schools. The life
of the few Hindu Govt. servants has been made extremely miserable as
many of them have either been superseded by junior Muslims or dismissed
without sufficient or any cause. Only very recently a Hindu Public
Prosecutor of Chittagong was arbitrarily removed from service as has been
made clear in a statement made by Srijukta Nellie Sengupta against whom
at least no charge of anti-Muslim bias prejudice or malice can be
leveled.
HINDUS VIRTUALLY OUTLAWED
(32) Commission of thefts and dacoities even with murder is going on as
before. Thana office seldom record half the complaints made by the
Hindus. That the abduction and rape of Hindu girls have been reduced to a
certain extent is due only to the fact that there is no Caste Hindu girl
between the ages of 12 and 30 living in East Bengal at present. The few
depressed class girls who live in rural areas with their parents are
not even spared by Muslim goondas. I have received information about a
number of incidents of rape of Scheduled Castes Girls by Muslims.
Full payment is seldom made by Muslim buyers for the price of jute and
other agricultural commodities sold by Hindus in market places. As a
matter of fact, there is no operation of law, justice or fair play in
Pakistan, so far as Hindus are concerned.
FORCED CONVERSIONS IN WEST PAKISTAN
(33) Leaving aside the question of East Pakistan, let me now refer to
west Pakistan, especially Sind. The West Punjab had after partition
about a lakh of Scheduled Castes people. It may be noted that a large
number of them were converted to Islam. Only 4 out of a dozen Scheduled
Castes girls abducted by Muslims have yet been recovered in spite of
repeated petitions to the Authority. Names of those girls with names of their
abductors were supplied to the government. The last reply recently
given by the office-in- Charge of recovery of abducted girls said that "his
function was to recover Hindu girls and stat "Achuts" (Scheduled
Castes) were not Hindus". The condition of the small number of Hindus that
are still living in Sind and Karachi, the capital of Pakistan, is simply
deplorable. I have got a list of 363 Hindu temples and gurudwaras of
Karachi and Sind (which is by no means an exhaustive list) which are
still in possession of Muslims. Some of the temples have been converted
into cobbler's shops, slaughterhouses and hotels. None of the Hindus has
got back.
Possession of their landed properties were taken away from them without
any notice and disturbed amongst refugees and local Muslims. I
personally know that the Custodian declared 200 to 300 Hindus non- evacuees a
pretty long time ago. But up till now properties have not been restored
to any one of them. Even the possession of Karachi Pinjra Pole has not
been restored to the trustees, although it was declared non-evacuee
property some time ago. In Karachi I had received petitions from many
unfortunate fathers and husbands of abducted Hindu girls, mostly Scheduled
Castes. I Drew the attention of the 2nd Provisional Government to this
fact. There was little or no effect. To my extreme regret I received
information that a large number of Scheduled Castes who are still living
in Sind have been forcibly converted to Islam.
PAKISTAN 'ACCURSED' FOR HINDUS
(34) Now this being in brief the overall picture of Pakistan so far as
the Hindus are concerned, I shall not be unjustified in stating that
Hindus of Pakistan have to all intents and purposes been rendered "
Stateless " in their own houses. They have no other fault than that they
profess Hindu religion. Muslim League leaders that Pakistan is and shall
be an Islamic State are repeatedly making declarations. Islam is being
offered as the sovereign remedy for all earthly evils. In the matchless
dialectics of capitalism and socialism you present the exhilarating
democratic synthesis of Islamic equality and fraternity. In that grand
setting of the Shariat Muslims alone are rulers while Hindus and other
minorities are jimmies who are entitled to protection at a price, and you
know more than anybody else Mr. Prime Minister, what that price is.
After anxious and prolonged struggle I have come to the conclusion that
Pakistan is no place for Hindus to live in and that their future is
darkened by the ominous shadow of conversion or liquidation. The bulk of the
upper class Hindus and politically conscious scheduled castes have left
East Bengal. Those Hindus who will continue to stay accursed promise
and for that matter in Pakistan will, I am afraid, by gradual stages and
in a planned manner be either converted to Islam or completely
exterminated. It is really amazing that a man of your education, culture and
experience should be an exponent of a doctrine fraught with so great a
danger to humanity and subversive of all principles of equality and good
sense. I may tell you and your fellow workers that Hindus will allow
themselves, whatever the threat or temptation, to be treated as Jimmies
in the land of their birth. Today they may, as indeed many of them have
already done, abandon their hearths and home in sorrow but in panic.
Tomorrow they strive for their rightful place in the economy of life. Who
knows what is in the womb of the future? When I am convinced that my
continuance in office in the Pakistan Central Government is not of any
help to Hindus I should not with a clear conscience, create the false
impression in the minds of the Hindus of Pakistan and peoples abroad that
Hindus can live there with honour and with a sense of security in
respect of their life, property and religion. This is about Hindus.
NO CIVIL LIBERTY EVEN FOR MUSLIMS
(35) And what about the Muslims who are outside the charmed circle of
the League rulers and their corrupt and inefficient bureaucracy? There
is hardly anything called civil liberty in Pakistan. Witness for
example, the fate of Khan Abdul Gaffar Khan then whom a more devout Muslim had
not walked this earth for many years and of his gallant patriotic
brother Dr. Khan Sahib. A large number of erstwhile League leaders of the
Northwest and also of the Eastern belt of Pakistan are in detention
without trial. Mr. Suhrawardy to whom is due in a large measure the League's
triumph in Bengal is for practical purposes a Pakistan prisoner who has
to move under permit and can't open his lips under orders. Mr. Fazzul
Huq, that dearly loved grand old man of Bengal, who was the author of
that now famous Lahore resolution, is ploughing his lonely furrow in the
precincts of the Dacca High Court of Judicature, and the so called
Islamic planning is as ruthless as it is complete. About the East Bengal
Muslims generally, the less said the better. They were promised at Lahore
of an independent State. They were promised of autonomous and sovereign
units of the independent State. What have they got instead? East Bengal
has been transformed into a colony of the western belt of Pakistan,
although it contained a population, which is larger than that of all the
units of Pakistan put together. It is a pale ineffective adjunct of
Karachi doing the latte's bidding and carrying out its orders. East Bengal
Muslims in their enthusiasm wanted bread and they have by the
mysterious working of the Islamic state and the Shariat got stone instead from
the arid deserts of Sind and the Punjab.
MY OWN SAD AND BITTER EXPERIENCE
(36) Leaving aside the overall picture of Pakistan and the callous and
cruel injustice done to others, my own personal experience is no less
sad, bitter and revealing. You used your position as the Prime Minister
and leader of the Parliamentary Party to ask me to issue a statement,
which I did on the 8th September last. You know that I was not willing
to make a statement containing untruths and half-truths, which were
worse those untruths. It was not possible for me to reject your request so
long as I was there working as a Minister with you and under your
leadership. But I can no longer afford to carry this load of false
pretensions and untruth on my conscience and I have decided to offer my
resignation as your Minister, which I am hereby placing in your hands and
which, I hope, you will accept without delay. You are of course at liberty
to dispense with that office or dispose of it in such a manner as may
suit adequately and effectively the objectives of your Islamic State.
8th Oct. 1950
Yours Sincerely,
J. N. Mandal
URL: http://www.mayerdak.com/jnmandal.htm
ফারুক মাহমুদ : মিথ্যা বারবার উচ্চারিত হলে সত্যের মতো শোনায়। অবশ্য শেষতক মিথ্যা ধরা পড়েই যায়, সবখানে, সব যুগেই। বাংলাদেশেও এমনি একটা নিরেট মিথ্যা গত কয়েক দশক ধরে চলে আসছে।
বলা হয়ে থাকে, সাম্প্রদায়িক মুসলমানরাই ভারত উপমহাদেশকে তিনভাগ করেছে, দ্বিখন্ডিত করেছে 'বাংলা মায়ের' দেহকে। প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমানরাই 'এপার বাংলা' 'ওপার বাংলা'কে আলাদা করেছে। কিন্তু কথাটা একবারে জলজ্যান্ত মিথ্যা।
ভারতকে বিভক্ত করার প্রথম একটি প্রস্তাব সম্বলিত বিবৃতি দেন মিঃ গান্ধীর স্নেহভাজন কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতা মিঃ রাজা গোপালাচারী ১৯৪৪ সালের এপ্রিল মাসে (The great divide. H. V. Hodson. P-113; মোঃ ওয়ালি উল্লাহ, আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, পৃঃ ৩৯৮) এবং পরে পুনরায় গুঞ্জরন তোলেন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি বল্লভ ভাই প্যাটেল ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর মাসে। [ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ, উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, মাওলানা আযাদের উদ্ধৃতি, পৃঃ ৩৬০-৬১]। যুক্ত ভারতের আওতায় 'মুসলমানদের সাথে একত্রে না থাকার ঘোষণা' প্রকাশ করেন, নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের তৎকালীন সভাপতি পন্ডিত জওহর লাল নেহেরু বোম্বাইয়ে প্রেস কনফারেন্সে ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই [মওলানা আবুল কালাম আযাদ, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম, পৃঃ ১৬৪-৬৫] আর এর পেছনে কলকাঠি নাড়েন নাটের গুরু 'ধর্মনিরপেক্ষতার অবতার' বলে প্রচারিত মিঃ এম, কে গান্ধী। ১৯৪৬ সালের ৮ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সর্দার প্যাটেল, পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, আচার্য কৃপালনী, মিঃ জওহরলাল নেহেরু এবং মিঃ গান্ধী একযোগে মওলানা আবুল কালাম আযাদকে খোলাখুলি জানিয়ে দেন যে, গ্রুপ সরকারের প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক কাঠামোতে তারা মুসলমানদের সাথে এক রাষ্ট্রে থাকবেন না- এর কয়েকদিন পূর্ব পর্যন্ত একটানা সাত বছর ধরে মওলানা আযাদই ছিলেন নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি (মওলানা আযাদ, India wins freedom)। শুনতে অবাক লাগলেও তাদের এরূপ স্পষ্ট ঘোষণায় কিছুদিন আগে ১৯৪৬ সালে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব অনুযায়ী তিনটি গ্রুপে গাঁথা সারা ভারতের সবগুলো প্রদেশ নিয়ে একটি ফেডারেশন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ই মেনে নেয়। ১৬ জুন তারিখে পরিকল্পনাটি প্রকাশ করার এক সপ্তাহের মধ্যেই কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় তা মেনে নেয়া হয়। [ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৬৬] অতঃপর ৭ জুলাই তারিখে মওলানা আবুল কালাম আযাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনেও হিন্দু-মুসলিম একত্রে থাকবে এ প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। [মওলানা আযাদ, India wins freedom P-164) কংগ্রেস অধিবেশনে এ প্রস্তাব গৃহীত হবার তিনদিন পরই মিঃ এম, কে, গান্ধীর ইঙ্গিতে জাতীয় কংগ্রেসের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মিঃ নেহেরু তার বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন ১০ জুলাই [মওলানা আযাদ-ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম পৃঃ ১৬৪-৬৫] পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এরূপ করার উদ্দেশ্যেই এর কয়েকদিন পূর্বে, মওলানা আযাদকে সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে পন্ডিতজীকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদে বরণ করা হয় এবং পরবর্তী কংগ্রেস অধিবেশনেই কেবিনেট মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা হয়।
কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব ছিল উত্তর ভারতের পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে একটি গ্রুপ, বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে একটি গ্রুপ এবং ভারতের অবশিষ্ট বিহার, উড়িষ্যা, মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, বোম্বাই ও মাদ্রাজ প্রদেশ নিয়ে আরেকটি গ্রুপ গঠন করা হবে। সব গ্রুপের সব প্রদেশই স্বায়ত্তশাসন পাবে; গ্রুপভুক্ত প্রদেশগুলো নিজেদের 'কমন' বিষয়গুলো যৌথভাবে সমাধান করবে। তিনটি গ্রুপের সমন্বয়ে সবগুলো প্রদেশ নিয়ে গঠিত হবে নিখিল ভারত ফেডারেল রাষ্ট্র সরকার। (Hodson, The Great Divide. P-162. জামিলুদ্দিন, ফাউন্ডেশন অব মুসিলম লীগ, হিস্টরি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট-পৃঃ '৮৬-৮; মওলানা আযাদ, প্রাগুক্ত-পৃঃ ১৮৫-৮৮। এতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে পররাষ্ট্র, দেশরক্ষা ও যোগাযোগ এ তিনটি বিষয় রেখে অবশিষ্ট যাবতীয় বিষয় প্রদেশের হাতে রাখা হয়। তাছাড়া প্রথমোক্ত দু'টি গ্রুপভুক্ত বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ ছিল মুসলমান সংখ্যাগুরু। ভারতীয় ফেডারেল সরকারের অধীনে থেকেও এসব প্রদেশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাদেশিক সরকারের অধীনে মুসলমানরা নির্ভয়ে নিজেদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি নিয়ে জীবনযাপন করতে পারতো। এ কারণেই পাকিস্তানের দাবি প্রত্যাহার করে নিয়ে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশনের গ্রুপ সরকার পদ্ধতি মেনে নেয়। কংগ্রেস প্রথমে দেখতে পায়, সারা ভারতে ৫০ কোটি জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মাত্র মুসলমান এবং মোট প্রদেশগুলোরও অধিকাংশ হিন্দুপ্রধান। সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারের পার্লামেন্টে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে হিন্দুরা। তারা সংখ্যাগুরু ভোটে যা খুশি তাই করতে পারবে। এ কারণেই মওলানা আযাদের ঐক্যের ডাকে সাড়া দিয়ে প্রথমে তারা কেবিনেট মিশন প্রস্তাব মেনে নেয়।
কিন্তু পরেই তারা বুঝতে পারে যে, এর মধ্যে একটা ঝুঁকিও রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় সরকার ব্রুট মেজরিটির চাপ সৃষ্টি করতে গেলে দু'টি গ্রুপই একযোগে আযাদীর নিশান উড়িয়ে দিতে পারে।
