মীরা দেব বর্মন একটি তারা, মেঘে ঢাকা !
(লেখাটি বেরিয়েছে আগরতলার সাতকাহনে)
নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক
পায়েলখানি বাজে
মাদল বাজে সেই সংকেত
কালো মেয়ে নাচে ।
পাগলপারা চাঁদের আলো
নাচের তালে মেশে।। '
'নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক পায়েল খানি বাজে' – গানটিতে কালো মেয়ের , শ্যামা মায়ের 'নিটোল পায়ের' ভাবনা কোন কবি ভাবতে পারেন সেটা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম ।কেমন কবি মায়ের পবিত্র পা নিয়ে এমন জাগাতিক কল্পানায় মাততে পারেন। সমস্ত গানের কথার মধ্যে একটি জাগাতিক মাদকতা।পাগলপারা আবিলতা। romanticism. এমন আধুনিক ভাবনা আমাদের ভক্তিমুলক গানের মধ্যে খুব কমই পাওয়া যায়।এক বন্ধুর শরনাপন্ন হলাম ।গান বাজনার যথেষ্ট খবর রাখে ।বলল শচিন কর্তার স্ত্রী –মীরা দেব বর্মণের হইতে পারে ।মীরা দেব বর্মণ ? গান লিখতেন নাকি? কই সেভাবে ত শুনিনি । কই কখনও তো সেটা নিয়ে মাতামাতি হয়নি!প্রচার নেই কোনও! তার সমসাময়িক সকল গীতিকারদের কথা বেশ সগৌরবে শোনা যায় । তবে মীরা দেববর্মণের নামটি ধুলোয় চাপা পড়ে রইল কেন? প্রছন্ন অগৌরবে? সে যে এক মহা খটকা !!
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম মীরা দেব বর্মণের এক নিকট আত্মীয়ের সরব কথা ,'korta was born genius,but Meera played an important role behind preserving his tunes by weaving them to-gether in notetions.Otherwise most of gems would have been lost.'
মীরা দেব বর্মণ যে শুধু তাঁর স্বামী শচীন দেব বর্মণের গানের নোটেশন সংরক্ষনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলেন তাই নয়। স্বামী ও পুত্রের চরম উৎকর্ষে পৌঁছে দেয়ার মাপকাঠি নির্দ্দিষ্ট করেছিলেন । অবশ্যই নিজেকে প্রচারের আলোয় না নিয়ে এসে । থেকেছেন আড়ালে ।অসামান্য সঙ্গীতের বোধ ও শিক্ষা তাঁর ছিল ।তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার ,সঙ্গীতশিল্পী ও নৃত্যশিল্পী। প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন ,সেই সঙ্গে যুগের তুলনায় সঠিকভাবে তালিমও পেয়েছিলেন। কেবলমাত্র শচীন দেব বর্মণের স্ত্রী বা রাহুল দেব বর্মণের মা ছিলেন কি তিনি? 'she was a gem' শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তুখোড় জ্ঞান সম্পন্ন গায়িকা ,নৃত্যশিল্পী ,রবীন্দ্রসংগীতেও সমান দক্ষতা,গানের কথাকার হিসেবে আধুনিক মনষ্কতা ,শব্দের ব্যবহার , মাটির কাছাকাছি থাকার প্রবনতা, অবাক হতে হয় ; assistant music director – হিসেবে ও চমক দেয়ার মত সুরের বিভা ছিল তার । শচীন দেব বর্মণের যে গান গুলোর সুরের আবেশে মাতাল হই ও নিয়ত গুন গুন করি—সে গুলোর অনেক সুর ই মীরা দেববর্মণের সহায়তায় তৈরি হয়েছে ।
