Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

What Mujib Said

Jyoti basu is DEAD

Jyoti Basu: The pragmatist

Dr.B.R. Ambedkar

Memories of Another Day

Memories of Another Day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Sunday, July 27, 2014

শহীদুল জহিরের গল্পের উপজীব্য প্রথমত নারী-পুরুষের ভালবাসা, প্রেম, তারপর সমাজ এবং রাষ্ট্রচিন্তা। পলাশ বিশ্বাস

শহীদুল জহিরের গল্পের উপজীব্য প্রথমত নারী-পুরুষের ভালবাসা, প্রেম, তারপর সমাজ এবং রাষ্ট্রচিন্তা।


পলাশ বিশ্বাস

কলকাতার মহানাগরিক সমাজের দেহে সীমাবদ্ধ বাংলা সাহিত্য আমাকে তেমন আকর্ষিত করে না আর।


ইলিয়াস পড়ার পর সমাজ বাস্তবের নিরিখে সত্তরের লেখা,মাণিক বন্দোপাধ্যায়,নবারুণ দা এবং অবশ্যই মহাশ্বেতাদি ছাড়া যাদের লেখা,যেমন অনিল ঘড়াই,ভালো লাগে তাঁরা এখন বৃত্তের বাইরে।


মন্দাক্রান্তা সেনের মত প্রতিভাময়ী লেখিকা আজ বাংলা সাহিত্যের মুখ্যধারায় তিলোত্তমা ও সঙ্গীতার তুলনায় ম্লান।


ইলিয়াস পড়ার পর সেলিনা হোসেন থেকে অবু বকর সিদ্দিকী সহ বাংলাদেশি কথাসাহিত্য বার বার পড়েছি গত দশ বছরে।


কিছু গল্পের অনুবাদ হিন্দীতে করেছি আমি এবং সবিতা মিলে।

তবু আফসোস শীদুল জহিরের কোনো লেখা পড়া হয় নি।


আজ সহীদুলকে নিয়ে এই সময়ের চমত্কারিক লেখা পড়ার পর শহীদুল সরণিতে এই আমার প্রথম প্রবেশ।


খুঁজে দেখছি শহীদুল বৃত্তান্ত।


বিশ্লেষণ তাঁর গল্প সমগ্র পড়ার পরই সময় পেলে করব।




শহীদুল জহিরের গল্পের উপজীব্য প্রথমত নারী-পুরুষের ভালবাসা, প্রেম, তারপর সমাজ এবং রাষ্ট্রচিন্তা। এর বাইরে কে থাকে ? নাঙ্গা দরবেশবৃন্দ ছাড়া। এবং সাধারণ মানুষ যেহেতু দরবেশ নয়, তারা তাই ভালবাসে অথবা ভালবাসার জন্য আকুলিবিকুলি করে, তারা নির্ঘাত পোড়ে এবং পোড়ায়- এ এক উম্মাদনা জীবৎকাল ব্যাপী মানুষের।




শহীদুল জহির সমগ্র (গ্রন্থিত, অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত সমস্ত রচনা, চিঠিপত্র, ডায়েরি, সাক্ষাৎকার, মূল্যায়ন, জীবনপঞ্জি এবং অ্যালবামসহ।) অনেকে বলতে চান, জাদুবাস্তবতার রচনাভঙ্গি গ্রহণ করে স্বতন্ত্রভাবে লেখক হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার মানসেই তিনি লেখক-নাম শহীদুল হক থেকে শহীদুল জহিরে বদল করেছিলেন। উত্তর-আধুনিক প্রগতিবাদী লেখক হিসেবেও শহীদুল জহিরকে মূল্যায়ন করা হয়েছি। শহীদুল জহির তাঁর রচিত সাহিত্যে ভাষা ব্যবহারে অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন, হয়তো সফলও হয়েছেন। সাধারণভাবে বলা যায়, তিনি নিম্নবর্গের মানুষের মুখের অকৃত্রিম ভাষাকে পুঁজি হিসেবে নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যজগতের ব্যতিক্রমী স্রষ্টা শহীদুল জহির অকালপ্রায়ত। বিগত শতাব্দী সত্তরের দশকে সৃজনশীল সাহিত্য অঙ্গনে তাঁর অগমন ঘটেছিল। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্র বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। তাঁর সাহিত্য-সৃষ্টি আমৃত্য (২০০৮) বহমান ছিল। তাঁর সৃষ্টির পরিমাণগত দিক খুব বেশি না হলেও গুণগত দিক অসাধারণ। অসাধারণত্বের বিষয়টি নানা দিক থেকে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। ঘটনার বহুরৈখিক বর্ণনা, বুননশৈলী, শেকড়স্পর্শী অনুসন্ধান, প্রতিটি বিষয় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে উপলব্ধিপূর্বক তা সুসংগঠিত করা, পূর্ণাঙ্গতা-এ সবই তাঁর সৃষ্টিকে বিশিষ্ট করে তুলেছে অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায়, সংরক্ষণ এবং সংগ্রহের অভাবে অনেক সৃজনশীল সাহিত্যকর্ম কালের অতল গহ্বরে তলিয়ে যায়। এ বিষয়টি অনুধাবন করে শহীদুল জহির স্মৃতি পরিষদ ও পাঠক সমাবেশ যৌথভাবে শহীদুল জহির সমগ্র প্রকাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সূচিপত্র ভূমিকা গল্প পারাপার * ভালোবাসা * তোরাব সেখে * পারাপার * মাটি এবং মানুষের রং * ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প * আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই * কাঠুরে ও দাঁড়কাক * ডুমুরখেকো মানুষ * এই সময় * কাঁটা * ধুলোর দিনে ফেরা * চতুর্থ মাত্রা ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যন্য গল্প * কোথায় পাব তারে * আমাদের বকুল * মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা * ইন্দুর-বিলাই খেলা * প্রথম বয়ান * ডলু নদীর হাওয়া * আমাদের কুটির শিল্পের ইতিহাস উপন্যাস * জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা * সে রাতে পূর্ণিমা ছিল * মুখের দিকে দেখি * আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু অনুবাদ গল্প * ফেরা অগ্রন্থিত গল্প * কার্তিকের হিমে, জ্যোৎস্নায় অপ্রকাশিত উপন্যাস, গল্প, অনুবাদ, কবিতা উপন্যাস * মেহেরনি গল্প * অদ্বৈত * তিন বান্দা * বিদ্ধ ক্রীতদাস অনুবাদ গল্প * History of our cottage Industry * মুক্তি * অনুবাদ কবিতা * মাও সে-তুংয়ের কবিতা শহীদুল জহিরের কবিতা * কবিতা শহীদুল জহিরের সাহিত্যকর্মের মূল্যায়ন * সোনা-মোড়া কথাশিল্পী : শহীদুল জহির * হাসান আজিজুল হক * চেনা না-চেনা কথার কারিগর * শহীদুল জহিরের গল্প * পুরাতন ঢাকার কথকঠাকুর শহীদুল জহির * এখনো অপেক্ষা : শহীদুল জহিরের মৃত্যু * আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু * আমাদের সাহিত্যে শহীদুল জহির কেন থাকবেন * থেমে গেল দক্ষিণ মৈশুন্দি আর ভূতের গলির গল্প * জাদু, বাস্তব, কিংবা জহিরের উপন্যাসগাথা * রাজাকারবিরোধী লেখক শহীদুর জহির * শহীদুল জহিরের গল্প : তৃতীয় বিশ্বের ময়না-শালিক * শহীদুল জহির : নবীন বীণার প্রবীণ বাদক * শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা * শহীদুল জহির: মৃত্যু যাকে জন্ম দিয়েছি * ইফতি ভাই, শহীদুল জহির এবং আলো-অন্ধকার বিষয়ক * শহীদুল জহির : কোথায় পাব তারে শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার, চিঠিপত্র ও ডায়েরী শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার * অপ্রকাশিত আড্ডার খসড়া * শহীদুল জহিরের সাক্ষাৎকার : ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর শহীদুল জহিরের * বাসভবনে এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন কথা শিল্পী কামরুজ্জামান জাহাঙ্গীর * আমার তো মনে হয়ে জীবনের ব্যর্থতাগুলোও একধরণের ঐশর্য : শহীদুল জহির * যে নিঃসঙ্গ নয় , সে হতভাগ্য :শহীদুল জহির * ছোটকাগজেই হলো সাহিত্যের যথার্থ উৎসভূমি : শহীদুল জহির * অন্তরঙ্গ শহীদুল জহির : শহীদুল জহিরের শেষ সাক্ষাৎকার শহীদুল জহিরের চিঠি * শহীদুল জহির ও তাঁর চিঠি শহীদুল জহিরের ডায়েরী শহীদুল জহিরের প্রকাশিত এবং গ্রন্থিত ও তাঁর সম্পর্কে প্রকাশিত লেখার তথ্য * তথ্য-বিবরণ * জীবনপঞ্জি পরিশিষ্ট শহীদুল জহিরের প্রকাশিত গ্রন্থের পর্যালোচনা * পারাপার-এর শহীদুলণ জহির * যাপন-বাস্তবতাই রাজনীতিক : শহীদুল জহিরের পয়লা উপন্যাস পাঠ * উপন্যাস পাঠ : সে রাতে পূর্ণিমা ছিল * ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প : শিল্পের চতুর্মাত্রিকতা * বাস্তবের বিপরীতে বাস্তব : ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প * ব্যক্তিগত অনুভব ও মুখের দিকে দেখি * মৃত্যু এবং মৃত্যু শহীদুল জহিরের জন্য কবিতা * কবিতাগুচ্ছ * Shahidul Zahir in Wikipedia ( An eminent post modernist of Bangladesh) স্মৃতিচারণ * বন্ধু শহীদুল জহিরের স্মৃতি ও সাহিত্যকর্ম * শহীদুল হক -আমার বন্ধু * অনুজের কথা