তাছাড়া মিঃ এম কে, গান্ধী আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন অখন্ড ভারতব্যাপী 'রামরাজ্য' প্রতিষ্ঠার। 'ডিসকভারী অব ইন্ডিয়া' গ্রন্থে পন্ডিত নেহেরু দক্ষিণ এশিয়াব্যাপী হিন্দু সভ্যতার প্রভাববলয় পুনঃপ্রতিষ্ঠার আবেগে আচ্ছন্ন মনোভাব প্রকাশ করেন- সেটাও ছিল তার আজীবন লালিত স্বপ্ন। গ্রুপ সরকার ব্যবস্থায় ভারত অবিভক্ত থাকলে তাদের কি লাভ। রামরাজ্যও হবে না, হিন্দু সভ্যতার প্রভাববলয়ও সৃষ্টি হবে না। তাহলে মওলানা আযাদকে সরিযে দিয়ে এ ব্যবস্থা বানচাল করাই বিধেয়। ১৯৩০ সালে গোলটেবিল বৈঠকের প্রাক্কালেও এভাবেই নিখিল ভারত কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ডক্টর মোখতার আহমদ আনসারীকে সরিয়ে দিয়ে মিঃ গান্ধীকে তারা বিলেতে পাঠান মুসলমানদের মোকাবিলা করতে। [আবদুর রহীম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, উদ্ধৃতি-রামগোপাল, ১৮৯, রব, ৭৭-৮৪; ব্রোমফ্রিল্ড ২৮৯; হামিদ-২১৩, বিনয়েন্দ্র নাথ চৌধুরী, ভারতের মুসলিম রাজনীতি, পট্টভি মিতারামাইয়া, কংগ্রেসের ইতিহাস]।
বাংলাকে হিন্দু বাংলা ও মুসলিম বাংলায় বিভক্ত করে দুটি প্রদেশ গঠনের প্রস্তাব প্রথম উত্থাপন করে জাতীয় কংগ্রেস নেতা লাল লাজপত রায় ১৯২৫ সালে। মন্টেগু চেমসফোর্ড শাসন সংস্কারের ফলে মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিম মন্ত্রিসভা কায়েমের সম্ভাবনা দেখা দিলে ভারতের কেন্দ্রীয় আইন সভায় তিনি এ দুটি প্রদেশকে ভাগ করার দাবি করেন। কেন্দ্রীয় আইন সভায় তৎকালীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টির নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উহার তীব্র বিরোধিতা করেন। দীর্ঘ ২ মাস তাদের মধ্যে এ নিয়ে বাকবিতন্ডা চলে। লালা লাজপত রায় ১৯২৪ সালের ২৫ নবেম্বর থেকে ১৭ ডিসেম্বরের মধ্যে Daily Tribune পত্রিকায় এই দাবিতে ১৩টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। (David page. Prelude to Partition, P-121) বাংলাদেশ দ্বিখন্ডিত করার কথা কোনদিন কোন মুসলমানের মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় নাই। স্বেচ্ছায় মুসলমানরা বাংলা বিভাগ মেনে নেয়নি। এমনকি বাবু বুদ্ধিজীবীগণ কর্তৃক চরম প্রতিক্রিয়াশীল বলে নিন্দিত এককালের কংগ্রেস নেতা, ১৯২৪ সালে প্রাদেশিক কংগ্রেসের সিরাজগঞ্জ অধিবেশনের সভাপতি ও পরবর্তীকালের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ পত্রিকায় প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন যে, ''বাংলা বিভক্তি করতে হলে তা করতে হবে বাংলার ছয় কোটি মুসলমানের লাশের উপর দিয়ে'' [আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেকশন, পৃঃ ১৪৭]। কিন্তু বাংলার প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল হাশিম এবং বাংলার প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি মি. শরৎ চন্দ্র বসু ও সাধারণ সম্পাদক বাংগালী কংগ্রেস নেতা মি. কিরণ শংকর রায় সার্বভৌম রাষ্ট্র স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের জন্য সাংবিধানিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হলেও গুজরাটী মি. এম. কে গান্ধী, কাশ্মীরী পন্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু ও বোম্বাইয়া মি. বল্লভ ভাই প্যাটেলের নির্দেশে বাংলার কংগ্রেস নেতা ও কর্মীরা মত পরিবর্তন করেন। উপরোক্ত মহলের ইংগিতেই তারা হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামাপ্রাসাদ মুখার্জীর দাবিতে [আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, গান্ধীর চিঠি তাং- ৮/৬/৪৭ পৃঃ ১৫৮] এবং ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন ও গবর্নর ফ্রেডারিক বারোজের সক্রিয়া সহযোগিতায় সে চেষ্টা ব্যর্থ করে দেন।
ঊনিশ শতকের শেষ দশকের জন্ম নেয়া মুসলমান সন্তানই বিশ্বাস করতে পারতো না তার মনিব ও পড়শী বাবুদেরকে।সেটা সম্ভবও ছিল না। দেড়শত বছর ধরে বাংলার মুসলমানদের উপর ইংগ-হিন্দু অত্যাচারের সব ইতিহাসই বাবু বুদ্ধিজীবীরা গায়েব করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ইতিহাসের জীবন্ত নায়কদের সবাইকে তো আর নিশ্চিহ্ন করতে পারেন নাই- তারাতো বাবুদের সেবাদাস, ক্ষেতমজুর হয়েই ঘোরাফেরা করছিল। মুখে মুখে তারাই ট্রান্সমিট করে গেছেন ইতিহাসের বিভীষিকাময় চিত্র। একটা ছোট্ট দৃষ্টান্ত দেই। -আমার দাদার জন্ম হয় ১৮৩৪ সালে, ইন্তিকাল করেন ১৯৩৩ সালে। আমার নানার জন্ম ১৮৪০ সালে, ইন্তিকাল করেন ১৯৫৪ সালে। নানার কাছে আমি শুনেছি তার যৌবনে ১৮৬০ দশকে বাবুদের হাতে নিগৃহীত মুসলমানদের নিদারুণ জীবন কাহিনী। আমার দাদার বাবা ১৮৩১ সালে তিতুমীরের সৈনিক হিসাবে নারিকেলবাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লার যুদ্ধে পরাজয়ের পর আহত সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে সুন্দরবন অঞ্চলে কিভাবে দিনাতিপাত করেছেন- বাপের কাছ থেকে শোনা সে সব কাহিনী আমার দাদা শুনিয়েছেন নাতিপোতাদের- শুনেছেন আমার পঁচিশ বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ এক চাচাতো ভাই। এভাবে ১৮৩৭ সালে রাষ্ট্রভাষা ফার্সীর বদলে যখন ইংরেজী চালু করা হয়। [আব্দুল মওদুদ, মধ্যবিত্ত সমাজের বিকাশ : সংস্কৃতির রূপান্তর, পৃঃ ৯৮], তখন সারা বাংলার এক লাখ মক্তব মাদরাসার সাথে [আব্দুর রহীম, বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস, উদ্ধৃতি জে, লং, এডামস রিপোর্ট, পৃঃ ১৮, ২৯, ৪০-৪২] আমাদের বাড়ির সামনের বিরাটকায় মাদরাসাটিও কিরূপে অর্থাভাবে ধ্বংস হয়ে যায় তার ইতিহাস এক পুরুষের ব্যবধানে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা হিসাবে ১৯৮৭ সালেও আমাদের কারো কারো মনে রেখাপাত করে আছে। ১৮৩৫ সালে তিতুমীরের প্রধান দুশমন গোবরডাংগার জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায় হাতিসহ বরকন্দাজ বাহিনী পাঠিয়ে আমাদের মুসলমান গাঁয়ের বাড়িঘর ভাংতে গেলে তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ বখশ, খোদা বখশ ভাইদের মরণপণ লড়াইয়ের কাহিনী উপাখ্যান হয়ে এখনো ছড়িয়ে আছে সারা এলাকায়। ঠিক এমনিভাবেই ঊনিশ শতকের ক্রান্তিকালের বাংগালী মুসলমান শিশুরা শুনেছে, মুটে-মাঝি, মিনতি-কিষাণ, ক্ষেত মজুরের কাজে নিয়োজিত তাদের বৃদ্ধ দাদা-নানাদের মুখে, তাদের বাপ-চাচাদের যৌবনের, পলাশী যুদ্ধের পূর্বকালীন প্রাচুর্যের রূপকথা, শুনেছে দারিদ্র্য ও অশিক্ষা দু'টি শব্দ সেদিন বাংলার মুসলমানদের কাছে ছিল একেবারেই অজ্ঞাত [উইলিয়াম হান্টার, দি ইন্ডিয়ান মুসলমান]।
ঊনিশ শতকের ক্রান্তিলগ্নে বাংলার মুসলিম সন্তানেরা যখন স্কুল-কলেজে ঢোকার প্রথম সুযোগ পায়, বাবু বুদ্ধিজীবীদের লেখা পাঠ্যপুস্তকে তাদেরকে ইতিহাসের বানোয়াট ব্যাখ্যা শোনানো হলেও, তাতে তাদের বুকের ক্ষত উপশম হতো না। বাবুরা বোঝাতেন, মুসলমান মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় দেশ পরাধীন হয়েছিল, আর মোল্লাদের অসহযোগিতায় মুসলমানেরা ইংরেজী শিক্ষা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাবুরা তখন, বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে, তাদেরকে ডাক দিয়েছেন ইংরেজবিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। দুর্জয় অনার্য-দ্রাবিড়-অস্ট্রেলয়েড-সেমিটিক রক্তের সাথে দুর্ধর্ষ তুর্ক আফগান আরব রক্তের মিলিত ধারা প্রতিটি বাংগালী মুসলমানের ধমনীতে বহমান। স্বাধীনতার স্পৃহা তাদের মজ্জাগত উত্তরাধিকার। বুকে বেদনার ক্ষত নিয়েও তাই তারা সাড়া দিয়েছে বাবুদের ডাকে, বৃটিশ-বিরোধী অসহযোগ আন্দোলনে, সত্যাগ্রহে, সংগ্রামে।
কিন্তু বুকের গভীরে তাদের দুরু দুরু ভয় ছিল। বাবুদের কাছ থেকে তারা হয়ত সুবিচার পাবে না। আন্দোলনের মাঝে থেকেও তারা চাকরি-বাকরি, জমি-জিরাত, ব্যবসা-বাণিজ্যের কিছু সুযোগ-সুবিধা মাত্র দাবি করেছিল। বাবুরা তাও দিতে চাইলেন না। এ সময়ে ভারতের সর্বত্র পৌরসভা, লোকাল বোর্ড, জেলাবোর্ড গঠিত হতে থাকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে [আব্দুর রহীম, বাংলা মুসলমানদের ইতিহাস]। অভিজ্ঞতার আলোকে তারা দেখলেন বৃটিশ ভারতে অধিবাসীদের ২৫% মাত্র মুসলমান, তাতে আবার তারা দরিদ্র নিঃসম্বল। বাবুদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এসব সংস্থায় নির্বাচিত হওয়া তাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব। তাই তারা কিছু নিরাপত্তার আশ্বাস চাইলেন- দাবি করলেন হিন্দু, মুসলমান ও নমশূদ্রেরা এসব প্রতিষ্ঠানে নিজেদের সংখ্যানুপাতে আসন পাবে, প্রাপ্ত আসনগুলোতে পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে। কিন্তু ভারতকে বা বাংলাদেশকে বিভক্ত করার কথা কোনদিনই তারা কল্পনাও করেনি। কংগ্রেসের পতাকার নিচে দাঁড়িয়েই তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করেছেন।
মওলবী একে ফজলুল হক, মওলানা মোহাম্মদ আলী, ডক্টর মোখতার আহমদ আনসারী, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, স্যার আবদুর রহীম, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মওলানা হাস্রত মোহানী, মওলানা মাযহারুল হক বাঙ্গালী, মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, মওলবী তমিজুদ্দিন খান, ব্যরিস্টার আব্দুর রসুল, মওলবী মুজিবুর রহমান, মি. মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ- এদের সবাইতো ছিলেন জাতীয়তাবাদী নেতা। জাতীয় কংগ্রেসের কেউবা কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি বা সম্পাদক, কেউবা প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভাপতি বা সম্পাদক। মওলবী ফজলুল হক তো একই সাথে নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি (১৯১৮) ছিলেন। আজিজুল হক শাহজাহান, শতাব্দীর কণ্ঠস্বর আবুল কাসেম ফজলুল হক, পৃঃ ৬১]। মওলবী মুজিবর রহমান ছিলেন একই সাথে বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি এবং প্রাদেশিক কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক (১৯২৪)। মি. জিন্নাহ সারা ভারতে নন্দিত ছিলেন 'হিন্দু মুসলিম মিলনের দূত' বলে।
এই যে মুসলিম মহাপুরুষগুলো, কোন অপরাধে, কেন তারা সাম্প্রদায়িক খেতাব পেলেন? নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সাত বছরব্যাপী পুতুল প্রেসিডেন্ট মওলানা আবুল কালাম আযাদ কেন ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম গ্রন্থে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে আফসোস করতে করতে মারা গেলেন?
'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম P-203]
গোলটেবিল বৈঠকের আগে সাইমন কমিশন পর্যন্ত ১৯২৯ সাল অবধি এসব নেতারা মুসলিম লীগের সদস্য থাকলেও কংগ্রেসকে মনে করেছেন হিন্দু মুসলমানের মিলিত জাতীয় প্লাটফর্ম, মুসলিম লীগকে মনে করেছেন মুসলমান সমাজের বিশেষ অভাব অসুবিধাগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার জন্য গঠিত সংগঠন। এ সংগঠনের মাধ্যমে মুসলমানেরা কেবল পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে শোনা বিভীষিকাময় অতীতকে স্মরণ করে, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য বিপদ এড়াবার আশায় সংখ্যাগুরু হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে আলাপ-আলোচনা চালাতেন। তাদের ভয় ছিল, বর্ণহিন্দুদের নেতৃত্বে উপ-মহাদেশের ৭৫% হিন্দু একজোট হয়ে সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে চললে তাদের কৃত জুলুম-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলোতে কোনদিন একজন মুসলমানও নির্বাচিত হতে পারবেন না। এ জন্য তারা যুক্তি সহকারে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে কেবলমাত্র এটুকু দাবি করেছিলেন যে, বৃটিশ ভারতের প্রদেশগুলোতে মুসলমানদেরকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের জনসংখ্যার অনুপাতে আসন প্রদান করে, তাদের নিজেদের ভোটে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে দেয়া হোক। এ ব্যবস্থায় ২৫% মুসলমান ৭৫% অমুসলমানের উপর টেক্কা দিয়ে সংখ্যাগুরু আসন অধিকার করতে পারতো না। কেবল নিজেদের নিম্নতম অধিকারটুকু রক্ষার ব্যাপারে সংখ্যাগুরুর সুদৃষ্টি ও সমর্থন আদায় করতে পারতো।
১৯১৬ সালের আখনৌ চুক্তিতেও মুসলমানেরা এটুকু আশা করেছিলেন [জামিলুদ্দীন, ফাউন্ডেশন অব মুসলিম লীগ]। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ১৯২৪ সালের লাহোর প্রস্তাবে, ১৯২৫-এর আলীগড় প্রস্তাবেও এটুকুই দাবি করা হয়েছিল। [রামগোলাপ, প্রাগুক্ত, ২৭৪, ২৫৮; হামিদ, ২২৪; কোরেশী, ১০০]। ১৯২৩ সালে মিঃ চিত্তরঞ্জন দাস মিঃ সুভাষ বসু মিঃ জে, এন, সেনগুপ্ত এবং স্যার আবদুর রহীম, মওলবী ফজলুল হক ও মিঃ শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সম্পাদিত ''বেগল প্যাস্টে''ও মুসলমানেরা এতটুকুই চেয়েছিলেন এবং বাংলা প্রদেশে মুসলমানেরা সংখ্যাগুরু হয়েও সংখ্যাসাম্য মেনে নিয়েছিলেন [ব্রোমফিল্ড, ২৪৫-২৭৫; রাম গোপাল, ইন্ডিয়ান মুসলমান; আব্দুর রহীম, প্রাগুক্ত, বেংগল প্যাক্টের প্রস্তাব পৃঃ ২২৬]। ১৯২৭ সালের ২০শে মার্চ তারিখের দিল্লী প্রস্তাবেও মুসলমানেরা এটুকুই দাবি করেছিলেন (খালেকুজ্জামান, পাথওয়ে টু পাকিস্তান, ১৭১]। ১৯২৮ সালের ২২শে ডিসেম্বর কলিকাতায় অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় বৈঠকেও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ দাবিই পেশ করেন [মুসলিম লীগ রিজোলুশন্স, পৃঃ ১১, ৪০-৪১]।
১৯২৯ সালের জানুয়ারীতে মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশনে গৃহীত বিখ্যাত ১৪ দফা দাবির মূল বক্তব্যও ছিল এটাই [মুসলিম লীগ রিজোলুশন্স, পৃঃ ১১, ৪০-৪২]। মুসলমানদের প্রতিবারের আবেদনই বর্ণহিন্দু কংগ্রেসী নেতারা সুকৌশলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯১৯ সালের মন্ডেগু-চেম্সফোর্ড ঘোষণার পর বাংলা-পাঞ্জাবসহ কতিপয় প্রদেশের আইন পরিষদ ও মন্ত্রিসভায় মুসলমানেরা আসন লাভ করায় বালগংগাধর তিলক ও মদনমোহন মালব্যের অনুসারীরা খেজুর তলার (আরব ইরান থেকে আগত এই মিথ্যা অভিযোগে) মুসলমানদেরকে খেজুর তলায় পাঠানোর জন্য সশস্ত্র কর্মসূচি ঘোষণা করে [ডাক্তার আবদুল ওয়াহিদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০, রবার্ট বাইরনের 'স্টেটস্ম্যান অব ইন্ডিয়া' থেকে উদ্ধৃতি]। ১৯২৩ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত সারা উপ-মহাদেশে মুসলিম নিধন দাংগায় বর্ণহিন্দুরা লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করে। এত কিছুর পরেও ১৯৩০-৩১ সালে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকেও মুসলমানেরা আগের মতই কেবলমাত্র আত্মরক্ষার রক্ষাকবচ দাবি করেছিলেন। ভারত বা বাংলাদেশ বিভাগের কোন প্রশ্ন কেউ কোথাও উত্থাপন করেননি। কিন্তু তখনও বর্ণহিন্দু বাবুদের একটিই জওয়াব ঃ ''হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান সবাই মিলে আমরা একই ভারতীয় জাতি, এখানে ভেদাভেদের প্রশ্ন তোলা যাবে না। যে যেখানে যেমন অবস্থায় আছো তেমনই থাকতে হবে। ভবিষ্যতে ধর্মনিরপেক্ষ নির্ভেজাল গণতন্ত্রের নীতিতে সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্তে সবকিছুর ফয়সালা হবে- সম্প্রদায় বিশেষের হয়ে কেউ কথা বলতে পারবে না।'' সহজ ভাষায় এর অর্থ দাঁড়ায়, উপ-মহাদেশের যেসব এলাকায় (যেমন বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা) মুসলমানেরা বাবুদের পায়ের তলায় রয়েছে, সেখানে তারা পায়ের তলায়ই থাকবে-উঠে দাঁড়ানোর সাম্প্রদায়িক দাবি তুলতে পারবে না। যেসব এলাকায় মুসলমানেরা নিদারুণভাবে সংখ্যালঘু, যেমন : মধ্যপ্রদেশে ৪%, মাদ্রাসে ৭%, বিহারে ১৩%, যুক্তপ্রদেশে ১৪%, বোম্বাই (সিন্ধুসহ) ২০% [রাম গোপাল, প্রাগুক্ত, ১৮৯; রব, ৭৭-৮৪; ব্রোমফিলড, ২৮৯; হামিদ, ২১৩; আবুল রহীম, প্রাগুক্ত, উদ্ধৃতি] সেখানে ব্রুট মেজরিটির জোরে তাদেরকে শূদ্র হরিজনদের স্তরে নামিয়ে দেয়া যাবে-সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্ন তোলা যাবে না। আমরা হিন্দু তোমরা মুসলমান, ভাই ভাই, আমরা সবাই একতাবদ্ধ। তোমাদের যা কিছু আছে সবই আমাদের, আর আমাদের যা কিছু তাও হেঁ হেঁ হেঁ- অর্থাৎ আমাদেরই, তোমাদের কিছুই নেই, কিছুই থাকবে না। কেবল থাকবে অবাধ (১) গণতন্ত্র (২) আর অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষতা এবং (৩) এক জাতীয়তাবাদ (হালে তারই সাথে তারা জুড়ে দিয়েছেন পুঁজিহীন দেশে) (৪) সমাজতন্ত্র। মওলবী ফজলুল হক ও মিঃ জিন্নাহর ক্ষুরধার যুক্তিতে মারাঠী 'মহাত্মার' মতলব ভেস্তে গেল, গোলটেবিল বৈঠকও ভেঙ্গে গেল [রামগোপাল, প্রাগুক্ত ১৮৯, ৭৭-৮৪; ব্রোমফিল্ড ২৮৯; হামিদ ২১৩; আব্দুর রহীম, প্রাগুক্ত উদ্ধৃতি]। বৃটিশ সরকার একতরফাভাবে ১৯৩২ সালে ২রা আগস্ট পৃথক নির্বাচন, আসন সংরক্ষণ ও প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা সম্বলিত সাম্প্রদায়িক রোয়েদাদ ঘোষণা করলেন। ১৯৩৫ সালে এলো ভারত শাসন আইনের নতুন প্রশাসন-বিধি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানেরা সরকার গঠন করলেন-কিন্তু একমাত্র বাংলা প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হলো মওলবী ফজলুল হকের নেতৃত্বে-অবশিষ্ট মুসলিম প্রধান প্রদেশগুলোতে কংগ্রেসী অথবা কংগ্রেসের সাথে অন্যান্য মুসলমান দলের মিলনে জাতীয়তাবাদী মুসলমানদের মন্ত্রিসভা কায়েম হলো। ভারত বিভাগ বা বাংলা-পাঞ্জাব বিভাগের কথা কখনও কোন মুসলমান রাজনৈতিক নেতা কল্পনাও করেননি।