জন্মেছিলেন তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্থানের(এখন বাংলাদেশ) কুমিল্লা জেলায়। দাদু ও দিদিমার বাড়ীতে জন্ম থেকেই থাকা পারিবারিক অসুবিধার কারনে। দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট-এর চিফ জাস্টিস। তারপর কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস শুরু করেন দাদু দিদিমার সঙ্গে। সেখানে শুরু হয় পড়াশুনো সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীত এর তালিম। দাদু দিদিমার বাড়ীতে বিদ্যালয় শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষা সমানতালে চলে।দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন ।নাতনীর সঙ্গীত শিক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করেছিলেন । সঙ্গীত গুরু ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছেন; কীর্তন ও ঠুমরী শেখেন সঙ্গীতাচার্য ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে ;১৯৩০ সালে আনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেন এমন কি শান্তিনিকেতনে আমিতা সেনের কাছে নৃত্যচর্চাও করেন ।সঙ্গীতের সকল ক্ষেত্রে সমান পারদর্শিতা ছিল তার। নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন, সম্পূর্ণ ছিল সুরের জ্ঞান ।
১৯৩৭ সালে এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে তাঁর দেখা হয় শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে। তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হন শচীন ।বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে । বয়েসের তাফাত ছিল অনেকটাই ।এ ছাড়া শচীন ছিলেন ত্রিপুরা রাজ পরিবারভুক্ত । তাই আপত্তি উঠেছিল ।ঝড় উঠেছিল দুই পরিবার থেকেই ।কিন্তু দুজনেই ছিলেন অনড় ।তাই শুভ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল সাড়ম্বরে ।শচীনএসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে ,হাতে তারবারি । বসেছিল নহবতখানা, বাজিয়েছিলেন আলি হুশেন খাঁ । রাহুলের জন্ম ১৯৩৯ সালের জুন মাসে ।
বিবাহের বছরেই All India Radio, kolkata থেকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন।শুরু করলেন পড়াশোনাও।আই এ পরীক্ষায় বসলেন ।কিন্তু সংগীতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন অনেক আগেই তাই পড়াশোনায় ইতি দিয়ে সঙ্গীতের পথ ধরেই হাঁটলেন। ইতিমধ্যে শচীন দেব বর্মণ তার সঙ্গীতের অভিমুখ বম্বের দিকে নিদ্দির্ষ্ট করলেন ।আর এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। বম্বে গিয়ে মীরা দেবী ফয়াজ মহম্মদ খানের কাছে আবার তালিম নিতে শুরু করলেন। সঙ্গীতের পিপাসা ছিল অসীম। নিজেকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস চলছিল নিরন্তর।১৯৪৫ সালে All India Radio,Bombay থেকে অডিশন পাশ করে ঠুংরি ও গজল পরিবেশন করতেন। BOMBAY IPTA-র সংগেও যোগাযোগ ছিল ।বম্বের সাংস্কৃতিক জগত তখন প্রগতিশীলতার কেন্দ্র। সেই সময় দুটি নাটক শান্তি ও নয়া প্রভাতের গানের কথা রচনা করেন। শচীণ দেব বর্মণের সঙ্গে অনেক গানের রেকর্ডও করেন তিনি –আজ দোল দিল কে~(১৯৪৬),তুম হ বড়ে চিতচোর ~(১৯৪৬),কেন হায় স্বপ্ন ভাঙ্গার আগে~(১৯৪৯),কালি বদরিয়া ছা গয়ে, ডালি ডালি ফুল~(১৯৪৮),কে দিল ঘুম ভাঙ্গায়ে~(১৯৪৯)।