Read more books at: http://www.amarboi.com/2014/02/shaheedul-jahir-shamagra.html


via @amarboi www.amarboi.com


শহীদুল জহিরের গল্প ও আটকে-পড়া বাঙালির যুদ্ধ / মাজুল হাসান

অনেকে বলে থাকেন জহিরের মূল জায়গা মুক্তিযুদ্ধ। কথাটা হয়তো অংশত সত্য। অংশত বললাম এই কারণে যে, কারো আসল জায়গা ওটা, ওটা ওমুকে ভাল পারে, এইসব বলে লোকে আসলে তাকে একটা গণ্ডিতে ফেলে দিতে চায়। এই ফেলে দেয়া তাকে প্রতিষ্ঠা বা খারিজের অপচেষ্টার নামান্তর। মানে, এর পেছনে রাজনীতি ও রণনীতি দুটোই বিদ্যমান। তাই জহিরের লেখায়, বিশেষত গল্পে মুক্তিযুদ্ধ কীভাবে এসেছে তা খতিয়ে দেখার একটু লোভ দেখা দিয়েছে। তবে আলোচনা বা বিশ্লেষণ যাই বলি না কেনো, প্রথমেই বলে নেই, আমার মতে, জহির নিত্য রাজনীতিময়। এই রাজনীতিময় শব্দটির আমার নিজস্ব ব্যাখ্যা আছে, যা জহিরের সামগ্রিক দর্শন, পাশাপাশি তার আন্তরিক প্রণোদনা ও সীমাবদ্ধতার সাপেক্ষে একটি তুলনামুলক অবস্থান মাত্র। যাক সে প্রসঙ্গ। চলে আসি মূলের কাছে।

এ কথা সত্যি, জহিরের লেখায় ঘুরেফিরে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ এসেছে। কখনো ঝলকের মতো, কখনো বর্তমানের সাথে অতীতের সর্ম্পক কাঠামো তুলনায়, কখনো নিপাট স্মৃতি রমন্থনে, কখনো বা প্রেমের জটিলটায় আরেকটু বেশি রুদ্ধশ্বাস বাড়াতে ব্যবহার করা হয়েছে যুদ্ধকালীন পটভূমি। এ কথা সবাই মানবেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক জহিরের সবচে গুরুত্বপূর্ণ ও ফ্রেমওয়ার্ক বিচারে সবচেয়ে পরিপূর্ণ লেখাটি হলো "জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা"। মাত্র ৪৮ পৃষ্ঠার ছোট্ট এই উপন্যাসটিতে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে ভয়াবহ নৃশংতা ও আশাভঙ্গের প্রামাণ্য হিসেবে, যার তুলনা অনেকে টেনেছেন হুয়ান রুলফোর "পেদ্রো পারামো"র সাথে। এই তুলনা যুগপৎ সম্মান ও সন্দেহের বিষয়। কারণ, এটা যদি কম্লিমেন্ট হিসেবেও ধরে নেয়া হয়, তারপরেও প্রশ্ন থাকে। প্রশ্নটা হলো—তারা কি মনে করেন, এতে করে জহিরের জাতের উত্তরণ বা অবনমন ঘটবে?!

শহীদুল জহির

জহির তো নিজেই স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি মার্কেজের কাছ থেকে জাদুবাস্তবতার তালিম নিয়েছেন। সেটা নতুন করে প্রমাণ-অপ্রমাণের কিছু নাই। কারণ, জাদুবাস্তবতা গল্প বলার একটা টেকনিক মাত্র। এই টেকনিক দিয়ে যা লেখা হবে তাই ভিনদেশী হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমার তো মনে হয় জহির অনেক বেশি স্বদেশী। স্বদেশী—নিজের শেকড়-মুখীতায়। তা না-হলে জহির এতো বহুলপাঠ্য হয়তো কখনোই হতে পারতেন না। নীরিক্ষা করে পাঠকপ্রিয়তা, এ কেবল জহিরের ভাগ্যে জুটেছে। আর জহির যে ভাষা বেছে নিয়েছেন তার সিনটাক্স বা পদবিন্যাস অনেকটা মুখের ভাষার কাছাকাছি। এটা অনেকটাই আমাদের গালগল্পের ঢঙ, যাতে দ্বিরুক্তি থাকে, মুদ্রাদোষ থাকে, থাকে অতিশায়ন। আর সবচে জরুরী জিনিস, তার লেখায় (ল্যাতিন আমেরিকা নয়) আমাদের প্রিয় দেশমাতৃকা বাঙলাই উঠে আসে। উঠে আসে বাঙলার রাজনৈতিক ও সামাজিক চিত্র, ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ।