নির্বাচনে হিন্দু প্রধান ৬টি প্রদেশে কংগ্রেস মন্ত্রিসভা গঠিত হলো-সেসব প্রদেশে দু'বছর ধরে মুসলমানদের উপর চললো অমানুষিক ধর্মনিরপেক্ষ নির্যাতন। নির্যাতনের স্বরূপ সম্পর্কে তদন্তের জন্য মুসলিম লীগ কর্তৃক ''পীরপুর কমিটি'' ও ''শরীফ কমিটি'' নিয়োগ করা হয়। রিপোর্টে বর্ণহিন্দুর অত্যাচারের যে বিভৎসতা ফুটে ওঠে তাতে বিচলিত হয়ে ১৯৩৯ সালে বাংলার প্রধানমন্ত্রী মওলবী ফজলুল হক ''কংগ্রেস শাসনে মুসলমানদের দুরবস্থা'' বর্ণনা করে এক দীর্ঘ বিবৃতি প্রদান করেন এবং এই মর্মে হুমকি দেন যে, কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলোতে 'এভাবে মুসলমানদের প্রতি জুলুমের ধারা বন্ধ করা না হলে বাংলাদেশে তিনি এর প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বাধ্য হবেন। [আব্দুর রহীম, প্রাগুক্ত, ২৫০; ব্রোমফিল ড ২৬০-৬৩; কমরুদ্দিন ১৯, ১৮১, ১৯৫-২০০]। হক সাহেবের বিবৃতিটি পুস্তিকা আকারে সারা উপ-মহাদেশে ছড়ানো হয়। অন্যান্য মুসলমান প্রধান প্রদেশগুলোতেও এ আবেগ সঞ্চারিত হয়। তারই স্বাভাবিক পরিণতি মুসলিম লীগের ১৯৪০ সালের লাহোর অধিবেশনে মওলবী ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত পাকিস্তান প্রস্তাব [আব্দুর রহীম, প্রাগুক্ত ২৫০; ব্রোমফিল্ড, ২৬০-৬৩; কামরুদ্দিন; ১৯, ১৮১.১৯৫-২০০]।
কিন্তু পাকিস্তান প্রস্তাবের ভিত্তিতে আন্দোলন চলাকালেও বৃটিশ সরকারের কাছে কংগ্রেসের প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগ দরকষাকষির প্রশ্নে দাবি করে আসছিল প্রদেশসমূহের স্বায়ত্তশাসন সংবলিত সর্বভারতীয় কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকার-আর কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল কেন্দ্রে যুক্তরাজ্য (Unitary) সরকার। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বৃটেনের যে লোক ক্ষয় হয় তাতে অবশিষ্ট বৃটিশ যুবশক্তির দ্বারা বিশ্বব্যাপী বৃটিশ সাম্রাজ্য পরিচালনা সম্ভব নয় বিধায় এ সময়ে বৃটেনে নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলী ১৯৪৬ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করেন যে (আয়ান স্টীফেন্স্, পাকিস্তান, ১১৯-২৮) বৃটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত দেশগুলোকে তারা অবিলম্বে স্বাধীনতা দিয়ে দেবেন। ভারতে এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলের প্রতি জোর তাগিদ দেন মিঃ এটলী। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেলকে সাহায্য করার জন্য বৃটিশ সরকার ভারত সচিব লর্ড প্যাথিক লরেন্স, বাণিজ্য বোর্ডের সভাপতি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপ্স ও নৌ-বহরের সচিব এ. ভি. আলেকজান্ডারের সমবায়ে একটি কেবিনেট মিশন প্রেরণ করেন। কেবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালের ২৪শে মার্চ তারিখে দিল্লী পৌঁছেন। তাদের প্রদত্ত ''গ্রুপ সরকার'' পরিকল্পনায় মুসলমানেরা প্রার্থিত নিরাপত্তার আশ্বাস দেখতে পাওয়ায় পাকিস্তান প্রস্তাবের দাবী স্থগিত রেখেই 'কেবিনেট মিশন প্রস্তাব' মেনে নেন। কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটি ৭ই জুলাই মওলানা আযাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় উহা মেনে নিলেও মিঃ এম. কে. গান্ধী এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেন। এর তিনদিন পরই গান্ধীর ''ইয়েসম্যান'' নবনির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি মিঃ নেহেরু উহার বিরোধিতা করে প্রদত্ত বিবৃতিতে জানান, ''গ্রুপ ব্যবস্থা'' থাকবে না। ১০ই জুলাই বোম্বাইয়ের সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি স্পষ্ট উক্তি করেন, 'কংগ্রেস গ্রুপ সরকার ব্যবস্থা আপাততঃ মেনে নিলেও ভবিষ্যৎ ভারত সরকারের শাসনতন্ত্র ও কর্মবিধি সম্পর্কে চাপিয়ে দেয়া কোন বিধান ভাবীকালের ভারতীয় গণপরিষদ বা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্ট মানতে বাধ্য থাকবে না। তারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরু ভোটেই সব স্থির করবে।' এ সময়ে আসামের মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বড়দলুই মি. গান্ধীর সাথে এক একান্ত বৈঠকে মিলিত হন এবং তারপরই আসাম বাংলার সাথে গ্রুপভুক্ত থাকবে না বলে বিবৃতি দিয়ে তিনি মি. গান্ধীর ইংগিতে আন্দোলন শুরু করেন। কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তাকে সে আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন জানান মি. এমকে গান্ধী (মওলানা আযাদের ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডমের টীকা গ্রন্থ- রইছ আহমদ জাফরীর ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছিল, অনুবাদ আবদুল্লাহ বিন সাঈদ, পৃঃ ১২৫]। মি. গান্ধী ও মি. নেহেরুর একগুঁয়েমির চাপে কেবিনেট মিশন ব্যর্থ হয়ে বিলাত ফিরে যান। [আয়ান স্টিফেনস পাকিস্তান, ১১৯-২৮; কোরেশী, ২৭২-৭৮]
ইতিপূর্বে বছরের গোড়ার দিকে উপ-মহাদেশব্যাপী নির্বাচনে মুসলমান আসনগুলোতে মুসলিম লীগ দল বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং সর্বভারতীয় মুসলমানদের আইনতঃ প্রতিনিধি হয়ে দাঁড়ায়। কংগ্রেস গ্রুপ-সরকার-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মুসলিম লীগও পাকিস্তান প্রস্তাবের দাবিতে ফিরে যায়। এ অবস্থাতেও মুসলিম লীগের ভূমিকা অস্বীকার করে এবং কংগ্রেসের দাবি মেনে নিয়ে ১২ আগস্ট তারিখে ভাইসরয় লর্ড' ওয়াভেল জাতীয় কংগ্রেসকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠনের আমন্ত্রণ জানান। এর জওয়াবে মুসলিম লীগ ১৬ আগস্ট ভারতব্যাপী 'প্রত্যক্ষ কর্মপন্থা দিবস' পালনের আহবান জানায়। এতে কর্মীদেরকে মিছিল ও জনসভার মাধ্যমে মুসলমান জনসাধারণের কাছে কেবিনেট মিশন প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার কারণ ও পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। [আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেকশন পৃঃ ১১৫-১৬]।
এ দিনে মুসলমানেরা দাংগার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলেন না। তার প্রমাণ এটাই যে, কোলকাতায় গড়ের মাঠে জনসভা দেখাবার জন্য বংগীয় মুসলিম লীগকে সাধারণ সম্পাদক জনাব আবুল হাশিম তার ১৫ বছর বয়সের কিশোর পুত্র বদরুদ্দিন উমর (বর্তমানে মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবী) ও ৮ বছর বয়সের শিশু পুত্র শাহাবুদ্দিন মোহাম্মদ আলিকে বর্ধমান থেকে সাথে করে নিয়ে গড়ের মাঠে হাজির হন। অন্য একজন মুসলিম লীগ নেতা ফরিদপুরের আবদুল্লাহ জহীরুদ্দিন লাল মিয়ার কোলে ছিল তার পাঁচ বছর বয়স্ক নাতী [আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৬]। অপ্রস্তুত মুসলমান জনতা সেদিন সভাশেষে ফেরার পথে কোলকাতার সড়কে গলিতে বর্ণহিন্দু মুসলমান জনতা সেদিন সভাশেষে ফেরার পথে কোলকাতার সড়কে গলিতে বর্ণহিন্দু গুন্ডাদের হাতে হাজারে হাজারে প্রাণ হারালো। কোলকাতায় মুসলমান নাগরিক ছিল ২৫%, হিন্দু ৭৫%। মুসলমানরা ছিল গরীব-দাংগার প্রস্তুতি নেবার সাধ্যও তাদের ছিল না। দাংগার জন্য হিন্দুরাই সপ্তাহকাল ধরে প্রস্তুতি গ্রহণ করে, আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে। প্রথম হাসপাতালে আনীত আহত-নিহতদের প্রায় সবই ছিল মুসলমান [মুসলিম লীগ ও মি. জিন্নাহর ঘোর শত্রু, মওলানা আযাদের দক্ষিণ হস্ত ও কংগ্রেস সমর্থক আবদুর রাজ্জাক মালিহাবাদী সম্পাদিত ও কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক হিন্দ পত্রিকার সংশ্লিষ্ট সময়ের সংখ্যাগুলো দ্রষ্টব্য]।
বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিমের অহবানে নমশূদ্র তপসিলী সম্প্রদায়, খৃস্টান, আদিবাসী ও উপজাতীয় সম্প্রদায়ের লোকেরাও সেদিন গড়ের মাঠের জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন। তাদেরও অনেকে ফেরার পথে প্রাণ হারিয়েছিলেন। কোলকাতার দাঙ্গায় খিদিরপুর ডকইয়ার্ডে কর্মরত নোয়াখালী ও কুমিল্লার কয়েক হাজার মুসলমান শ্রমিককে হত্যা করা হয়। [আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, ১১৮]- এবং এর প্রতিক্রিয়ায় মওলানা গোলাম সরওয়ারের নেতৃত্বে নোয়াখালীর কয়েকটি গ্রামে দাংগার পরিবেশ সৃষ্টি হয়ে উঠে। একই সময়ে বিহার প্রদেশে ব্যাপক মুসলিম নিধন শুরু হয়। ১৯২৩-২৬ সালেও ভারতের নানা স্থানে বর্ণহিন্দু দাংগাবাজদের হাতে মুসলমানেরা প্রাণ হারান। কিন্তু সবকিছু দেখেও না দেখার ভানকারী মি. এম কে গান্ধী তখন কোহাটে মুসলিম সংখ্যাগুরু এলাকায় সংঘটিত একটি তাৎক্ষণিক দাংগার প্রতি সারা ভারতের হিন্দুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মুসলিম নিধনের নতুন ইন্ধন যোগাবার মতলবে অনশন ধর্মঘট করেন। এবারও তিনি সমগ্র বিহার প্রদেশব্যাপী মুসলিম নিধন অভিযান উপেক্ষা করে নোয়াখালীর উপদ্রুত গ্রাম কয়েকটিতে এসে তাঁবু ফেলেন, মুসলমান 'দাংগাবাজ চরিত্রে'র উপর হিন্দু দৈনিক পত্রিকাগুলোতে হেড লাইন সৃষ্টি করে বিশ্ববাসীর ও ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের মতলবে। সে মতলব সফল হলো, উপ-মহাদেশের অন্যান্য হিন্দুপ্রধান প্রদেশগুলোতেও দাংগা ছড়িয়ে পড়লো। মজার ব্যাপার, মি. গান্ধীর নোয়াখালী উপস্থিতিকালেই পত্রিকায় প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী সেখানে নিহতের মোট সংখ্যা ছিল নোয়াখালীতে ২২০ ও ত্রিপুরা জেলায় ৬৫ জন এবং বিহারে নিহত মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার [কোলকাতার দৈনিক স্টেটস্ম্যান পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক আয়ান স্টিফেনস, পাকিস্তান, ১২৭-১৩০; ইস্পাহানী, কায়েদে আযম, ২৩০-৩৩]।
এ সময়েই ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বরের শেষ ভাগে ভাইসরয়ের শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভিপি মেনন সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের সাথে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হয়ে ভারত বিভাগের নতুন পরিকল্পনা খাড়া করেন। ভিপি মেমন : 'ট্রান্সফার অব পাওয়ার ইন ইন্ডিয়া', পুঃ ২৫৮-৫৯; খালিদ বিন সাঈদ, 'পাকিস্তান ইন ফর্মেটিভ ফেজ' পৃঃ ১১৯]। উল্লেখ্য, দাংগা শুরুর পূর্ব হতে কংগ্রেস মন্ত্রীদের সমবায়ে গঠিত ভাইসরয়ের অন্তবর্তীকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা ভারতের শাসনকার্য পরিচালনা করতে থাকেন। অক্টোবর মাসে মুসলিম লীগও সে মন্ত্রিসভায় যোগদান করে। মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল (বাংলা) আই আই চুন্দ্রীগড় (বোম্বাই), সরদার আবদুর রব নিশতার (সীমান্ত), গজনফর আলি (পাঞ্জাব) ও লিয়াকত আলী খান (যুক্তপ্রদেশ) অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। দেশরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়গুলো কংগ্রেসী মন্ত্রীরা গ্রহণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লিয়াকত আলীকে প্রদান করেন।
তাদের বিশ্বাস ছিল, মুসলমানেরা বাজেট প্রণয়নের মতো কঠিন কাজ সমাধা করতে পারবে না; সবকিছু লেজে-গোবরে করে ফেলবে। কিন্তু চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও গোলাম মোহাম্মদের সহযোগিতায় লিয়াকত আলী খান 'পুওরম্যানস্ বাজেট' বলে অভিনন্দিত এমনই নিখুঁত বাজেট প্রণয়ন করেন যে, বাজেটের অনুমোদননীতির প্যাঁচে পড়ে নেহেরু প্যাটেল সকলেই নাজেহাল হন। বিরাট কিছু করা দূরে থাক, একটি পিওনের নিয়োগপত্র দানেও তারা অপারগ হন। এতে সর্দার প্যাটেল ক্ষিপ্ত হয়ে খোলাখুলি বলতে শুরু করেন যে, মুসলমানদের সাথে একত্রে সরকার চালানো সম্ভব হবে না। ভিপি মেনন, প্রাগুক্ত; খালিদ বিন সাঈদ, প্রাগুক্ত। এ সময়েই তারা মনে মনে স্থির করে নেন যে, পাকিস্তান মেনে নেয়ার মধ্যদিয়েই মুসলমানদের শায়েস্তা করতে হবে। তদনুযায়ীই ভারতের মুসলমান প্রদেশগুলোর মানচিত্র ও আদমশুমারী রিপোর্টসহ প্যাটেল-মেনন গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে তারা মুসলমান প্রধান প্রদেশ পাঞ্জাব ও বাংলার জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত বিভাগের প্রস্তাব সম্বলিত এরূপ একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ইংল্যান্ডে ভারত সচিবের কাছে প্রেরণ করেন এবং তার এমনই খসড়া সীমানা সংযোগ করে দেন যে, তারা নিশ্চিত ছিলেন, এরূপ 'ছেঁড়া কাটা পোকায় খাওয়া' পাকিস্তান কায়েম হলেও অল্পদিনের মধ্যেই তার পুরা কাঠামোই ধসে পড়বে। ভারত সচিবকে প্রেরিত এ পরিকল্পনা সম্বলিত চিঠিতে ভিপি মেনন জানান যে, 'ভারত যদি ভাগ করতেই হয়, এরূপভাবে বিভক্ত হলে কংগ্রেসের কাছে তা গ্রহণীয় হতে পারে। ভিপি, মেনন, প্রাগুক্ত; খালিদ বিন সাঈদ, প্রাগুক্ত। জাতীয় কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নেহেরুর পক্ষ থেকে একটি গোপন প্রতিনিধি দল বিলেতে হাজির হয়ে স্যার স্টাফোর্ড ক্রীপ্সের মাধ্যমে এটলি সরকারকে রাজী করেন লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় নিয়োগ করতে। ফ্রিডম এ্যাট মিডনাইট, ল্যাপিয়ার এন্ড কলিন্স, পৃঃ ৮। যত দ্রুত সম্ভব ভারত ছেড়ে যেতে ব্যস্ত এটলি সরকার এই গোপন পরিকল্পনা মেনে নিয়েই লর্ড ওয়াভেলের স্থলে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে ভাইসরয় করে পাঠান। মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ছিলেন মিঃ নেহেরুর বিলেতী জীবনের বন্ধু। ভাইসরয়ের স্ত্রী ছিলেন নেহেরুর ততোধিক প্রিয়। পক্ষান্তরে বৃটিশ পলিসির লক্ষ্য ছিল ভারতকে এমনভাবে রেখে যাওয়া, যাতে নিজেদের বিবাদ-বিসম্বাদের কারণে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান উভয় পক্ষই বৃটিশ প্রভাব-বলয়ের আওতায় থাকে। তদুপরি ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠায় এবং দুশ' বছরব্যাপী শাসনে হিন্দুরাই ছিল বৃটিশের অকৃত্রিম বন্ধু। প্রশাসনে উত্তরোত্তর অধিকতর অংশীদারিত্বের দাবিতে আন্দোলন করলেও গান্ধী-নেহেরু নেতৃত্ব কোনদিন মুসলমানদের মতো সুস্পষ্ট ভাষায় স্বাধীনতা দাবি করেনি- এমনকি ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট গৃহীত বহুল প্রচারিত ''কুইট ইন্ডিয়া'' প্রস্তাবেও স্বাধীনতার ঘোষণা নেই, আছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে সাহায্যের বিনিময়ে স্বাধীনতা মঞ্জুরির প্রতিশ্রুতির দরখাস্ত। সর্বোপরি বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায় হাজার বছর ধরে খৃস্টান জগতের দুশমন। উভয় পক্ষের মধ্যে ১০২৮ খৃস্টাব্দ থেকে ১৪৪৮ খৃস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে ১০টি ক্রুশেড যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া [ফারুক মাহমুদ, 'জাগ্রত মুসলিম আফ্রিকা' ভূমিকা অংশ] ছাড়াও সব সময়েই কোথাও না কোথাও যুদ্ধ চলেছেই। মুসলিম বিশ্বের যে কোন অংশকে দুর্বল করতে পারলেই তাদের লাভ। এ সবের বাইরেও এ সময়ে নবোত্থিত লগ্নি পুঁজিবাদী আমেরিকা মুক্ত ভারতে বাণিজ্য সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ভারতের স্বাধীনতার জন্য চাপ দিতে থাকায় বৃটেনও ভাবতে থাকে যে, ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক স্বার্থে মুক্ত ভারতের সংখ্যাগুরু অংশকেই খুশি রাখা প্রয়োজন।
১৯৪৭ সালের ২২ মার্চ দিল্লী অবতরণ করে ২৪ মার্চ মাউন্টব্যাটেন ভাইসরয় হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং একসপ্তাহের মধ্যেই ভারত বিভাগের প্রস্তুতিপূর্ণ সমাধা করেন। ভাইসরয় প্রথমেই সর্দার প্যাটেলের সাথে গোপন বৈঠকে মিলিত হন। পরবর্তী দিন মিঃ নেহেরুর সাথে বৈঠক হয় মাউন্ট ব্যাটেনের। (মওলানা আযাদ, 'ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ১৯৮, ডাঃ আব্দুল ওয়াহিদ, উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ৩৫৯-৬২)। ভিপি মেনন এবং কৃষ্ণ মেননও বিষয়টি আগেই অবহিত ছিলেন। তারা তিনজন প্রকাশ্যে ভারত বিভাগের পক্ষে প্রচারণা চালানো শুরু করেন। (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ১৯৮-২০৩, ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ৩৫৯-৬২)। নেহেরু ভারত বিভাগের বিরোধিতা করতে মওলানা আযাদকে সারাসরি নিষেধ করেন এবং তাকে জানান, ''এরূপ বিষয় সম্পর্কে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের বিরোধিতা করা আমার পক্ষে ভালো নয়'' (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ১৯৮-২০৩, ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ৩৫৯-৬২)। ২৯ মার্চ তারিখে মওলানা আযাদ মিঃ গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ করে তাকে বলেন, এখন ভারত বিভক্তি ভয়ের াকরণ হয়েছে, মনে হয় প্যাটেল, এমন কি জওয়াহের লালও আত্মসমর্পণ করেছে। আপনি কি আমার পাশে থাকবেন? না আপনিও পরিবর্তিত হয়েছেন?''
