Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

What Mujib Said

Jyoti basu is DEAD

Jyoti Basu: The pragmatist

Dr.B.R. Ambedkar

Memories of Another Day

Memories of Another Day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Saturday, July 4, 2015

ফেলানিঃ আধুনিক অসমিয়া উপন্যাস


            


ফেলানি


            

          আগে এই ছোট্ট শহরের সীমা ছিল ছেলে-মিশনটি। ছেলে-মিশন মানে হোস্টেলের সঙ্গে ডনবস্কো স্কুলখানা। স্বাধীনতার বছর বিশেক আগেই এর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বেশ ক'বিঘা জমিতে বিশাল এলাকাপরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খৃষ্টান মিশনারিরা মূলত এই শহরের লাগোয়া কয়েকটি বাগানের শ্রমিকের ছেলেমেয়েদের দিকে চোখ রেখেই এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিল। অন্য ডনবস্কো স্কুলের সঙ্গে সুদৃশ্য এই স্কুলের বিল্ডিঙের মিল থাকলেও এর চরিত্রের সঙ্গে অন্যগুলোর কোনও মিল নেই। হাইস্কুলটি অসমিয়া মাধ্যমের,ছাত্রেরা প্রায় সবাই বাগানের আদিবাসী ছেলেমেয়ে । ছেলে-মিশনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের মানুষের খুব একটা সম্পর্ক নেই । শুধু ওই শনিবার বিকেলে যখন ফাদার লাইন ধরিয়ে ছেলেগুলোকে শহরের রাস্তা দিয়ে বেড়াতে নিয়ে যান তখন সে দৃশ্য লোকে বেশ একটা আগ্রহ নিয়ে দেখতে থাকে। দৃশ্যটি অনেক বছরের পুরোনোকিন্তু মনে হয় যেন চির নতুন। 'ছেলে-মিশনশব্দটিও শহরের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত নাম
           ছেলে-মিশনের আশে পাশে লোক জনের বসতি খুব নেই। আসলে এটি রিজার্ভের মাটি। কেউ ঘর তুলতে চায় না। কেননাকখন এসে উচ্ছেদ করে তার কোনও ঠিক নেই। দু'এক জন কোনও উপায় না পেয়ে ঝুপড়ি ক'খানা তৈরি করে বসতে হবে বলে বসেছে। যাকে বলে সংসার পাতা তেমন কিছু করেনি। ছেলে-মিশনের থেকেই শুরু হয়েছে রিজার্ভের জঙ্গল। এই জঙ্গলের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট্ট পাহাড়ি নদী রাধিকা। জঙ্গলের একেবারে শেষ প্রান্তযেখানে গ্রামের মানুষের ধানের খেতে গিয়ে জঙ্গলটি শেষ হয়েছে সেখানেই রয়েছে কৃষ্ণাই নদী। রাধিকার মতো এক হাঁটু জলের ক্ষীণকায়া নদী নয়। শীত বরষাতে জল থাকে এরকম গভীর নদী। নদী দুটো নেমেছে ভুটান পাহাড় থেকে। সেখান থেকেই নেমেছে তিনটে নদীকৃষ্ণাই আর রাধিকা কিছু দূর পাশাপাশি বইতে বইতে একসময় আলাদা হয়ে গেছে আরেকটি নদী সোনজিরি কিছু দূর রাধিকা কৃষ্ণাইর কাছে কাছে বইতে বইতে একসময় পুরো অন্যদিকে বয়ে চলে গেছে। নদী তিনটির উৎসে একটি বাঁধ আছে। লোহার জাল আর পাথরে বাঁধানো মজবুত বাঁধ। নদী তিনটির জল যাতে একটা শৃঙ্খলা মেনে বয়বাঁধটি তাতে সাহায্য করে এসেছে। নদী মুখে ঐ জালে তৈরি বাঁধের জন্যেই বোধ হয় জায়গাটির নাম জালিমুখ
     