লক্ষ্মীবাজারের লোকদের মনে পড়ে, একাত্তর সনে বদু মওলানা নরম করে হাসত আর বিকেলে কাক ওড়াত মহল্লার আকাশে। এক থালা মাংস নিয়ে ছাদে উঠে যেত বদু মওলানা আর তার ছেলেরা। মহল্লায় তখনো যারা ছিল, তারা বলেছিল, বদু মওলানা প্রত্যেকদিন যে মাংসের টুকরোগুলো আকাশের দিকে ছুড়ে দিত, সেগুলো ছিল মানুষের মাংস। কারণ, মহল্লার সবচাইতে প্রাচীন মুসলমান পরিবারটির প্রধান, খাজা আহমেদ আলী বলেছিলেন যে, একদিন এক টুকরো ছুড়ে দেয়া মাংস কাকেরা ধরতে ব্যর্থ হলে সেটা এসে পড়েছিল তার বাড়ির ছাদের ওপর। তিনি ছাদের ওপর বিকেলের একচিলতে রোদে বসে অতীত যৌবনের স্মৃতির ভেতর নিমজ্জিত হয়ে ছিলেন, তখন মাংসখণ্ডটি তার পায়ের কাছে এসে পড়ে। তিনি কিছুক্ষণ দেখে অনুধাবন করেন যে টুকরোটির গায়ের একদিকে চামড়া রয়ে গেছে এবং তিনি দেখেন যে এই চামড়া একেবারে মসৃণ। এসব কথা মহল্লার সকলে পরে জেনেছিল। সেই বিকেলে মাংসটুকরোটি হাতে তুলে নিয়ে তিনি দেখেন যে, সেটার গায়ে ছোট্ট মুসুরের ডালের মতো একটি পাথরের ফুল। তিনি হাহাকার করে ওঠেন, দুহাতের অঞ্জলিতে টুকরোটি নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে বড় ছেলে খাজা শফিকের সহায়তায় সেটা দাফন করেন নিজের বাড়ির আঙিনায়। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ার সময় তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন। একটি অদেখা মেয়ের জন্য লক্ষ্মীবাজারের এক বিষন্ন বৃদ্ধের হৃদয় সেদিন ভেঙে পড়ে। এখন তার বাসার আঙিনায় তার নিজের আর তার ছেলের জোড়া কবর। -জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার ও পাক-আর্মিদের নৃশংসতা ও পরবর্তীতে স্বাধীনতা বিরোধীদের সাধারণ ক্ষমা ও সামাজিকভাবে পূনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার প্রেক্ষাপটকে জাদুর মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। জহির তার জাদুবাস্তব বয়ানে পাক-হানাদার ও দোসর বদু মওলানাদের নৃশংসতা ও বিভৎসতার যে বর্ননা দিয়েছেন তাতে যে কোনো পাঠক আঁতকে উঠবেন। এই জাদু-আবহ কিন্তু ঘটনার মূল টেস্টকে ক্ষুন্ন করে না, বরং তা হয়ে ওঠে বহুমাত্রিক। বাংলায় জাদুবাস্তবতার এতো বিশাল-বিপুল-সফল প্রয়োগ এর আগে ছিল প্রায় অজ্ঞাত। সব মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও তার লাভ-ক্ষতির খতিয়ান এই উপন্যাস। আর এর মূল ম্যাসেজের জায়গাটি হলো: একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধীদের সীমাহীন দমন-পীড়ন ও বিভৎসতার কথা আজো ভুলে যায়নি নিহত-নির্যাতিত মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার-পরিজন। কিন্তু রাজাকার বদু মওলানা-আব্দুল গনির মতো সেই নির্যাতনের হোতারা আবারো সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশে। পরিতাপের বিষয়, এই উত্থান বা পূনঃপ্রতিষ্ঠা মেনে নিয়েছে আজিজ পাঠানের মতো একসময়ের ডাকসাইটে মুক্তিযোদ্ধারাও। তাই আব্দুল মজিদদের আর কোনো আশ্রয়স্থল থাকে না; নিজ বাসা-বাড়ি বিক্রি করে তাদের হতে হয় খড়কূটোর মতো উদ্বাস্তু।

এতো গেলো উপন্যাসের কথা। কিন্তু গল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি কিভাবে ধরা দিয়েছে জহিরের লেখনীতে, কী-কী তথ্য-উপাত্ত কি-কি টেকনিকে গল্পে ইনপুট করা হয়েছে, আমার বিশেষ প্রচেষ্টা থাকবে সে স্বরূপটি উদ্ঘাটনের দিকে।

উপন্যাসে জহিরকে অনেক বেশি এককেন্দ্রিক ও সুসংহত মনে হয়। কারণ, এসময় তাকে পারম্পরিক সাজুয্যপূর্ন কাহিনী নির্মাণ করতে দেখি ( এখানে ভাষা ও জাদুবাস্তবতার প্রায়গিত জৌলুসের প্রসঙ্গটি উহ্য রাখছি)। কিন্তু গল্পে? গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বর্ননায় এই জহিরই আবার অনেক বেশি স্ক্যাটার্ড। আর সেখানেও চলে আসে জহিরের গল্প বলার নিজস্ব টেকনিকের প্রসঙ্গটি। "পারাপার"এর পর আমরা জহিরের যেসব গল্প পাই, তাতে গল্পকেন্দ্র এতো বেশি ফ্লাকচুয়েট করে যে, তাকে তখন নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় ফেলা যায় না। বলা যায় না—"গল্পটার পটভূমি হলো এইটা.." অথবা বলা যায় না—"তিনি এইটা বলতে চাইছেন"। এক্ষেত্রে জহিরের টাইম লাইন ভেঙে ফেলার প্রবণতা সাধারণ পাঠকদের জন্য অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তবে যেহেতু জহিরের ভাষাটি বেশ সহজ এবং (সিনটাক্স) প্রায় কথ্য ঢঙের কাছাকাছি, সর্বোপরী একটা চাপা হিউমার তাতে বিরাজমান, সেকারণে গল্পটি শেষ না করে পাঠক স্বস্তি পায় না। পাশাপাশি গল্পে নানান মাত্রার রূপক ও ইলিউশন ব্যবহার করে জহির গল্পকে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গায় দাঁড় করান। সব মিলিয়ে প্রথাগত গল্পের তুলনায় জহিরের গল্প অনেক বেশি স্ক্যাটার্ড। (তবে তা মজাদার)। জহিরের গল্প যারা পড়েছেন তারা জানেন, তার অনেক গল্পেই মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি প্রবলভাবে হানা দেয়। "মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা" ও "কাঁটা"সহ জহিরের বেশ কয়েকটি গল্প তো সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক। তবে এসব গল্প তিনি লিখেছেন তার ট্রেডমার্ক গসিপীয় ঢঙে। আসলে, জহিরের গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর বহুমুখী অর্থবোধকতা, তথা এর সম্প্রসারণশীলতা। জহির গল্পে যা বলেন অথবা বলেন না, তার চেয়েও বেশি কিছু, এমন কী সম্পূর্ন ভিন্ন মানে দাঁড় করাতে পাঠককে তেমন বেগ পেতে হয় না। এতে করে পাঠক নিজের মতো করে গল্পটাতে সক্রিয় অংশ নিতে পারেন। যার ফলাফল: গল্পে আসে গতিশীলতা, সেই সাথে ইমাজিনেসেনের যথেষ্ট সুযোগ থাকায় তা হয়ে ওঠে পাঠকের মনোজগতের নিকটবর্তী।

