Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Unique Identity No2

Please send the LINK to your Addresslist and send me every update, event, development,documents and FEEDBACK . just mail to palashbiswaskl@gmail.com

Website templates

Zia clarifies his timing of declaration of independence

What Mujib Said

Jyoti basu is DEAD

Jyoti Basu: The pragmatist

Dr.B.R. Ambedkar

Memories of Another Day

Memories of Another Day
While my Parents Pulin Babu and basanti Devi were living

"The Day India Burned"--A Documentary On Partition Part-1/9

Partition

Partition of India - refugees displaced by the partition

Friday, April 19, 2013

টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি হাসনাত আবদুল হাই |

টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি

হাসনাত আবদুল হাই | তারিখ: ১৩-০৪-২০১৩


মেয়েটি অনেকক্ষণ ধরে তার পেছনে পেছনে ঘুরছে, সেই অনুষ্ঠান শেষে হলঘর থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে যখন তার চারদিকে ভক্ত ও তদবিরবাজদের ভিড়। এত ছেলেমেয়ের মাঝখানে সাদামাটা প্রায় ময়লা কাপড়ে উসর-ধূসর চুল মাথায় বিদ্ঘুটে রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়েটির প্রতি তার চোখ পড়ার কথা না, তবু পড়ল। এতে তিনি বিস্মিত হলেন এবং কিছুটা বিরক্তও। অনেকেই তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে। কেননা, তিনি শুধু একজন সেলিব্রিটি নন, ইংরেজিতে যাকে বলে ফেভার। তা অন্যের প্রতি দেখানোর মতো তার যথেষ্ট ক্ষমতাও আছে। সেলিব্রিটির পেছনে, ছেলেমেয়েরা ঘোরে মুগ্ধতার জন্য অথবা কিছু পাওয়ার আশায়। সংসারে সবারই কিছু না কিছু চাওয়ার আছে। জীবন যতই জটিল হচ্ছে, চাওয়ার তালিকা বেড়েই যাচ্ছে। চারদিকে প্রতিযোগিতার দৌড় জীবনকে আরও জটিল করে তুলছে।