 রিজার্ভ ফরেস্ট যেখানে শেষ হয়েছে সেখান থেকেই রাধিকা নদীর পাড়ে পাড়ে শুরু হয়েছে একটা বস্তি। রিজার্ভেরই সরকারি জমি ছিল। গাছ লাগানো হয়নি। এমনি পড়ে ছিল। খালি জমিটার একদিকে একখানা গ্রাম। ধাননারকেলসুপারি গাছে সাজানো বডো আর রাভা মানুষের গ্রাম। নেপালিবাঙালি আর ক'ঘর অসমিয়া মানুষও রয়েছে
 
           সরকারি জমিতে অসংখ্য ছোট ছোট ঝুপড়ি। ঝুপড়িগুলোর সংখ্যা কিছুদিন থেকে হঠাৎই অকল্পনীয়ভাবে বেড়ে গেছে। একই রকম একচালার ঘর সব। টিনগুলো চিকচিক করতে থাকে। প্রায় সব ক'টা ঘরে টিনের সংখ্যা একই। সরকারে দেয়া টিনের বাণ্ডিল গুলোতেই সাহস করে লোক গুলো ঘর তুলেছে। একই রকম টিনের চালের উপর বাঁশ আর ইটের টুকরোভেতরের মানুষগুলোর অবস্থাও একই ।  তুফানে বাসা ভেঙ্গে ফেলার পর পিঁপড়েগুলো আবারও বাসা বাঁধবার আয়োজন করছে
      
     ক্যাম্পের মানুষজনের অনেকেই সরকারি টিনগুলো নিয়ে এখানে এসে উঠেছে। কোনও দিক থেকে বাধা আসে নি। বস্তি তো ছিলই। সবাই এখানে তাড়া খাওয়া মানুষ। কাউকে জলে তাড়িয়েছেকাউকে হাতিতে কাউকে আবার খিদে। জায়গাটি সুবিধেরহাত বাড়ালেই নদীটিরয়েইছে। রিজার্ভের জঙ্গলটাও আছে। ঢেঁকি শাকলাকড়ি এসব এমনি মিলে যায়। গামারি,সেগুনশিশুলালি গাছের অজস্র ডাল পালা না কাটতেই এমনিতে এখানে ওখানে পড়ে থাকেগাছগুলোতে কেউ হাত দেয় না। রিজার্ভ পেরুলেই ছেলে-মিশন পেরিয়ে শহর। দু'মুঠো ভাত জোগাড় করবার জন্যে এই বাড়ন্ত শহরে সুযোগের কোনও অভাব নেই
  