মিঃ গান্ধী তাকে জানালেন, ''এতে জিজ্ঞাসার কি আছে। কংগ্রেস যদি বিভক্তি মেনে লয় তবে তা হবে আমার মৃতদেহের উপর। যতদিন আমি বেঁচে আছি, ততদিন ভারত বিভক্তি প্রস্তাবে রাজি হবো না, তাতে সাহায্য করবো না এবং কংগ্রেসকে এ প্রস্তাব গ্রহণ করতেও দেবো না। (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ২০৩, ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ৩৫৯-৬২)।
''পরবর্তী দিন মিঃ মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পরের দুইদিন প্যাটেলের সাথে আলোচনা করেন।'' (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', থেকে উদ্ধৃতি ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ২৩৬-৬৫)। এতে তিনি নিশ্চিত হন যে, তার আশীর্বাদে প্রণীত মেনন প্রস্তাব বাস্তবায়নের মাধ্যমে 'ছেঁড়া কাটা পোকায় খাওয়া' পাকিস্তান বরাদ্দ করে মুসলমানদেরকে শায়েস্তা করার সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত হয়েছে। চতুর্থ দিন মওলানা আযাদ মিঃ গান্ধীর সাথে পুনরায় দেখা করেন এবং চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করেন যে, মিঃ এম, কে, গান্ধী শিবাজীরই বংশধর, কিন্তু ততক্ষণে 'মহাত্মাজীর' চাদরের নীচে লুকানো বাঘনখ অস্ত্র আফজল বেগের মতো তারও পাঁজর-দেশকে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে ফেলেছে। মওলানা আযাদের ভাষায় : ''আমি আমার জীবনের সর্বাপেক্ষা কঠিন আঘাত পাই। আমি লক্ষ্য করি, তিনি পরিবর্তিত হয়ে গেছেন। এর চেয়েও আমি অন্তরে আরও আঘাত পাই ও আশ্চর্য হয়ে যাই যখন তিনি সর্দার প্যাটেলের যুক্তিগুলোরই পুনরুক্তি করেন। আমি তার কাছে দুই ঘণ্টা ওকালতি করি। কিন্তু তার মনে কোন প্রকার ছাপ ফেলতে অক্ষম হই।'' (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ২০৩, ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ ''উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান'', পৃঃ ৩৫৯-৬২)।
১৪ জুন তারিখে নিখিল ভারত কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ভারত বিভাগের প্রস্তাব উত্থাপন করেন পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এবং তার সমর্থনে প্যাটেল, নেহেরু ও গান্ধীর বক্তৃতার পর প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। (মওলানা আযাদ, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রীডম'', পৃঃ ২১৪, ডাঃ আবদুল ওয়াহিদ ''উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান'', পৃঃ ৩৫৯-৬২)। মিঃ নেহেরু এক বিবৃতিতে ঘোষণা করেন : ''যদি মুসলিম লীগ ইচ্ছা করে তাদের পাকিস্তান পাইতে পারে কিন্তু তাদেরকে এই শর্ত মানতে হবে যে, ভারতের যে সব অংশ পাকিস্তানে থাকতে ইচ্ছা প্রকাশ করবে না সে সব অংশ পাকিস্তানভুক্ত হবে না (আয়ান স্টিফেন্স, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৫, ১০০, ১৫)। মিঃ জিন্নাহর কাছে তখন আর এটা প্রকাশ পেতে বাকি রইল না যে, সারা জীবন যে কংগ্রেস ভারত বিভাগের বিরোধিতাকারী তারাই যখন এবারে বিভাগ চাইছে- তখন নিশ্চয়ই এটা একটা ষড়যন্ত্রের নাটক অভিনীত হচ্ছে।
কংগ্রেসী রাজনীতির মঞ্চে যখন এ নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে তখন তার পাশাপাশি বৃটিশ-কংগ্রেস যোগসাজশের ধারাও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। যেমন- প্যাটেল প্রস্তাবের মূল ভিত্তিতে ''মাউন্টব্যাটেন তাহার উপদেষ্টাদের সহিত পরামর্শ করিয়া একটি শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা রচনা করেন। এই পরিকল্পনায় প্রদেশগুলোর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয় এবং বলা হয় যে, ইচ্ছা করিলে তাহারা উপ-যুক্তরাষ্ট্র (Confederation) গঠন করিবে। পরিকল্পনায় বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের মাধ্যমে হিন্দু বাংলা ও অমুসলিম পাঞ্জাব গঠনেরও প্রস্তাব করা হয়। এই পরিকল্পনা ১৫ ও ১৬ এপ্রিল গবর্নরদের বৈঠক অনুমোদিত হয়। ২ মে লর্ড ইসমে এই পরিকল্পনা নিয়ে লন্ডনে যান। শ্রমিক সরকার কিছুটা সংশোধন করিয়া ইহা অনুমোদন করেন। ১০ মে বড়লাট ইহা ফিরিয়া পান। এই সময়ে মাউন্টব্যাটেন ও নেহেরু ইহার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। কারণ তিনি মনে করেন যে, ইহার ফলে কলকান অঞ্চলের মতো ভারতে বহু রাষ্ট্রের সৃষ্টি হইবে। নেহেরুর আপত্তির জন্য পরিকল্পনাটি বাতিল হইয়া যায় এবং নতুনভাবে পরিকল্পনা রচিত হয়। মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা সংশোধনের ভার তাহার শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভিপি, মেননের উপর ন্যস্ত করেন। মেনন তাহার পূর্বের প্রস্তাব অনুযায়ী খসড়া পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। ইহা ১১ মে নেহেরুকে দেখিতে দেয়া হয়। নেহেরু ইহা অনুমোদন করেন। এই পরিকল্পনা নিয়া মাউন্টব্যাটেন নিজে ১৮ মে লন্ডন যান। এটলী সরকার ইহা অনুমোদন করেন। ৩১ মে বড়লাট ভারতে প্রত্যাবর্তন করেন (আয়ান স্টিফেন্স, প্রাগুক্ত, পৃ ১৯৫, ১০০, ১৫)। মাউন্ডব্যাটেন ২ জুন নেহেরু, প্যাটেল, জে বি কৃপালনী, জিন্নাহ, লিয়াকত, আব্দুর রব নিশতার ও বলদেও সিং এই সাতজন নেতাকে এক বৈঠকে আমন্ত্রণ করেন। তিনি তাহার শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা নিয়া তাদের সহিত আলোচনা করেন। এই প্রধান দুইটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় প্রতিনিধিদের এ বৈঠকে ভইসরয় (ক) বাংলা বিভাগ, (খ) পাঞ্জাব বিভাগ, (গ) ভারতে অথবা পাকস্তিানে যোগদানের প্রত্যক্ষ ইস্যুতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে গণভোট এবং (ঘ) আসামের এক জেলা সিলেটে অনুরূপ গণভোট অনুষ্ঠান বিষয়ক বৃটিশ সরকারের প্রস্তাব বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি জানান যে, বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগের জন্য একটি বাউন্ডারি কমিশন গঠন করা হবে-কমিশনের সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত, অপরিবর্তনীয় এবং সংশ্লিষ্ট সকলের ওপর বাধ্যতামূলক (ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস, ওয়ালী খান, পৃঃ ১২৫]। ভাইসরয় মাউন্ট ব্যাটেন জানিয়ে দেন যে, দুই দলের নেতাদের কাছ থেকে তিনি তাৎক্ষণিক কোন প্রতিক্রিয়া আশা করেন না; তারা যেন নিজেদের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় আলোচনা করে অভিমত ব্যক্ত করেন। মিঃ জিন্নাহ জানান যে, এতবড় একটি বিষয়ে তাকে মুসলিম লীগ পার্টির কাউন্সিল অধিবেশন আহবান করে কাউন্সিলের মতামত গ্রহণ করতে হবে-ওয়ার্কিং কমিটির মতামতই যথেষ্ট হবে না। কংগ্রেস নেতারা জানালেন যে, 'চতুর' জিন্নাহকে যেন পরিস্থিতি পরিবর্তনের মতো সময় মঞ্জুর করা না হয়, তাকে একটি নির্ধারিত সময়সীমা দিয়ে দেয়া হোক। মিঃ জিন্নাহ সেদিন বিকালেই এ ব্যাপারে তার অভিমত জানাবেন বলে তার ওয়াদা আদায় করা হয়। কিন্তু তিনি স্থির সিদ্ধান্তে আসতে না পারায় অভিমত জানাতে বিলম্ব হয়। ভাইসরয় সেদিনই মধ্যরাতে তাকে লাট ভবনে হাজির হতে বাধ্য করেন। মিঃ জিন্নাহ হাজির হয়ে জানান যে, তিনি সংগঠনের নিয়মতান্ত্রিক প্রধান মাত্র। ''এ ব্যাপারে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের অভিমত নেয়া প্রয়োজন।'' মাউন্ট ব্যাটেন তাকে বলেন, ''মিঃ জিন্নাহ এ প্রশ্নে ফয়সালার যেসব ব্যবস্থা সম্পাদিত হয়েছে তা বানচালের কোন সুযোগই আমি আপনাকে দেবো না। আপনি যেহেতু মুসলিম লীগের পক্ষে এটা মেনে নেবেন না, আমি নিজেই তাদের তরফে কথা বলবো।'' ভাইসরয় এখানেই ক্ষান্ত না দিয়ে আরো বললেন যে, আগামী প্রভাতেই তিনি সকল নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দেবেন যে, জিন্নাহ তাকে সন্তোষজনক আশ্বাস দিয়েছেন এবং কোন অবস্থাতেই জিন্নাহকে সে ঘোষণার প্রতিবাদ করতেও দেয়া হবে না। মাউন্ট ব্যাটেন বলেন, ''এ ঘোষণার পর আমি যখন আপনার দিকে তাকাবো, আপনি শুধু এমনভাবে মাথা কাৎ করবেন, যাতে বোঝা যায় যে, আমি যা বলছি তা সঠিক।'' মাউন্ট ব্যাটেন আরো জানান, ''পরবর্তী সকালে অনুষ্ঠিত বৈঠকে জিন্নাহ কর্তব্যপরায়ণভাবেই মাথা নেড়েছিলেন।'' মিঃ জিন্নাহ যে সম্মতির মাথা নেড়েছিলেন, না অসম্মতি প্রকাশ করে নেড়েছিলেন তার সাক্ষ্য কিন্তু অন্য কোথাও মেলেনি। যে মাউন্ট ব্যাটেন কংগ্রেসের সাথে মিলে এতদূর পারলেন, তিনি অসম্মতিসূচক মাথা নাড়াকে সম্মতিসূচক বলে ধরে নিতে এবং তা নিজের পক্ষে সাফাই হিসেবে প্রকাশ করতে পারবেন না, তাকে এমন দুর্বলচেতা ভাববার কোন সংগত কারণ নেই। ......... এর পর ভারত, বাংলা, পাঞ্জাব বিভাগের প্রশ্নে মিঃ জিন্নাহ বা মুসলিম লীগের কাউকে কিছু বলতে দেয়া হয়নি-যা বলার মাউন্ট ব্যাটেন একাই বলেছেন। এভাবেই মাউন্ট ব্যাটেন ''সকলের সম্মতি'' লাভ করতে সমর্থ হন। ৩ জুন পরিকল্পনাটি প্রকাশিত হয় এবং নেহেরু, জিন্নাহ ও বলদেও সিং বেতার ভাষণে আপোষমূলকভাবে ইহা গ্রহণ করার কথা ঘোষণা করেন। ৪ জুন এক সাংবাদিক সম্মেলনে মাউন্ট ব্যাটেন জানান যে, '১৫ আগস্ট বৃটিশ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর করিবে' [ডঃ মুহম্মদ আবদুর রহিম, ''বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস'', পৃঃ ৩০০-৩০১]।
একটি বিষয় অত্যন্ত স্পষ্ট যে, কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হবার পর মারাঠী রাজপুতদের বর্ণহিন্দু নেতৃত্ব অথবা মোগলাই মেজাজের শেরোয়ানীসর্বস্ব পশ্চিমা নবাবজাদা-পীরজাদা খান্দানীদের মুসলিম নেতৃত্ব কোন মহলই বাংলার হিন্দু বা মুসলমানদের তেমন গুরুত্ব দেননি। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর থেকে '৪৭ পর্যন্ত বৃটিশ ভারতের একমাত্র বাংলা প্রদেশেই মুসলিম লীগ সরকার কায়েম ছিল এবং '৪৬-এর নির্বাচনে বাংলার মুসলমানরা ১১৯ জন মুসলিম লীগ প্রার্থীর ১১৬ জনকে জয়যুক্ত করে পাকিস্তান কায়েম সম্ভব করে। সে সময়ে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, সীমান্ত প্রদেশের কোথাও মুসলিম লীগ দল সরকার গঠন করতে পারেনি। [কোরেশী, হিস্টোরী অব দি ফ্রীডম মুভমেন্ট' পৃঃ ২৪১-৪৪; রব, 'সোহরাওয়ার্দী পৃঃ ৩৭; ইস্পাহানী, 'কায়েদে আজম', পৃঃ ১৪৩; জামিলুদ্দীন, ফাউন্ডেশন অব মুসলিম লীগ পৃঃ ২৭২]। তদুপরি সারা উপমহাদেশের ১১টি প্রদেশের মোট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ছিল বাঙালি তা সত্ত্বেও ভাইসরয়ের অন্তর্বর্তীকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় বাঙালি মুসলমানদের কোন প্রতিনিধিই লওয়া হয়নি এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের জায়গা করে দিতে গিয়ে বাঙালি হিন্দুদের একমাত্র প্রতিনিধি শরৎচন্দ্র বসুকেই মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় দেয়া হয়। এর দুই যুগ আগে মহাপ্রাণ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখের সাথে স্যার আবদুর রহীম, শেরে বাংলা ফজরুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখরা ১৯২৩ সালে বাংলার হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে দেশ শাসনের ওয়াদায় যখন ''বেঙ্গল প্যাক্ট'' স্বাক্ষর করেন তখনও পশ্চিমা ব্রাহ্মণ মাড়োয়ারীরা তা বানচাল করে দেয় [ব্রোমফিল্ড, ১৭৫-৭৬; কমরুদ্দিন সোস্যাল হিস্ট্রি অব ইস্ট পাকিস্তান, ২৫০-৫৯; রফিকুল ইসলাম, কাজী নজরুল ইসলাম জীবন ও কবিতা; পৃঃ ১৩৮-৩৯] এবং তার আগে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ 'পূর্ববঙ্গ ও আসাম' প্রদেশের প্রতি পশ্চিমা নবাবজাদা খানজাদারা সমর্থন প্রদানে অনীহা প্রকাশ করায় বাংলাদেশে মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং বেঙ্গল প্যাক্টের পরে কৃষক প্রজা পার্টির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩৮ সালে বাঙালি সুভাষ চন্দ্র বসু নিখিল ভারত জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলে মিঃ এম, কে, গান্ধীর 'নীরব ভেটো'র ধাক্কায় তিনি আসন ত্যাগ করতে বাধ্য হন। [রইস আহমদ জাফরী, ''ভারত যখন স্বাধীন হচ্ছিল''-মওলানা আযাদের, ''ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম''-এর টীকা গ্রন্থ]। পাশাপাশি দেখা যায়, ১৯৪১ সালে প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী হিসাবে বাংলার মওলবী ফজলুল হক এবং পাঞ্জাবের সিকান্দার হায়াত খান ভাইসরয়ের যুদ্ধকালীন উপদেষ্টা পরিষদে যোগদান করেন; সেই 'অপরাধে' ফজলুল হক মুসলিম লীগ থেকে 'বহিষ্কৃত' হন, কিন্তু সিকান্দার হায়াত খান পরিষদে না থেকেও ভাইসরয়কে সাহায্য-সহযোগিতার অনুমতি পেয়ে বেকসুর বিবেচিত হন [মোহাম্মদ ওয়ালি উল্লাহ, আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, পৃঃ ৩৬৩]। তবে ফজলুল হককে নাজেহাল করে মুসলিম লীগ ত্যাগে বাধ্য করার পেছনে কলকাতাকেন্দ্রিক অবাংলাভাষী অথচ ''নামে বাঙালি'' গ্রুপের সাথে ঢাকার নবাব পরিবার ও অন্যান্য খাজা-গজা-খানবাহাদুর, খানসাহেবদের নিয়ে গঠিত প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগদের চক্রান্তই ছিল প্রধানত দায়ী।
গান্ধীপন্থী পশ্চিমাদের হাতে বাস্তব শিক্ষা পেয়ে মিঃ শরৎ বসু কলকাতা ফেরার পরদিনই বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম তার বাড়িতে গিয়ে সাক্ষাৎ করলেন এবং প্রস্তাব করলেন যে, সাবেক বেঙ্গল প্যাক্টের অনুরূপ চুক্তির ভিত্তিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করা হবে-পশ্চিমা নেতাদের নেতৃত্বের পরিধি বাড়াবার প্রয়োজনে বাংলাকে বিভক্ত করতে দেয়া হবে না। দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় এ খবর প্রকাশের পর সারা বাংলায় আলোচনার ঝড় উঠলেও তদানীন্তন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও আবুল হাশিমের প্রস্তাবে জোর সমর্থন দান করেন। মুসলিম লীগ নেতাদের প্রগতিশীল অংশের সবাই স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করেন। জনাব আবুল হাশিম কলকাতার সুভাস ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত আজাদ হিন্দ ফৌজের বার্ষিক ভোজসভায় দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে স্বাধীন বাংলার পক্ষে তাদেরও সর্বসম্মত ও সর্বাত্মক সমর্থন লাভ করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট শরৎ চন্দ্র বসুর সাথে প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতা মিঃ কিরণ শংকর রায়, নলিনী রঞ্জন সরকার, সত্যরঞ্জন বখশীসহ অনেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এবং কংগ্রেস কাউন্সিলরও যোগদান করেন। স্বাধীন বাংলার স্বপক্ষে জনাব সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম মিঃ জিন্নাহর সাথে কয়েক দফা আলোচনা ও [Abul Hashim. In Retrospection : Dr. Enayetur Rahim, Provincial Autonomy in Bengal (1937-43)] যোগাযোগ করেন এবং শরৎ বসু ও কিরণ শংকর প্রমুখরা মিঃ গান্ধীর সাথে কয়েক দফা সাক্ষাৎ ও অনেকগুলো পত্র বিনিময় করেন। [আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেকশন পৃঃ ১৪৭, ১৫১-৬৩]।
এদিকে স্বাধীন বাংলা পরিকল্পনার আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছানোর পর বাংলার মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের নেতাদের সমবায়ে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি গঠিত হয় এবং ভাবী রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। উভয় দলের মিলিত সমাবেশে কংগ্রেসের পক্ষে শরৎ চন্দ্র বসু এবং লীগের পক্ষে আবুল হাশিম ১৯৪৭ সালের ২০ মে তারিখে উহাতে স্বাক্ষর করেন (আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেকশন, পৃঃ ১৪৭, ১৫১-৬৩)। স্বাধীন বাংলার এ সাংবিধানিক চুক্তিতে অন্যান্য বিধানের মধ্যে উল্লেখ্য ধারায় বলা হয় : ''বাঙলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচিত হবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সংখ্যানুপাতিক হারে প্রদত্ত আসনে যুক্ত নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী... গণপরিষদ নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত, বর্তমান মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিয়ে সমানসংখ্যক মুসলমান ও হিন্দু (তপশিলীসহ) সদস্যদের সমবায়ে নয়া মন্ত্রিসভা গঠিত হবে। উহাতে প্রধানমন্ত্রী থাকবেন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন হিন্দু। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত আইন পরিষদ ও মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সামরিক ও পুলিশ বাহিনীসহ সরকারের যাবতীয় চাকরিতে মুসলমানরা (৫৫% জনসংখ্যা হওয়া সত্ত্বেও) ৫০% অংশ নেবেন এবং হিন্দুরা (তফশিলীসহ) ৫০% পাবেন। (আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেক্শন, পৃঃ ১৪৭, ১৫১-৬৩)।