মেয়েটি নাছোড়বান্দা, তিনি যতই তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন, সে ঘুরে এসে দাঁড়ায় সামনে, প্রথম সারিতে না হলেও দ্বিতীয় কি তৃতীয় সারিতে। দেখতে সে সুশ্রী নয়, তবে তার চোখে-মুখে তীক্ষ একটা ভাব আছে, নতুন ছুরির মতো। তার চোখের নিচে ক্লান্তির কালো দাগ, মুখে একধরনের রুক্ষতা। আগে সেখানে যে কমনীয়তা ছিল তা মুছে ফেলেছে। ঠোঁট দুটি চকচক করছে, যেন গ্লিসারিন মাখানো। আসলে সে ঘন ঘন জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে নিচ্ছে। গলার নিচে কণ্ঠি বের হয়ে এসেছে, ওপরের দিকে গলার মধ্যে কয়েকটি ভাঁজ, সেখানে ঘামের পানি জমে আছে রুপার চিকন হারের মতো। শুকনো খড়ের মতো চুল উড়ছে বাতাসে। প্রায় ময়লা সবুজ ওড়না লাল কামিজে জড়ানো শরীরের ওপরে একটা স্তন ঢেকে রেখেছে, বুকের অন্য পাশে ওড়না কামিজের কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে রাখা, প্রায় সমতল দুই দিকেই, হঠাৎ দেখে ছেলে কি মেয়ে বোঝা যায় না। মেয়েটি বাংলাদেশের পতাকার রং দিয়েই সালোয়ার-কামিজ বানিয়েছে অথবা সেই রকম তৈরি করা কাপড় কিনেছে। আজকাল অনেকেই এভাবে কাপড় পরে, কিছুটা দেশপ্রেম দেখাতে, কিছুটা ফ্যাশন স্টেটমেন্টের জন্য। মেয়েটা দেখতে সুশ্রী না হলেও বয়সের জন্য একধরনের আকর্ষণ আছে তার শরীরে। অগোছালো বেশবাস সেই আকর্ষণে একটা বন্যতার ভাব সৃষ্টি করেছে, যেন সে যেখানে খুশি লাফিয়ে পড়তে পারে। দেখেই মনে হয় খুবই বেপরোয়া আর অ্যাগ্রেসিভ।
বুঝলেন স্যার, ওরা আমার সঙ্গে পলিটিকস করছে। সামনের সারিতে থাকতে দিচ্ছে না। অথচ এই কদিন আমি সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে থেকে স্লোগান দিয়েছি। আমার গলার স্বর এত উঁচু যে মাইক্রোফোনের বলতে গেলে দরকার হয় না। এক মাইল দূর থেকেই শুনে বুঝতে পারবেন এটা আমার গলার স্বর। মিটিংয়ের জন্য স্লোগানের দরকার, স্লোগানই মিটিং জমিয়ে তোলে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন। অভিজ্ঞ লোক আপনি। আমি কয়েক দিন মিটিং জমিয়ে রেখেছি শুধু আমার গলার জোরে স্লোগান দিয়ে দিয়ে। কাগজে আমার নাম এসেছে। টেলিভিশনে আমাকে প্রায়ই দেখিয়েছে। পাবনা থেকে দেখে আমার ছোট বোন ফোনে বলেছে, আপু তোকে দেখা গিয়েছে। কয়েকবার। তুই খুব মাতিয়ে রেখেছিস। আমার মাও প্রশংসা করেছেন দেখে। কেন করবেন না? নিজের মেয়ের খ্যাতিতে কোন মা গর্ব অনুভব করে না? বাবা? না, তিনি কিছু বলেননি। বেতো রুগি, বিছানায় শুয়ে থাকেন সব সময়। শুনেছি, ছোট বোনকে বলেছেন, ও ঢাকা গেল পড়াশোনা করতে। এখন মিছিল-মিটিং আর মানববন্ধন করে সময় নষ্ট করছে। ওর পড়াশোনার কী হবে? জমির ভাই তো পড়ার কথা বলেই ওকে নিয়ে গেলেন ঢাকায়। এখন এসব কী হচ্ছে? ওর ভবিষ্যৎ আমার চোখের সামনে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