         বুলেন একটা ঠেলা ভাড়া করে এনে তাতে সামান্য যেটুকু মালপত্র আছে তাই তুলে দিয়ে মালতী আর মণিকেও সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পের থেকে বেরিয়ে রাস্তাতে পা বাড়ালফেলানি বুলেনের ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলো। মণি এর আগেও বুলেনের সঙ্গে সে বস্তিতে বেশ ক'বার গেছে। মণির পেছনে পেছনে ফেলানি এগুতে থাকল। কাল এক পশলা বৃষ্টি দিয়েছিল। আজ গরম অনেকটাই কমে গেছে। হাসির শব্দ শুনে সে পেছনে ফিরে তাকালো। ঠেলাতে বসে সুমলা হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাসছিল। ঠেলাতে সে হাত পা মেলে বসেছে। বারে বারে গায়ের থেকে কাপড় চোপড় ফেলে দেয়বুলেন তুলে তুলে দেয়হঠাৎই মণির মায়ের চোখে পড়ল সুমলার চাদরটির এই বারে বারে পড়ে যাওয়ার দিকে পথের কিছু মানুষ তাকিয়ে আছে। সে নিজের ব্লাউজের থেকে সেফটিপিন একটা খুলে সুমলার চাদরে ব্লাউজে আটকে দিল। কিছুক্ষণ টানাটানি করে সে চাদর টানা বাদ দিয়ে খোঁপা খুলে চুলগুলোকেই এলোমেলো করতে শুরু করল। বুলেন ঠেলাটাকে অল্প দাঁড় করিয়ে ওর লম্বা চুলে আবারো খোঁপা বেঁধে দিল। আশে পাশের দু'একটা মানুষ তাই দেখে হেসে ফেলল। বুলেন সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার ঠেলা চালাতে থাকল। সুমলা এবারে শান্ত হয়ে গেল
         বুলেন সরকারি টিনে একটা ঘর তুলে নিয়েছে। মণিদের জন্যে কালীবুড়ির বাড়িতে এক কোঠার ঘর একটার ব্যবস্থা করেছেবুড়িকে মাসে পঞ্চাশ টাকা দিলেই হবে। বুড়ি মাসে নব্বুই টাকা করে চেয়েছিল। কিন্তু মণিদের দেয়া ঘরটার শুধু বেড়া ক'টিই আছেচাল নেই বললেই চলে। বুলেন ফেলানির ভাগের টিন ক'খানা লাগিয়ে দেবার পরেই শুধু ঘরটি ঘর হয়ে উঠে। বুড়িও মাসে পঞ্চাশ টাকাতে রাজি হয়ে গেল
       কালী বুড়ির গলার স্বরটি বেশ রুক্ষ । খানিকটা ভাঙা ভাঙা আর চড়া। দূর থেকে শুনলে এমন মনে হয় যেন এই স্বরের অধিকারিণী এক মোটা গাট্টা মেদবহুল,শক্ত সমর্থ মহিলা। কাছে চাপলে দেখা যায় ধারণাটি একেবারেই ভুল। বরং ইনি এক হালকা পাতলা মহিলাগায়ের চামড়াও হালকা শিরা ধমনিগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। রঙটি একসময় হলদেটে সাদা ছিল। এখন এমন মনে হয় যেন ভদ্রমহিলা নিজের শরীর ধুয়ে ধুয়ে পুরোনো হয়ে ছিঁড়তে বসা একটি এড়ি চাদর প্যাঁচিয়ে রেখেছেন। মহিলার মুখোমুখি হলেই প্রথম যে প্রশ্নটি মনে দেখা দেয় তা এই যে এমন স্বর কী করে এসে এমন এক মহিলার মুখে জুড়ে বসলএকটু অবাক লাগলেও উঁচু আওয়াজের এই ভাঙা ভাঙা গলা নিয়ে দুর্বল মহিলাটি নিজের স্থিতি ঘোষণা করে চলেছেন
       এই বস্তিতে যারা প্রথম এসেছে কালীবুড়ি তাদেরই একজনতাড়া খাওয়া মানুষ। জলে নয়রায়টে নয়খিদেতেও নয়তার তাড়া খাবার গল্প অন্য। যৌবনে বুঝি কালীবুড়ি বেশ রূপসী ছিলেন। গরীব ঘরের রূপসী তরুণীদের সাধারণত যা হয় তাঁরও তাই হয়েছিল। সতেরো বা আঠারো বছর বয়সে মোটামোটি ভালো অবস্থার একটি মানুষ ওকে বিয়ের সমস্ত খা-খরচ দিয়ে নিয়ে গেছিল। লোকটি আগের বিয়ের বৌ চলে গেছে। চার পাঁচটি ছেলে মেয়ে দেখার জন্যে মেয়ে মানুষ চাই। তাই তাকে নিয়ে যাওয়া। ব্যবসায়ী আর ধার্মিক মানুষ ছিলেন তাঁর স্বামী। বাড়িতে নিত্য পুজো পার্বণ কীর্তনাদি লেগেই থাকত। কেউ টের না পেতেই কালী এক নধর কান্তি জোয়ান গোঁসাইর সঙ্গে চলে গেল। সে গোঁসাইর স্বভাব ছিল ফুলে ফুলে মধু খুঁজে ফেরা । একটি ফুলে ওর নৈবেদ্যের থালা ভরে না। রোজ নতুন নতুন মহিলা ভক্তরা ওর দেহে চন্দন লেপে দেয়স্নান করিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দেয়। ভোর রাত অব্দি কীর্তনের সুরে ভক্তদের ভক্তিমার্গ দর্শন করিয়ে ক্লান্ত হলে তার সেবা আত্তি করে। তার নৈবেদ্যের থালা ভরে থাকে। নতুন বস্ত্র,অলংকারচন্দনে সেজে থাকে তার দুধের আলতার মতো নধরকান্তি শরীর । পেটে সন্তান দিয়ে সেই গোঁসাই তাকে বাসি ফুলের মত ফেলে দিয়ে চলে গেল। এক মাসের পেটে খসিয়ে কালী এক চেনা পরিবারের সঙ্গে সীমান্ত পেরিয়ে এখানে এসে পৌঁছুল । ধার্মিক ব্যবসায়ী আবারো বিয়ে করলনইলে তার ঘর দেখবে কে বাপের বাড়ির লোকেরা মেয়ে মরে গেছে ভেবে ভুলেই বসল। ব্যবসায়ী জামাইর থেকে ওরা কম সুবিধে আদায় করেন নি। মেয়ের এই কাণ্ড সবাইকে অসহায় করে ফেলল। বাকি আর কিছু বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে কেউ খুঁজতে বেরুলো নাখবরা খবর করাতো দূরেই থাক