বাংলার হিন্দু -মুসলমান বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকদের বৃহৎ অংশ যখন মতৈক্যে পৌঁছে গেছে এবং আবুল হাশিম-শরৎ বসুর স্বাধীন বাংলা গঠন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে তখনই, ১৯২৪ সালের হিন্দু-মুসলিম বেঙ্গল প্যাক্ট বাতিলের মতো এটাকেও বাতিল করার জন্য ব্যাপকভাবে সক্রিয় হয়ে উঠলেন মারাঠী মহাত্মা-কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ চক্র। মিঃ এম, কে, গান্ধীর সাথে দুই দফা সাক্ষাৎ আলোচনা ছাড়াও অনেকগুলো পত্র বিনিময় হলো বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট মিঃ মঞরৎ বসুর। মিঃ গান্ধী তাকে অনেক ঘোরালো যুক্তি দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করলেন যে, বাঙ্গালী সংখ্যাগুরু মুসলমানদের সাথে থাকলে হিন্দুদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। কিচতেই যখন শরৎ বসু মিঃ গান্ধীর মত মেনে নিতে রাজী হচ্ছিলেন না, তখন মারাঠী 'মহাত্মা' শেষ খড়ঘাগাত হানলেন তার উপর। ৮ জুন তারিখের চিঠিতে তাকে জানিয়ে দিলেন, 'ঢের হয়েছে, আর নয়। অবিভক্ত বাংলা রাখতে জওয়াহের লাল নেহেরু ও বল্লভ ভাই প্যাটেল কোনক্রমেই রাজি নন। সুতরাং বাংলা ভাগ হবেই। এ ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।' (আবুল হাশিম, ইন রিট্রোসপেক্শন, গান্ধীর পত্র পৃঃ ১৫৪, ১৫৬)। হুমকি দিয়েই শেষ নয়। মারাঠী 'মহাত্মা' প্রচার চালালেন 'বাঙ্গা কংগ্রেসী ও তফশিলী হিন্দুরা মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে অবিভক্ত বাংলা দাবি করেছে।' ৯ জুন তারিখে মিঃ শরৎ বসু মিঃ গান্ধীর কাছে প্রেরিত তারবার্তায় অনুরোধ করলেন এই মিথ্যা অভিযোগের সূত্র এবং যারা ঘুষ খেয়েছে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করতে। ১০ জুন তারিখে তারযোগে মিঃ গান্ধী উহা প্রকাশ করতে অসামর্থ্য জ্ঞাপন করেন- কারণ অভিযোগটি ছিল মিঃ গান্ধীর উদ্ভাবিত, বানোয়াট। মিঃ গান্ধীর মাধ্যমে নিখিল ভারত কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির রেফারেন্স থাকলেও আসলে এটা ছিল গান্ধীরই অভিপ্রায়। মিঃ গান্ধীর ধমকে শরৎ বসু মত পাল্টালেন না, কিন্তু বুঝে নিলেন ১৯৩৮ সালে বাঙ্গালী সুভাষ বসু (শরৎ বসুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা) নিখিল ভারত কংগেসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েও এই গান্ধীর নম্রকুটিল বিরোধিতায় সে আসন থেকে নেমে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। শরৎ বসু কপালে করাঘাত করে বসে পড়লেন।
কেন্দ্রীয় কংগ্রেস হাই কমান্ডের নির্দেশে বাংলা কংগ্রেসের ডাক্তার বিধান রায় ও প্রফুল্ল ঘোষের দলভুক্ত গান্ধীবাদী নেতা-কর্মীরাও বাংলা বিভক্তির দাবিতে সোচ্চার হলেন। তবু দিল্লী ছুটলেন প্রাদেশিক কংগ্রেসের আরেক বাঙ্গালী নেতা মিঃ কিরণ শংকর রায়। শেষ চেষ্টা হিসাবে তিনি কৃপালনী-নেহেরু-প্যাটেলের কাছে অনুনয়-বিনয় করে জানালেন, 'দয়া করে বাংলাকে বিভক্ত করবেন না। সেখানে আমরা একসাথে থাকতে চাই' 'তার সে কাতরোক্তির প্রতি কেউ কর্ণপাত করলেন না। ১৪ জুন কেন্দ্রয়ি কংগ্রেস অধিবেশনের প্রেসিডেন্ট আচার্য কৃপালনীর সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে যখন বাংলাকে বিভক্ত না করার কাতর প্রার্থনা জানাচ্ছিলেন বাংগালী কিরণ শংকর রায়, তার বিগলিত অশ্রু কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। (ডাক্তার আবদুল ওয়াহিদ, উপমহাদেশের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলমান, পৃঃ ৩৬৭, মওলানা আযাদ, ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম, পৃঃ ২১৬-১৭)। কিন্তু ডি, এল, রায়ের কল্পিত চরিত্র কৌপীনধারী কৌটিল্যের আধুনিক উত্তরসূরী গুজরাটী 'মহাত্মা।' তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অনাবৃত থাকলেও অসাম্প্রদায়িকতার চাদরে আবৃত বক্ষদেশ ছিল লৌহকঠিন বর্মে বেষ্টিত। কিরণ শংকর রায় কুলীন হলেও আর্য ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিতে তিনি 'বংগজ' 'ক্ষেত্রজ' কুলনি তার অশ্রুর ছিটা লেগে তাদের বুক আর্দ্র হবার নয়। কল্পিত ব্রাহ্মণ কৌটিল্য অনার্য চন্দ্রগুপ্তের কল্যাণে চন্দ্রগুপ্তের কাতর প্রার্থনা উপেক্ষা করে তারই ভ্রাতার শিরোচ্ছেদ করেন, কঠিনখড়ঘাতে। কৌপিনধারী আর্য মিঃ গান্ধীও বাঙ্গালী হিন্দুদের কল্যাণেই বংগজ রায় বসু বাবুদের প্রার্থনায় পদাঘাত করে কুঠারাঘাতে ''বাংলা মা''-কে লাকড়িচেলা করার নির্দেশ দেন। (আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত)।
প্রাদেশিক কংগ্রেসকে ধমক দিয়ে বশ করার আগেই ব্রহ্মণ্যবাদের স্বনামী বাহিনী হিন্দু মহাসভাকেও তারা মাঠে নামিয়ে দেন। হিন্দু মহাসভা ও মহাসভাপন্থী কংগ্রেসী নেতাদের উদ্যোগে ভাইসরয়কে প্রেরিত বিশ হাজার টেলিগ্রামে বাংলা বিভক্তির দাবি করা হয়। (মোহাম্মদ ওয়ালিওল্লাহ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯৮)) ১৯৪৭ সালের ২২ ফ্রেব্রুয়ারি তারিখে বাংলার গবর্নর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ-এর সাথে শ্যামা প্রাসাদ মুখার্জীর একান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। (আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৭)। পরদিনই তিনি পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দাবি করেন, মুসলমানদের জন্য যদি ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান হতে পারে হিন্দুদের জন্যও বাংলা বিভক্ত হয়ে হিন্দু বাংলা গঠিত হতে হবে। বাংলার হিন্দুরা 'হিন্দু বাংলা' চায়। ভাইসরয় গ্রীন সিগনাল দেন প্রাদেশিক গবর্নর ফ্রেডারিক বারোজকে, আর গান্ধী-নেহেরু-প্যাটেল চক্র ইঙ্গিত পাঠান হিন্দু মহাসভার প্রেসিডেন্ট শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীকে। ভারতীয় কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট কৃপালনী উহার সমর্থনে পত্রিকায় বিৃবতি দেন। ১৫ এপ্রিল তারিখে হিন্দু মহাসভার উদ্যোগে তারকেশ্বরে অনুষ্ঠিত হলো সম্মেলন। তাতে হিন্দু বাংলা গঠনের দাবি পাস হলো। ভারত বিভাগের মতো বাংলা বিভাগের ব্যবস্থা এতদিনে পাকপোক্ত হয়ে গেল (আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৭)।
বাংলাকে অবিভক্ত রাখার ব্যাপারে মিঃ জিন্নাহর সাথে সংযোগ রক্ষা করছিলেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। মিঃ জিন্নাহ অবিভক্ত বাংলা বহাল রাখার পক্ষে সমর্থন জানিয়ে যাচ্ছিলেন। (আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, ওয়ালী খান, ফ্রাক্টস আর ফ্রাক্টস, পৃঃ ১২৮)। বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনকে ২৬ এপ্রিল তারখে জানান যে, তাকে পরিমিত সময় দেয়া হলে তিনি বাংলাকে অবিভক্ত রাখার ব্যাপারে সবাইকে সম্মত করতে পারবেন। জিন্নাহকেও তিনি এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারবেন এবং সেক্ষেত্রে বাংলার পাকিস্তানভুক্ত হবার প্রয়োজন পড়বে না'' (ওয়ালী খান, ফ্রাক্টস আর ফ্যাক্টস, পৃঃ ১১৬)। জনাব সোহরাওয়ার্দীকে মিঃ জিন্নাহর সাথে সাক্ষাতের কোন সুযোগ না দিয়েই, সেদিন মাউন্টব্যাটেন মিঃ জিন্নাহর সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করেন এবং অতিভক্ত বাংলা সম্পর্কে তার মতামত জানতে চান। মাউন্টব্যাটেন লিখেছেন, ''কোনরূপ ইতস্তত : না করেই মিঃ জিন্নাহ উত্তর দেন, আমি তাতে অত্যন্ত খুশি হবো। কোলকাতা বাদ দিয়ে বাঙলার কি দাম আছে'' (ওয়ালী খান, ফ্যাক্টস আর ফ্যাক্টস, পৃঃ ১১৬; এইচ, ভি, হডসন, দি গ্রেট ডিভাইড, পৃঃ ২৪৬)।
এ সময়ে মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনা বিবেচনা ও গ্রহণের জন্য দিল্লীতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় সংগঠনের প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় পরিষদে নির্বাচিত সদস্যদের পৃথক পৃথক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অবিভক্ত বাংলার দাবিদার লীগ সদস্যদেরকে নিয়ে জনাব আবুল হাশিম এবং কংগ্রেস সদস্যদেরকে নিয়ে মিঃ শরৎ বসু দিল্লী পৌঁছেন। দিল্লী রেল স্টেশনেই মিঃ শরৎ বসুকে দিল্লীর মহিলারা জাঁটা হাতে মিছিল করে বিরূপ সম্বর্ধনা জানায়। (মরহুম আবুল হাশিমের মুখে শ্রুত)। জনাব আবুল হাশিম দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে উপস্থিত হলেই নোয়াখালীর লীগ নেতা জনাব আবদুল জববার খদ্দর ছুটে এসে তাকে জানান, হাশিম ভাই, আমাদের পরাজয় হয়ে গেছে। কায়েদে আযম বাংলা বিভাগ মেনে নিয়েছেন-জনাব সোহরাওয়ার্দী তাকে সমর্থন জানিয়েছেন। (আবুল হাশিম, প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৯)। মাউন্টব্যাটেনের আর্কাইভস, ডায়রী ও চিঠি-পত্র ভিত্তিক গ্রন্থাবলী অনেক পরে (১৯৭৬) লিখিত ও প্রকাশিত হওয়ায় তখনকার মতো ঘটনাগুলো সবার কাছেই ছিল রহস্যাবৃত। অনেকেই ভেবেছিলেন কায়েদে আজম ও জনাব সোহরাওয়ার্দী মত পাল্টিয়েছেন। আসলে মাউন্ট ব্যাটেন তখন যদি সুসংগঠিত মহাশক্তিশালী জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নেহেরুর কাছে ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌ-বাহিনী ও বিমানবাহিনীর অধিনায়কদের আনুগত্যের শপথ করিয়ে সারা ভারতের শাসনক্ষমতা এককভাবে কংগ্রেসের হাতেই দিয়ে দিতেন তাহলেই বা কায়েদে আজম কি করতে পারতেন। ২রা জুন রাত্রে মাউন্টব্যাটেন মিঃ জিন্নাহকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সে কথা জানিয়েও দেন। [ল্যাপিয়ার ও কলিন্স, মাউন্টব্যাটেন এন্ড দি পার্টিশন অব ইন্ডিয়া] কার্যতঃ এভাবেই ভাইসরয়ের ফরমান জারির মাধ্যমে ভারত বিভাগের ফর্মূলা বাস্তবায়িত করা হয়। বিধান দেয়া হয় যে, প্রত্যেক প্রদেশের আইন পরিষদের সদস্যরা প্রথমে মিলিত বৈঠকে প্রস্তাব পাস করবেন, সংশ্লিষ্ট প্রদেশ পাকিস্তানে না হিন্দুস্থানে যোগ দিবে এবং প্রদেশকে বিভক্ত করতে তারা রাজি আছেন কিনা। হিন্দু মহাসভা পন্থীরাতো ''হিন্দু বাংলা'' দাবীই করছিল, কংগ্রেস সদস্যদের প্রতিও কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের নির্দেশ ছিল বাংলা বিভাগে সমর্থন দানের। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমপন্থীদের প্রভাব খর্ব করে পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করতে ব্যাগ্র নাজিমুদ্দীন শাহাবুদ্দীনপন্থী মুসলিম লীগ গ্রুপের পক্ষ থেকে তখন প্রচার চালানো হয় যে, কায়েদে আজম স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে এবং অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তানভুক্ত করার পক্ষে ভোটদানের জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। তদনুযায়ী বংগীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের ২০ জুন তারিখের অধিবেশনে মুসলিম সদস্যরা বাংলাকে অবিভক্ত রাখার ও পাকিস্তানভুক্ত করার পক্ষে ভোটদান করেন। স্যার নাজিমুদ্দিন, পার্লামেন্টারী জাদুকর খাজা শাহাবুদ্দিন, রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান প্রমুখ মহল এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন। মুসলিম লীগের প্রস্তাবে অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানভুক্তির দাবিতে এবারে সকল হিন্দু সদস্যই শংকিত হলেন। ফলে এ অধিবেশনে ১২৬-৯০ ভোটে অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তানভুক্ত রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিভক্তিকরণ ফর্মূলার অংশহিসেবেই ১৫ মিনিট পরে অনুষ্ঠিত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর সদস্যদের বৈঠকে ৫৬-২১ ভোটে পাস হয়ে গেল বাংলাকে বিভক্ত করার প্রস্তাব। একই পদ্ধতিতে দ্বিখন্ডিত হলো পাঞ্জাব প্রদেশও।
তারপরই সবকিছু এগিয়ে চললো ১৯৪৬-এর ডিসেম্বরে প্যাটেল ভি.পি. মেনন পরিকল্পিত দেশকে শিরায়-উপশিরায় বিভক্ত করার কর্মসূচি। র্যাটক্লিফ রোয়েদাদ ঘোষিত হলো। ঘোষিত হলো বাউন্ডারী কমিশন। কিন্তু র্যাটক্লিফ রোয়েদাদের ঘোষিত নীতি সীমানা নির্ধারণে অনুসৃত হলো না [ডাক্তার আবদুল ওয়াহিদ, প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৭২] কথা ছিল সীমানা নির্ধারণের বেলায় যতোদূর সম্ভব প্রাকৃতিক সীমানা অনুসরণ করা হবে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা পূর্ব পাকিস্তানে আসবে। কিন্তু ভাগিরথী নদী হাজার হাজার বছর ধরে রাঢ় বাংলা ও মূল বাংলার সীমানা নির্ধারণ করে বয়ে চললেও এবারে তা উপেক্ষিত হলো। হিন্দু প্রধান থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যন্ত ভারতভুক্ত করার জন্য এমন সীমারেখা টানা হলো যে, কোথাও কোথাও বাড়ির বাসগৃহ পাকিস্তানে এবং পাকঘর ও গোয়ালঘর পড়লো হিন্দুস্থানে। অথচ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমগ্র মুর্শিদাবাদ জেলা, যার অনেকাংশ ভাগিরথীর পূর্ব পারে অবস্থিত, বীরভূমের বামপুর হাট মহকুমা, আসামের করিমগঞ্জ মহকুমা সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে ভারতভুক্ত করে দেয়া হলো। সিলেটকে পাকিস্তানে দেয়া হলো ন্যায় বিচারের জন্যে নয়- আসামে মুসলমানদেরকে নিশ্চিত সংখ্যালঘু করার লক্ষ্যে।
সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ঢাকেশ্বরী, লক্ষ্মীনারায়ণ, চিত্তরঞ্জন ও মোহিনী মিল বস্ত্রকল এবং ছাতক সিমেন্ট কারখানা ছাড়া আর কোন কল-কারখানা এলো না। সেগুলোও ছিল সম্পূর্ণ পুঁজিহীন। পূর্ব সীমানার সম্পদশালী পাহাড়গুলোকে হিন্দুস্থানে রেখে পাকিস্তানকে সামরিক স্ট্রাটেজিতে দুর্বল করে দেয়া হলো। বিভক্তিকরণ সমাপ্ত হলেই স্পষ্ট হলো প্যাটেল, মেনন, নেহেরু, গান্ধী, মাউন্টব্যাটেনের গোপন বৈঠকও সলাপরামর্শের স্বাভাবিক পরিণতি।
সুতরাং এপার বাংলা ওপার বাংলা বিভক্ত করেছেন মারাঠী কাশ্মীরী আর্য ব্রাহ্মণ্য নেতৃত্ব এবং অবিভক্ত বাংলার দাবি সমর্থন করেও, স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব বরদাশত করতে পারেননি বংগীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগেরই মোগলাই মেজাজের বাংলাবাসী কিন্তু উর্দুভাষী উন্নাসিক নবাব নাইট খাজাগজা, খান বাহাদুর, খানসাহেবেরা-নিছক ক্ষমতা দখলের চিরস্থায়ী ব্যবস্থা কায়েমের মতলবে। আর তাতে সমর্থন যুগিয়েছেন বাংগালী নামধারী এ অঞ্চলের তথাকথিত খান্দানী বৃটিশপোষ্য প্রতিক্রিয়াশীল মহল। বাংলার সাধারণ মুসলমানদের সাথে সম্পর্ক-বর্জিত হলেও তারাই পরে হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের কর্ণধার। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের সাথে বিশ্বাস রক্ষা না করার পরিণতিতেই এক পাকিস্তান ভেঙ্গে গেছে। তবু এপার বাংলা আজ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ওপার বাংলায় বাবুরা আজ বড় বিলম্বে বড় বেচঈন।
কোলকাতা মহানগরীর প্রাসাদরাজি বিত্ত-সম্পত্তিতে বাংগালী বাবুদের কোন অংশ নেই। সারা পশ্চিমবঙ্গের কল-কারখানার মালিক তারা নন-সবকিছুই পশ্চিমা মাড়োয়ারীদের। কোলকাতার পথে চলার সময়ে দোকান দফতরের নামফলকগুলোও বাংগালী সন্তানেরা পড়তে পারে না। সবই হয় হিন্দীতে না হয় ইংরেজীতে লেখা। বাংগালী বাবুরা এখন স্বদেশে প্রবাসী। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কোলকাতা থেকে ফারাক্কাতে সরিয়ে নেবার উদ্যোগ হয়েছে মাড়োয়ারীদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার মতলবে।
এতদিনে যদি বাংগালী বাবুদের বোধোদয় হয়ে থাকে, আর তারই আন্তরিক শ্লোগান হয়, 'এপার বাংলা-ওপার বাংলা এক হও'; আমরাও সে শ্লোগানে সাড়া দেবার বিষয় বিবেচনা করতে রাজী হবো। তবে তার আগে বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় তাদেরকে বলবো, ''তাইলে দুইহান কতা আছে।''
আমাদের দেশ যতই ক্ষুদ্র হোক, আমরা যতই গরীব হই-এপার বাংলা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কোলাকুলি গলাগলি হয় সমান অবস্থানে দাঁড়িয়ে, উপরে-নীচে দাঁড়িয়ে নয়। গোলামে-স্বাধীনে মৈত্রী হয় না। আমরা পিন্ডি ছেড়েছি, আপনারাও দিল্লী ছাড়ুন।
আপনারা মাড়োয়ারীদের গৃহভৃত্য থাকবেন আর এপার বাংলা আপনাদের সেবাদাস হবে-গৃহভৃত্যের সেবাদাস। ভাবতে মজা লাগে, কিন্তু সে-কি সম্ভব? আপনারা দিল্লীর খোঁয়াড়ে জাবর কাটতে কাটতে হাম্বা হাম্বা ডাক ছাড়বেন, আর সেই আহবানে আকৃষ্ট হয়ে বাংগাল বলদেরা হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে আপনাদের সাথে একই খোঁয়াড়ে ঢুকে পড়বে, বন্দিত্ব বরণ করবে- এমনটি ভাবাও, আপনারাই বলুন, নেহায়েত বেকুবি নয় কি?