লক্ষনীয় যে, জহির তার গল্পে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলিয়েছেন মহল্লার সাধারণ মানুষের মুখে অর্থাৎ থার্ড পারসন প্লুরাল নাম্বার দিয়ে। বিভিন্ন জনের (আমরা, মহল্লার লোকেরা..) মুখ দিয়ে অথবা দোদুল্যমান স্মৃতি উপচে এসেছে সুবোধচন্দ্র ও তার স্ত্রীর মতো সংখ্যালঘুদের কথা, রাজাকারের কথা, পাক-আর্মির অত্যাচার, এসেছে জ্বালাও পোড়াও ডামাডোল। আবার কখনো বা শহর ছেড়ে পালানো ভীত সন্ত্রস্ত মানুষেরা উঠে এসেছে গল্পের ভরকেন্দ্রে। আমরা জানতে পারি নয়াবাজারে গোলাগুলি, রাতে কার্ফ্যু আর দিনে রাজাকারের তাণ্ডবের সেই ভীতিকর সময়ের কথা। পাক-আর্মির দোসররা যারা বাঙালিই ছিল, সেই সুবিধাভোগীদের বিরুদ্ধে জহিরের একটি পরিস্কার অবস্থান রয়েছে। এই বাঙালি হত্যাকারী বাঙালিদের (রাজাকার, আল-বদর, শান্তি কমিটির সদস্য) স্বরূপ উন্মোচন ও তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশে জহির সদা সচেষ্ট থেকেছেন।

জহিরের গল্প পাঠক মাত্রই জানেন তার বেশ কিছু গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে জিঞ্জিরার স্মৃতি। জহির কিভাবে তার গল্পে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটি এনেছেন সে আলোচনায় যাবার আগে এই জিঞ্জিরা ম্যাসাকার সম্পর্কে আলোকপাত করা জরুরী মনে করছি। চিটাগাং থেকে প্রকাশিত "কথা" নামের একটি লিটলম্যাগে দেয়া সাক্ষাতকারে সে প্রসঙ্গে জহির বলেন—

জিঞ্জিরায় থাকলাম একটা বাসায়, চরাইল নামের একটা গ্রামে একদিন থাকলাম, পরের দিন বের হয়া আসতে হইলো। দ্বিতীয় দিনের খুব সকালে পাকিস্তানী মিলিটারি তাদের অপারেশন শুরু করে, জিঞ্জিরার কোথাও বুড়িগঙ্গার কিনারা থেকে মিলিটারিরা গানবোট দিয়া গোলা ছোড়ে। …..। আমরা সকালে তখন ঘুমের মধ্যে ছিলাম, গোলার শব্দে জেগেই দেখি এই বাসায় আশ্রয় নেওয়া পনর বিশটা পরিবারের সকলে বাসা থেকে বের হয়া কোথাও পালায়া যেতে চাচ্ছে। ….। আমার পরিস্কার মনে আছে আমার মা তার দুই হাত দিয়া বুক চেপে ধরে আছে আতঙ্কে, আব্বার কোলে আমার ছোট ভাই আর আমার কোলে আমার একদম ছোট বোন। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠের ভিতর দিয়া ট্রেসার বুলেটের মতো লাল গুলি চলে যাচ্ছিল, পাকিস্তানী মিলিটরি হয়তো তাক করে গুলি ছুড়ছিল না, কিন্তু এগুলা ফাকা গুলিও ছিল না, মাঠের ভিতর দিয়া পলায়নরত মানুষের শরীরে লাগার মতো করেই এগুলা এলোপাথারিভাবে ছোড়া হচ্ছিল। আমার মনে আছে, যেদিক থেকে গুলি আসছিল আমি আমার বোনটাকে কোলের উল্টা দিকে নিলাম, কারণ, মনে হচ্ছিল তাহলে গুলি লাগলে আমার গায়েই লাগবে, আমার বোনের গায়ে লাগবে না। যা হোক, তখন দেখা গেলো যে দৌড়ায়া পালায়া অন্য কোথাও যাওয়ার রাস্তা নাই, মিলিটারি বৃত্ত তৈরী করে নিয়েছিল, আমরা দেখলাম দূরে আমাদের সামনের দিকেও মিলিটারি আছে। তখন আমরা অন্য একটা অপরিচিত বাসায় যায়া উঠলাম। …। দুপুর পর্যন্ত অপারেশন চললো। তারপর আমরা পুনরায় চরাইল গ্রামে চেয়ারম্যান বাড়িতে ফিরা গেলাম। যায়া দেখি অন্য সকলেও ফিরা আসছে। হয়তো দুয়েক জনকে পাওয়া গেল না। সেদিন রাত কাটায়া পরদিন আবার ঢাকায় চলে এলাম, মগবাজার, নয়াটোলায়। সম্ভবত এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আমি আমার পরিবারের সাঙ্গে আমি গ্রামের বাড়ি চলে যাই। সম্ভবত জুলাই আগষ্টে আব্বার সঙ্গে আবার আমি ঢাকায় আসি, তারপর আব্বা সিরাজগঞ্জ ফিরা যান, কিন্তু আমি ঢাকায় একা থেকে যাই। -শহীদুল জহিরের সাক্ষাতকার, কথা (কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ)।

গল্প আলোচনায় লেখকের সাক্ষাতকারের এতো বড় অংশ কোট করা দেখে অনেকে বিরক্ত হতে পারেন। কিন্তু এই অংশটি আমার কাছে খুবই জরুরী মনে হয়েছে। লেখকের অভিজ্ঞতার চারণক্ষেত্রটি জানা না থাকলে তার সাহিত্য-দর্শন ও বক্তব্য, কিয়দংশে সীমাবদ্ধতা কোনোটাই বোঝা সম্ভব নয়। এখানে লক্ষনীয়: কিছুদিনের জন্য ঢাকা ছেড়ে পালালেও জহির কিন্তু যুদ্ধে যাননি। তার ভাষ্য মতে, নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি, হয়তো যুদ্ধের আকস্মিতা ও আকিস্মকভাবে খুব কম সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেটা সম্ভব হয়নি। তবে যুদ্ধকালীন সময়ের একটা বড় অংশ তিনি কাটিয়েছেন রাজধানী ঢাকায়। ঢাকা তখন অনিশ্চিত, অবরুদ্ধ নগরী। এই অবরুদ্ধ নগরীর কথাই এসেছে জহিরের লেখায়, যেখানে সবাই আটকে-পড়া, গ্রামে কী ভারতে অথবা অন্য কোথাও তারা পালিয়ে যেতে পারে নি, পালিয়ে গ্যালেও ফিরে এসেছেন আবারো (ঠিক জহির

যেমন করেছিলেন)। সেজন্যই হয়তো, তার গল্পে মুক্তিযুদ্ধের যে বর্ননা পাই, তা অসহায়, হতবিহ্বল, কখনো কখনো একেবারে অক্ষিদূরত্বে দেখা গুমোট সময়ের কহনকথা হয়ে ওঠে। তার গল্পে ঘুরেফিরে আসে ভূতেরগলি, লক্ষীবাজার, জিঞ্জিরা, আটকে পড়া মানুষ, যারা কথা বলে, কে যুদ্ধে গেলো, কার ছেলে মারা গেলো যুদ্ধে, কোন হিন্দুবাড়ি পুড়লো রাজাকারের আগুনে… এইসব বিবিধ বিষয়-আশয় নিয়ে। তবে যেমনটি হয়ে থাকে, জহির গল্প বলেন গসিপীয় ঢঙে, একটু ঘুরপথে, ঠিক তেমনি, মুক্তিযুদ্ধও তার গল্পে এসেছে একটু ঘুরপথে। এসব গল্পকে সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত "উমুক" গল্প। এই "অমুক" হতে পারে প্রেম, আটপৌরে জীবনযন্ত্রনার প্রতিনিধিত্বশীল শব্দ।