 সেই মেয়ে এই বস্তিতে এসে ধীরে ধীরে কালী বুড়ি হয়ে গেল। মা বাবার দেয়া এক নাম ছিল তাঁর। আরতি। সে নাম অন্যে তো বাদই থাককালীবুড়ির নিজেরও হয়তো মনে নেই। আরতি নাম নিয়ে যখন তিনি এ বস্তিতে আসেন আলাদা আলাদা চেহারাতে এখানেও গোঁসাই আর ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার দেখা হয়। ঠিক সেরকম সময়ে তাঁকে একদিন কালী ঠাকুর ভর করেন। যারা তার কাছে প্রায় রোজ আসত কালী পাবার পর তারা এখানে আসা ছেড়ে দেয়। দিনে সে মুড়ি ভাজতবাড়ি বাড়ি গিয়ে বিক্রি করত। রাতে তার গায়ে রোজ কালী ভর করত। একবছর এভাবে চলার পর মুড়ি বেচার পয়সা দিয়ে সে বড় করে কালী পুজো দিয়েছিল। বছর না ঘুরতেই লোকে দেখল রাতে যখন ঠাকুর ভর করেন তখন তার মাথাতে এক লম্বা জটা বেরিয়ে আসে। সকাল হতেই আবার মিলিয়ে যায়। আরতি ধীরে ধীরে কালী বুড়ি হয়ে যায়। প্রতি বছরের কালীবুড়ির দেয়া পুজো এখন বস্তির সমস্ত মানুষের উৎসবে পরিণত হয়েছে। এই কালি বুড়ির দু'টো ঘরের বাড়ির একটাতে ফেলানি এসে উঠল । সকাল দশটা নাগাদ এসে পৌঁছেছিল। ঠিক ঠাক করে রাখবার মতো আর কীই বা এমন জিনিসপত্র রয়েছেঘরটির এক কোনে চুলো একটা ছিলই । সে একটু লেপে টেপে নিলো। কেঁচোর মাটিতে সারা ঘর ভরা ছিল । মণির সঙ্গে সেগুলো পরিষ্কার করে ফেললকোদালে শেওলাগুলো চেঁচে নিয়ে লাল মাটিতে মুছে ফেলার পর ঘরে শ্রী ফিরে গেল। মণি ইতিমধ্যে নদীতে স্নান করতে গেছে। বুলেন এসে ডাক দিল
   