জমির ভাই, মানে আমার বাবার অনাত্মীয় জমির সাহেবকে জানেন স্যার? আমরা তাকে চাচা বলি। তিনি একজন রাজনৈতিক নেতা, মফস্বল শহর পাবনা থেকে শুরু করেছিলেন রাজনীতি, আস্তে আস্তে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ঢাকায় পৌঁছেছেন। বাবার সঙ্গে জানাশোনা অনেক দিন থেকে। আগে প্রায় প্রতিদিন আসতেন, ঢাকায় আসার পর যান মাঝেমধ্যে। একদিন আমাদের বাসায় এসে বললেন, তোমার বড় মেয়েটা বেশ চটপটে আছে। ওকে ঢাকায় পাঠাও। মফস্বলে থেকে কত দূর আর যেতে পারবে? এখানে কি-ই বা সুযোগ রয়েছে? এখন সবই তো ঢাকায়।
ঢাকায় গিয়ে কী করবে সীমা? ওর তো গ্র্যাজুয়েশনও হয়নি। বাবা বলেছিলেন।
শুনে জমির চাচা উত্তর দিয়েছিলেন, কেন? ঢাকাতেই গ্র্যাজুয়েশন করবে। সেই ব্যবস্থা করে দেব আমি। কলেজ ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জানাশোনা আছে। বললেই অ্যাডমিশন হয়ে যাবে। হোস্টেলেও জায়গা পেতে অসুবিধা হবে না। সবই তো রাজনৈতিক দলের কন্ট্রোলে, যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তাদের। এখন আমরা আছি, সব সিদ্ধান্ত আমরাই নিই। কে অ্যাডমিশন পাবে, কার জন্য সিট খালি করাতে হবে—এ সবই আমাদের আওতায়। বুঝলেন না, একটা সিস্টেম তৈরি হয়ে গিয়েছে। বেশ সুন্দর চলছে। কেউ বাদ সাধছে না, কোনো হট্টগোল নেই। সবাই পাবে এই সুযোগ, পালা করে। বেশ গণতান্ত্রিক এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া দলের কেউ না হলেও এসব সুযোগ পাওয়া যায়। একটু খরচ করতে হয় আর কি। সে যাই হোক, আপনার মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিলাম। ও ঢাকায় যাবে, কলেজে ভর্তি হবে, হোস্টেলে থাকবে। পড়াশোনা করবে। মাঝেমধ্যে আমাদের পার্টি অফিসে এসে এটা-ওটা নিয়ে কাজ করে সাহায্য করবে।
কী কাজ করবে? কী নিয়ে সাহায্য করতে হবে সীমাকে? বাবার স্বরে উদ্বেগ ও ব্যাকুলতা।
তেমন কিছু না। ধরেন নেতার জন্য বক্তৃতা লেখা, প্যামফ্লেট তৈরি, প্রচার পুস্তিকা লেখা, ব্যানারের স্লোগান—এই সব আরকি। বড় ধরনের কোনো কাজ না, জটিলও না। খুব বেশি সময় দিতে হবে না তাকে। পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।
বাবা শুনে আমার দিকে তাকিয়েছেন। মাথা নেড়ে বলেছেন, ও অমন কাজ আগে কখনো করেনি। পারবে না। তা ছাড়া ওই সব নিয়ে থাকলে পড়াশোনা লাটে উঠবে।
জমির চাচা আশ্বাস দিয়ে বললেন, কাজগুলো সব সোজা। লেখালেখি, তা-ও বাংলায়। ছোট ছোট আকারে। তাতে সময় বেশি লাগবে না। আর পড়াশোনার সময় তো সে এসব কাজ করবে না, অবসরে করবে। সন্ধ্যার পর। কখনো রাতে।
সন্ধ্যার পর, রাতে? বাবা খুব চিন্তিত হয়ে তাকিয়েছেন জমির চাচার দিকে। বলেছেন মাথা দুলিয়ে কাঁপা গলায়, শুনেছি, সন্ধ্যার পর ঢাকার রাস্তাঘাট নিরাপদ না। গুন্ডা-বদমাশ ঘুরে বেড়ায়। ইভটিজার পিছু নেয়।
আরে না। ওসব বাড়িয়ে বলে লোকে। ঢাকা রাজধানী, সেখানে আইনশৃঙ্খলা থাকবে না তো থাকবে কোথায়? অন্য সব মেয়ে থাকছে না ঢাকায়? কাজ করছে না, ঘোরাঘুরি করছে না? মজার ব্যাপার কি জানেন?
কী? বাবার চোখে একরাশ কৌতূহল এবং পুরোনো প্রশ্ন।