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বৈমাত্রিক আচরণ করছে না কেন্দ্রীয় সরকার। রাজ্যের অভিযোগ উড়িয়ে আজ একথা বলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। তিনি জানিয়েছেন, ঋণ মকুবের যে আর্জি কেন্দ্রের কাছে জানিয়েছে রাজ্য, তা বিবেচনা করার জন্য বলা হয়েছে অর্থ কমিশনকে। অন্যদিকে, ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলিকে সাহায্যের ইস্যুতে রাজনৈতিক খেলা খেলছেন চিদম্বরম। এভাবেই পাল্টা আক্রমণে গেলেন তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন। তিনি বলেন, দ্বাদশ অর্থ কমিশনের রিপোর্টে ঋণগ্রস্ত রাজ্যগুলির জন্য বিশেষ ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা রয়েছে। অথচ সেই সবের উল্লেখ না করে অহেতুক বিতর্ক তৈরি করছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
আর্থিক প্যাকেজ নিয়ে কেন্দ্র বঞ্চনা করছে বলে বারবার অভিযোগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিলেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
শুধুমাত্র আর্থিক প্যাকেজ নয়, ঋণ মকুব নিয়েও বারবার সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, শুধু এ রাজ্যই নয়, ঋণে জর্জরিত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রের সরকারের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে অর্থ কমিশনের কাছে জানতে চেয়েছে কেন্দ্র।
রাজ্যের জন্য বিশেষ আর্থিক প্যাকেজের বিষয়টিও নিয়েও খোলসা করেননি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী।
ডিজেলের দাম ৪৫ পয়সা বাড়ানর সিদ্ধান্ত নিল তেল সংস্থাগুলি। আজ মাঝরাত থেকে বর্ধিত মূল্য লাগু হতে চলেছে বলে ইন্ডিয়ান অয়েলের তরফে জানানো হয়েছে। প্রট্রোলের দাম লিটার প্রতি ২ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় ফের দাম বাড়ল ডিজেলের।
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না থাকলেও ডিজেলের দাব বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয় প্রট্রোলিয়াম মন্ত্রকই। গত তিন মাসে এই নিয়ে তিন দফায় দাম বাড়ল ডিজেলের।
চলতি বছরের শুরুতে তেল সংস্থাগুলিকে ডিজেলের দাম প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ পয়সা করে বারানোর ছাড়পত্র দেয় কেন্দ্র। তেল সংস্থাগুলি যতক্ষণ না ক্ষতির পরিমাণ কাটিয়ে উঠতে পারছে ততদিন দাম বৃদ্ধির পথেই হাঁটার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সরকারের সঙ্গে সংঘাতের জেরে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে সোমবার বৈঠকে বসবে কমিশন। রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সরকারের সঙ্ঘাত তুঙ্গে। সরকার একতরফা ভাবে পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা করে দেওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে নির্বাচন কমিশন।
পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারায় বলা আছে, কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করে পঞ্চায়েত ভোটের দিন ঘোষণা করার অধিকার রাজ্য সরকারের পঞ্চায়েত দফতরের।
ওই আইনেরই ৪৩ নম্বর ধারায় বলা আছে, ভোটের নির্ঘণ্ট প্রকাশের দায়িত্ব কমিশনের। সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলে সরকারকে তা পুনর্বিবেচনা করতে বলতে পারে কমিশন।
যদিও সেই সম্ভাবনার কথা মানতে নারাজ পঞ্চায়েতমন্ত্রী।
সমাধান সূত্র না বেরোলে কমিশন আদালতেও যেতে পারে। ২০০৩-এ সালে আমেদাবাদ পুর নির্বাচন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের হওয়া মামলায় হেরে যায় সরকার।
কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলাতেও কমিশনের সুপারিশ মেনেই রাজ্য সরকারকে কাজ করার নির্দেশ দেয় আদালত। কংগ্রেস নেতা, আইনজীবী অরুনাভ ঘোষ আবার সরকারের আচরণে অন্য ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন।
প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় আবার শোনালেন আরও ভয়ঙ্কর আশঙ্কার কথা।
আক্রান্ত হওয়ার পরে হাসপাতালে শুয়েই বলেছিলেন, পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে নামার চেষ্টা করবেন। আর শনিবার নেমেই পড়লেন প্রবীণ সিপিআইএম বিধায়ক রেজ্জাক মোল্লা। রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার বিরুদ্ধে, ঘরছাড়া দলীয় কর্মীদের ঘরে ফেরানোর দাবি সহ একাধিক ইস্যুতে আজ ভাঙড়ে মিছিলে নেতৃত্ব দিলেন রেজ্জাক মোল্লা। মিছিল শুরু হল কাঁটাতলা থেকে, ছয়ই জানুয়ারি যেখানে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রবীণ সিপিআইএম বিধায়ক। ছয়ই জানুয়ারি কাঁটাতলা পুড়ে যাওয়া দলীয় কার্যালয় দেখতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছিলেন প্রবীণ বিধায়ক আবদুর রেজ্জাক মোল্লা। শনিবার সেখানেই সভা করল সিপিআইএম।
এলাকার মহিলাদের নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলাতেই তিনি আক্রান্ত হন দাবি করলেন রেজ্জাক মোল্লা।
হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ের কথা বলতে গিয়ে শিল্পমন্ত্রীকে কটাক্ষ করলেন একেবারে নিজস্ব ভঙ্গিতে।
ভাঙড়ের ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রতিক আরও কয়েকটি ঘটনার সম্পর্কও খুঁজে পাচ্ছেন রেজ্জাক মোল্লা।
সভায় সিপিআইএমের জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী বললেন, তাঁদের নেতাদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে তৃণমূল।
সুজনবাবুর অভিযোগ, দুই তৃণমূল নেতা টাকার লোভ দেখিয়ে নিহতের বাবাকে দিয়ে সাদা কাগজে সই করিয়ে নেন।
ঘটনাটা প্রকাশ্যে আসে শনিবার নিহত যুবকের বাবা নিজেই সাত্তার মোল্লার কাছে আসার পরে।
শনিবার কাঁটাতলার সভায় উপস্থিত থেকে রেজ্জাক মোল্লা বুঝিয়ে দিলেন পঞ্চায়েত ভোটে দলকে নেতৃত্ব দিতে তিনি তৈরি।
২৬ এপ্রিল জেলায় পঞ্চায়েত ভোটের ঘোষণার পরেই দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ভোটপ্রচারে নামল সিপিআইএম নেতৃত্ব। রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসার প্রতিবাদ, ঘরছাড়া দলীয় কর্মীদের ঘরে ফেরানোর দাবি সহ একাধিক ইস্যুতে আজ ভাঙড়ে মিছিল-সমাবেশের ডাক দিয়েছে সিপিআইএম।
সকাল সাড়ে নটা নাগাদ কেএলসি থানার কাঁটাতলা থেকে শুরু হওয়া মিছিলে পা মেলান রেজ্জাক মোল্লা, সত্তার মোল্লা সহ একাধিক নেতানেত্রীরা। কাঁটাতলায় সিপিআইএমের দলীয় কার্যালয় সামনে থেকে শুরু হয় মিছিল। গত ৬ জানুয়ারি এই কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ এবং রেজ্জাক মোল্লাকে শারীরিক আক্রমণের অভিযোগ উঠেছিল শাসকদলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
ধর্ষণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখার তীব্র সমালোচনা করলেন তাঁরই দলের সাংসদ কবীর সুমন। তাঁর মতে, আধুনিকতার জন্যে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলা অর্থহীন। সেইসঙ্গে রাজ্যের সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা, পঞ্চায়েত নির্বাচন ও কেন্দ্রীয় অনুদান প্রসঙ্গেও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে সরব তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ।ভিও- বিভিন্ন ইস্যুতে বার বার মুখ খুলেছেন। দলের অস্বস্তি বাড়লেও নিজের অবস্থানে অনড় থেকেছেন। ব্যতিক্রম হলনা শনিবারও। শুক্রবারই বিধানসভায় রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় সব মহলেই বিতর্কের ঝড় ওঠে। শনিবার মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের সমালোচনায় সরব হন কবীর সুমন।
রাজ্যের অন্নুয়নের দায়টা প্রতিটি সভায় নিয়মকরে কেন্দ্রীয় সরকারের কাঁধে চাপিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন্দ্রের টাকা না দেওয়ার প্রসঙ্গে দলনেত্রীর যুক্তি মানতে নারাজ কবীর সুমন।
পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে ফের বিতর্ক উসকে দিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। আজ তিনি বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে মানতে হবে। এটাই আইন। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে গেলে নির্বাচন পর্বকে যেভাবে ভাগ করা দরকার, সেভাবেই ভাগ করা হয়েছে। এর পিছনে কোনও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।
স্বাভাবিক ভাবেই পঞ্চায়েতমন্ত্রীর আজকের মন্তব্যে সরকার ও কমিশনের মধ্যে সংঘাতের পথ আরও প্রশস্ত হল।
এই প্রসঙ্গে এদিনই প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন কমিশনকে অগ্রাহ্য করে পঞ্চায়েতের নির্ঘণ্ট ঘোষণা সুরকারের `কাপুরুষোচিত` সিদ্ধান্ত।
অন্যদিকে, এক তরফাভাবে পঞ্চায়েত ভোটের বিজ্ঞপ্তি জারি করার পর আগামী সোমবার বৈঠকে বসতে চলেছে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। সেখানেই কমিশন তাঁদের পরবর্তী পদক্ষেপ চূড়ান্ত করবে। মূলত তিনটি সম্ভাবনার কথা উঠে আসছে। রাজ্যের কথা মেনে দু`দফায় ভোটে রাজি হয়ে যেতে পারে নির্বাচন কমিশন। আবার সিদ্ধান্ত না মেনে রাজ্যকে ফের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য বলতে পারে। এক্ষেত্রে রাজ্যপালের দ্বারস্থ হতে পারে রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কোনও রফাসূত্র না বেরোলে সুষ্ঠু পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে নির্বাচন কমিশন।
গতকালই বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে রাজ্যের পঞ্চায়েত দফতর। সেখানে কমিশন যে যে প্রস্তাব রাজ্যকে পাঠায়, তার একটিও মানা হয়নি। ২৬ এবং ৩০ এপ্রিল দুদফায় নির্বাচনের বিজ্ঞপ্তি জারি করে শুক্রবার কমিশনকে চিঠি দিয়েছে রাজ্য। বুথ পাহারার জন্য ভিনরাজ্য থেকে সশস্ত্র পুলিস আনা হলেও, কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রস্তাব পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছেন পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
চেক নয়, চেকের ফটোকপি। বিনপুরের সভায় দাঁড়িয়ে ঝাড়গ্রামের নটি শহিদ পরিবারের হাতে চেকের ফটোকপিই তুলে দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। চেকের বদলে ফটোকপি পেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন চেক প্রাপকরা। প্রশাসন থেকে ব্যাঙ্ক, নানা মহলে ঘুরেও উপযুক্ত জবাব পাননি। ২৪ ঘণ্টার খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পর অবশ্য বিভ্রান্তি দূর হল। কিন্তু উত্তর মেলেনি বহু প্রশ্নেরই।
বিনপুরে মুখ্যমন্ত্রীর হাত থেকে চেক পাওয়ার পর কিছুটা আশাবাদী হয়েছিলেন মাওবাদী হামলায় নিহতদের পরিবার। কিন্তু চেক ভাঙাতে গিয়েই বিপত্তি। প্রশাসনের কর্তাদের প্রশ্ন করলেও তাঁরা কোনও উত্তর দিতে পারেননি।
২৪ ঘণ্টায় এ খবর সম্প্রচারিত হওয়ার পরই মুখ খোলে জেলাপ্রশাসন। জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তা জানান, নিয়ম বা রীতি অনুযায়ী চেক নয়, প্রাপকদের দেওয়া হয় চেকের ফটোকপি। প্রাপকের নামে টাকা ব্যাঙ্কে ফিকসড ডিপোজিট করে দেওয়া হয়।
কিন্তু চেকের বদলে যে চেকের ফটোকপি দেওয়া হয়েছে সে কথা প্রাপকদের জানানো হল না কেন? তার অবশ্য সদুত্তর মেলেনি জেলাশাসকের কাছ থেকে। এরচেয়েও বড়কথা চেক প্রাপকদের দাবি, ব্যাঙ্কে গিয়ে তাঁরা জানতে পেরেছেন, শুক্রবার পর্যন্ত তাঁদের নামে কোনও ফিক্সড ডিপোজিটও হয়নি। এক্ষেত্রেও জেলাপ্রশাসনের বক্তব্য, পদ্ধতিগত কারণেই সময় লাগে ফিকসড ডিপোজিট হতে। তাহলে কি তড়িঘড়ি মুখ্যমন্ত্রীর হাত দিয়ে চেকের ফটোকপি বিলি করা হয়েছে? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি জাতীয়তাবাদ
একবার কলকাতায় গিয়েছি একটা কাজে। তখন আমদের বসবাস দিল্লিতেই। হাতে পয়সাকড়ি যা আছে, তাতে দু-তিনদিনের বেশি চলবে না। ক্রেডিট কার্ডের কোনও গল্প নেই। তখনও আমি দিল্লিতে অধ্যাপনার চাকরি পাইনি, ইন্টারভিউ দিয়ে চলেছি। সবাই করুণার হাসি হেসে বলছেন, চেনাজানা ছাড়া কি আর জেনেরাল ক্যাটিগরিতে চাকরি হয়! স্ত্রী ফোনে বলছেন দিল্লিতে ফিরে যেতে, কাজ মাথায় থাকুক। কিন্তু আমার দুটো একটা বিষয়ে বেশ বাঙালপনা আছে। যদিও অর্ধাঙ্গিনী বলেন যে আমি ঘটিফায়েড বাঙাল। সেটা খাদ্যাভাসে।
আমি রবীন্দ্র সদনের সিঁড়ির এককোনায় বসে ছিলাম। সঙ্গে কোনও বন্ধু নেই। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই চত্বরটা খুব প্রিয় ছিল। সবদিনের মতই সেদিন কিছু একটা অনুষ্ঠান চলছে। কিছু বিশেষ অনুষ্ঠান, কারণ একের পর এক ধুতি পাঞ্জাবি ও জমকালো শাড়ি পরিহিত অভিজাত পঞ্চাশোর্ধ বাঙালি নারী-পুরুষ এসে গাড়ি থেকে নামছিলেন, এবং উদ্যোক্তারা সমাদর করে তাদের ভেতরে নিয়ে যাচ্ছিল। কোনও অল্পবয়সী অভ্যাগতকে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছিল, যে এটাই খুব সম্ভবত বাঙালিয়ানা। এক্সক্লুসিভ, নাক-উঁচু, উচ্চ-ভ্রূ, মেনোপজ়াল, এবং সংস্কৃতিপরায়ণ। এর সঙ্গে সাধারণ বাঙালির, জীবনযুদ্ধে নামা বাঙালির, যুবা-বাঙালির যোগ কোথায়?
বাঙালি বললে বহুদিন ধরে শুধু বাঙালি হিন্দু বোঝানো হয়েছে, আজও পশ্চিমবঙ্গের অনেক স্বল্পশিক্ষিত মানুষ এইভাবে বাঙালি শব্দটা ব্যবহার করেন। আমরা বাঙালি এবং ওরা মুসলমান। আর বাঙালি হিন্দু বললে অবশ্যই বাঙালি ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ। আমাদের দেশভাগ হবে না তো কাদের হবে!
বাঙালি জাতীয়তাবাদ কি? সাধারণ বাঙালির সঙ্গে এর সম্পর্ক কি? বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কি জ্যাঠা জাতীয়তাবাদ বলে যায়, অর্থাৎ এ শুধু বিভিন্ন ক্ষেত্রের জ্যেষ্ঠদের একচেটিয়া? স্টার আনন্দের প্যানেল আলোচনায় যারা স্টুডিও আলো করে বসে থাকেন, তাঁরা কি আমাদের জাতির অভিভাবক? বাঙালি জাতীয়তাবাদ মানে কি অবাঙালি বা বিদেশিরা কোনও বাঙালিকে সাফল্যের স্বীকৃতি দিলে তাই নিয়ে খবরের কাগজ ও নিউজ় চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ়? একজন লিখেছিলেন, বাঙালির শুধু সৌরভ গাঙ্গুলি ও অমর্ত্য সেন, দুটি বই ল্যাজ মোর নাই রে! যেমন কিছুদিন আগে আনন্দবাজারে খবর হল যে বাঙালি বিজ্ঞানি আমেরিকার জন্য যুদ্ধবিমান বানিয়েছেন। যেমন সেরা বাঙালির পুরস্কার দেওয়ার জন্য আ.বা.প. সিঙ্গাপুর, দিল্লি, বম্বে ও অ্যামেরিকা থেকে বাঙালি খুঁজে আনে। প্রশ্ন হল, এই হ্যাংলামি ও আদেখলেপনা কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? বিদেশ-বিভুঁইয়ে দু-একটি বাঙালির সাফল্যে ছাগলের তিননম্বর ছানার মত লম্ফ দেওয়া কি বাঙালি জাতীয়তাবাদ? এবং সর্বোপরি, এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি কেন হল, যে বাঙালির জীবনে বামফ্রন্ট হল ভিত্তি আর আনন্দবাজার হল ভবিষ্যৎ?