           "ও বৌদিকী করছ?' হাতে দা কোদাল নিয়ে এসেছে ও"
         "এখন এই ভর দুপুরে তোকে কে কাজে রাখবে রে?"
         এই শহরের এক মাষ্টার বাবুর ঘরে বেড়া একটার কাজ আদ্ধেক করে রেখে এসেছিলাম। ভাবছিসেটাই পুরো করে দিয়ে আসি গে। আগাম টাকা নিয়ে এসেছি যে"
       " তোর জন্যে কি আর বেড়া পড়ে রয়েছেদেখগেঅন্য কামলা লাগিয়ে কাজটা করিয়ে ফেলেছে"
      " আমার হাতে কাজ না হলে মাষ্টার মাস্টারণী কারোরই মন ভরে না বুঝলে!বুলেন হাসছিল। ওর ভুরুর উপর কোঁচকানো রেখাগুলো আজ নেই। ওই নর্দমার থেকে বেরিয়ে হয়ত ফেলানির মতোই ওরও মনটা আজ খোলামেলা লাগছে
হঠাৎই আবার ওর কপালের গাঁট কুঁচকে গেল। খানিকের হাসিমুখখানা আবারও আঁধার হয়ে এলো
     " বৌদি ওকে একটু দেখবি। নতুন জায়গা বলেই বোধহয় ওর আজ আবার সেই পাগলামোতে পেয়েছেসে ওর পরনের গামছাখানা অল্প তুলে দেখালো। উরুতে জন্তুতে আঁচড়ানোর মতো লাল লাল ফোলা দাগ
        " ওষুধ দিলি ওকে?"
        "হ্যাঁদিয়ে শুইয়ে রেখেছি। আমি আসা অব্দি উঠবে না। বৌদিতুই বরং এটা কাজ কর। ভাত রান্নাটা তুই আমাদের ওখানে কর গেযা। ছেলেটাকেও খাওয়াবি। আর ও যদি উঠে যায় তবে ওকেও...মানুষটির রা বন্ধ হয়ে গেল। ফেলানির এমন মনে হলো যেন উরুতে আঁচড়ানোর দাগ বুলেনের সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে
       বুলেনের গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছিল যেন কফে বসে গেছে, " ওকে কিচ্ছু খাওয়াতে পারি নিহঠাৎই সে কোনও দিকে না তাকিয়ে চলে গেল
         ফেলানি ভেতরে এসে দেখে কালী বুড়ি বসে আছে। বুড়ি ওকে ডাকল, "আয়বুড়ির ডাকটা কেমন যেন লাগল ওর। আস্তে কথা বললে মনে হয় বুড়ি ফিসফিসিয়ে বলছেশব্দগুলো একের গায় আরেকটা জুড়ে বসে। যখন জোরে বলে শব্দগুলোর যেন তেজ বেড়ে যায়কানে এলে বেশ ভয় করে। ফেলানিও বুড়িকে এক ধরণের ভয় পায়। কিন্তু আস্তে আস্তে ফিসফিসিয়ে কথা বললে দুর্বল এই মহিলাকে ভয় পাওয়া তো দূরকেমন যেন মায়াই হয়। মণির মা বুড়ির ঘরে গিয়ে ঢুকে গেল। ধূপ আর ধূনার গন্ধ একটা নাকে লাগল। ঘরটির চারদিকে নানা রকম কালী মায়ের মুখোশ। জিহ্বা মেলে কালো মুখগুলো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। ও চাদরের আঁচল খুটতে খুটতে মাথা নুয়ে বসে রইল। বুড়ি মুড়ি আর চা নিয়ে এলো। মুড়িগুলোর থেকে তেল পেঁয়াজের গন্ধ একটা বেরুচ্ছে
          "আপনি খাবেন না?" ফেলানি বাংলাতে বলে বুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে সামান্য হাসল। বুড়ির অবাক হবার পালা
         " তুই বাংলা বলছিস!"
         "আমার বাবা ছিলেন ক্ষিতীশ ঘোষদাদু ছিলেন কিনারাম বডোআমাকে বড় করেছেন রতন ঘোষ"
          বুড়ি মুখে কিছু না বলে বাটি একটাতে অল্প মুড়ি আর এক কাপ লাল চা নিয়ে এসে ওর কাছে বসল
       "তোর আর কে কে আছে?"
       তাইতোওর আর কে কে আছেওকে লম্বোদরের কাছে সমঝে দিয়ে রতন আর বিন্দু একেবারে চলে গেল। রতনের ছেলেমেয়ে নেই। নিজের কাছের মানুষ রয়েছে। ওদের সঙ্গে একসঙ্গে থাকবে বলে আলিপুর দুয়ারের কাছের এক গ্রামে চলে গেল। পাহাড়ের তলার গ্রামটির কিনারামের বাড়িতেলম্বোদরের বাড়িতেসবকিছু কেমন যেন ধোঁয়াশার মতো
সে মনে মনে হাতের তালুতে মুড়ি দু'একটা নিয়ে এমনি নাড়াচাড়া করতে থাকল
          "তুই এখন কী করবি?"
           সে এ প্রশ্নের জবাবেও চুপ করে বসে রইল
          বুড়ি কাপ আর বাটিগুলো সরিয়ে রাখল
          " কালী মাকে প্রণাম কর। মা সব ঠিক করে দেবেবুড়ি কালীর মুখোশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করলেঅও তাই করল
          "আপনি কী করে...সে কালী বুড়ি কী করে ঘর চালায় জানতে চেয়েছিলকিন্তু কেমন এক সংকোচে কথাটা স্পষ্ট করে জিজ্ঞেস করতে পারল না। একা এক মহিলা। বাড়ি ঘর করেছে। নিজেও চলছে। ওকেও কিছু একটা মুখে দিতে উপরোধ করছে
বুড়ি আবারও কালীর মুখোশগুলোকে প্রণাম করছে। সে উঠতে গেলে বুড়ি ওকে দরজা অব্দি এগিয়ে দিল। দরজা পেরোতেই বুড়ি ওর হাত ধরল। এবার বুড়ি জিজ্ঞেস করল, "তুই মুড়ি ভাজতে জানিস?" সে অবাক হয়ে মাথা নাড়ল, "জানি"
          "জানবিই তোবাঙালি মেয়ে"
         "আমি বাঙালি নই। আমার ছেলের বাবা...বুড়ি ওর কথাতে কান দিল না
          "মুড়ি ভাজলে চাল অল্প বেশি করে নিই। কাল একসঙ্গে শহরে যাব"
         সম্মতি দিয়ে সে বুলেনের ঘরের দিকে রওয়ানা দিল
       