ঢাকায় মফস্বলের মেয়েরাই বেশি ফ্রি, বেশি দুরন্ত, বেশ সাহসী। ওরা কাউকে পরোয়া করে না। সব পার্টিতেই তারা আছে। টেলিভিশনে দেখেন না, মিছিলের সময় সামনে থেকে কেমন হাত তুলে জোরে জোরে স্লোগান দেয়। মফস্বলের মেয়েরাই ঢাকায় আন্দোলন জমিয়ে রাখে। বলতে গেলে ওরাই আসল কর্মী দল। ছেলেগুলো ফাঁকিবাজ। তারা মেয়েদের দিয়েই সব কাজ করিয়ে নিতে চায়। শুধু বাহবা আর টাকা নেওয়ার সময় সামনে থাকে। সব কাজের ক্রেডিট নেয়। জমির চাচা অনেকক্ষণ কথা বলে থামেন।
স্যার, কিছুই জানা ছিল না আমার, মফস্বলের মানুষ, তা-ও আবার মেয়ে। অল্প সময়ে অনেক কিছু শিখলাম। হয়তো আরও শেখার আছে। মেয়েদের সারা জীবনটাই জানার। ছাত্রী হয়েই থাকতে হয় সবকিছু জানার জন্য। অ্যাপ্রেন্টিস বলে না? আমরা হলাম তাই। কিন্তু আমি আর পারছি না স্যার। আমার একটা চাকরি দরকার। ভদ্রলোকের, ভদ্রমেয়ের মতো চাকরি। আপনি দিতে পারেন। আপনার তো সেই সুযোগ রয়েছে। আমার বেশি কিছু দেওয়ার নেই, সবই তো দেখতে পাচ্ছেন। প্রায় দেউলে হয়ে গিয়েছে শরীর আর মন। দেওয়ার মতো কিছু হয়তো একসময় ছিল, এখন তেমন কিছু নেই। মিথ্যে বলব কেন। আপনি অভিজ্ঞ লোক। সেলিব্রিটি।
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন, তোমার একটা দোষ আছে। তুমি বেশি কথা বল।
মেয়েটি শুনে মিইয়ে যায়। তারপর বলে, জমির চাচা কোথায়? আছেন, তিনি তার জায়গাতেই আছেন, দলের কাজ করছেন উঠে-পড়ে, দলে আরও কিছুটা ওপরে উঠতে পেরেছেন। অনেক ফন্দিফিকির জানেন তিনি। কী করে ডিঙিয়ে যেতে হয়, ওপরের মানুষকে তুষ্ট করতে হয়, সব জানা আছে তার। তিনি আরও ওপরে উঠবেন।
আমি? না, আমার পক্ষে ওপরে ওঠা সম্ভব হবে না। যেটুকু উঠেছি, ওই পর্যন্ত। মানববন্ধন করি, মিছিলে যাই, মঞ্চ তৈরি করে তার ওপরে উঠে গলা ফাটিয়ে স্লোগান দিই। টেলিভিশনে দেখায়। কাগজে নাম ছাপা হয়। পাবনা থেকে ছোট বোন প্রশংসা করে ফোনে জানায়। মা-ও খুশি, তার মেয়েকে টেলিভিশনে দেখা যাচ্ছে, সবাই তার কথা বলছে। মা আমাকে নিয়ে গর্ব করেন বলে শুনেছি।
পড়াশোনা? হ্যাঁ, জমির চাচা তাঁর কথা রেখেছিলেন। কলেজে অ্যাডমিশন হয়েছে। হোস্টেলে শেয়ারে সিট পেয়েছি, মানে দুজনে একসঙ্গে থাকতে হয়। ক্লাস বেশি হয় না, প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমরাও ফুরসত পাই না। হরতাল, মিটিং, মিছিল। মঞ্চে উঠে স্লোগান দেওয়া। এতে অনেক সময় চলে যায়। তবে কলেজে নামটা আছে খাতায়। হোস্টেলে সিটটা আছে এখনো। কেউ আপত্তি করে না, কেন করবে? প্রায় সবাই তো আমার মতো অবস্থার। কারও অনুগ্রহে অ্যাডমিশন আর সিট পাওয়া। সন্ধ্যার পর পড়াশোনা? না, সেটা প্রায় কারোরই হয় না। সবাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত, টাকার ধান্দায় ঘোরে। আমি পার্টি অফিসে যাই। কখনো একা, কখনো ছাত্রনেতাদের সঙ্গে। জমির ভাইয়ের অফিসে বসে বক্তৃতা লিখি, কখনো লিফলেট। কম্পিউটারে প্রিন্ট আউট বের করে দেখাই। তিনি প্রুফ দেখে দেন। আবার টাইপ করি। এসব কাজ ছেলেরা করতে চায় না। তারা মারধর, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, ভাঙচুর—এসব নিয়ে ব্যস্ত থাকে। কাজ শেষ হলে আড্ডা দেয়, ড্রিংক করে একসঙ্গে বসে।