জহিরের আগে-পরে সরাসরি যুদ্ধের ওপর অনেক গল্প-উপন্যাস লেখা হয়েছে। তবে সেসবের বেশির ভাগই সাহিত্যিক মূল্য বিবেচনায় এক-একটা অশ্বডিম্ব। কারণ, সেখানে মুক্তিযুদ্ধের কতগুলো জেনারেল ফিচার ঠিক করে গল্পের সেট-আপ দেয়া হয়েছে। যেন, বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের গল্প মানে—কিছু রেপ, হিন্দু নিধন, রাজাকারের দৌরাত্ব আর দলমত নির্বিশেষে বাঙালীদের তীব্র সম্মূখ সমর। এতে যুদ্ধ-যুদ্ধ ফ্লেবার আসে ঠিকই, কিন্তু দাদামা-বাজানো রুদ্ধশ্বাস আসে না, পালসটা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে কম হয়ে যায়। ফলে, সেসব লেখার অনেকগুলোই সৎ ডকুমেন্টেশন হয়তো হয়েছে, কিন্তু ভাল সাহিত্য হয়নি। জহির হয়তো এই কথা উপলব্ধি করতেন। আর সে কারণেই হয়তো তিনি মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছেন ভিন্ন ভাবে; এপ্লাই করেছেন নিত্য-নতুন টেকনিক। উপন্যাসের কথা আগেই বলেছি। তা বাদে, আমরা যদি "কুয়ো" গল্পটির কথা ধরি তবে এটাকে অবশ্যই একটা মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে হবে। কিন্তু এটা কি কেবল যুদ্ধের কাহিনি, নাকি আরো বেশি কিছু? কোথাও কোনো বীরত্ব নেই, নেই রেপ-সিন, তারপরেও সবকিছু কী রকম প্রতীক হয়ে ওঠে! কালের গন্ডি ভেঙে ফেলে জহির চলে আসেন নব্বই দশকের বাবরি মসজিদ ভাঙার পর হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রসঙ্গটিতে। সমস্ত বিষয়টি এক সূত্রে গেঁথে "কাঁটা"য় একটি অভাবনীয় রূপক বা এরিগরিকাল গল্প উপহার দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করেছে তার অনির্দিষ্ট বয়াণ কৌশল ও অনিশ্চিতায়ত্মক ডায়লোগের আধিক্যযুক্ত নতুন এক ভাষা। যেখানে সোজা কথা সোজা করে বলেন না তিনি, বলেন ঘুরিয়ে ফিরেয়ে। কখনো আবার ভেঙে দেন ঘটনার ধারাক্রম। এতে পাঠককে সদা জাগ্রত থাকতে হয়। একটু বেপুথো হলে তার অবস্থা হবে "সে রাতে পূর্ণিমা ছিলোর" মতো। তখন চাঁদের রহস্যময় আলোর কারণে আসল সত্য ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়ে যেতে বাধ্য। পাঠক ভাববেন তিনি গল্পটির পুরোটাই বুঝেছেন, ভিজুয়ালাইজ করেছেন। কিন্তু তা হবে বিভ্রমের শামিল। (জহির হয়তো নিজেও বিভ্রম তৈরীর সচেতন চেষ্টা করেছেন)

যা হোক, কথা বলছিলাম জহিরের গল্পে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি ব্যবহারের মাত্রা-প্রকৃতি নিয়ে। জিঞ্জিরা ম্যাসাকারে কথা অনেকটাই এসেছে তার "প্রথম বয়াণ" গল্পটিতে। (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, মহল্লায় বান্দর… এই গল্পগুলোতেও জিঞ্জিরার বর্ননাও প্রায় একই রকম)। তবে এখানে যা বাড়তি, তা হলো, সুপিয়া বেগম কেরেক্টারটি, মূল চরিত্র আব্দুর রহমানের সাথে যার সম্পর্কটি শেষ পর্যন্ত অনির্দিষ্ট থেকে যায়। থেকে যায় অব্যাখ্যেয়। মহল্লার রোকে বসে-বসে কেবল চপল কিশোরী সুপিয়ার চলে যাওয়া দেখে (তার ফুলের ডাল রেখে যাওয়া দেখেও) তার প্রতি রহমানের যে বিশেষ আকর্ষণের সূত্রপাত সেটাই গল্পে মূল সুর হয়ে ওঠে। আর এই ঘটনা ঘটাবার জন্য জহির বেছে নিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে। সুপিয়ার সাথে রহমানের প্রথম সরাসরি কথা-বার্তা যুদ্ধ শুরু হবার পর, জিঞ্জিরায়, কোনো এক আশ্রিত বাড়িতে। এখানেও সুপিয়া-রহমান সম্পর্কের ধরণটি কিন্তু পরিস্কার হয় না। আর এর কারণ, জহিরের গসিপীয় ঢঙ। মুক্তিযুদ্ধের সময়টাকে যথেষ্ট স্পেস দেয়া সত্বেও আমার চোখে এই গল্পটি শেষ পর্যন্ত প্রেম বিষয়ক জটিলতাই মূখ্য হয়ে ওঠে। এখানে অনেকে, আমার বন্ধুজনেরা একটি প্রতীকায়ণ আরোপের চেষ্টা করেন। কারো কারো মতে, রহমান যখন মহল্লা অনেক আগের কোনো কেরসিন বাত্তির খুঁটির খোঁজ করে তখন সে আসলে তার শেকড় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ফিরার চেষ্টা করে। কিন্তু এমন ব্যাখ্যার বিপরীতে, পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পুরনো প্রেমের স্মৃতিকাতরতার চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না। আমার মতে—প্রেম, স্মৃতিকাতরতা, সেই সাথে দাম্পত্য-জটিলতাই এই গল্পের কেন্দ্রবিন্দু।

আসলে, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের ডকুমেন্ট্রির মতো, মুক্তিযুদ্ধকে গ্লোরিফাই করার জন্য কোনো গল্প লেখেন নি জহির। এমন কি পুরো গল্প আগাগোড়া মুক্তিযুদ্ধের সময়ের টাইমফ্রেমে বন্দী জহিরের এমন গল্পের সংখ্যা মাত্র একটি। সেটি হলো: "মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা"। এই গল্পে বান্দর হয়ে ওঠে রাজাকার-আল-বদর অথবা সে সময়ের লুটপাটকারী সুবিধাবাদীর প্রতীক। এ বাদে জহিরের অন্যান্য গল্পে মুক্তিযুদ্ধ এসেছে তীব্র ঝলকানির মতো। আবার কখনো কখনো তা থেকে গেছে ক্রোমা-ক্যানভাসের মতো। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের অনেক ঘটনাই জহিরের কলমে ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে। আর সেটার পেছনে তার ভাষা ও গল্প নির্মাণ টেকনিক বড় সাহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে "কাঁটা" গল্পের কিছু খণ্ডিত অংশ কোড করা যেতে পারে—

ক্যাপ্টেন যখন বলে, কলেমা বলো, তখন একে-একে সকলে কলেমা তৈয়বা পড়ে শোনায় কিন্তু এইদিন আবুবকর মওলানা বিষয়টি শেষ প্রান্ত পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিল, সে পাকিস্তানি মিলিটারির ক্যাপ্টেনের সাথে কথা বলার পর বন্দুক বাগিয়ে ধরে দুজন সিপাই এগিয়ে এসে লাইনের প্রথম ব্যক্তিকে বলে, লুঙ্গি উঠাও এবং তখন লাইনে দাঁড়ানো মহল্লার অন্য লোকেরা দেখে, আঠার নম্বর বাড়ির পাকা দাড়িওয়ালা ইদ্রিস মিয়া কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর লুঙ্গি উঁচু করে ধরে দিনের আলোর ভেতর খাতনা করা শিশ্ন উন্মুক্ত করে তার পরিচয় প্রমাণ করে এবং মহল্লার লোকেরা বলে যে তখন তারা ইদ্রিস মিয়ার চোখ থেকে শুভ্র দাড়ি বেয়ে অশ্রু নেমে আসতে দেখে।