        একচালা ঘরটা বুলেন বেশ গুছিয়ে সাজিয়েছে। আধ কাঠার মতো মাটি বের করে নিয়েছে। নদীর পারের জমি। তার উপর বুলেনের খেটে খাওয়া হাত। দুদিনেই এই মাটি ফুলে ফলে ভরে উঠবে। সে ভেতরে ঢুকে গেল। সুমলা বাঁশের চাঙে ঘুমিয়ে আছে। লম্বা চুলগুলো বেণি বাঁধাসিঁথিটা বাঁকা। দেখলেই বোঝা যায় ছেলে মানুষের হাত পড়েছে। এভাবে এক ঘুমিয়ে থাকা মেয়ে মানুষকে দেখে কে বলবে সে খানিক আগেই ওর বরের উরুতে খামচে রক্ত বের করে দিয়েছে। ছেলেটি নেইনিশ্চয়ই মণি কোলে নিয়ে কোথাও গেছে। ঘুমন্ত সুমলাকে একটা মৌমাছি বিরক্ত করছিল। সে আস্তে করে পায়ের কাছে রাখা পাতলা কাপড়খানা তুলে ওর গায়ে দিয়ে দিল। মৌমাছিটা চলে গেল। সুমলাও শান্তিতে শুয়ে রইল