ড্রিংক? না, না। চা-টা না। অ্যালকোহল। হুইসকি। বিয়ার। আমাকেও খেতে হয়েছে পাল্লায় পড়ে। ওদের সঙ্গে থাকতে হলে তাদের সমর্থন পাওয়ার জন্য নানাভাবে সঙ্গ দিতে হয়। এড়ানোর উপায় নেই। ওরা নেতাদের কাছে নালিশ করলে আমাদের ভাতা বন্ধ। দেড় হাজার টাকা ভাতা পাই আমি অফিস থেকে, তাই দিয়ে কলেজে পড়া, হোস্টেলে থাকা। খুব মূল্যবান সেই ভাতা। বোকামি করে হারাতে পারি না। তাহলে যে পথে বসব।
জমির ভাইকে বলোনি কেন এসব? কী যে বলেন! তিনি কি ধোয়া তুলসি পাতা? তিনিও ড্রিংক করেন। রাতে কাজ শেষ হয়ে গেলে অফিসে বসেই করেন। আমাকেও খেতে হয়েছে তার সঙ্গে। আদর করে জড়ানো গলায় বলেছেন, খাও, খাও। ভালো জিনিস। স্বাস্থ্য ভালো থাকে। এনার্জি বাড়ায়। এত পরিশ্রম করার পর দরকার আছে এটার। সাহেবরা তো খারাপ জিনিস তৈরি করেনি। অল্প অল্প খাও, তাহলে বেসামাল হবে না। একটু সামলে চলতে হবে, হাজার হোক এটা পার্টি অফিস। বেসামাল হতে চাও তো আমার বাসায় এসো। তোমার ভাবি? আরে সে থাকলে তো! কেউ নেই, বাসা খালি। মারা গিয়েছে? না, মারা যাবে কেন? মেয়েরা অত তাড়াতাড়ি মরে না। এই ঝগড়া করে চলে গেল আরকি। বলল, রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ঘর করা পোষাবে না তার। কয়েক বছর একসঙ্গে থাকার পর এই কথা বলা। এত দিন যখন সহ্য করতে পেরেছে, তখন বাকিটাও পারত। কোনো মানে হয় হঠাৎ করে এসব কথা বলার? যারা দেশের জন্য খাটছে দিন-রাত, তাদের কিছু খামখেয়ালি, নিয়ম ভেঙে চলা—এসব সহ্য করতে না পারলে চলবে কেন? শুনল না মেয়ে মানুষটা। চলে গেল। যাক গে। বেশ আছি। হাত-পা ঝাড়া। চাকর আছে, রাঁধুনি আছে বাসায়। খাওয়া-দাওয়ার অসুবিধা হচ্ছে না, ঘুমোবার সময় বেশ ঘুমোচ্ছি। হ্যাঁ, তোমার যখন খুশি যেতে পারো। ওদের বললেই তোমাকে খেতে দেবে। দোকানে দোকানে সব সময় খাওয়া ভালো না লাগারই কথা। সেই তো বিরিয়ানি, নয়তো পরোটা-গোশত। কত দিনের পুরোনো কে জানে। স্বাদ বদলের জন্য এসো আমার বাড়ি মাঝে মাঝে। যখন খুশি। আমি বলে রাখব। জমির চাচা বললেও আমি সঙ্গে সঙ্গে তার বাসায় যাইনি। আমার মনে বেশ সন্দেহ জমেছিল। আস্তে আস্তে লোকটার চেহারা খুলে যাচ্ছিল আমার সামনে।
জমির চাচা নিজেই একদিন নিয়ে গেলেন তার বাসায়। প্রায় জোর করেই ড্রিংক করালেন ড্রয়িংরুমে বসে। সেদিন বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, তারই চাপে। ড্রিংকের পর পোলাও-কোর্মা খাওয়া হলো। খুব ফুর্তি লাগছিল। অমন মজা করে খাইনি অনেক দিন। তিনি যখন অনেক রাতে বললেন, দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন হোস্টেলে যাওয়া ঠিক হবে না। থেকে যাও এখানে।
তাঁকে বেশি করে বলতে হলো না। থেকে গেলাম প্রায় স্বেচ্ছায়। সেই শুরু। তারপর বেশ কয়েক দিন হয়েছে অমন, একসঙ্গে ড্রিংক করা, খাওয়া আর ঘুমানো। দলের ছেলেরা তো বোকা না, টের পেয়ে গিয়েছে। ঠাট্টা করেছে, মিসট্রেস বলে। গায়ে মাখিনি। এমন ভাব করেছি, যেন শুনতেই পাইনি। ওরা ঠাট্টা করা বন্ধ করেনি।
জমির চাচাকে কেন বলিনি ওদের কথা? এই জন্য বলিনি যে জমির চাচা ওদের কিছু বলবেন না। তাদের নিয়ে কাজ করতে হয় তাকে।