এতো কিছুর পরও কিন্তু সক্রিয় সমর কিংবা গেরিলা যুদ্ধের তেমন কোনো অভাবনীয় বর্ননা জহিরের গল্পে খুঁজে পাওয়া যায় না। তার লেখার মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বও কারনামাগুলো লোকমুখে শোনা যায়। তারপর যখন তাদের গল্পের ফ্রেমের মধ্যে পাওয়া যায় তখন যুদ্ধ শেষ; এটাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তণ দৃশ্য। জহিরের গল্পে পাওয়া যায় না যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে যাওয়া হাজারো ছেলের অবর্ননীয় ত্যাগের কথা। খাওয়া-পরার কষ্টের কথা বাদ দিলেও সেসময় অনেক তরুণ ট্রেনিং নিতে গিয়ে প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও নেতৃত্বহীনতার যে ভয়াবহ চিত্র দেখেছিল, তার কোনো কিছু জহিরের গল্পে আসেনি। আসেনি যুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালীদের কূট-রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। আর এই অনুপস্থিতির কারণ লুকানো আছে একটু আগে উদ্ধৃত তার স্বাক্ষাতকারেই। জহিরের ঝুলিতে যে সেসব অভিজ্ঞতাই ছিল না!? জহিরের সামনে যা ছিল তা হলো, আটকে পড়া অসহায় বাঙালী আর তাদের নিত্যদিনের রুদ্ধশ্বাস। পাক-হানাদার আর বদু মওলানার মতো রাজাকারের তাণ্ডব। সেই রুদ্ধশ্বাস উপলব্ধিতে জহিরের অবশ্য কোনো ভুল হয়নি। একদিক দিয়ে বলতে গেলে, জহির আসেল কোনো অসততার আশ্রয় নেন নি। যার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না সে বিষয়ে তিনি গাল-গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেন নি। আর যাতে সম্পৃক্ত ছিলেন, চোখে দেখেছেন, গল্পে ঘটিয়েছেন তার সর্বোত্তম চিত্রায়ণ।

মহল্লার লোকেরা জানতে পারে যে, আব্দুল হালিমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, সে নিখোঁজ হয়েছে, তার মায়ের জন্য রেখে গেছে ছোট্ট চিরকুট। ভূতের গলির লোকেরা যখন এই খবর পায় এবং তারপর তারা যখন গোপনে রাতের বেলা বিবিসি এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে রুদ্ধদার খবর শোনে, তাদের মনে হয় যে, হয়তো আব্দুল হালিম কোথাও কোন সেক্টরে কোন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছে। তখন একদিন তারা তার মৃত্যুর খবর শোনে, এবং তারা বলে, আহারে আব্দুল হালিম! মায়ের জন্য টেবিলের ওপর চিরকুট রেখে যাওয়ার মাস দুয়েক পর ভাদ্র মাসের ১৬ তারিখ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার সময় এক অপরিচিত যুবক আসে মহল্লায়, সে দ্রুত হেঁটে গিয়ে আব্দুল হালিমদের বাসার সম্মূখ দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে তারপর আমেনা বেগমের সাঙ্গে কথা বলে পিছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে যায়; এই যুবক আব্দুল হালিমের মৃত্যু খবর নিয়ে আসে। -মহল্লায় বান্দর, আব্দুল হালিমের মা এবং আমরা

আব্দুল হালিম নামের এই যুবক কিন্তু সত্যি কেরেক্টার। হালিম (আসল নাম কাঞ্চন) ছিলেন জহিরের মহল্লার বাসিন্দা; যুদ্ধ জয়ের পর বাড়ি ফেরার পথে বুড়িগঙ্গায় নৌকাডুবিতে মারা গিয়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। গল্পে তাঁর মৃত্যুর সময়টা একটু চেঞ্জ করেছেন জহির। তাঁকে তিনি মেরে ফেলেন যুদ্ধে যাবার আগেই, অই একই বুড়িগঙ্গায় ডুবিয়ে।

তবে একটা বিষয় আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে খুব খাপছাড়া মনে হয়। তখন তো লোকমুখে বঙ্গপোসাগরে মার্কিন রণতরী আসা, চীনের সাথে পাক-আঁতাত, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু অথবা বেঁচে থাকাসহ নানা বিষয়ে নানান কথা শোনা যাচ্ছিল। জহিরের গল্প বলার যে ধাঁচ তাতে এ বিষয়গুলো সহজেই আসতে পারতো। যথেষ্ট পলেটিক্যাল ওরিয়েন্টেশন ও এতো বেশি রাজনীতি সচেতন হয়েও জহির কেনো তার গল্পকে দেশীয় রাজনীতির গণ্ডি পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপটের সাথে রিলেট করতে পারলেন না?! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অথবা পরবর্তী সময়ের  পরাশক্তিদের কূট-রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার (হস্তক্ষেপ) প্রসঙ্গগুলো এলে জহিরের গল্প হয়তো আরো বৈশ্বিক (যেমনটি দেখা যায় ল্যাতিন সাহিত্যে) হয়ে উঠত। (এ প্রসঙ্গে সৈয়দ ওয়ালীউল্লার "কদর্য্য এশিয়া" উপন্যাসটির কথা মনে পড়ে, যেখানে আর্ন্তজাতিক রাজনীতির সাথে দেশীয় রাজনীতির সংশ্লিষ্টতার চিত্র তুলে ধরার একটি বড় ধরণের উদ্যোগ দেখা যায়।)

সব দিক বিবেচনা করলে, জহিরকে আমার কাছে মনে হয়, যুদ্ধত্তর বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটের (স্বাধীন-সার্বভৌম স্বনির্ভর বাংলাদেশের আশাভঙ্গের) সবচেয়ে শক্তিশালী ইন্টারপ্রেটর। তার গল্পে যুদ্ধপরবর্তী সময়ের রাজনৈতিক চালচিত্রের যে সন্নিবেশ ও চিত্রময়তা দেখতে পাওয়া যায় তা এক কথায় অতুলনীয়। সেখানে নিত্য হয়ে ওঠে যুবকের আর্তনাদ (পারাপার), মধ্যবৃত্তের নির্বিবাদ ভন্ডামি ও বিষাদপূর্ন একঘেয়েমি  জীবন যন্ত্রণা (চতূর্থ মাত্রা; আগারগাও কলোনীতে নয়নতারফুল কেনো নাই), আছে মহল্লার রাজনীতি (এই সময়), তাতে পিষ্ট মানুষের নাভিশ্বাস ইত্যাদি অপরাপর বিষয়গুলো। 'ইন্দুর বিলাই খেলা' যে বন্ধ হয়নি তা তিনি এই নামে গল্প লিখে জানিয়েও দিয়েছেন। গল্পটিতে ক্ষমতা রাজনীতির নানান সময়ের নানান স্তরের বহিপ্রকাশকে ধরার চেষ্টা করেছেন তিনি। আর এ বিষয়ে তার মন্তব্য বা উপপাদ্য হলো: গরীব বা ক্ষমতাহীনদের মানে বিলাইদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় নাই, হয় না। গল্পের শেষে নিজের জবানিতে মন্তব্য করার মতো করে তাই তিনি বলেন— " এই খেলার শেষ নাই, খেলোয়াড়ের শেষ আছে, খেলোয়ার খেইল ছেড়ে চলে যায়, কিন্তু খেইল জারি থাকে।….। কেবল বিলাইরা ইচ্ছা করে খেলা ছেড়ে যেতে পারে, ইন্দুররা পারে না; বিলাই খেলতে চাইলে ইন্দুরকে খেলতে হবে"। ক্ষমতা-রাজনীতির এই তামার-বিষ সম্পর্কে জহির এতোটাই নিশ্চিত যে, "ইন্দুর বিলাই খেলা" গল্পে একটি বিরল ঘটনার বর্ননা দিয়েছেন তিনি। সেখানে তিনি যে তীর ছুড়েছেন তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের গৌরব কিছুটা ম্লান হয়েছে কীনা সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ, তবে জহিরের এমন দুঃসাহস চমকিত করে। যুদ্ধ থেকে যখন মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন, মানুষ যখন স্বপ্ন দেখছে শান্তি ও স্বস্তির; হয়তো সমৃদ্ধিরও, ঠিক তখনই জনৈকা খতিজা'র অভিজ্ঞতার কথা জহির বলছেন এভাবে—