         বুলেনের ছেলেকে নিয়ে মণি এসে ঘরে ঢুকল
         "মা তোকে ঘরে খুঁজে পেলাম না"
         "খিদে পেয়েছে?"
       " পেয়েছিল। কিন্তু কালীবুড়ি চা মুড়ি খাইয়ে দিল"
       " কালী বুড়ি বলবি না। আইতা ...খানিক থেমে গিয়ে বলল, " 'দিদাবলে ডাকবি... তুই স্নান করলি?"
        "হ্যাঁসে হাতের পলিথিনের থলে একটা মাটিতে উলটে দিল। একটি সাদা চকচিকে পুটা মাছ। ছেলে উচ্ছ্বসিত আনন্দে জানান দিল, " মাআমি যখন স্নান করছিলামএ আমার পিঠে এসে ঠেকেছিল। আমি গামছা দিয়ে ধরে ফেলেছি!"
     "তোকে ভেজে দেবযাবাবুকে পিঠে তুলে মণি দৌড় দিলসে মুখ ফুটিয়ে বলেই ফেলল, 'ঐ হাগা মুতার নর্দমার থেকে বেরুতে পেরে সবারই দেখি মনটা ভালো হয়ে গেছে!"
         বুলেন চুলোর কাছে এক আঁটি লাকড়ি রেখে গেছে। রিজার্ভ থেকে গুটিয়ে নিয়ে আসা শুকিয়ে কনকনে হয়ে আছে ডালগুলো। চুলোতে তুষের আগুন একটু জ্বলছে। কাঁচা চুলো বলে তুষ জ্বালিয়ে রেখেছেতাতে খড়ি কটা দিতেই খানিক চেষ্টাতে আগুন জ্বলে উঠল। চুলোর উপরে চাল ডালমিষ্টি লাউ একটাআলু দু'একটা তেল নুন গুটিয়ে রাখা আছে। কী করে যে মানুষটা মেয়ে মানুষের মতো সব করে রেখেছেসে ডালের মধ্যেই দুটো আলু আর মিষ্টি লাউ টুকরো দুটো দিয়ে দিলভাতও ওদিকে হয়ে গেল। মণির আনা মাছটা আঙটাতে পুড়ে অল্প তেল নুন দিয়ে ভর্তা বানিয়ে দিল। ছেলে দুটোকে খাইয়ে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো। মিষ্টি লাউ যেমন লাল তেমনি মিষ্টি। গরম মসুর ডাল দিয়ে অনেক দিন পর সে পরম তৃপ্তিতে ভাত ক'টা খেল। বুলেন আর সুমলার জন্যে আলাদা করে রেখে সুমলাকে জাগাতে পারে কিনা তার চেষ্টা করে দেখল। ওঁ ওঁ শব্দ করে ও আবার এক কাতে ঘুমিয়ে পড়ল। ওষুধ খাওয়া ঘুমকই আর এতো তাড়াতাড়ি ভাঙবেমণি আর বাবু ভাত খেয়েই বেরিয়ে গেল। গাছের থেকে শালিকের বাচ্চা একটা পড়ে গেছে। সেটিকে নিয়েই দুজনে ব্যস্ত হয়ে গেছে। বাকি দুনিয়ার খবর ভুলেই গেছে। ফেলানি সুমলার কাছেই একটু গড়িয়ে নেবে বলে শুয়ে পড়ল। সুমলা জেগে উঠলেই দুমুঠো খাইয়ে দেবে। ঘরের গায়ে লেগে আছে একটি লিচু গাছ । পাখি এনে ফেলা বীজ থেকে গজানো গাছ হবে। খয়েরি রঙের কিন্তু বড়ইর মতো ফল ধরে বলে বুলেনের মায়া পড়ে গেল । সে ওটি আর কাটে নি। ঘড়টিকেও ঢেকে রাখে গাছটি। সে দেখল সুমলা গা থেকে চাদরটা ফেলে দিয়েছে। বোতাম খোলা শরীরটার দিকে সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। কী মানুষের কী হয়েছে। ওর চোখদুটো ভিজে এলো
         বুলেনের ডাকে ফেলানি জেগে গেল। কখন যে ঘুম পেয়ে গেছে সে টেরই পায়নি। উঠে দেখে সুমলা বিছানাতে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে আছে। বুলেনকে সে ভাতগুলো দেখিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হলোবুলেন একটি থালাতে দু'জনের মাপে ভাত নিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে আনার মতো করে স্ত্রীকে কোলে তুলে নিলো। কোলে করে ওকে এক গ্রাস দু'গ্রাস করে ভাত খাওয়াতে শুরু করল। ওর নগ্ন শরীর বুলেনের বুক ছুঁয়ে আছে। সুমলা এক হাতে বুলেনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। শান্ত কচি খুকীর মতো ভাতগুলো খেয়ে নিচ্ছে। দু'জনকে এভাবে এক লহমার জন্যে দেখে নিয়ে ফেলানি বেরিয়ে গেল। যাবার আগে দরজাটা আঁজিয়ে গেল। তার চোখে পড়ল--তাই দেখে পাশের কিছু লোক জটলা পাকিয়ে ফিশিং ফিশাং শুরু করেছে
        ফেলানি ঘরে গিয়ে ঢুকল। দরজা আঁজিয়ে সে ভেতর থেকে কাঠ দিয়ে দিল। তার পরেই খানিক আগেই লেপে মোছে রেখে যাওয়া ভেজা মেঝেতে বসে পড়ল। ওর বুকখানা যেন ভেঙে পড়বে। কেউ যেন ওর কাঁধে খসখসে শুকনো হাত একখানা রেখেছে," কাঁদছ কেনমালতী...ও মালতী...এমন করবি নাতো... আমি মানুষটা মরিনিনা!হাত খানা সে ছুঁয়ে দেখতে চাইল। একবার বলতে চাইল, "এ্যা মাএ কি সেগুনের পাত না মানুষের হাতকী বড়রে বাবা!সেগুন পাতার মতো হাতে টগর ফুলের মত হাতখানা লুকিয়ে গেল। তাই হোকভগবান তোকে তো টগর ফুলের মতো হাত দিয়েছেতাতেই হবে..."কথাটা পুরো হতে পারল নাগা থেকে ভোঁৎকা একটা গন্ধ বেরুচ্ছে যে লোকটার সে এসে লেলিয়ে লেলিয়ে বলে কিনা , " মলি বাবা পুকুলেল থেকে নামঘল... মাথা নেই ...চোখ নেই...কান্নাটা শব্দ হারিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। শব্দহীন কান্নাটি মেয়ে মানুষটিকে একেবারে ঝাঁজরা করে দিয়ে গেল
  