তিনি রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন, অনেক জায়গাজুড়ে মঞ্চ। রাস্তায়, ফুটপাতে মানুষের ভিড়। অল্প বয়সের ছেলেমেয়েই বেশি। স্লোগান উঠছে থেকে থেকে, কোলাহল বাড়ছে। তিনি সীমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি মঞ্চে যাবে না আজ? স্লোগান দিতে?
না। ছাত্রনেতারা পলিটিকস করছে আমার সঙ্গে। বলছে, তাদের খাদ্য হতে হবে। শুধু জমির চাচার একার খাদ্য হলে চলবে না। রাতের বেলা মঞ্চের আশপাশে তাদের সঙ্গেও শুতে হবে। তাহলেই হাতে মাইক্রোফোন দেবে, নচেৎ নয়।
শুনে তিনি অবিশ্বাসের চোখে তার দিকে তাকান। রাস্তার স্লোগান ক্রমেই জোরালো হয়। তিনি সীমা নামের মেয়েটিকে বলেন, মাইক্রোফোন ওরা কন্ট্রোল করে? ওরাই ঠিক করে কে কখন স্লোগান দেবে?
তা নয় তো কী? ওরাই তো মঞ্চের নেতা। ওদের কথা যারা মানবে না, তারা হাতে মাইক্রোফোন পাবে না। গলা যত সুন্দরই হোক। আমার মতো ভরাট গলা হলেও চান্স পাবে না। মেয়েটি হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বলল, শুনবেন স্যার? একটা স্লোগান দেব? আমার ভরাট গলায়?
না, না। দরকার নেই। এমনিতেই বুঝতে পারছি তোমার গলা বেশ ভরাট। রেডিও, টিভি অ্যানাউন্সারদের মতো, নিউজ রিডারের মতো।
মেয়েটি খুব খুশি হয় শুনে। হাসিমুখে বলে, সত্যি বলছেন স্যার? টিভি অ্যানাউন্সার, নিউজ রিডারের মতো? বলতে বলতে মেয়েটির চোখ ভিজে এল। ধরা গলায় বলল, আমার মতো অধঃপতিত মেয়ের ভাগ্যে কি তা হবে কখনো? হতে পারত যদি খারাপ হয়ে না যেতাম। ভালো পথে চলতাম। ভালো লোকের সঙ্গে মিশতাম। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আমার মতো অবস্থার একটা মেয়ে ভালো পথে কী করে চলবে? ভালো মানুষের সঙ্গ সে কোথায় পাবে? হাজার চেষ্টা করলেও তা হবে না। পাবনা থেকে ঢাকা অনেক দূরের পথ। আমি তো জানি পথের বাধাগুলো কোথায় কোথায় দাঁড়িয়ে। না, অত বড় কিছুর কথা ভাবতে পারি না আমি এখন। ছোটখাটো একটা চাকরি পেলেই বর্তে যাব। যেকোনো কাজ, যা ভদ্রভাবে চলতে দেবে, সুন্দরভাবে থাকতে দেবে। আচ্ছা স্যার, আপনার টেলিভিশন চ্যানেলে লেখাটেখার কোনো কাজ নেই? আমি খুব ভালো বাংলা লিখি। কবি শামসুর রাহমানের ওপর লেখা আমার কয়েকটা প্রবন্ধ আছে। অনেকে প্রশংসা করেছিল। আরও কয়েকটা লিখে একটা বই বের করব ভেবেছিলাম। কিন্তু সময় হলো না। ইচ্ছেটা এখনো আছে।
জমির চাচাকে বলব? তিনি উড়িয়ে দেবেন কথাটা। বলবেন, কবি-টবিদের ওপরে বই লিখে কী হবে? তার চেয়ে আমাদের দলের ওপর লেখো। দলের নেতাদের ওপর লেখো। তারপর একটু থেমে বলেছেন, তোমার অসুবিধা কোথায়? এই সব কথা তোমার মাথায় ঢোকে কেন? মাসে তিন হাজার টাকা পাচ্ছ। সেই টাকায় কলেজের ফি, হোস্টেলের খরচ দিচ্ছ। এই বয়সে এর চেয়ে ভালো চাকরি আর কী হতে পারে? তাও আবার পার্টটাইম। পরীক্ষায় পাস করার পর বেশি বেতনে চাকরি পেয়ে যাবে, তখন তুমি শুধু শামসুর রাহমান কেন, সব কবিদের নিয়ে লিখবে। এখন তোমাকে আমার অফিসের কাজের জন্য বেশি দরকার। ছাত্রনেতারা হাসি-ঠাট্টা করে? তা একসঙ্গে করলে বন্ধুরা অমন