তারা রাস্তায় নেমে আসে এবং মাসুদ আর মুনিরকে ঘিরে ধরে, তারা তাদের আগ্নেয়াস্ত্রে হাত বুলায়…… এবং তখন খতিজা সিলভারের জগে করে শরবৎ বানিয়ে আনে, বলে, তুমাগো লাইগা বানাইছি, খাওন লাগব, তুমরা আমাগো ভাই না? ….। খতিজা হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাবর্তনে শরবৎ বানিয়ে খাওয়ায়, কিন্তু এই শরবৎ খাওয়ার পরেও, এক সপ্তাহের ভিতর একদিন সন্ধ্যা বেলা শামসুল আলম খতিজাদের বাড়িতে আসে এবং তার বাপ অব্দুল জলিলের কাছে রাজাকারদের ভাত খাওয়ানোর কারণ জানতে চায়, এবং সে যখন সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারে না, তখন শামসুল আলম বলে, আপনে আমার লগে আহেন। মহল্লার লোকেরা বলে যে, তখন খতিজার নসিব পূনরায় তাকে প্রতারিত করে, সে ভেতর ঘর থেকে বের হয়ে এসে বলে, আমার বাপমায়ের দুষ নাই, রাজারকাররে ভাত আমি খাওয়াইছি। শামসুল আলমের হয়তো এ সব গল্প জানা ছিল; সে নিজেকে সংবরণ করতে পারে না, বলে, তাইলে তুমি আহ আমার লগে, এবং খতিজার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়। তারপর, শামসুল আলম দক্ষিণ মৈশুন্দির গলির মুখে তাদের দোতালা বাড়ির ছাতের চিলে কোঠায় খতিজাকে তিন দিন আটকে রাখে; এই খবর যখন প্রকাশিত হয়, তখন মাসুদ এবং মনির হোসেন এসে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। শামসুল আলমের বাপ, সিরাজ ব্যাপারি, এই ঘটনার পর কোন একদিন খতিজার বাসায় আসে এবং আব্দুল জলিলের কাছে শামসুল আলমের সঙ্গে খতিজার বিয়ের প্রস্তাব দেয়, কিন্তু তখন হয়তো অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, খতিজার দেহ মনে শামসুল আলমের জন্য কিছুই অবশিষ্ঠ ছিল না; ফলে, আব্দুল জলিল কিছু বলার আগেই খতিজা ভিতরের ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং বলে, আপনে যান! -ইন্দুর বিলাই খেলা

এই গল্পে জহির কেবল খতিজাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখার কথা বলেছেন। নির্যাতন কিংবা অন্য কিছু(?!) -সে বিষয়ে মুখ খুলেন নি তিনি। কিন্তু যখন তিনি খতিজার মুখে দিয়ে বলান- "আল্লার কাছে বিচার দিছি। আল্লায় বিচার করবো" -তখন বিষয়টা অনেকটাই পরিস্কার হয়ে যায়। আর গল্পের শেষে যখন দেখি, শামসুল আলম যে ছিল মুক্তিযোদ্ধা, সামান্য মশার কামড়ে তার মৃত্যু হচ্ছে, আর মহল্লার লোকেরা বিষয়টাকে রিলেট করছে খতিজার অভিশাপের সাথে; তখন কী বলবো, একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। জহির ছাড়া এভাবেই কঠিন ধাক্কা আর কে দিয়েছেন?

এভাবেই জহির তুলে ধরেছেন চালচিত্র, তা যতই রূঢ় হোক। এক অর্থে বলতে গেলে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সততাপূর্ণ স্পিরিট তিলে-তিলে নষ্ট হয়ে যাবার কথাই বেশি বলেছেন তিনি। এই বিষয়ে একটু আগাগোড়া চোখ ফেরাতে চাই। "পারাপার" -প্রথম গল্পগ্রন্থের এই নাম-গল্পটিতে জহির ধরতে চেয়েছেন সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের যুব-সমাজের আশাভঙ্গের সূত্রপাতটাকে। গল্পটি যে সময়ের পটভূমিতে লেখা দেশে তখন একদিকে দিকভ্রান্ত ভবিষ্যৎ যাত্রা, অন্যদিকে পাঞ্জাবি এলিটের জায়গায় রঙ বদলে চলে আসা বাঙালী এলিট। প্রবল-প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠা এই নব্য-বণিকদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্চিত হতে হয় গল্পের মূল চরিত্র ওলি'কে। আর তখন ওলি যেন হয়ে ওঠে অসহায় যুব সমাজের প্রতিনিধি। তারপর এই অসহায়ত্বকে টেনে আরো এক্সটেনশন করে 'এই সময়' পর্যন্ত বিস্তৃত করেন জহির।

তদন্তকারী পুলিশ অফিসার তার নোট বইয়ে সব টুকে নেয়, তারপর সে যখন এরশাদ সাহেব, মওলানা জব্বার, মালেকা বানু, মেজর ইলিয়াসকে বিষয়টি সর্ম্পকে জিজ্ঞেস করে তারা বলে যে, তিন ভাই ভাল ছেলে। …। তখন মহল্লার লোকেরা প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে থাকা তিন ভাই এবং অন্যান্য গন্যমান্য লোকের দিকে তাকায়, তারা কিছু বলতে পারে না। -এই সময়

দেখা যাচ্ছে, "পারাপার"-এর নির্যাতন এ গল্পে এসে বিস্তৃত হয়েছে আরো তৃণমূল পর্যায়ে। হয়ে উঠেছে আরো বেশি নির্মম; প্রাণঘাতী। তাই "এই সময়"-এ এসে জহিরকে লিখতে হয়েছে, পাড়ার মাস্তাদের (তিন ভাই—আবু, হাবু, শফি) হাতে নিহত মোহাম্মদ সেলিম নামের এক কিশোরের কথা। একটি অসম বয়সী কিশোর-যুবতীর প্রেমের ট্রাজেডীর আড়ালে জহির এই গল্পে যে ম্যাসেজটি দিয়েছেন তা হলো, রাজনৈতিক দূর্বৃত্তায়নের ষোলকলা-পূর্ণ হয়েছে। কারণ, স্বাধীনতা বিরোধী মওলানা জব্বার (জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা বদু মওলানার এক্সটেসশন), এরশাদ সাহেব, মালেকা বানু আর মেজর ইলিয়াস, সবাই আজকে গাঁটছড়া বেঁধেছে।