হাজার বছর ধরে বাঙালি জাতি শাসিত হচ্ছে comprador শ্রেণির দ্বারা। বৌদ্ধধর্মের বিলুপ্তির পরে যে দুটি ধর্ম আমাদের গ্রাস করেছে, সনাতন ধর্ম ও ইসলাম, দুটিই পশ্চিম থেকে আগত। বৌদ্ধধর্ম আমাদের মননের খুব কাছাকাছি ছিল, ভৌগলিক দিক থেকেও সেই নৈকট্য খুব প্রকট, কারণ এটি ছিল পূর্বভারতের ধর্ম। সনাতন ধর্মের জাতপাত আমাদের কুৎসিত অভিশাপ। আর পূর্ববঙ্গে প্রচারিত ইসলামের গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা, ভিন ধর্মের প্রতি নোংরা বিদ্বেষ এবং ভিনধর্মীকে নিকেশ করে পূণ্যার্জন এসবের কথা যত কম বলা যায় ততই ভাল।
আমাদের সমাজ যাঁরা শাসন করছেন, গত হাজার বছর ধরে করে আসছেন, তাঁরা যথাক্রমে সনাতন ধর্ম ও ইসলামের অনুমোদিত দালাল শ্রেণি। এটা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান দুর্বলতা। এই সমস্যা, যেমন ধরুন, দ্রাবিড় জাতীয়তাবাদের হয়নি। কেন হয়নি সে প্রসঙ্গে একটু পরে আসছি।
বিষয়টা অবশ্য এমন একদেশদর্শী নয়। বাঙালি উচ্চবর্ণ সবসময় দালালি করেননি। ভক্তি আন্দোলন এই সনাতন ধর্মী নিপীড়নকে কিছুটা স্তিমিত করেছিল। আমি চৈতন্যের কথা বলছি। আচারভ্রষ্ট, এই অভিযোগ এখানকার উচ্চবর্ণের বিরুদ্ধে বহুবার উঠেছে। বাঙালি ব্রাহ্মণকে উত্তরভারত ঠিক ব্রাহ্মণ বলে মানেও নি কখনও। তার কারণ অনেকগুলি। আমাদের উচ্চারণ, খাদ্যাভ্যাস, রক্তে প্রবল ভেজাল (বস্তুত বাঙালি উচ্চবর্ণের অনেকের গায়ের রঙ ঘোর কালো, ওদিকে বর্ণ কথাটার মূল অর্থই ছিল গাত্রবর্ণ। বাঙালি উচ্চবর্ণ নৃবিদ্যা অনুসারে অস্ট্রিক, মোঙ্গল, এবং দ্রাবিড় রক্তের অনেক বেশি কাছাকাছি, সেটা আমরা যারা উত্তরভারতে থাকি, ভালোরকম বুঝি)। আর সীমিতভাবে হিন্দু উচ্চবর্নের মধ্যে একটি রেনেসাঁস, রিফর্মেশন ও এনলাইটেনমেন্ট হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দিতে, সেটা নস্যাৎ করা উচিত নয়।
ইসলামের ইতিহাস আমি খুব বেশি জানি না, তবে লালন ফকির আছেন। যদিও তিনি আসলে হিন্দু ছিলেন, এবং সনাতন ধর্মের ছুঁৎমার্গের সমস্যায় পড়ে কিভাবে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তা আমাদের জানা। বাঙালি মুসলমানরা অধিকাংশই ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ বা হিন্দু, এবং এই ধর্মান্তরকরণ তরবারির জোরে কিছুটা হয়েছে এটা সত্যি। ইসলামি শাসকরা ছ'শো বছর বাংলার অধিকারি ছিলেন এবং অধুনা বাংলাদেশ (যার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম) ইসলামি মৌলবাদিদের খানিকটা দখলে। কাজেই এমন হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ধর্মান্তরকরণ মূলত হয়েছে সনাতনধর্মের জাতপাতের সমস্যায়। সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, পূর্ববঙ্গে ইসলাম এসেছিল সাম্যের বার্তা নিয়ে, নাবিকদের মাধ্যমে, আর পশ্চিমবঙ্গে তা ছিল পাঠান-মোঘল শাসকের রক্তচক্ষু। তাই এমন আশ্চর্য কাণ্ড দেখতে পাওয়া যায়। বাকি ভারতে ইসলাম ছড়িয়েছে একভাবে, বাংলায় অন্যভাবে। ইসলাম ভারতের পশ্চিমে থাকল, যা তার সাম্রাজ্য বিস্তারের itinerary তেই পড়ে। বাংলায় এসে সেটি পালটে গেল। পশ্চিম নয়, পূর্ব ইসলামে আস্থা জানাল। যদিও প্রাতিষ্ঠানিক ইসলাম সেই সাম্যপরায়ণ প্রাক্তন বৌদ্ধদের খুব শিগগিরি গ্রাস করে নিয়ে এক মনোলিথিক ধাঁচায় পুরে দিতে দেরি করবেনা।
বাঙালি হিন্দু সমাজের দুটি প্রধান উচ্চবর্ণ, ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ, দুটিই এসেছে উত্তরভারত থেকে। কিংবদন্তি, রাজা আদিশূর পাঁচটি ব্রাহ্মণ ও পাঁচটি কায়স্থ আনিয়েছিলেন। আহা, সেই দত্ত কারও ভৃত্য নয় গল্পটি জেনে দত্তদের প্রতি আমার বেশ পক্ষপাত জন্মে যায়। যদিও অনেক বাঙালি আজও কায়স্থরা যে উত্তরভারতীয় তা ঠিক জানেন না। অমিতাভ বচ্চন একজন কায়স্থ। ওড়িশাতেও কায়স্থরা একটি প্রধান, আধিপত্যময় জাত এবং সেখানে এরা করণ বলে পরিচিত। পট্টনায়করা এই জাতের অন্তর্গত। এরা সিভিল সার্ভেন্ট ও কেরাণির কাজ করতেন, কাজেই সরকারের কাজে অপরিহার্য। বাঙালি বৈদ্যরা একটু অন্যরকম কেস, এ বিষয়ে আলাদাভাবে কিছু লিখতে চেষ্টা করছি, তাই এখন আর কিছু লিখলাম না। বাঙালি নিম্নবর্ণের মধ্যে নমশূদ্ররা একটি ভীষণ আকর্ষণীয় ইতিহাস বহন করেন, এবং সে ব্যাপারে আমি খুবই আগ্রহী ও কিঞ্চিত পড়াশোনা করছি, এবং তাঁদের বিষয়ে একটি লেখায় হাত দিতে চাই, তাই ও ব্যাপারেও আর কিছু লিখলাম না।
একটা বড় অংশের নিম্নবর্গীয় বাঙালিরা ইসলাম গ্রহণ করায়, উচ্চবর্নের বিরুদ্ধে, সনাতন ধর্মীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে যেভাবে দ্রাবিড় আন্দোলন গড়ে উঠতে পেরেছিল, সে সম্ভাবনা বাংলায় দেখা দেয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় বাংলায় এস সি ফেডারেশন যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল, এর নেতারা মুসলিম লিগের সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ হয়ে পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থন করেছিলেন। যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল স্বাধীন পাকিস্তান সরকারের মন্ত্রীও হন। এরপরের ইতিহাস অত্যন্ত ট্র্যাজিক। তিনি ১৯৫০ সালে প্রাণ বাঁচাতে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং কলকাতার ঠাকুরপুকুর অঞ্চলের একটি বস্তিতে ৫৬ সালে মারা যান। বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্নের পাকিস্তানের দাবীকে সমর্থনের জন্য দুয়েকটি হিন্দুপ্রধান জেলা পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়, কাজেই উচ্চবর্গীয় নেতারা যোগেন্দ্রকে ক্ষমা করবেন না, জানা কথা। দেশভাগের ট্র্যাজেডি আসলে বাঙালি হিন্দু নিম্নবর্ণের ট্র্যাজেডি। এবং সেই যে এস সি ফেডারেশনের শিড়দাঁড়া ভেঙ্গে যায়, আজ পর্যন্ত নিম্নবর্ণরা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে (বাংলাদেশের কথা ছেড়েই দিলাম, সেখানে হিন্দুরা ক্রমশ দেশত্যাগ করছে) ব্রাত্য হয়েই আছেন, বাকি ভারতে যেখানে দলিতদের (অন্তত তাদের একটা অংশের) ক্ষমতায়ন হয়েছে। বাঙালি দলিত পূর্বে অর্ধচন্দ্র খেয়েছেন, আর পশ্চিমে মরিচঝাঁপি পেয়েছেন।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান সমস্যা এই। এদিকে ভদ্রলোক শাসিত, ওদিকে মুসলিম এলিট শাসিত (একজন ঐতিহাসিক লিখেছিলেন, এদিকে ব্রাবৈকা, ওদিকে শেসৈকা। অর্থাৎ এদিকে ব্রাহ্মণ বৈদ্য কায়স্থ, ওদিকে শেখ সৈয়দ কাজি)। পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থি আন্দোলন, যেটি আসলে কাঁঠালের আমসত্ব থেকে গেছে, এই ভদ্রলোক ডমিনেশন আর স্তালিনবাদি ভালগার মার্ক্সবাদের যুগলবন্দীতে (একে রামে রক্ষা নেই, সুগ্রীব দোসর) একের পর এক বিপর্যয় ঘটিয়ে এখন খুব সঙ্গত কারণেই গঙ্গাপ্রাপ্তির অপেক্ষায়।
দেশভাগ, ১৯৫০এর গণহত্যা এবং আমার মামার বাড়ির গল্প
Author : Sushanta Blog :সুশান্ত....Sushanta.... Date: 11/14/2012 3:14:00 PM
করিমগঞ্জের বর্তমান বাড়িতে শিবমন্দির এবং বিগ্রহ |
একটি সাক্ষাৎকারঃ
নামঃ গোপিকা রঞ্জন সেন।জন্ম তারিখঃ ১৬-০১-১৯৩৪। জন্মস্থানঃনিজ কুরুয়া, থানা ঃ বালাগঞ্জ, জিলাঃশ্রীহট্ট।পিতার নামঃ ৺হরমোহন সেন।পূর্ব পাকিস্তানে থাকা কালীন আপনার পেশাঃ ছাত্র। পূর্ব-পাকিস্তানে থাকা কালীন পিতা/মাতার পেশাঃ গৃহস্থি।দেশভাগের আগে ও পরে আপনার ধর্মঃ হিন্দু।পূর্বপাকিস্তানে আপনার ঠিকানাঃ ঐ। মাতার নাম ও তাঁর পৈত্রিক ঠিকানাঃ ৺নীরদা বালা সেন; গ্রামঃ কেয়ামপুর, সদর সিলেট। মামার নামঃ ৺অধর চন্দ্র দেব।ভারতে আপনার ঠিকানাঃ করিমগঞ্জ। ( ঘাট লাইন, রায়নগর )প্রথম ঠিকানাতে অতিবাহিত সময়ঃ অদ্যাবধি প্রথম ঠিকানাতে আছি। পূর্ব পাকিস্তানে ফেলে আসা সম্পত্তি (ঐতিহাসিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ কোনও সম্পত্তি বা বস্তু থাকলে তার বিষয়েও লিখুন) ঃ বসত বাড়ী এবং ধানক্ষেতের জমি। ভারত সরকার কর্তৃক বণ্টিত সম্পদঃ (X )।ভারতে আপনার আগমনের বিস্তৃত বৃত্তান্তঃ আলাদা ভাবে যুক্ত। আপনার সঙ্গে আর ক'জন বা ক'টি পরিবার যাত্রা শুরু করেঃ আমাদের পরিবার একক ভাবেই আসিয়াছি। পূর্বপাকিস্তানে থেকে যাওয়া আপনার কোনো আত্মীয়ের নাম ও ঠিকানাঃ মামাতুতো ভাইয়েরা বর্তমানে বাংলাদেশে তাদের নিজস্ব বাড়িতেই আছে, কিন্তু যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়া আপনার আত্মীয়দের দেশভাগ –পূর্ব অবস্থা (আর্থিক-সামাজিক)ঃ সম্পন্ন পরিবার। তাদের বর্তমান পরিস্থিতিঃ জানা নাই। আপনার পরিবারের কোনো সদস্য বা কোনো আত্মীয় কি দেশভাগের সময় বা যাত্রাকালে নিহত হয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করুনঃ না। আপনার পরিচিত অন্য কেউ কি দেশভাগের সময় নিহত হয়েছিলেন? সেক্ষেত্রে প্রেক্ষাপট বর্ণনা করুন।: না। আপনাদের সাথে কি কোনো সশস্ত্র প্রতিরক্ষা সহচর ছিল (মিলিটারি, পুলিশ বা অন্য কেউ) ? থাকলে নাম ও পদবীঃ না। ভারতে তৎকালীন প্রবেশ স্থলঃ সুতারকান্দি বর্ডার।
দেশভাগের কথা জানার পর আপনার ব্যক্তিগত কী অনুভূতি হয়েছিল? ঃ দুঃখজনক। সামগ্রিকভাবে দেশভাগ সম্পর্কে আপনার অনুভূতি কী? দেশভাগ কি অনিবার্য ছিল?: দেশভাগ অনিবার্য্য ছিল না, দেশভাগের ফলে লক্ষ লক্ষ হিন্দু পরিবার স্থায়ী বাড়িঘর ত্যাগ করিয়া নিঃস্ব ও উদবাস্তু হইয়াছে। অনেকে প্রাণ হারাইয়াছে। শত শত হিন্দু রমনীরা ধর্ষিতা হইয়াছে। আপনার মতে কি ভারত , পাকিস্তান, এবং বাংলাদেশ আলাদা আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে বর্তমানে ভালো আছে? ঃ না।দেশভাগের পর আপনার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থা কি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে?ঃ আমরা সংগ্রাম করিয়া জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করিতেছি। আপনার বন্ধু বান্ধবী, পরিবার-পরিজন বা অন্য কারো সাথে কি আপনি পুনর্মিলিত হতে চান বা তাদের বর্তমান অবস্থা জানতে চান? ঠিকানা বা কোন তথ্য দিতে পারেন? ঃমামাতুতো ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা অবশ্যই আছে। আপনার কি বর্তমান বাংলাদেশ সরকার থেকে কিছু চাইবার আছে? বিশেষ করে অর্পিত সম্পত্তি আইন উঠে যাবার পর?: আমাদের ফেলে আসা সম্পত্তি উদ্ধারের ব্যাপারে সাহায্য করার যদি কোন সুযোগ থাকে। (সম্পত্তির দলিলাদি আমাদের নিকট আছে।)
১৯৪৭ ইংরেজীতে দেশভাগ এবং আমাদের ভারতে আগমনের বৃত্তান্তঃ
আমাদের বাড়ি শ্রীহট্ট জিলার সদর মহকুমায় ছিল। শ্রীহট্ট জিলার ৫টি মহকুমা ছিল। যথাক্রমে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলবীবাজার, সদর সিলেট এবং করিমগঞ্জ। দেশভাগের পরে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা চিহ্নিত করার সময় সম্পূর্ণ শ্রীহট্ট জিলাকে পূর্ব্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। করিমগঞ্জ মহকুমার মাত্র ২টি থানা ভারতের সংগে যুক্ত রহিয়াছে।
দেশভাগের আগে বর্ত্তমান বাংলাদেশে (পূর্ব্ব পাকিস্তান) হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করিয়া আসিয়াছেন। দেশভাগের আগে পূর্ব্বপাকিস্তানের ( বর্ত্তমান বাংলাদেশ) সংগে রেল, বাস এবং রেল, বাস এবং জলপথে ভারতের সংগে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল।পূর্বপাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে আমি একজন ভূক্তভোগি হিসাবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এখানে তুলিয়া ধরিতেছি।
১৯৫০ ইং ( ১৩৫৭ বাংলা) ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে ( তারিখ মনে নাই) আমি এবং আমাদের গ্রামের একটি ছেলে ( আমরা দুইজনই তখন স্কুলের ছাত্র) করিমগঞ্জ যাওয়ার উদ্দেশ্যে By train শ্রীহট্ট হইতে কোলাউড়া নামক রেল জংশনে আসি। এখান হইতে পৃথক ট্রেইনে করিমগঞ্জ যাইতে হইবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা কোলাউড়া জংশনে পৌঁছিয়া করিমগঞ্জ যাওয়ার কোনো Train পাই নাই। Train না থাকার কারণে হিন্দুমুসলমান বহুযাত্রী কোলাউড়া জংশনে আটক পড়িয়া যান।
সন্ধ্যার পরে একজন মুসলমান ব্যক্তি মাইক যোগে ঘোষনা করিতে লাগিল, মুসলমা যাত্রিরা কেহ যেন ঐ দিন করিমগঞ্জ না যান। আমি ঐ ঘোষক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিলাম কেন এই ঘোষণা? সে আমাকে বলিল এই ঘোষণা শুধু মুসলমান যাত্রিদের জন্য।
আমরা প্লেটফর্মে হাটাহাটি করিতেছি, এমন সময় আমাদের পরিচিত জনৈক মুসলমান কলেজ ছাত্রের সংগে দেখা হইল। তাহাকে আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম করিমগঞ্জ যাওয়ার Train বন্ধ কেন ? সে তখন আমাদিগকে একটু দূরে নিয়া গিয়া প্রকৃত ঘটনা আমাদিগকে বলিল। সকালে একটি Train কোলাউড়া হইয়া করিমগঞ্জ গিয়াছে। ভৈরব নামক স্থানের একটি সেতুর উপর উক্ত Train দাঁড় করাইয়া নৃশংসভাবে অনেক হিন্দু যাত্রিকে খুন করা হইয়াছে এবং মৃতদের লাস নদীতে ফেলিয়া দেওয়া হইয়াছে। Train এর প্রতিটি কামরা রক্তে লাল ছিল। ঐ Train করিমগঞ্জ পৌছার পর Train এর কামরাগুলিতে রক্ত দেখিয়া করিমগঞ্জের মানুষ উত্তেজিত হইয়াছে। এবং সেখানে কিছু গোলমাল হইয়াছে। Train টিকে সেখানে আটক রাখা হইয়াছে। ঐ Train ফেরৎ না আসায় এখান হইতে কোন Train করিমগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করিতেছে না। একই কারণে করিমগঞ্জ না যাওয়ার জন্যে মুসলমান যাত্রিদের নিষেধ করা হইতেছে।
উক্ত ছাত্রটি আমাদিগকে আরো জানাইল যে, সরকারের সমর্থণে সমগ্র পূর্ব্বপাকিস্তান ব্যাপিয়া সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাইবার একটি পরিকল্পনা রচনা করা হইয়াছে। ভৈরব নামক স্থানে একটি সেতুর উপর Train আটক করিয়া যে হিন্দু নিধন যজ্ঞ হইয়াছে তাহা উক্ত পরিকল্পনারই অঙ্গ এবং দাঙ্গা যে সমগ্র দেশ ব্যাপিয়া ছড়াইয়া পড়িবে এই ঘটনা তাহারই ইঙ্গিত বহন করিতেছে।
আমরা করিমগঞ্জ যাইবার চেষ্টা না করিয়া নিজনিজ বাড়িতে ফিরিয়া যাইবার জন্য সে আমাদিগকে অনুরোধ করিল।আমাদের বাড়ি শ্রীহট্ট শহর হইতে ১০ মাইল দক্ষিণে। আমরা যদি রাতের Train এ বাড়ীতে যাইতে হয় তা হইলে বাড়ীতে পৌছিতে অনেক রাত হইয়া যাইবে। তাই আমরা বাড়ীতে না যাইয়া কোলাউড়া হইতে ২ ঘণ্টার রাস্তা মঙ্গলো বাজারের পাশে আমাদের আত্মীয় বাড়ীতে যাওয়াই যাওয়াই স্থির করি এবং যথাসময়ে Train এ উঠি। উক্ত Train মঙ্গলো বাজার ষ্টেশনে রাত ১১- ৩০ মিনিটে পৌছে। আমরা Train হইতে নামিয়া যাই এবং নির্দ্দিষ্ট সময়ে Train খানা উক্ত ষ্টেশন ছাড়িয়া যায়। ষ্টেশন হইতে আমাদের আত্মীয় বাড়ী পায়ে হাটিয়া যাইতে আধা ঘণ্টা সময় লাগিবে। Train হইতে নামিয়া যাইবার সময় একজন লোক আমাদের Ticket চাহিয়া নিয়া গেল আমরা আত্মীয় বাড়ি যাওয়ার রাস্তা ধরিয়া হাটিতে আড়ম্ভ করিয়াছি এমন সময় ৮/১০জন লোক লাঠি ছুরি লইয়া আমাদিগকে ঘেরাও করিয়া মারামারি আরম্ভ করিল এবং আমাদের সংগে সমস্ত জিনিস পত্র লুটপাট করিয়া লইল। এই ফাঁকে প্রাণ বাঁচাইবার জন্য আমরা দৌড়াইতে আরম্ভ করিলাম তাহারা আমাদের পিছনে ধাওয়া করিল বটে কিন্তু আমাদিগকে ধরিতে পারে নাই। আমরা রাত প্রায় ১ ঘটিকার সময় আত্মীয় বাড়ী পৌছিয়াছি।
আমরা সেখানে গিয়া জানিলাম তাহাদের আশেপাশে বাজারে দোকানগুলো ঐদিনই লুটপাট করা হইয়াছে এবং তাহারাও আতঙ্কের মধ্যে রহিয়াছেন। আমরা পরদিন ভোরে একজন মুসলমান লোককে সংগে নিয়া মুসলমান পোষাক পরিধান করিয়া 'ছনখাইড়' নামক একটি গ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। সেখানে পৌছিয়া জানিলাম যে আগের দিন তাহাদের আশে পাশের বাজারগুলোও লোটপাট হইয়াছে। ঐদিনই সকাল ১০ ঘটিকায় প্রায় ৫০০০ লোক উক্ত ছনখাইড় গ্রাম আক্রমণ করিয়াছে। সকল জিনিষ পত্র লোটপাট করিয়া নিয়া গিয়াছে। এই গ্রামে প্রায় ৫০০ পরিবার হিন্দুর বাস ছিল। গ্রামের মেয়েরা জঙ্গলে যাইয়া লুকাইয়া থাকায় তাহাদের ইজ্জত রক্ষা পাইয়াছে।
আমরা সেখান হইতে মুসলমান পোষাকে একজন লোক সংগে নিয়া আমাদের বাড়ীতে পৌঁছাই। বাড়ি পৌঁছিয়া জানিলাম আমাদের গ্রাম সহ আশেপাশের অন্যান্য গ্রামগুলাও আক্রান্ত হইয়াছে। দেশের অন্যান্য অংশ হইতেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংবাদ আসিতে লাগিল।
করিম গঞ্জ বাজারে আমার বাবার একটি ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছিল। তাই আমি আমার মা ও ভাই বোনকে নিয়া করিমগঞ্জ চলিয়া আসি। আসার সময় সুতারকান্দি বর্ডারে আমার মায়ের সোনা গহনা যাহা ছিল সব তাহারা রাখিয়া দেয়।আমাদের গ্রামের তথা দেশের অন্যান্য অংশের লোকজন বাড়িঘর ত্যাগ করিয়া বিভিন্ন সীমান্ত দিয়া ভারতে প্রবেশ করে। ভারতে আসিয়া অধিকাংশ লোকই আশ্রয় শিবিরে আশ্রয় নেয়। করিমগঞ্জ আশ্রয় শিবির হইতে অনেক লোককে দোহালিয়া নামক জায়গায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পুনর্বাসন দেওয়া হইয়ছিল। সেখানে মেলেরিয় রোগে আক্রান্ত হইয়া অনেক লোক মারা গিয়াছিল।
এখানে একটি কথা উল্লেখ করা আবশ্যক, দাঙ্গার সময়ে পূর্ব্ব পাকিস্তানের সরকার হইতে হিন্দুদের কোন রকম নিরাপত্তা দেওইয়া হয় নাই। বরং হিন্দুদের পক্ষ থেকে থানায় সাহায্য প্রার্থণা করিতে গিয়া গালাগালি শুনিতে হইয়াছে।
আমাদের ভারতে আগমন এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি এখানে তুলিয়া ধরিলাম, তাহা আমার জ্ঞান বিশ্বাস মতে সম্পূর্ণ সত্য!