করবেই, গায়ে না মাখালেই হলো অথবা হেসে উড়িয়ে দেবে। আর শোনো, আমাকে না বলে ছাত্রনেতাদের সম্পর্কে কিছুই বলতে যাবে না। ওরা রেগে গেলে সবকিছু করতে পারে। দল ভেঙে অন্য কোথাও যাওয়ারও চেষ্টা কোরো না। দলের ছেলেরা সেটা সহ্য করবে না। ওরা সাংঘাতিক কিছু করে ফেলবে। দলের ছেলেমেয়েদের দলে রাখা তাদের জন্য একটা প্রেসটিজের ব্যাপার। ইচ্ছে করলেই কাউকে চলে যেতে দেওয়া যায় না। ঢোকা সহজ, বেরোনো কঠিন। বুঝলে? মাথা ঠিক রেখে কাজ করো। সমস্যা হলেই আমার কাছে চলে আসবে, খোলাখুলি সব বলবে।
জমির সাহেব মঞ্চের ছেলেদের বলছেন না কেন তোমাকে মাইক্রোফোন দেওয়ার জন্য? তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন।
বলছেন না এই জন্য যে তিনি তাদের সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে চান না। তা ছাড়া ব্যাপারটা নাটকের মতো। পেছন থেকে প্রম্পটার যা বলছে, তাই নিয়ে স্লোগান হচ্ছে, সে অনুযায়ী সবকিছু চলছে। বাইরে থেকে কিছু বোঝা যায় না। জমির চাচা মঞ্চের পেছন থেকে সামনে আসতে যাবেন কেন? তিনি এবং তার বন্ধুরা টাকা দিয়ে যাচ্ছেন, খাওয়ার প্যাকেট পাঠাচ্ছেন। মঞ্চ চালু থাকছে, মিছিল বের হচ্ছে। ব্যস, এতেই তারা সন্তুষ্ট। একটা মেয়ের জন্য তিনি কিংবা তার সহকর্মীরা ছাত্রনেতাদের খেপাতে যাবেন কেন? নিজের দুর্বলতা থাকলে এমনই হয়। না, জমির চাচাকে বলে কিছু হবে না। সে আমার জানা আছে। হাতে মাইক্রোফোন পাওয়ার একটাই উপায়। ছাত্রনেতাদের কথা শুনতে হবে। সোজা কথায়, তাদের খাদ্য হতে হবে। হ্যাঁ স্যার, আমার মতো মেয়েরা সবাই খাদ্য। তারা মেনে নিয়েছে, ইচ্ছায় এবং অনিচ্ছায়। কী করবে? বাবার এত টাকা নেই যে তার খরচে ঢাকায় থাকবে। চাচা নেই, মামা নেই যে সাহায্য করতে পারেন। একমাত্র জমির চাচারা আছেন। তারা আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে আসেন। বড় মিষ্টি তাদের ব্যবহার। প্রায় অপত্যস্নেহে তাঁরা সঙ্গে নিয়ে ঘোরেন।
মেয়েটি প্রসঙ্গ বদলায়। বলে, আপনাকে টেলিভিশনে দেখেছি, টকশোতে আপনার কথা শুনেছি। আপনাকে অন্য রকম মনে হয়েছে। মানে অন্য পুরুষদের মতো না। আমার ভুলও হতে পারে। কিন্তু সত্যিই আপনাকে দেখে আমার এমন মনে হয়েছে। তা স্যার, পারবেন আমার জন্য কিছু করতে? বড় কিছু না। মঞ্চের আড়ালেই থাকব, লেখালেখি কিছু থাকলে করে দেব। টেলিভিশনেও লেখার কাজ নিশ্চয়ই আছে?
এই বইটা থেকে পড়ব? কতটুকু? এক প্যারা? বেশ পড়ছি। বলে মেয়েটি পড়তে থাকে এক মনে। পড়া শেষ হলে সে তাকে বলে, ক্যামন হলো স্যার? স্লোগান দিয়ে দিয়ে গলাটা ভেঙে গিয়েছে। নরমাল হলে আর একটু ভালো হতো। তা লেখালেখির কাজের জন্য তো গলার স্বরের দরকার নেই। আমার লেখা প্রবন্ধগুলো আপনাকে দেব। কবি শামসুর রাহমানের ওপর লেখা প্রবন্ধ। আমার খুব প্রিয় কবি ছিলেন। 'স্বাধীনতা তুমি' কবিতাটি পড়লেই আমার গায়ের রোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। আমি প্রবন্ধগুলো আপনার অফিসে গিয়ে দিয়ে আসব। আপনার কাছে পৌঁছাবে কি না কে জানে। কত রকমের সিকিউরিটি আপনাদের অফিসে। তবু আমি দিয়ে আসব।