এই উদার ও মধ্য ডানপন্থী রাজনৈতিক ধারাক্রমের পাশাপাশি বাংলায় রয়েছে বামপন্থী আন্দোলনের সুদীর্ঘ ইতিহাস। সেখানেও রয়েছে নানা চরাই-উৎরাই, স্বপ্ন-বিভক্তি; ও মলিনতার বালিয়াড়ি। তাই, কোথাও কোনো যাওয়া নেই, নেই ফিরে আসার পথ। "ধুলোর দিনে ফেরা"য় বিষয়টি ধরেছেনও জহির। গল্পটিতে যুগপৎ ভাবে এগিয়ে চলেছে প্রেম ও রাজনৈতিক অবনমনের ইতিবৃত্ত। গল্পের মূল চরিত্র আব্দুল ওয়াহিদ যিনি কীনা একজন স্বশস্ত্র মার্কসিস্ট ছিলেন, শেষ পর্যন্ত তিনি নিজ গ্রাম সুহাসিনীতে ফিরে আসেন। তারপর, ছোট্ট ছোট্ট ক্যামেরা ফ্ল্যাশের মতো অনেকগুলো বিষয় উন্মোচিত হতে থাকে। আর গল্পের শেষে, বিরোধী গ্রুপের হাতে খুন হন আব্দুল ওয়াহিদ। ওয়াহিদকে খুন করার পর যখন ঘাতকেরা বার্তা রেখে যায়—শোধ নিয়ে গেলাম, তখন বাংলার চরম বামপন্থীদের মধ্যে মতভেদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের যে চিত্র আমরা পাই, তা দেখে জহিরের রাজনীতি সচেতনতার সর্বব্যাপকতার পরিচয় পাওয়া যায়। গল্পে, আব্দুল ওয়াহিদের মৃত্যুর কথা লিখলেও, এই নকশালী কিংবা মার্কসিস্টদের প্রতি জহিরের এক ধরণের টান আছে বলে মনে হয় (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, জহির ছাত্র ইউনিয়ন করতেন, মেনন গ্রুপ)। সে কারণেই হয়তো, আমরা দেখি, আব্দুল ওয়াহিদ গোলাপ গাছের সাথে নিয়মিত রুটিন করে কথা বলেন, ময়নাপাখিকে কথা শেখানোর চেষ্টা করেন। তখন এই বিষয়গুলোকে নিন্মবর্গের মানুষের স্বশস্ত্র বিপ্লবের স্বপ্ন বাঁচিয়ে রাখার প্রতীক বলে মনে হয়। লেখকের নিজের মন্তব্য এখানে স্মরণ করা যেতে পারে—

যারা একদিন স্বপ্ন দেখেছিল, তাদেরকে ব্যর্থ বলতে পারি না আমি। গল্পের ভিতরে বা বাস্তবে মরে যাওয়াই ব্যর্থ হয়ে যাওয়া না। …। এমনকি স্বপ্ন ও প্রচেষ্টার ব্যর্থতার পরেও, আমাদের রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামো তৈরিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই স্বপ্ন ও প্রচেষ্টার ফলাফল একেবারে অদৃষ্টিগ্রাহ্য না।…। তারপরও আমি বলছি না যে, অব্দুল ওয়াহিদরা সফল ছিল, তারা সফল ছিল না, কিন্তু সেটাই শেষ কথা না। -শহীদুল জহিরের সাক্ষাতকার, কথা (কথাসাহিত্যের ছোট কাগজ)।

এসব সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাবক ও প্রভাবান্বিতদের প্যারালালি আরেকটি বিষয় জহির এড়িয়ে যাননি কখনো—তা হলো, মানুষের মধ্যে এবসার্ডিটি ও সামুষ্টিকরণের বিপরীতে ক্রমবর্ধমান একাকত্বিবোধ। এর ফলে মানুষ হয়ে পড়ছে রাজনীতি-বিযুক্ত। রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক অথবা 'ইন্দুর-বিলাই খেলা' অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক মানুষ আজ বড় একা, (স্বাধীন বাংলা বড় একা), তার দুঃখটাও একার। এই একাদের সংখ্যা অনেক। বাড়ছে আরো। তাদের মুখে হাসি নেই, চোখে কান্না নেই, জীবনে যন্ত্রণা নেই, খোঁজ আছে প্রাপ্তি নেই। আবার সুখের ভারও নেই এদের। দিন দিন মানুষ যেন বন্দী হচ্ছে গোলক-ধাঁধায়। ধাঁধা মানুষকে বিভ্রান্ত করে, রহস্য মানুষকে নিজের সাথে খেলায়, যে খেলার নাম বাঁচা-বাঁচা খেলা, তা আবার নতুন খেলার সুযোগ দেয়। জহিরের অনেক গল্পই সে খেলার কথা বলে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ে "ডুলু নদীর হাওয়া" গল্পটির কথা। সেটাও তো খেলা! আবার 'চতূর্থ মাত্রা'র আব্দুল করিমও খেলেন। প্রতিদিন একই কাজ, গ্লাস ভাঙা, সেই ভাঙ্গারি নিয়ে বাচ্চাদের মারামারি, প্রতিদিন পেপার বিক্রি, তারপর পেপার শেষ হয়ে গেলে উল্টো পেপারওলার কাছ থেকে বেশি দামে পেপার কিনে, সেই পেপার কম দামে বিক্রি করা… এসবই খেলা, নিজের সাথে নিজের বাকবন্দী খেলা। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে মানুষ যেভাবে একা ও খণ্ডিত হয়েছে তা তার একান্ত গৃহকোণ অথবা সামান্য চিলেকোটাটিতেও, তার বেশ কিছু গল্পভাষ্য আমরা জহিরের কাছ থেকে পেয়েছি। এই সব মনোটনাস একাকীত্বের বর্ননায় জহির বেশ হিউমারাস হয়ে ওঠেন। তার হিউমারে আমরা হাসি, মজা পাই, কিন্তু আসল বিষয়তো—বিষাদ! এই বিষাদ দেখি "আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই"-এর আবদুস সাত্তারের চোখে। এই অব্দুস সাত্তার হলো "চতূর্থ মাত্রা"র আব্দুল করিমের আরেকটি ফর্ম, যে কীনা সংসারে থেকেও সংসারের বাইরে, অফিস-বাড়ি, বাড়ি-অফিস, কলুর-বলদের মতো কেরানি-জীবন। কোনো হাসি নেই, রঙ্গ নেই, কেবল পথে পড়ে যাওয়া আছে; পড়ে গিয়ে কাঁদা যায় না। অন্যের হাসির পাত্র হয়ে তাদের হাসিতে যোগ দেয় সাত্তার, হয়তো ঠোট ঈষৎ স্ফুরিত হয় মাত্র, আর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে—"পইরা গেলাম"।

এভাবে, "জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা" হয়ে "পারাপার"; তারপর "ধুলোর দিনে ফেরা" হয়ে জহিরের রাজনৈতিক অবজারবেশনের যে যাত্রা— "এই সময়" গল্পে এসে তা স্পর্শ করেছে সর্বসাম্প্রতিক উপরিতল। আরেকটি শাখা পল্লবিত হয় অবদুস সাত্তার, আব্দুল ওয়াহিদ (তিনিও সফল নন), আব্দুল করিমদের নিস্ক্রিয়-নিস্প্রভ জীবন যাত্রায়; যেখানে কোনো নয়ততারা নেই, গোলাপ ফুল নেই, নেই কথা-বলা ময়না পাখি। যা আছে তা হলো, মোহাম্মদ সেলিমের মতো আক্ষেপ- "আইজকা ফুল ফুটে নাই, … ফুল আনা পারিনিকা"।

এরই নাম হয়তো চাপচাপ অসহায়ত্ব; মৃত্যু অথবা প্রকল্প: মৃত্যু-কল্প।


Ei Samay


No comments:

Post a Comment