শ্রী গোপিকা রঞ্জন সেন
০২-০৭-১২
আমাদের সংযোজনঃ
আমার মামারা তিন ভাই, সবচে' ছোট আমার মা। গোপিকা রঞ্জন আমার বড় মামা। এর পর থেকে মামা বলেই উল্লেখ করব। সম্ভবত তাঁদের দেশ ছাড়বার বছরে আমার মায়ের বয়েস তিন ছিল। যদিও কোনো একক সাক্ষাৎকার বা স্মৃতিকথা কোনো পূর্ণাঙ্গ চিত্র তুলে ধরে না তবু বেশ কিছু আগ্রহব্যঞ্জক তথ্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যে হাঙ্গামা শুরু হয়েছিল প্রায় তিনমাস আগে ডিসেম্বর ১৯৪৯ থেকে তার সম্পর্কে তিনি কিছুই প্রায় জানতেন না কোলাউড়া স্টেশনে আসবার আগে অব্দি। মুসলমান যাত্রীদের করিমগঞ্জ যেতে মানা করা হচ্ছে শুনে কোন ভয় শংকারও কারণ দেখেন নি। সম্পন্ন গৃহস্থ মানে ধনী কৃষকের ঘরের সন্তান তিনি, করিমগঞ্জে আগে থেকেই আছে পৈত্রিক ব্যবসা। বাবা ওখানেই আছেন। যেতে আসতে কোনো সীমান্ত চৌকি ছিল বা ভিসা পাসপোর্ট দিতে হতো এমন সংবাদ নেই। যিনি ঘোষণা করছেন তাকেই গিয়ে জিজ্ঞেস করছেন কারণ। পরে যার থেকে জানলেন তিনি কলেজে পড়া ছাত্র মাত্র নয়। দেশের খবরাখবর রাখেন এবং খবরের ভেতরের খবর রাখবার যোগ্যতাও রাখেন। রাষ্ট্র নিজে এটা সংগঠিত করছে এটা বোঝেন এবং বোঝাতে পারেন। তিনি মুসলমান। কিন্তু বক্তা এবং স্রোতার পরস্পরের মধ্যে নিজেদের পরিচিতি নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। নেই সংশয়। অথচ সেদিনই সামান্য দূরে ভৈরব সেতুতে কয়েক শত হিন্দু যাত্রীদের উপর আক্রমণ নেমেছে। তিনি তাদেরকেও বাড়ি ফিরে যাবার পরামর্শ দেন। আত্মীয় বাড়ি যাবার পথেও আক্রান্ত হলেন, গিয়েও জানলেন আশেপাশের বাজারে সেদিন হামলা হয়ে গেছে তারপরেও পরদিন সকালে মুসলমান সঙ্গীকে নিয়ে ছনখাইড় পথ ধরতে অসুবিধে হয় নি। ছনখাইড়ে গিয়ে শুনলেন সেখানেও আগুন জ্বলেছে। মেয়েরা জঙ্গলে গিয়ে প্রাণ বাঁছিয়েছে। সেখান থেকেও বাড়ি যাবার নিরাপত্তা পাওয়া গেল আরেক মুসলমান সঙ্গীর থেকে। রাষ্ট্র কী আচরণ করত এসব তাঁর শোনা কথার থেকে কিছু জানা যাচ্ছে। এসব হামলা থেকে বাঁচাবার কোন উদ্যোগই ছিল না। বরং পুলিশে নালিশ করলে গালিগালাজ শুনতে হতো হিন্দুদের। তাদের প্রত্যক্ষ বাজে অভিজ্ঞতাটি এই যে যখন একেবারে চলে আসছিলেন তখন সুতারকান্দি সীমান্তে তাঁর মায়ের সোনা গহনা 'তাহারা' রাখিয়া দেয়। আমরা অনুমান করতে পারি ওদিককার সীমান্ত সুরক্ষা বাহিনীর কথা বলা হচ্ছে। একেবারে নিরাশ্রয় তারা হলেন না কিন্তু । এ যেন ওবাড়ি থেকে এবাড়ি চলে আসা। ওবাড়িতে শুধু আর যাবেন না। করিমগঞ্জে ব্যবসা না থাকলে চলে আসতেন কি? জানি না। সবটাইতো আর নিরাপত্তাহীনতার গল্প নয়। সেই মুসলমান কলেজ পড়ুয়া ছাত্রটি থেকে শুরু করে বাড়ির পথের মুসলমান সঙ্গীদের আশ্বাস বলে এক বাস্তবতাও ছিল তো? সম্ভবত সেগুলো অনেককে আটকেও রেখেছিল।যেমন তাঁর মামাদের।তাঁরা কিন্তু চলে আসেন নি।
আমি আমার পরিবারের কথা কিছু জানি। আমার বাবা সে অর্থে কোনকালেই বাংলাদেশ থেকে চলে আসেন নি। ১৯৬৪ নাগাদ নাগাল্যাণ্ড সরকারের চাকরি নিয়ে তুয়েনসাং জেলার সামাতুরে চলে যান। সেখানে থাকতেই দেশের বাড়িতে তাঁর বাবা মারা গেলে দূরত্বের জন্যে তিনি আসতে পারেন নি। পরের বছর এসছিলেন। পরের বছর যখন করিমগঞ্জে গিয়ে বিয়ে করেন তখনো দেশের বাড়ি হাত ছাড়া হয় নি। কিন্তু সেখানে গেছেন বলে শুনিনি। কারণ ওখানে মহিলা বলে কেউ নেই। তাঁর মা গত হয়েছিলেন বাবার আগেই। ততদিনে তাঁর বড় তিন বোনেদেরও বিয়ে হয়ে গেছে এবং তাদের পরিবার এসে গেছেন অসমে। ছোট দুই ভাই ছিলেন ,তারাও জীবিকার সন্ধানে শিলচরে এবং গুয়াহাটিতে তখন। বাড়িটি আছেই। সেই বাড়ি নিয়ে কোনো আগ্রহ দেখান নি বাবা—এই অভিমান পরে অনেক শুনেছি মেজো কাকার কাছে। ১৯৫২ থেকে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হলেও মনে হয় না খুব কড়াকড়ি ছিল। আমাদের পরিবারের কারো কোন পাসপোর্ট ছিল না। তার দরকার আছে বলেও মনে হয় না কেউ ভাবতেন। শুধু ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধের পর থেকেই সমস্ত যোগাযোগ তাদের বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিল সে দেশের সঙ্গে। এই তাদের দেশভাগ।
কী হয়েছিল তবে ১৯৫০ এ ঃ
দেশভাগের তিন বছর পর এই হাঙ্গামা কেন? মুসলমানের দেশে হিন্দুকে মারা হবে--- এ আর বিচিত্র কী কথা! –এভাবে কেউ কেউ ভাবতে পারেন। কিন্তু এ আসলে অতিসরলী করণ হয়ে যাবে। আসলে এটি ছিল ১৯৭১এর মুক্তি যুদ্ধের গর্ভযন্ত্রণা।দু'বছর পরেই কিন্তু ১৯৫২র ভাষা আন্দোলন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি। এটা আমাদের বোঝা ভালো। ১৯৪৯এর ডিসেম্বরে কমিউনিষ্ট দমনের অভিযান দিয়ে শুরু হয়েছিল ঘটনাক্রমের। খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমাতে কালশিরা গ্রামে কমিউনিষ্ট সন্দেহে পুলিশ ধরতে যায় জয়দেব ব্রহ্মকে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রীকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করে। তিনি চেঁচালে প্রতিবেশি লোকেরা এসে মেরে পুলিশ তাড়িয়ে দেয়। একজন পুলিশ মারাও গেছিল। তারই প্রতিশোধ নিয়ে পরদিন জেলার পুলিশ সুপার সশস্ত্র পুলিশ এবং আনসার বাহিনী ( ভারতের হোমগার্ডের মতো অনেকটা) নিয়ে এসে কালশিরা এবং পাশের হিন্দু গ্রামগুলোতে আক্রমণ নামান। সাধারণ মুসলমান গুণ্ডাদের উস্কে রেখেছিলেন লুটপাট এবং ঘরে আগুন দিতে। সেই শুরু। সেই মাসেই প্রায় হাজার ত্রিশেক লোক খুলনা ছেড়ে ভারতে চলে আসেন। জানুয়ারিতে পুলিশ একই রকম তেভাগা আন্দোলনের ঘাটি রাজশাহী জেলার নাচোলে সাওঁতালদের উপর আক্রমণ নামায়। বিখ্যাত নেত্রী ইলা মিত্রকে তখনই পুলিশ থানাতে নিয়ে গিয়ে অমানবিক অত্যাচার এবং ধর্ষণ করে। ইলা মিত্র চিকিৎসার জন্যে এবং মামলা এড়াতে ১৯৫৪এর জুনে কলকাতা চলে এসে থেকে গেলেও অত্যাচারিত সাঁওতালরা চলে এসছিলেন পাকাপাকি সেরকম খবর নেই। হয়। ১০ ফেব্রুয়ারিতে প্রাদশিক বিধান সভাতে কংগ্রেস সদস্যরা কালশিরা এবং নাচোলের ঘটনা নিয়ে আলোচনার দাবি জানালে অধ্যক্ষ অনুমতি দেননি। প্রতিবাদে কংগ্রেস সদস্যরা বেরিয়ে আসেন। সেদিনই ঢাকাতে আক্রমণ নামে। বিমান বন্দরে পলায়নরত যাত্রীদেরকে হত্যা করা বরিশাল , ময়মন সিংহ, নোয়াখালিতেও আক্রমণ নামে। বরিশালে যে আক্রমণ নামে সেটিই বোধকরি ভয়াবহ ছিল। প্রায় ছ'লাখের উপর মানুষ শুধু সেই জেলা থেকেই পালিয়ে ভারতে এসছিলেন। নোয়াখালিতে আক্রান্ত অধিকাংশই ত্রিপুরাতে প্রবেশ করেছিলেন। সব মিলিয়ে দশলাখের বেশি মানুষ সেবারে গোটা দেশ ছেড়ে ভারতে এসছিলেন।
আমার মামা যে ভৈরব সেতুর কথা উল্লেখ করেছেন সেটির সরকারি নাম ছিল এণ্ডারসন ব্রীজ। সেটি কিন্তু সিলেটের নয় । এখনকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ এবং কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব বাজার জংশনকে যুক্ত করে মেঘনা নদীর উপর এই সেতু প্রায় এক কিলোমিটার থেকেও বেশি দীর্ঘ। সিলেট জেলা থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে এর অবস্থান। অসম বেঙ্গল রেলওয়ে অসমের চাবাগানগুলোর সুবেধের জন্যে ১৮৯১তে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেল বসিয়ে ক্রমে কোমিল্লা কোলাউড়া হয়ে লামডিং অব্দি টেনে এনেছিল যে লাইন এই সেতু কিন্তু সেই লাইনে পড়ে না। আখাউড়া থেকে এর একটা শাখা চলে গেছিল ঢাকা ময়মনসিংহকেও যুক্ত করে। সেই লাইনেই ১৯৩৭এ ঐ সেতু তৈরি হয়। উদ্বোধনের তারিখটি এখন বেশ আগ্রহোদ্দীপক মনে হবে। ৬ ডিসেম্বর। সুতরাং ঠিক ঐ রেলই রক্তধোয়া হয়ে করিমগঞ্জ পৌঁছেছিল কিনা নিশ্চিত জানি না। সম্ভবত ঢাকা থেকে আখাউড়া হয়ে আসছিল সেই ট্রেন। এখনো ঢাকা সিলেটের রেলপথ এটাই।
যাইহোক, সিলেটে তখন দু'শোর উপর গ্রাম আক্রান্ত হয়েছিল। ৫০০র উপর ছোটবড় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বসিয়ে দেয়া হয়েছিল। মণিপুরিরাও ব্যাপক আক্রমণের স্বীকার হয়েছিলেন। এই মণিপুরি বা সাঁওতাল বা গারো বা হাজং যারা আক্রান্ত হয়েছিলেন তাঁরা কেউ কেউ যদিও বা সাময়িক ভাবে সীমান্তের এপারে এসছিলেন পাকাপাকি থেকে গেছিলেন এমন সংবাদ কিন্তু নেই। আর থাকলেও শরণার্থী সংক্রান্ত রাজনৈতিক বয়ানে কিন্তু তারা ভারতে একেবারেই অনুপস্থিত।
সুতরাং যতটা বলা হয় যে মুসলমানরা ক্ষেপে গিয়ে হিন্দুদের দেশছাড়া করিয়েছিল—এগুলো এতো সরল বাক্য নয়। মুসলমানরা বাঁচিয়েও ছিল, প্রতিরোধও করেছিল। তার প্রথম কারণতো অবহমান সামাজিক ঐক্য। যেমন আমার মামাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এর রাজনৈতিক কারণও ছিল। সেও অনেকগুলো। ৮ অক্টোবর ১৯৫০এ আইন এবং শ্রমমন্ত্রী যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল তাঁর পদত্যাগ পত্রে১ বাঙালি এবং অবাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বিরোধ , নিজামুদ্দিন এবং শোহরাবর্দী গোষ্ঠীর মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ, ইন্দো-পাক বাণিজ্যিক সম্পর্কের জটিলতার থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেওয়া এবং দুই বাংলা এক করার লড়াই প্রবল হয়ে উঠার আশঙ্কা ইত্যাদির থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে এই হাঙ্গামা বলে উল্লেখ করেছেন। এগুলো হয়তো সব ঠিকই। কিন্তু এরমধ্যেই ইতিমধ্যে যে এক বাঙালি জাতীয়তাবাদ দানা বাঁধছিল তার ইঙ্গিত আছে। আর তেভাগা আন্দোলনের ভয়তো ছিলই। যার বৌদ্ধিক নেতৃত্ব অবশ্যই ইলা মিত্রের,রণেন মিত্রের মতো বাঙালি বর্ণহিন্দুদের হাতে ছিল। যে লড়াইতে অচিরেই মুসলমানরা যোগ দিতে পারতেন বৃহৎ সংখ্যাতে,আর দিয়েওছিলেন অনেকে। কেননা "বাঙ্গালী মুসলনমান সে সময়ে দেশের সম্পদের মাত্র ৩ শতাংশের অধিকারী ছিলেন, যখন স্টেট টেন্যান্সি এক্ট ১৯৫১ জারি করা হয় তখনও দেশের ১৫ শতাংশ সম্পদ ও ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রন করতে উচ্চবর্ণের হিন্দু ও মারোয়ারী সম্প্রদায় ।"২ বস্তুত ব্যাপক মুসলমান কৃষক জনতার সঙ্গে বর্ণহিন্দু জমিদার, জোতদার ,ধনীকৃষকদের সংঘাত কাজে লাগিয়ে মুসলমান জনতাকে নমসূদ্র সহ অন্যান্য পিছিয়ে পড়া হিন্দু জনগোষ্টীর বিরুদ্ধেও লেলিয়ে দিতে চাইছিল। যে জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে মুসলমানের দ্বন্দ্ব ছিল অবৈরি। তাই যোগেন মণ্ডলের মতো নেতা পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু সেই দ্বন্দ্বকে বৈরি দ্বন্দ্বে পরিণত করে ফেলতে চেয়েছিল এবং অনেকটাই পেরেছিল পাকিস্তান নামের নয়াউপনিবেশের শাসক শ্রেণি। যার গাঁটছড়া তখনো বাঁধা ছিল ব্রিটিশের সঙ্গে, এবং মুখিয়ে ছিল আমেরিকা সহ অন্যান্য পশ্চিমী দেশগুলোর দিকে, যেমন ছিল ভারতীয় শাসকদেরও। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সাম্রায্যবাদ তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সমস্ত দেশেই সামন্তশেণী এবং দেশীয় পুঁজিপতিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে শাসন চালিয়ে যেতে সমর্থ হয় ,কিন্তু পরোক্ষে। পুঁজিবাদী উৎপাদনের সমস্ত সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে, সেই সঙ্গে বহাল রাখে উদ্বৃত্ত আহরণের সমস্ত অর্থনীতি বহির্ভূত উপায়সমূহ। ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণও সেই স্বার্থেই দরকার পড়ে। পাকিস্তানের কাছে এই উপায়গুলোর একটি ছিল ঊর্দু জাতীয়তাবাদ। এমনিতে ভারত থেকে আলগা হবার পরেই ভারতীয় বর্ণহিন্দুদের সঙ্গে যে বিবাদ তার কার্যকারিতা ফুরিয়ে যাবার কথা ছিল। জিন্না তাই একবার পাকিস্তানে ধর্ম-জাতির নির্বিশেষে কোন বৈষম্য রাখা হবে না বলে ঘোষণা করেন। হয়তো তিনি তা মনের একদিক থেকে চেয়েওছিলেন। কিন্তু অচিরেই তিনি উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র স্বীকৃত ভাষা বলে ঘোষণা দিয়ে বসেন।স্বাধীনতার বছরেই পরের মার্চ মাসে তিনি ঢাকাতে এসে এই ঘোষণা দেন। তার আগের মাসেই পাকিস্তান সংসদে কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তান সংসদে দাবি তুলেছিলেন ইংরেজি উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সেখানে সেটি নাকচ হয়ে গেলেও ঢাকাতে ছাত্ররা পথে নামে। অনেকের সঙ্গে গ্রেপ্তার বরণ করেন নবীন ছাত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান। যিনি পরে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবেন। সে বছরের জুন মাসে তিনি মৌলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গড় তোলেন আওয়ামী লীগ। দুই পাকিস্তানের সবচে'বড় জনগোষ্ঠী ছিল তখন বাঙালিরা। সুতরাং তারা না আলাদা হয়ে যায়, অখণ্ড বাংলার স্বপ্নকে সাকার করবার জন্যে মাঠে নামে এমন এক ভয় জিন্না এবং পরবর্তী শাসকদের কুরে কুরে খাচ্ছিল। সেই সঙ্গে শুধু নাচোল বা তেভাগাই নয় চীন বিপ্লবের ভূতও তাড়া করে ফিরছিল দ্বিখণ্ডিত ভারতের শাসকদের। এগুলো আটকাতে গেলে হিন্দু আর মুসলমানে বিরোধটা চাগিয়ে দিতে হয়। তবে পশ্চিম বাংলাতেও আর কেউ অখণ্ডবাংলার স্বপ্ন দেখার সাহস করে না। ইতিমধ্যে দু'টুকরো সিলেট নিয়ে হয়তো তিনি ভাবেন নি। হয়তো ভেবেছিলেন সিলেটের স্থানীয় পাকিস্তানপন্থীরা, যারা বর্ণহিন্দু আধিপত্যের থেকে মুক্তি চাইছিলেন আর সিলেটি হিন্দুরা তখনো দেশ ছাড়ার নাম নিচ্ছিলেন না। এতোসব কথা আমার মামারা জানতেন না। তাই যেদিন ভৈরবের পুলে গণহত্যা হয় সেদিনও তারা বেরিয়েছিলেন করিমগঞ্জ আসবেন বলে, সেখানে তাদের পৈত্রিক ব্যবসা আছে আগে থেকেই। আর যে ব্যক্তি মুসলমানদের করিমগঞ্জ যেতে মানা করছিল তাঁকে গিয়ে নির্দ্বিধায় জিজ্ঞেস করতে পেরেছিলেন, কারণটা কী?
তথ্যসূত্রঃ
১) আইন এবং শ্রমমন্ত্রীর যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পদত্যাগ পত্র;মুক্তমনা ইয়াহুগ্রুপ.
২)বাংলা বিভাজন ভবিষ্যত বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিভাজনের সূচনা করেছিলো হয়তো- ০৩/রাসেল পারভেজ;আমারব্লগ ডট কম.
গ্রন্থসূত্রঃ
১) দেশভাগ –স্মৃতি আর স্তব্ধতা; সম্পাদনা সেমন্তী ঘোষ;গাঙচিল; কলকাতা৭০০১১১।
২)বাংলায় মুসলমানের আটশ বছর;জাহিরুল হাসান;পূর্বা;কলকাতা-৯।
No comments:
Post a Comment