তিনি পকেট থেকে মোবাইল বের করে চোখের সামনে নিয়ে একটা নম্বরে টিপ দিলেন। তারপর ওপাশে কণ্ঠস্বর শোনা যেতেই তিনি বললেন, একটা মেয়ে যাবে অফিসে। নাম সীমা। ওর একটা অডিশন নেবে। হ্যাঁ, সে একটা কিছু পড়ে যাবে, যা তোমরা তাকে দেবে। শোনার পর নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবে। তারপর আমাকে তোমাদের মত দেবে। হ্যাঁ, আমিও শুনব তার রেকর্ড করা অডিশন।
স্যার, আমি টেলিভিশনে অডিশন দেব? সত্যি বলছেন? না, না ঠাট্টা করবেন না আমার সঙ্গে। আমি এর মধ্যেই জীবনে অনেক কষ্ট পেয়েছি। আর বাড়াতে চাই নে কষ্টের বোঝা। স্যার, চাকরি না দেন, আমার সঙ্গে ঠাট্টা করবেন না। আমি মফস্বলের সামান্য একজন মেয়ে, তার ওপর আবার অধঃপতিত। পড়ে গেলে নাকি ওঠা কঠিন। আমি একটু দেখতে চাই, পড়ে গেলেও ওঠা যায় কি না, তার জন্য ছোট একটা সুযোগ দেন শুধু।
তিনি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি খুব বেশি কথা বল।
শাহবাগ চত্বর লোকে লোকারণ্য। সব বয়সের মানুষ নর-নারীতে ভরে গিয়েছে সব রাস্তা, ফুটপাত। সবাই ব্যগ্র হয়ে তাকিয়ে আছে দক্ষিণের দিকে, যেখানে জাতীয় জাদুঘর, পাবলিক লাইব্রেরি আর তারপর আর্ট ইনস্টিটিউট। হকাররা ভিড়ের মধ্যে নানা ধরনের জিনিস বিক্রি করছে। খেলনা, খাবার জিনিস—সবই। লাল আর সাদা হাওয়াই মিঠাইয়ের পেজা তুলার মতো ফাঁপানো শরীর প্লাস্টিকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বাবার কাঁধে চড়ে একটা শিশু হাওয়াই মিঠাই খাচ্ছে, কাঁধে চড়েই কেউ বাতাসে খেলনা নাড়ছে। বাঁশি বাজাচ্ছে এক হকার, গলায় ঝোলানো ঝোলায় বিক্রির বাঁশি। শুকনো মিষ্টি বিক্রি করছে ঠেলাওয়ালা। বাতাসে ভাজা-পোড়ার গন্ধ। শিশুপার্কের সামনে এক চিলতে জায়গায় ফকির আলমগীর তাঁর দল নিয়ে লালনসংগীত গাইছেন ফিউশন সুরে।
একটু পরে আর্ট ইনস্টিটিউট থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হলো। সঙ্গে সঙ্গে ভিড়ের মধ্যে ঢেউয়ের মতো একটা চঞ্চলতা আছড়ে পড়ল। পেপিয়ার-ম্যাশে তৈরি মস্ত বড় বাঘ, প্যাঁচা, ময়ূর মাথার ওপরে তুলে এগিয়ে আসছে শোভাযাত্রার ছেলেমেয়েরা। উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে যেন, চঞ্চল হয়ে উঠেছে ভিড়ের মানুষ। গরমে ঘামছে সবাই, লাল হয়ে এসেছে মুখ। ধুলো উড়ছে, বাতাসে রোদের ঝাঁজ।
মেয়েটি ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে বলছে, 'নতুন বর্ষকে স্বাগত জানিয়ে এগিয়ে আসছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এতক্ষণ যারা অধীর প্রতীক্ষায় ছিল, হাজার হাজার সেই সব নর-নারী শিশু-কিশোরের প্রতীক্ষা শেষ হলো। গান শোনা যাচ্ছে, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।' বলতে বলতে মেয়েটির স্বর ক্রমেই উঁচু হলো। এত কোলাহল, গানের চড়া সুর, তার ভেতরে মেয়েটির কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। সে পরেছে লাল পেড়ে সাদা সুতির একটা শাড়ি। তার এক হাতে ছোট গাঁদা ফুলের মালা বালার মতো জড়িয়ে।

No comments:

Post a Comment