Assistant Music Director হিসেবেও তার বিকাশ ছিল উজ্জ্বল। সেই সময় কজন মহিলা সঙ্গীত পরিচালিকা ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সময় থেকে সব বিষয়েই এগিয়ে ছিলেন তিনি।স্বাকিয়তা ছিল তার সব সৃষ্টির মূল কথা। নয়া জমাণা, তেরে মেরে স্বপ্নে , শর্মিলি ,অভিমান , বারুদ ,প্রেম নগর – এই বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলোর সহযোগী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন তিনি। এই চলচ্চিত্র গুলোর সুরের অভিযান মুখরিত করেছিল সমস্ত শ্রোতাদের । এখনো এগুলো আমাদের কাছে স্বর্ণযুগের গান । মন গাথা সুর সে সব। কিছু কিছু গানের যেমন- ইয়ে দুনিয়া আগর মিল যায়ে তো (রফি,পেয়াসা,১৯৫৭) ,কোই আয়া ধড়কন (আশা ,লাজবন্তী , ১৯৫৮), ওয়াক্ত নে কিয়া ,(গীতা দত্ত,কাগজ কে ফুল ,১৯৫৯) ,উচে সুর মে গায়ে যা, (কিশোর,হাউস নং-৪৪,১৯৫৯),মেরে বৈরাগী ভওমরা, (লতা,ইস্ক পর যোর নেহি,১৯৭০), শুন শুন শুন মেরী (লতা,ছুপা রুস্তম,১৯৭৩)-সুরের মূর্ছনায় আবিষ্ট হয়েছিল মানুষ ।তাঁর কথায় কয়েকটি বিখ্যত বাংলা গান-আজ দোল দিল কে বীণায়, কেন আলেয়ারে বন্ধু ভাবি,বাঁশী তার হাতে দিলাম,ভঙ্গিতে ওর নেশা, বিরহ বড় ভাল লাগে,গানের কলি সুরের দুরিতে,ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা,বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতে, কালসাপ দংশে আমায় ,কে যাস রে ভাটি গাঙ্গ বাইয়া,কি করি আমি কি করি, না আমারে শশী চেয়ো না , নিটোল পায়ে রিনিক ঝিনিক, রাধার ভাবে কালা হইল, সে কি আমার দুষমন দুষমন, শোন গো দখিন হাওয়া , তাগডুম তাগডুম বাজে ।
১৯৭৫ সাল, স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত বম্বের বাড়ি জেটে বাস করেছেন।তারপর পুত্র রাহুলের সঙ্গে রাহুলের ভদ্রাসন মেরি ল্যান্ডে।কৃতী পুত্র রাহুল মারা গেলেন ১৯৯৪ সালে। পুত্র ও স্বামীর মৃত্যুর অসম্ভব শোক তাকে মানসিক ভারসাম্যহীনতায় পৌছে দিল। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর ছিল এই অসামান্য গীতিকার, সুরমালিকার ।কথায় কথায় মালা গেথেছিলেন যিনি,বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কথা।কেবল SD-র গান শুনলে নড়ে চড়ে উঠতেন। চেতনার জগত তার কাছে মুল্য হারিয়েছিল। ভাসির একটি ওল্ড এজ হোমে তার মৃত্যু হয় ২০০৭ সালের,১৫-ই অক্টোবর ।
একজন এরকম মানুষের শেষের পরিণতি কেনই বা এমন হয় সে এক বিস্ময়! তার গানের অভিনব ব্যপ্তি ভরিয়ে তুলেছিল কথা ও সুরের জগত।জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শব্দ, সুর ,ব্যঞ্জনা বাঙময় হয়ে উঠেছিল তার সৃষ্টিতে।জীবনমুখী শব্দবন্ধ সেদিন ছিল না,কিন্তু লোকজীবনেরই কথকঠাকুর ছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাতৃভূমির টানে ছুটে গিয়েছিলেন সেখানে। যখন ফিরছিলেন গ্রামের পুকুর পার দিয়ে, দেখলেন একটি চৌদ্দ –পনের বছরের মেয়ে পুকুর পারে বসে হাপুশ নয়নে কাঁদছে ।দু চোখে তার জলের ধারা। জিজ্ঞেস করায় মেয়েটি বলল –সদ্য বিয়ে হয়েছে, ভাই আসবে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। সকাল থেকে অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত সে, ভাইয়ের আর দেখা নেই। তৈরি হল মন আকুল করা কথা 'কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া আমার ভাই ধনরে কইও নাইয়র নিত আইয়া'।এমনি ছিল মাটি দিয়ে তার প্রতিমা গড়া।
শুধু বোঝা গেল না এমন মরমী শিল্পীর প্রাপ্তির ঘর এত শূন্য কেন? শেষের কটা দিন ই বা কেন এত কষ্টে কাটাতে হল শব্দসম্রাজ্ঞীকে? একটি পুরস্কারও তার জন্যে বরাদ্দ হল না? আশ্চর্য নীরব চরাচর!
"রইল তাহার বানী, রইল ভরা সুরে,রইবে না সে দূরে—"
No comments:
Post a Comment