      মামা ও মাকিছু একটা দে তো। পাখির বাচ্চাটা দেখকেমন করে মুখ মেলে চিঁ চিঁ করে যাচ্ছে!"
  "
         সে চোখ মুখ মোছে দরজাটা খুলে দিল। বাইরে তখন সন্ধ্যার অন্ধকার
        "বৌদি!কচু পাতা একটাতে মাছ কতকগুলো নিয়ে বুলেন এসে হাজির
          " মণির মা...হাতে সন্ধ্যা পূজার প্রসাদ নিয়ে কালীবুড়ি
        সে বাইরে গিয়ে হাত দুটো অঞ্জলির মতো মেলে দিল। মণির পাখিটির জন্যে। বুলেনের মাছগুলোর জন্যে। কালীবুড়ির প্রসাদের জন্যে। মণির পাখিকে কিছু খেতে দিতে হবে। বুলেনের মাছগুলো কাটতে হবে। কালীবুড়ির প্রসাদের থালা ঘুরিয়ে দিতে হবে। ভেতরে ঢুকে পড়া কান্না এবারে চোখ দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে চাইল। পারে নি। সে হাতদিয়ে মুছে ফেলল


টীকা:
         লালিঃ এক রকম আরণ্যক গাছ
         আইতাঃ দিদিমা


No comments:

Post a Comment